গভীর গোপন গল্পের লিংক || অনন্য শফিক

গভীর গোপন পর্ব ১
অনন্য শফিক

কদিন ধরেই আমার পেটে চিনচিনে একটা ব্যথা হচ্ছে।আশফাককে এই নিয়ে কয়েকবার বলা হয়েছে। সে বলেছে ডাক্তার দেখাতে গিয়ে।আমি
বললাম,’ আমি একা একা কি করে এই শরীর নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবো? তুমি নিয়ে যাও।’
আশফাক বললো, তার হাতে আপাতত সময় নাই। প্রচন্ড চাপ যাচ্ছে কাজের।
আমি অভিমান করেই বললাম,’ ঠিক আছে। তুমি তোমার কাজ নিয়েই পড়ে থাকো।আমি মরে যাই!আমি মরলেই তোমার শান্তি!’

আশফাক আমার থুতনি ধরে মুখটা উপরে তুলে বললো,’ এমন কথা বলো না লক্ষ্মী! তোমার পেটে আমার অনাগত সন্তান। তোমরা মা এবং বাচ্চার ভালোর জন্যই তো আমি সব করছি। তুমি টেনশন করো না।দেখি আজ, যদি অফিসের কাজ গুছিয়ে ফেলতে পারি তবে আগামীকাল তোমায় নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবো।’
আমি কথা বললাম না। অভিমান করেই বসে রইলাম।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আশফাক অফিসে চলে গেল।আমি মাকে ফোন করলাম। বললাম,’ মা আমার কদিন ধরেই পেটে ব্যথা। চিনচিনে ব্যথা।ব্যথা যখন বেশি হয় তখন শরীর ঘামতে শুরু করে। অসহ্য লাগে সবকিছু।ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিৎ না?’
মা বললেন,’ কি সর্বনাশের কথা! তুই এখনও বলছিস উচিৎ কি না? এখনও ডাক্তারের কাছে যাসনি কেন? তোর কেমন আন্দাজ বল? আশফাক কোথায়? ওর কি আক্কেল জ্ঞান নাই নাকি? তোকে নিয়ে এখনও ঘরে বসে আছে কেন’
আমি বললাম,’ ওর কাজের খুব চাপ।তাই আমায় নিয়ে যেতে পারছে না।’

মা বললেন,’ কিছু একটা হয়ে গেলে তখন তার কাজ বেরুবে! আমি ফোন করছি এক্ষুনি ।’
আমি বললাম,’ ফোন করতে হবে না মা।ও বলেছে কাল নিয়ে যাবে আমায়।’
মা আমায় ধমক দিলেন। বললেন,’ ও যাবে না।আমার ধমক খেলেই পরে যাবে।এমনি এমনি কখনো চিড়ে ভিজে না বুঝলে!’
বলে মা ফোন কেটে দিলেন।

এর আরো বিশ মিনিট পর মা আবার ফোন করলেন আমায়। ফোন করে কেঁদে কেঁদে বললেন,’ তুই এক্ষুনি বাসায় এসে পড়। ওখানে আর এক দন্ড না।ওই অমানুষের ঘরে থাকার কোন প্রয়োজন নাই!ওই সংসার তোকে আর করতে হবে না।’
আমি অবাক হলাম। এরকম ওভার রিয়েক্ট করবার কি আছে এখানে? আশফাক তো মায়ের খুব পছন্দের ছেলে। ওর সম্পর্কে মা এসব বলছেন কেন? তাছাড়া এভাবে কাঁদছেনই বা কেন?
আমি বললাম,’ মা, কি হয়েছে ? ও কি কিছু বলেছে তোমায়?’

মা বললেন,’ আমি ওকে আপন ভেবেই শাসনের গলায় বলেছিলাম, আশফাক, তোমার কেমন আন্দাজ বলো, তুলির এতোদিন ধরে অসুখ। তার পেটে বাচ্চা।কখন কি ঘটে বলা যায়! তুমি এখনও তোমার অফিস নিয়ে পড়ে আছো! আমার মেয়ে আর নাতির কিছু হলে তোমায় উচিৎ শিক্ষা দিয়ে ছাড়বো আমি! এটা বলতেই আশফাক বললো,আমি যেন তোকে নিয়ে যাই বাসায়। তোকে নিয়ে আর সে সংসার করবে না।

