কোন কাননের ফুল গো তুমি পর্ব ১০

কোন কাননের ফুল গো তুমি পর্ব ১০
মুন্নি আক্তার প্রিয়া

সৌন্দর্য সবসময় মানুষের চোখে থাকে না। আসল সৌন্দর্য মন দিয়ে উপলব্ধি করতে হয়। মন থেকে লক্ষ্য করলে বাহ্যিক রূপ মনে ধরে না। মনে তখন মানুষটার প্রতি একটা টান আসে, অনুভূতি আসে। অন্যরকম অনুভূতি। আর তাই তো এখন নওশাদও মনের দোলাচলে ভুগছে। চৈতি মিতুলের তুলনায় সুন্দর। গায়ের রং নজরকারা ফরসা। স্বভাবে ভীষণ সহজ-সরল। কিন্তু মিতুলের মাঝে আলাদা টান আছে, মায়া আছে যেটা চৈতির প্রতি নওশাদের নেই। হাজার ইতিউতি করেও নওশাদ এখনো কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি চৈতির ব্যাপারে। চৈতির মাঝে অবশ্য কোনো তাড়াহুড়া নেই। সে তার মতো দিব্যি আছে। তার হাতে যেন অফুরন্ত সময় আছে নওশাদের জন্য।

নওশাদ আধ খাওয়া সিগারেট নিভিয়ে ফেলে দিল। কোনো কিছুই ভালো লাগছে না। কোনো কিছুতে মনও বসছে না। হঠাৎ করেই যেন সব বদলে গেল। সবটা এখন ফিকে, রংহীন লাগছে তার নিকট। জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আকাশপানে তাকিয়ে সে মনে মনে বলে,
“তুমি যেভাবে ভালো থাকতে চাও, সেভাবেই ভালো থেকো মিতুল। একবার ভুল করে তোমার জীবনের সুন্দর অনেক সময় নষ্ট করে ফেলেছি। এবার আর কোনো ভুল করতে চাই না। শুধু তুমি ভালো থাকলেই হবে।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

অনেক অপেক্ষা, প্রতিক্ষার পর টুটুল ও রিনভীর বিয়ের ডেট চলে আসে। বিয়ের সব বন্দোবস্তের শুরু থেকে রূপক টুটুলের সাথে ছিল। বাড়ির ছেলের মতো সমানভাবে কাজ করেছে। বাড়িভর্তি মানুষজন। অবসর নিয়ে বসে থাকার ফুরসত নেই। মিতুল ওর বান্ধবী এবং কাজিনদের নিয়ে এক রুম দখল করে রেখেছে। সেখানে সবাই মিলে দরজা বন্ধ করে নাচছে, গাইছে। কিছুক্ষণ বাদে বাদে আবার সবার একত্রে হাসির শব্দও ভেসে আসছে।

টুটুল তখন বাহির থেকে এসে ড্রয়িংরুমে বসেছে। সঙ্গে রূপক এবং আরও কয়েকজন বন্ধু ছিল। মিতুলদের হৈ-হুল্লোড় শুনে টুটুল উঠে গেল। দরজায় নক করে অনেকক্ষণ ডাকার পর দরজা খুলল মিতুল। ভীষণ ব্যস্ততা দেখিয়ে বলল,
“কী হয়েছে?”
টুটুল বেশ ভড়কে গেল। না জানি রাজ্যের সব কাজ নিয়ে তার বোন কী ব্যস্ত! কিছুটা বিরক্তের সাথে বলল,

“এত চেঁচাচ্ছিস কেন সবাই?”
“কই চেঁচাচ্ছি? আমরা গান গাইছি।”
“গান গেয়েছিলি নাকি? হায় আল্লাহ্! আমার মনে হচ্ছিল কতগুলো রামছাগলের ছানা চিউচিউ করছিল।”
“ফালতু কথা বোলো না তো! কেন ডেকেছ সেটা বলো।”

“তোদের গানটান বন্ধ কর। স্থির থাক। বাড়িতে কত কাজ পড়ে আছে সেগুলো করছিস না কেন? যা সবাই মিলে কাজ কর।”
“ডিয়ার ভাইয়া, তোমার বিয়ে তুমি কাজ করো। আমরা পারব না।”
বলে দরজা আটকে দিল মিতুল। টুটুল রাগ করে ড্রয়িংরুমে এসে বসল আবার। ওদের কথোপকথন এখানে উপস্থিত সবাই শুনেছে। টুটুল দম নিয়ে বলে,
“এই মেয়ে যার জীবনে যাবে তার জীবন ভাজাভাজা!”
বাকিরা হাসলেও রূপক কাশল।

