গোধূলি লগ্নের সেই তুমি পর্ব ১৯

গোধূলি লগ্নের সেই তুমি পর্ব ১৯
লেখনীতে জেনিফা চৌধুরী

নিজের বাবার আর খালা’কে উল্টো করে ফুটন্ত পানির উপর ঝুলিয়ে রেখেছে ফারদিন। ফাইজা পাশের চেয়ারে এখনো হাত পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে। চেয়ে চেয়ে সব’টা দেখছে। কাল পার্কে ঘুরে রাতে বাসায় কাছে নামিয়ে ফারদিন চলে যেতেই এক দল লোক ও’কে তুলে নিয়ে আসে এখানে। তারপর থেকে ওর কিছু মনে নেই। যখন চোখ খুললো তখন এই দুজন’কে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখে ওর আত্মা কেঁপে উঠলো। তার পাশেই ফারদিন চেয়ারে হেলান দিয়ে গান’টা কপালের সাথে ঠেঁকিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। সব পরিবেশ কিছু বুঝতে না পেরে ফাইজা চুপ করে বসে বসে চেয়ে চেয়ে দেখছে। রেজওয়ান আর কাকনের হাত পা বাঁধা আর মুখে টেপ লাগানো বলে ওরা কোনো শব্দ করতে পারছেনা। ফারদিনের দুই পাশেই দুইজন গার্ড দাড়িয়ে আছে। ফারদিন কিছুক্ষন থম মে/রে বসে থেকে শান্ত হয়ে জোরে একটা নিশ্বাস ছাড়লো। ফাইজার সামনে এগিয়ে এসে ওর দুই গালে হাত রাখলো। ওর হাতে গান’ থাকায় ফাইজা কিছু’টা ভয় পেলো। ফারদিন বুঝতে পেরে অভয় বানী দিয়ে বললো…..

–আর ইউ ও’কে জান? কোথায় লেগেছে? কোথায় কষ্ট দিয়েছে ওরা? বলো আমাকে?
ফারদিনের চিন্তিত স্বর শুনে ফাইজা একটা ঢোক গিয়ে ফারদিনের কপালে নিজের কপাল ঠেঁকিয়ে বলে উঠলো….
–আমি জানতাম আপনি থাকতে আমার কোনো ক্ষতি হবে না। দেখুন আমি একদম সুস্থ আছি। ঠিক আছি।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ফাইজার কথা শুনে ফারদিন একটু হেসে ওর কপালে আদুরে স্বরে ঠোঁট ছোঁয়ালো। কাল যখন শুনেছিলো ফাইজা কিডন্যাপ হয়েছে তখন ওর মনে হচ্ছিলো কেউ ও’র গলা চে’পে ধরেছিলো। দম নিতে পারছিলোনা। এইসব কে করেছে সব জেনেও ফাইজা’কে খুঁজে পেতে পেতে সারা রাত কেটে গেলো। সকালে যখন এখানে এসেছিলো তখন ফাইজা সেন্সলেস অবস্থায় ছিলো। আর ফারদিনের লোকেরা কাকন আর রেজওয়ান’কে ফারদিনের কথামতো এইভাবে রেখে দিয়েছে৷ সব কিছু এত তাড়াতাড়ি হয়ে গেছে যে রেজওয়ান আর কাকন কিছু বুঝেই উঠতে পারেনি। ফাইজা’র হাত পা দুটোর বাঁধন খুলে দিয়ে ও’কে একটু জড়িয়ে ধরে ঠিক ভাবে ওড়না’টা গায়ে প্যাঁচিয়ে দিলো। তারপর ওর লোক’দের ইশারা করতেই ওরা রেজওয়ান আর কাকন’কে নামিয়ে আনলো। ওদের দুজন’কে একটা চেয়ারে বসিয়ে হাত পা বেধে দিলো। ফারদিন একটা চেয়ার টেনে ওদের মুখোমুখি বসে সামনের একটা টেবিলের উপর পা তুলে বসলো। গান’টা টেবিলের সাথে লাগিয়ে ধরে আছে। রেজওয়ান আর কাকন ওর দিকে ভয়ার্ত চোখে তাঁকিয়ে আছে। ফারদিন ওদের দিকে তাঁকিয়ে হালকা হেসে বলে উঠলো….

–কি ভেবেছিলেন? আমার প্রথম ভালোবাসা আমার মায়ের মতো আমার দ্বিতীয় ভালোবাসা’টা ও কেড়ে নিবেন। আমাকে নিঃস্ব করে দিবেন। হাউ ফানি ম্যান…..
বলেই হাহা করে হেসে দিলো। ফাইজা প্রশ্নওর চোখে তাঁকিয়ে সব’টা দেখছে। ফারদিন একটু থেমে শান্ত স্বরে ফাইজার দিকে না তাঁকিয়েই বলতে লাগলো….
–আমি যখন সাত বছরের একটা বাচ্চা। তখন চোখের সামনে প্রতিদিন বাবা-মা’কে ঝগড়া করতে দেখতাম। প্রতিদিন রাতে ড্রিংকস করে বাড়ি ফিরে মায়ের সাথে ঝগড়া করে মা’কে মা/রধর করা ছিলো বাবার নিত্যদিনের রুটিন। আমি দরজার আড়াল থেকে লুঁকিয়ে দেখতাম। আর চাপা আতৎনাদ করতাম। কি, বা বুঝতাম? শুধু মায়ের কান্না দেখে বুঝতাম মা খুব কষ্টে আছে।

