খড়কুটোর বাসা পর্ব ৫

খড়কুটোর বাসা পর্ব ৫
Jhorna Islam

যুথি ইরহান কে কথা গুলো বলতে বলতে প্লেটের প্রায় অর্ধেকের বেশি খাবার খাইয়ে ফেলেছে।ইরহান যুথির বলা সবগুলো কথা মনোযোগ সহকারে শুনেছে। পাল্টা কিছু বলেনি।
যুথির কথাগুলো চিরন্তন সত্যি ইরহান ও মানে। কিন্তু এতোদিন যে সে এদের আসল রুপটা দেখতে পায় নি। এদের জন্য এতোকিছু করে গেলো আর এরা এতোদিন মুখোশ পরে ছিলো।

এইযে এদের আসল মুখোশ ধীরে ধীরে সামনে আসছে ইরহান চেয়েও কিছু বলতে পারছে না। ইরহান বরাবর ই শান্তি প্রিয় লোক।ঝু’ট ঝামেলা থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে। ইরহানের বাবা মারা যাওয়ার আগে বলেছিলো ইরহান যেনো ওদের খেয়াল রাখে। ইরহান ভেবে পায়না এতোদিন কিছু না করে এখন কেনো তারা এমন করছে। তাকেই বের করতে হবে এর আসল কারণ।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

এতোদিন ইরহানের সাথে এরা এমন ব্যবহার করেনি।ওদের সাথে সম্পর্কটা এতোটা কাছের না হলেও এমন আচরণ করে নি কেউ।ইরহানের মাথায় আসছেনা এদের এমন আচরণেের কারণ। ইরহান ঐসময় ওদের কথা গুলো শুনে চাইলেই প্রতিবাদ করতে পারতো কেন জানি মন সায় দেয়নি।
ইরহানের ভাবনার মাঝেই যুথি ইরহানের মুখের কাছে আবার খাবারের লোকমা তুলে ধরে।ইরহানের ধ্যা’ন ভাঙে।
এই দেখো যুথি তোমার কথার তালে পরে সব আমি একাই খেয়ে ফেলতেছি। তুমিতো এখনো এক লোকমা ও মুখে নাও নি।

আমি আর খাবোনা বাকি টুকু তুমি খাও।পেট ভরে গেছে আমার।
জানা আছে এই অল্প কয়টা খেয়ে কি পেট ভরেছে আপনার। চুপচাপ খেতে থাকেন।
তোমার না প্রচুর খিদে পেয়েছে? আমি আর খাবো না এবার তুমি খাও।

— নানা আপনি আরেকটু খান।
— এখানে অল্প খাবার আছে যুথি এটুকু তে তোমার পেট ভরবে না। তুমি খাও।
— আচ্ছা ঠিক আছে। দুইজন একসাথে খাবার টুকু শেষ করি।আপনি একবার আমি একবার।
— একদম না। এইটুকু খাবারে বাচ্চাদের ই পেট ভরবে না। আবার আমাকে কেনো জোর করছো? আমিতো খেয়েছি।তুমি একটুও খাওনি।
— আপনি আমার কথা শুনবেন না?
— নাহ্।

— দুইজন এক প্লেট থেকে একসাথে খেলে এইটুকুতেই পেট ভরবে। আমার কথা বিশ্বাস না হলে খেয়ে দেখেন।
ইরহান কে যুথির সাথে অগত্যা খেতেই হলো।কি সুন্দর করে যুথি নিজের মুখে একবার খাবার দিচ্ছে আবার ইরহানের মুখে একবার পরম যত্নে তুলে দিচ্ছে। ইরহানের জানা নেই কবে কেউ এতো যত্ন সহকারে তাকে খাইয়ে দিয়েছে। মা মারা গেছে সেই ছোট্ট বেলা ঐসময়ের তেমন কিছুই মনে নেই।

শুধু মাঝে মাঝে অনেক চেষ্টা করলে ঝাপসা স্মৃতি ভেসে ওঠে চোখে।
যুথির এতো যত্ন সহকারে খাওয়ানো দেখে কেন জানি ইরহানের চোখ দুটি ছলছল করে উঠে। ইরহান খুব ভালোবাসার কাঙাল।নিজের মা কে ছোট বেলা হারিয়েছে। বাবা কাজের জন্য বাইরে থাকতো বেশি সময় দিতে পারতো না। তাছলিমা বানু ইরহানের ব্যাপারে সব সময় উদাসীন থাকতো।তাও ইরহান একটু ভালোবাসা পেতে কতো কি করতো। পিছন পিছন ঘুরতো মা মা করে।