মিতুলদের বাড়ি থেকে বেশ কিছুজন মানুষ রিনভীর বাসায় যাবে। টুটুলেরও ভীষণ ইচ্ছে ছিল যাওয়ার। হলুদের সাজে রিনভীকে কেমন লাগছে দেখার জন্য চোখ, মন-প্রাণ অস্থির হয়ে আছে। মনের বাসনা বড়ো শখ করেই রিনভীর নিকট প্রকাশ করেছিল টুটুল। কিন্তু রিনভীর কাঠকাঠ জবাব, এসব আদিখ্যেতা তার পছন্দ নয়। বন্ধু-বান্ধব, আত্নীয়-স্বজন হাসবে, মজা নেবে এসব তার সহ্য হবে না। অগত্যা মন খারাপ হলেও টুটুল রিনভীর কথা মেনে নিয়েছে। টুটুল যাবে না বলে মিতুলও যেতে চাইছিল না।

কিন্তু কাজিনদের জন্য তার সিদ্ধান্ত স্থির রইল না। টুটুলও বুঝিয়ে-সুঝিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। গাড়িতে ওঠার পর বারংবার করে রূপককে বলেছে, ওদেরকে যেন সাবধানে নিয়ে যায় আর তাড়াতাড়ি ফিরে আসে। রূপকও আশ্বস্ত করেছে টুটুলকে। বিপত্তি বাধল মাঝপথে। গাড়িটা হঠাৎ করেই নষ্ট হলো। মেজাজ তুঙ্গে উঠে গেল মিতুলের। সে রাগে চিড়মিড় করতে করতে কাজিনদের কিছুক্ষণ বকাবকি করল। রূপক ড্রাইভারের পাশের সিটে বসেছিল। মিতুলের রাগারাগি এতক্ষণ সে ভিউ মিররে দেখছিল। এবার পিছু ফিরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

“কী হয়েছে তোমার? এত রেগে আছো কেন?”
মিতুল শান্ত কিন্তু শক্ত কণ্ঠে বলল,
“কিছু না।”
“বাইরে বেরোবে?”
মিতুল নিশ্চুপ। রূপক বলল,
“বাইরে বের হও। গাড়ি ঠিক হয়ে যাবে। সময় লাগবে না। ততক্ষণে তোমার মেজাজও ঠান্ডা হবে। এসো।”
টুম্পা মিতুলের গায়ে হাত বুলিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, আপু বাইরে বের হয়ে একটু দাঁড়াও। ভালো লাগবে।”

মিতুল কেন জানি রাজি হয়ে গেল। বাইরে বের হলো সে। সঙ্গে রূপকও। বাকিরা গাড়িতে বসে রইল। তারা মূলত এখন হাইওয়েতে। অবিরতভাবে গাড়ির চলাচল এখানে। দমকা বাতাসে হঠাৎ করেই মিতুলের মনে হলো সে একটু দম নিতে পারছে। আসলে সকাল অব্দি সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল। ভাইয়ের বিয়ে নিয়ে খুশির আমেজে ছিল। মেজাজ খিটমিটে হয়েছে বিকেল থেকে নওশাদের কল আসার পর।

মিতুল ভেবেছিল সরাসরি কথা বলে সবটা বোঝানোর পর আর সে যোগাযোগ করবে না। কিন্তু এরপরও নওশাদ কল করেছিল। এবার অবশ্য বিয়ের ব্যাপারে কিছু বলেনি। সে শুধু মিতুলকে অনুরোধ করেছে, প্রতিদিন যেন এক মিনিট হলেও তার সাথে কথা বলে। মিতুল এরকম যোগাযোগও চায় না। কোনোভাবেই সে ফের বিপদ টেনে আনতে চায় না। সে চায় না নওশাদের প্রতি দুর্বল হতে। হ্যাঁ, এ কথা সত্য যে নওশাদের প্রতি তার কোনো অনুভূতি অবশিষ্ট নেই। কিন্তু মনুষ্য মন মেঘের মতো। কখনো কালো আঁধারে ঢাকা তো কখনো শুভ্র তুলার মতো। কখন বদলে যায় কোনো বিশ্বাস নেই।

রূপক মিতুলের চোখের সামনে তুড়ি বাজাতেই মিতুল হকচকিয়ে যায়। অন্যমনস্ক থাকাতে একটু বেশিই ঘাবড়ে গেছে। পরক্ষণেই তার কপালে ভাঁজ পড়ল। ভীষণ বিরক্ত দেখাল তাকে। রূপক দু’হাত বগলদাবা করে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,