একটুতেই অতো গলে গেলে তোকে বিয়ে দিয়েছি কেন? ঘরের সুকেশে সাজিয়ে রাখলেই পারতাম। এইগুলো বলেছে। তাছাড়া আমায় বলেছে,আমি কোন সাহসে এসব কথা তাকে বললাম? আমি নাকি এসব বলবার অধিকার রাখি না। বল, আমি কি কিছু ভুল বলেছি ওকে?’
আমি কি বলবো আসলে বুঝতে পারছি না।মা ওকে ওভাবে না বললেও পারতেন যে তিনি কিছু হলে উচিৎ শিক্ষা দিবেন। সে তো বলেছিলই আগামীকাল আমায় নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবে ।এতো রাগ থাকা কি ভালো? মা যে কেন এমন পাগলামি করেন!
তাছাড়া আশফাকেরই বা এতো রাগ দেখাতে হয় কেন! আমার মা তো তারও মা। মায়ের সঙ্গে কেউ এরকম ব্যবহার করে?

বিকেল বেলা মন খারাপ করে বসে আছি। তখন কোন খোঁজ খবর না দিয়েই আশফাকের একমাত্র বোন জুই এলো।জুই আমার সঙ্গে ভীষণ মিশে। সমস্যা হলো ওর ভাইয়ের সঙ্গে মিশে না। একটুও না। না মেশার কারণ হলো সে তার ভাগের সব সম্পত্তি নিয়ে যেতে চায়। সম্পত্তি নেয়ার জন্যই কদিন পর পর আসে।আশফাক দেয় না। না দেয়ার কারণ হলো আশফাকের ধারণা জুই সম্পত্তি নিজের নামে লিখিয়ে নিলে দুদিন পরই তার হাসব্যান্ড সব বিক্রি করে দিবে।

বিক্রি করে দিবে কারণ ওর হাসব্যান্ড জোয়ারি। ক্রিকেট খেলায় বলে বলে টাকা ধরে। চাকরি বাকরি ছেড়ে এখন এসবে ধরেছে। নিজের বাবার যা সহায় সম্পদ ছিল তা বেচাবিক্রি করে শেষ করেছে কবেই।এখন শুধু ঘরের জায়গাটা আছে। এখন নজর পড়েছে এদিকে। জুইয়ের ভাগের সম্পত্তিতে।জুইকে কিভাবে কি বুঝিয়েছে কে জানে! জুইয়ের দু চোখের বিষ এখন আশফাক।জুই সব সময়ই বলে আশফাক তার সৎ ভাই বলে এরকম।আপন ভাই হলে কখনোই সম্পদ নিয়ে এরকম করতো না! ভাগ বুঝিয়ে দিয়ে দিতো।

জুই এবার এসে হঠাৎ করেই বললো,’ ভাবি, একটা দারুন সংবাদ আছে তোমার জন্য!’
আমি বললাম,’ কি সংবাদ?’
জুই বললো,’ ভাইজান নাকি গোপনে আরেকটা বিয়ে করেছে।শুনেছো নাকি এই বিষয়ে কিছু?’
আমি হেসে বললাম,’ ফাজলামো রাখো।’

জুই আমার হাত ধরে বললো,’ আচ্ছা ভাবি,যদি ভাইজান কখনো এরকম কিছু করে তবে কি তুমি তা সহ্য করতে পারবে?’
আমি ওর দিকে আগুন বর্ণ চোখে তাকিয়ে বললাম,’ এরকম কিচ্ছু হবে না।হলে এই সংসার আমি নিজেই আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিবো !’

জুই হাসতে শুরু করলো শুনে।আমি ওর গালে দুষ্টুমি করে ছোট্ট একটা চড় বসিয়ে দিয়ে বললাম,’ সাবধান!এরকম পঁচা কথা আর কখনোই আমার সামনে বলবি না তুই!বললে তোকে খু*ন করে ফেলবো আমি।’
জুই মৃদু হেসে বললো,’ আচ্ছা আর বলবো না। তোমার হাতে খু*ন হয়ে এই যুবতী বয়সেই পৃথিবী ত্যাগ করতে চাই না আমি। পৃথিবীতে অনেক কিছু দেখার, করার শখ রয়ে গেছে আমার। আগে সেসব পূরণ করি। এরপর খু*ন করো আর যাই করো করতে পারো।’
বলে জুই হাসলো। আমিও হাসলাম ওর কথা শুনে।