এই যে নিজের সব শখ আল্লাদ বাদ দিয়ে প্রবাস পারি জমিয়েছিলো ভেবেছিলো এবার মা কাছে টেনে নিবে আঁচল তলে একটু ঠাঁই দিবে। প্রতিবার যখন মায়ের ফোন থেকে কল যেতো বা ভাইদের ফোন থেকে কল যেতো ইরহান কি খুশি হতো। কিন্তু ওরা ওদের প্রয়োজনে কল দিতো ইরহানের খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য না। তাছলিমা বানু যা বলতো ইরহান তাই করতো মনে মনে আশা ছিলো একদিন না একদিন ঠিক একটু ভালেবাসা দিবে কাছে টেনে নিবে।

কিন্তু আজ সকালে নিজের কানে সব শোনার পর ইরহানের সব ধারণা ভুল হয়ে গেছে।
ইরহান মুখে খাবার তুলতে তুলতে যুথির মুখের দিকে তাকায়। যুথি অতটা সুন্দরী না সাধারণ একটা মুখ অথচ ইরহানের কি যে ভালো লাগছে দেখতে। নিষ্পাপ মুখ’শ্রী।

যুথির দিকে তাকিয়ে তাকিয়েই ইরহানের মনে হলো ও এই মেয়েটাকে ঠকিয়েছে।চরম ভাবে ঠকিয়েছে। স্বামীর দায়িত্ব তো ইরহান পালন করতে পারেনি। প্রতিটা মেয়েরই স্বামী শ্বশুর বাড়ি নিয়ে হাজারো স্বপ্ন থাকে।যুথির ও নিশ্চই আছে।
খাবার আর গলা দিয়ে নামলো না ইরহানের।যুথি খাবারের লোকমা মুখের সামনে নিলে না করে দেয়।যুথি আর জোর করে নি।

নিজেও খাবার তারাতাড়ি শেষ করে হাত ধুয়ে প্লেট টা খাটের নিচে রেখে দেয় কাল সকালে নিয়ে জায়গা মতো রাখবে।এখন ঐ লোক গুলোর মুখোমুখি হওয়ার একটু ও ইচ্ছে নেই। ইরহানের মুখে টা ধুয়ে দিয়ে নিজের ওড়না দিয়ে মুছে দেয়।
যুথি তোমার এখানে এইভাবে এসে পরা একদম ঠিক হয়নি।
হুট করে ইরহানের এমন কথায় যুথি কিছুটা চমকে ইরহানের দিকে তাকায়।
মানে?

আমি অন্য কিছু ভেবে রেখেছিলাম যুথি তুমি এখন এখানে এসে একদম ঠিক করোনি। তুমি পরিস্থিতি টা বুঝতে পারছোনা। তোমাকে আমি বলতেও পারবো না।
যুথি ইরহানের চোখে চোখ রেখে বলল আপনি যে কোন পরিস্থিতি তে আছেন সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি। আপনি না বললেও এই বাড়ির প্রতিটা লোক কেমন আমার জানা হয়ে গেছে। আর আপনার সাথে কি করেছে তা ও।
ইরহান কিছু টা অবাক হয় যুথির কথায়। তুমি জানো? না মানে কিভাবে?

সকালে যে আপনি আমার সাথে কথা বলতে বলতে আপনার মায়ের রুমে যাচ্ছিলেন সেটা নিশ্চই মনে আছে? আর ওদের কথা শুনে আপনি ভুলেই গিয়েছিলেন আমি অপর পাশে ছিলাম।কল টা কিন্তু না আপনি কেটেছিলেন না আমি।ওদের সব কথা শুনে তারপরই আমি কল কেটেছি।

আমি যুথি যেখানে অন্যের উপর করা অ’ন্যায় অ’ত্যা’চার সহ্য করতে পারিনা একদম সেখানে কি করে আমার নিজের মানুষটার উপর হওয়া অন্যায় মুখ বুজে মেনে নেবো,?
ঐ স্বা’র্থপর মানুষ গুলো দিনের পর দিন একজন মানুষ কে ঠকিয়ে যাচ্ছে। তার সুযোগ নিচ্ছে জেনেও আমি চুপ থাকবো?
আপনাকে আমার ভালো করেই চিনা হয়ে গেছে। আর আমি যে এভাবে আসা ছাড়া এই বাড়িতে সহজে পা রাখতে পারবো না সেটাও বোঝা হয়ে গিয়েছিলো আমার।

হ্যা আমি মানছি আমার এভাবে আসা উচিৎ হয়নি। কোনো মেয়েই হয়তো এমন করে তার শ্বশুর বাড়িতে পা রাখে না। আমি কি করতাম? ওদের কথা গুলো শুনে আমার মাথা ঠিক ছিলো না। এখন আমি এমন ভাবে আসায় আপনার কি খুব অসুবিধা হচ্ছে? আপনি চাইলে আমায় শাস্তি দিতে পারেন।