“সত্যি করে বলো তো আমায়, তোমার কী হয়েছে?”
“বললাম তো কিছু হয়নি।”
“মিথ্যা বলছ কেন?”
“কে বলল আমি মিথ্যা বলেছি?”
“তোমার চোখ বলছে তুমি মিথ্যা বলছ।”
“বাব্বাহ্! আপনি দেখি চোখের ভাষাও পড়তে পারেন।”
“চোখ দেখলে সত্যি-মিথ্যা বোঝা যায়।”
“তাই? আমি তো বুঝি না।”
“বুঝতে হবে না। আচ্ছা বলতে না চাইলে এ কথা থাক। তোমাকে একটা প্রশ্ন করি?”
“হু।”

“বলো তো ভালোবাসে মানে কী?”
“জানিনা।”
“জানোনা! কেন তুমি কাউকে ভালোবাসোনি?”
“এসব জেনে আপনি কী করবেন?”
“আচ্ছা এটা বলো যে মেয়েরা কেমন ছেলে পছন্দ করে?”
“আমি কী করে বলব? আমি কি সব মেয়ের মনের খবর জানি নাকি!”
“তুমি কেমন ছেলে পছন্দ করো?”

“আমার বাবা আর ভাইয়ের মতো। কেয়ারিং, নম্র-ভদ্র; যারা মেয়েদের সম্মান করতে জানে। ভালোবাসতে জানে।”
“ব্যস এইটুকুই?”
গাড়ি ঠিক হয়ে গেছে। ড্রাইভার এসে গাড়িতে উঠতে বলল। মিতুল গাড়ির দরজা খুলল। বসার আগে একবার রূপকের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভালোবাসার মানুষটার সঙ্গে থাকার জন্য এরচেয়ে বেশি কিছুর প্রয়োজন নেই।”

রূপক উত্তর শুনে আনমনেই মৃদু হেসে গাড়িতে উঠে বসল। ওরা রিনভীদের বাড়িতে গিয়ে রীতিমতো অবাক। বিরাটভাবে গায়ে হলুদের আয়োজন করা হয়েছে। ওদের বাড়ির সামনে থেকে রিসিভ করে নিল অনিক। সে মিতুলকে দেখে মুগ্ধ হয়ে বলল,
“ওয়াও! তোমাকে দারুণ লাগছে মিতুল।”
মিতুল মৃদু হেসে বলল,
“থ্যাঙ্কিউ।”

সবাই মিলে রিনভীকে হলুদ দিল। একসাথে ছবি তুলল। এরপর ওদের খাওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। ওরা অবশ্য হলুদ দিয়েই চলে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু তা আর হয়নি। অনিক এবং ওর কাজিনরা খাবার সার্ভ করছিল। মিতুল অনকিকে বলল,

“আপনিও আমাদের সঙ্গে বসুন।”
অনিক হেসে বলল,
“না, আমি পরে খাব। এখন একটু বেয়াইনদের আদর-যত্ন করে খাওয়াই।”
অনিকের রসিকতা শুনে সবাই হাসল। মিতুলকে খাবার দেওয়ার সময় ফিসফিস করে বলল,
“তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করো। কথা আছে তোমার সাথে।”
“কী কথা?”

“এখানে বলা যাবে না। পরে বলব।আগে খাওয়া শেষ করো।”
মিতুলের সব ভালো লাগে। শুধু এই অর্ধেক কথা শুনলেই মেজাজ চটে যায়। পরেই যদি বলতে হয় তাহলে আগে অর্ধেক কথা বলার প্রয়োজন কী? একেবারে বললেই তো হয়ে যায়। কী বলবে না বলবে কৌতুহলে পেটের মধ্যে পাকাচ্ছে। খাওয়াও হলো না ঠিকমতো। সবার আগে খাওয়া শেষ করে অনিকের সাথে একটু আড়ালে গেল সে। জানতে চাইল,

“এবার বলেন।”
“আসো আমার সাথে।”
“কোথায়?”
“আগে আসো। তারপর বলছি।”
মিতুলকে একদম ছাদের কর্ণারে নিয়ে গেল অনিক। মিতুল প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। অনিক বলল,
“একটু ওয়েট করো।”
এরপর সে ফোন বের করে কাউকে কল করে কিছু একটা বলল। মিতুল ঠিকমতো অবশ্য শুনতে পায়নি। ফোন কাটার পর সে বলল,