সেদিন কিছু ঘটলো না। ঘটনা ঘটলো এর পরদিন।জুই এবার ঝগড়া বাঁধিয়ে বসেছিল ওর ভাইয়ের সঙ্গে।বলে বসলো সাত গায়ের লোক নিয়ে সালিশ বসাবে। আমি অনেক চেষ্টা তদবির করে তাকে বিদেয় করলাম।জুইকে বিদায় করার খানিক সময় পর আশফাক বললো রেডি হতে।ডাক্তারের কাছে যাবে আমায় নিয়ে। আমি ওয়াশরুমে ঢুকেছি চেঞ্জ করতে। এরিমধ্যে আশফাকের ফোন বাজলো। সে কথা বললো ফোনে। কথা শেষ করে ডাকলো আমায়। আমি তখন শাওয়ার ছেড়েছি মাত্র।ওর ডাকে আধভেজা শরীরেই দরজা ঠেলে উঁকি দিয়ে বললাম,’ কি হয়েছে?’
আশফাক বললো,’ তুলি, তোমায় বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। আজকে আমাদের বাসায় একজনের আসার কথা। এসে কদিন থাকবে।’

আমি বললাম,’ কে আসবে? কার আসার কথা?’
আশফাক বললো,’ জেবার।জেবাকে চিনো না তুমি?’
আমি বললাম,’ চিনি। তোমার বান্ধবী।ও হঠাৎ এখানে আসবে কেন? সংসার রেখে, স্বামী বাচ্চা রেখে হঠাৎ এসে বন্ধুর বাসায় কদিন থাকতে হবে কেন ওর?’
আশফাক বললো,’ ওর ডিভোর্স হয়েছে।ওর হাসব্যান্ড ওকে ডিভোর্স দিয়েছে।’

আমি অবাক হলাম।চোখ কপালে উঠে গেল আমার। বললাম,’ কি বলছো এসব? এরকম হলো কেন?’
আশফাক বললো,’ বিয়ের আগে জেবার একটা রিলেশন ছিল। এরপর কোন একটা কারণে বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ওর বিয়ে হয়নি। বিয়ে হয়েছে অন্য কারোর সঙ্গে। এতো দিন কোন সমস্যা হয়নি।এই এতো বছর পর হঠাৎ করে জেবার এক্স তার কাছে থাকা একটা স্ক্যা*ন্ডাল ভিডিও ভাইরাল করে দিয়েছে। সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে এই ভিডিও।

সঙ্গে সঙ্গে ওর হাসব্যান্ড তিন তালাক বলে দিয়েছে। এবার নাকি কাগজে কলমেও দিবে। তাছাড়া ওর ভাই ওকে ফোন করে বলেছে, ওকে সামনে পেলে তার ভাই নিজেই গলা টিপে মেরে ফেলবে। জেবা মরতে গিয়েছিল। কিন্তু বাচ্চাটার কথা ভেবে মরতে পারেনি। অসহায় হয়ে আমায় ফোন করেছে। ওকে আমি কি করে ফেলে দেই বলো? ওর এই দুর্দিনে আমি যদি ওর পাশে না থাকি তবে ও নিরুপায় হয়ে সো*ইসাইড করে ফেলবে হয়তো। তখন কেমন হবে বলো?’
আমি বললাম,’ ঠিক আছে। ওকে আসতে বলো।’

আশফাক সঙ্গে সঙ্গে ফোন করলো।বললো,’ তুই এসে পড়। বোরখা পরে আয়। সাবধানে আসিস।’
জেবা এলো। ওর দু’ হাত ভর্তি ব্যাগ।সব কাপড় চোপড় আর প্রয়োজনীয় জিনিস পত্তর নিয়ে এসেছে। তিন বছরের মেয়ে টুকিও সাথে।টুকিকে দেখেছি অনেক আগে। তখন তার বয়স এক বছর। শুধু হাসতো ঠোঁট মেলে।কি সুন্দর লাগতো! এখন তার সৌন্দর্য্য আরো বেড়েছে।চুল লম্বা করেছে।চোখ জোড়া কেমন মায়াবী হয়েছে। দেখলেই কাছে টেনে আদর করতে ইচ্ছে করে।
টুকি এখানে আসার পর থেকেই আমার সঙ্গে তার বেশ ভালো সম্পর্ক হয়ে গিয়েছে।ও মানুষের মন কাড়তে জানে।