আমি ওদের অন্যায় একদম মেনে নিবো না।আপনি মহান হতে পারেন আমি না।
এখন ওদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করার জন্য আপনি কি আমায় তাড়িয়ে দিবেন?
এসব কি বলছো যুথি? আমি এসব ভেবে বলিনি। তোমারতো কতো স্বপ্ন ছিলো হয়তো শ্বশুর বাড়ি নিয়ে।খালি হাতে আসতে হয়েছে তোমাকে এখানে।এসেও তো কারো কাছ থেকে ভালো ব্যবহার পাওনি। ইমন আর ইশানের বউ তোমাকে অপমান করে চলেছে।

আমি ওদের কে গুনায়ই ধরি না। ওদের অপমানের যোগ্য জবাব দিতে জানি।কথাটা বলেই জুথি বিছানার এক পাশে গিয়ে শুয়ে পরে।
ইরহান ও বাতি বন্ধ করে অপর পাশে এসে শোয়।যুথি চুপচাপ শুয়ে আছে কোনো নড়াচড়া ও করছে না। ইরহান শুয়ে থাকলেও চোখে ঘুম নেই।তার মাথায় নানান চিন্তা। সে বুঝে গেছে তার এমনভাবে চুপ করে থাকলে চলবে না।
হঠাৎ করেই ইরহান ফোপানোর শব্দ শুনতে পায়। পাশ থেকেই আসছে যুথি হয়তো কাঁদছে।

— যুথি কি হয়েছে কাঁদছো কেনো?
যুথি কোনো সারা দেয় না। সে কেদেই চলেছে অপর পাশে ফিরে।
ইরহান এবার যুথিকে টেনে নিজের দিকে ফিরায়।কি হয়েছে কাঁদছো কেনো? আমার কথায় কষ্ট পেয়েছো? তাহলে আমি মাফ চাইছি কেঁদো না আর।

যুথি মাথা নাড়িয়ে জানায় সে ইরহানের কথায় কষ্ট পায় নি।
তাহলে কেনো কাদছো? বাড়ির কথা মনে পরছে? তোমার দাদির কথা?
যুথি হুট করে ইরহানের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে আর হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। এসব কিছু না বোকা পুরুষ।
ওরা আপনাকে ঠকিয়ে দিলো।সব দিক দিয়ে ঠকিয়েছে। আপনি তো এমন জীবন পাওয়ার কথা না।আপনার মতো মানুষের জীবন টা খুব সুন্দর হওয়ার কথা।ওরা কিভাবে পারে এমন করতে?

আমি এবার ভালো করে বুঝতে পারছি কেনো আমার মতো গরিব ঘরের একটা মেয়েকে আপনার সাথে জড়ালো।ওরা চায়নি আপনি ভালো কিছু পান। আপনার জীবনে আমাকে এনেও ঠকিয়ে দিলো ওরা।না পাবেন শ্বশুর বাড়ির আদর আপ্যায়ন না পাবেন শ্বশুর শ্বাশুড়ির ভালোবাসা।
আমি আপনার কষ্ট টা খুব ভালো করে বুঝতে পারছি।আমিও যে আপনার মতো একা কেউ নেই। আপনার ও কেউ নেই আমারও কেউ নেই। আমাদের কষ্ট এই লোক গুলো বুঝবেনা।

আপনাকে ওরা সব দিক দিয়ে ঠকিয়ে দিলো যে বোকা পুরুষ!
কে বলেছে আমি ঠকে গেছি? আমিতো মনে হচ্ছে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় জিনিস টা পেয়েগেছি। আমার মুখোশ দ্বারী মা আমার ক্ষতি করতে গিয়ে নিজের অজান্তেই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহারটা আমার কাছে এনে দিয়েছে। জানো আমি যখন ওদের আসল রুপটা দেখলাম এতো কষ্ট হচ্ছিল ভেবেছিলাম আমার জীবনে আর ভালো কিছু নেই সব অন্ধকার দেখছিলাম।কিন্তু না আমি আমার জীবনের আলো পেয়ে গেছি।আমার যুথি রানীকে।বলেই ইরহান যুথিকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে।

এবার আর কারো কথা ভাববোনা।এবার তোমার আর আমার জন্য যা করার করবো।ওদের জন্য তো অনেক করলাম।আশা করি ওদের আর অসুবিধা হবে না।
যুথি ইরহানের বুক থেকে নিজের মাথাটা একটু উচিয়ে বলে আপনি এতো ভালো কেনো বোকা পুরুষ?

খড়কুটোর বাসা পর্ব ৪

এর থেকে বড় করে প্রতিদিন গল্প দেওয়া সম্ভব না। আরো বড় চাইলে একদিন পর পর দেওয়া লাগবো। আর আপনাদের কয়েকজনের মন্তব্য দেখলে আমার লিখার আগ্রহই হারিয়ে ফেলি।🙂

খড়কুটোর বাসা পর্ব ৬