“কী?”
“দাঁড়াও বলছি।”
মিতুল চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। মিনিট দুয়েক পর অনিকের চোখে-মুখে হাসি ফুটে উঠল। মিতুলের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,
“মিট মাই গার্লফ্রেন্ড তিশা।”
মিতুল কিছু বুঝে ওঠার আগেই হাত বাড়িয়ে একটা মেয়েকে কাছে এনে দাঁড় করাল অনিক। তিশা হেসে মিতুলের উদ্দেশ্যে বলল,

“হাই।”
মিতুলও হেসে বলল,
“হ্যালো।”
অনিক পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল,
“এটাই আমার একমাত্র বেয়াইন। যাকে না দেখেই তুমি হিংসে করা শুরু করেছিলে।”
মিতুল বেশ অবাক হয়ে বলল,
“আমায় হিংসে?”
অনিক হেসে বলল,

“আর বোলো না! তোমরা মেয়েরা এত জেলাসি কেন? তিশা যখন শুনল যে আপুর বিয়ে ঠিক হয়েছে আর মিষ্টি একটা ননোদও আছে তখন থেকেই কথায় কথায় শুধু তোমাকে নিয়ে খোঁটা দেয়। আমিও রাগানোর জন্য আরও বেশি বেশি ওর কাছে তোমার প্রসংশা করতাম।”
মিতুল কী করবে বুঝতে পারছে না। তার হাসা উচিত নাকি মুখ গোমড়া করে রাখা উচিত? এমন সিচুয়েশনে মানুষ করেই বা কী! সৌজন্য রক্ষার্থে স্মিত হাসল শুধু। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে অনিক মিতুলকে জিজ্ঞেস করল,

“আমার হবু বউ কেমন বেয়াইন?”
এবার মিতুল হেসেই বলল,
“দারুণ, মাশ-আল্লাহ্।”
“দেখতে হবে না কার পছন্দ?”
পাঞ্জাবির কলারটা টেনে ভাব নিয়ে বলল অনিক। মিতুল খেয়াল করে দেখল, তিশা এখন লজ্জা পাচ্ছে। লজ্জারাঙা মুখটা দেখতে কী দারুণ লাগছে! দুজনকেই বেশ মানিয়েছে একসাথে। টুম্পা মিতুলকে খুঁজতে খুঁজতে এখানে চলে এসেছে।

“তুমি এখানে! ফোন আনোনি কেন?” জানতে চাইল টুম্পা।
“কী হয়েছে?”
“চলে যাবে সবাই এখন। আসো।”
মিতুল তিশাকে বলল,
“আপু বিয়েতে তো আসবেনই। পরে না হয় সময় নিয়ে আড্ডা দেবো কেমন? আর আমাদের বাসায় কিন্তু আপনার দাওয়াত রইল।”

তিশাও মিষ্টি করে হেসে বলল,
“অবশ্যই। একদিন সময় করে কিন্তু আমাদের বাসায়ও যেতে হবে।”
“আচ্ছা আপু। আসছি।”
“সাবধানে যেও।”
অনিক তিশাকে বলল,
“তুমি থাকো। আমি ওদের এগিয়ে দিয়ে আসি।”
“ঠিক আছে।”

সিঁড়ির দরজার কাছে গিয়ে দেখল রূপক দাঁড়িয়ে আছে। বাকিরা সবাই আগেই গাড়িতে গিয়ে বসেছে। শুধু সে, রূপক আর টুম্পা বাকি। গাড়িতে বসে ঘুম ঘুম ধরে গেল মিতুলের। ঘুমের ঘোরে খেয়ালই নেই যে তার চোখে কাজল আছে। সে ঘুমের তালে চোখ ডলা দেওয়াতে কাজল, আইলানার সব নষ্ট হয়ে গেল। বাড়ি ফিরে ভেতরে যাওয়ার সময় রূপক পিছু ডাকল তাকে। মিতুল দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,
“কী?”

রূপক একটা টিস্যু নিয়ে মিতুলের কাজল মুছে দিতে দিতে বলল,
“কী অবস্থা করেছ দেখেছ একবার? তোমার এক চোখে এখন আইলানার আছে, অন্য চোখে নেই। রুমে গিয়ে আইলানার দিও আবার।”

কোন কাননের ফুল গো তুমি পর্ব ৯

মিতুল স্থির, নির্বাক। তার কথা বলার ভাষা নেই। বুকের ভেতর কেমন যেন দ্রিমদ্রিম আওয়াজ হচ্ছে। এমন হচ্ছে কেন? রূপক এতটা কাছে বলে?

কোন কাননের ফুল গো তুমি পর্ব ১১