সেদিন আর ডাক্তারের কাছে যাওয়া হলো না।এর পরদিন আশফাক আমায় নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেল।ডাক্তার দেখিয়ে এলাম।ডাক্তার বললো, চিনচিনে ব্যথাটা অস্বাভাবিক কিছু না। এটা গ্যাসের সমস্যা থেকেই হয়েছে।ভয় পাওয়ার কিচ্ছু নাই।আর ঘামটা ব্যথার জন্যই হয়।ব্যথায় শরীর ক্লান্ত হয়ে এলে তখন শরীর ঘেমে উঠে। ভাজাপোড়া না খেতে বলেছে।তরল খাবার গ্রহণের কথা বলেছে।

ফেরার সময় আশফাক অনুতপ্ত হয়েছে এরকম গলায় বললো,’ মা ওইদিন ফোন করে আমায় রাগ উঠিয়ে দিলেন। আমিও খারাপ বিহেইভ করেছি।মার কাছে মাফ চাওয়া উচিত!’
সে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করলো।মাফ চায়লো মার কাছে। এরপর মাকে জানালো আমার কোন সমস্যা নাই। টেনশন না করতে বললো। এরপর দেখলাম তারা অনেকক্ষণ ধরে ফোনে কথা বলছে। হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে আশফাক।দেখে কে বলবে মায়ের সঙ্গে একটু আগেও তার মনোমালিন্যের সম্পর্ক ছিল! মা এরকমই।আশফাকও এরকম।ওরা মুহুর্তে রাগতে পারে। মুহুর্তে আবার মিলেও যেতে পারে।

বাসায় ফিরে মেজাজ বিগড়ে গেলো।জার্নি করে এসেছি। শরীর ঘেমে একসার।এতো গরম পড়েছে!গোসলে ঢুকতে যাবো সেই উপায়ও নাই।জেবা গোসলে।জেবার গোসল হলে আমি ঢুকলাম।গোসল সেরে ভাবলাম রেস্ট নিবো। এরপর রান্না বান্না নিয়ে ভাবা যাবে । আশফাক বাইরে গেছে। জেবার নাকি মাথা ধরেছে। ওষুধ আনতে গিয়েছে। জেবা এখানে আসার পর থেকেই দেখছি আমার সঙ্গে তেমন কথাবার্তা বলছে না।আমি আগ বাড়িয়ে কথা বলতে গেলেও তেমন পাত্তা দিচ্ছে না। হয়তো ওর মনটা খারাপ বলে। এতো বড় একটা ঝড় ওর জীবনে বয়ে যাচ্ছে,মন তো খারাপ থাকবেই!

আমি বসে আছি। জানলার পাশে বসে আকাশ দেখছি। হঠাৎ করে আকাশে মেঘ করেছে। হাওয়া দিচ্ছে গাছের পাতায় পাতায। এক দুটা চিল ওড়াওড়ি করছে। শরীর জুড়িয়ে আসছে শীতল বাতাসে।বড়ো ভালো লাগছে । এরিমধ্যে আমার পেছনে এসে কে যেন আমার চোখ চেপে ধরলো।আমি চমকে উঠে হাত দুটো স্পর্শ করতেই বুঝলাম ছোট্ট টুকি।টুকিকে আমি টুকটুকি বলে ডাকি। বললাম,’ টুকটুকি,কি খবর? আমার চোখ এভাবে চেপে ধরলে কেন?’
টুকি হেসে ফেললো শব্দ করে।হাত ছেড়ে দিয়ে বললো,’ মজা করতে ধরেছি।অ্যাই, তুমি কি রাগ করেছো নাকি আমার সঙ্গে ? ‘

ছোট্ট একটা মেয়ে এতো সুন্দর করে কথা বলে! আমি ওকে আদর করে এনে কাছে বসালাম। তারপর ওর কপালে একটা চুমু এঁকে দিলাম। টুকি আমার দিকে তখন চোখ বড় বড় করে তাকালো। তারপর আমার কানের কাছে কান এনে ফিসফিস করে বললো,’ তুমি আমার সঙ্গে এমন করলে কেন ?’
আমি বললাম,’ আদর করেছি তো।’
টুকি বললো,’ তুমি জানো, মাকেও এভাবে আদর করে আশফাক মামা! আজকেও —-‘

গভীর গোপন পর্ব ২