আমার মা সব’টা মেনেও কোনো শব্দ করতো না। বাবার অফিসের যত সুন্দরী মেয়ে ছিলো তাদের সবাই’কে টাকার লোভ দেখিয়ে বাবা বাড়ি নিয়ে এসে ভোগ করতো। তাও আমার মায়ের চোখের সামনে। মা’কে রুমের এক কোনে বেঁধে রেখে মায়ের সামনেই অন্য মেয়ে’র সাথে দিনের পর দিন রাত কাটিয়েছে এই লোক’টা। পাঁচ বছর থেকেই আমাকে একা অন্য রুমে কা’টাতে হতো। কত রাত কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়েছি হিসেব নেই। টাকা পয়সার অভাব ছিলোনা। বিশাল বাড়ি সম্পত্তি কিছুর অভাব ছিলোনা। অভাব ছিলো ভালোবাসা আর শান্তির। আর এইযে এই মহিলা’টা(কাকনের দিকে ইশারা করে) ইনি আমার আপন খালা। আমার মায়ের আপন রক্তের বোন। আমি শুনেছিলাম খালা হলো দ্বিতীয় মা। কিন্তু এই মহিলা’টার থেকে জঘন্য মহিলা আমি কোনোদিন দেখি’নি।

যে নিজের আপন বোনের স্বামীর সাথে পরকিয়া করে গেছে দিনের পর দিন। অন্য মেয়ের সঙ্গ পেয়ে আমার বাবা আমার মা’কে যেই নির্যাতন করতো। সেগুলো দেখে ওই সাত বছরের বাচ্চা’টা আমি’র মনে আস্তে আস্তে মেয়েদের নিয়ে ক্ষোভ ঘৃনা জমতে শুরু করেছিলো। আমি প্রতিদিন আড়ালে লুঁকিয়ে মায়ের কান্না দেখতাম। মায়ের শরীরে আঘাতের ক্ষত গুলো আমার থেকে লুঁকিয়ে রাখার জন্য মা বড় বড় পোষাক পড়ে নিজেকে আড়াল করে রাখতো। আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেক রাত মা নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলতো। আমি চেয়ে চেয়ে বোবার মতো মায়ের কান্না দেখতাম। বাবা নামক মানুষ’টার থেকে কোনো দিন আমি আদর, স্নেহ, ভালোবাসা কিছু পাই’নি। বরং পেয়েছি অবহেলা। যেদিন মা জানলো তার বোন তার সংসার ভাঙ্গছে সেদিন মা বড় হয়েও ছোট বোনের পা জড়িয়ে নিজের স্বামী আর সংসার ভিক্ষা চেয়েছিলো। কিন্তু ওরা আমার মা’কে ভিক্ষা দেয়’নি। বাবার সাথে তর্ক করার সময় বাবা মা’কে বেল্ট দিয়ে আ’ঘাত করে র’ক্তা’ক্ত করেছিলো। মা তারপরের দুইদিন তীব্র জ্বর আর ব্যাথায় ছটফট করেছিলো কিন্তু জঘন্য লোক’টা ফিরেও তাঁকায়’নি।

বাড়ির কাজের আন্টি মা’কে ওষুধ দিয়ে আমাকে খাইয়ে দিয়ে যেতো। ওই কাজের আন্টি’টাকেও আমার বাবা ভোগ করেছে বহুবার। লোক লজ্জার ভয়ে সে কোনোদিন মুখ খুলতে পারে’নি। তার চোখে আমি অসহায়ত্ব খুঁজে পেয়েছিলাম৷ নভেম্বরের ১২ তারিখ আমার জীবনে কাল রাত্রী হয়ে যাবে আমি ভাবতেও পারি’নি। সেদিন সন্ধ্যায় বাবা আর এই মহিলা’টা ড্রিংকস করে একসাথে আমাদের বাড়ি ফিরেছিলো। রুমে যেতেই মা ওদের দেখে প্রতিবাদ করা শুরু করে। রেগে গিয়ে এই মহিলা’টাকে থা’প্প’ড় বসিয়ে দেয়। আমি তখন ওই রুমের বেলকনি’তে বসে বসে খেলছিলাম। চেঁচামেচি শুনে দরজা দিয়ে উঁকি দিতেই দেখি ওরা তিনজন কিছু নিয়ে চেঁচামেচি করছিলো। ওই টুকু আমি বুঝিনি এতসব কিছু। এই মহিলা’টাকে থা’প্প’ড় মা/রায় বাবা রেগে মায়ের চুলের মুঠি ধরে দেয়ালের সাথে জোরে বারি মা/রতেই মায়ের মাটা ফেটে রক্তাক্ত হয়ে যায়। মা চিৎকার করে নিচে পড়ে যেতে’ই এই মহিলা’টা গিয়ে মা’কে একাধারে হিল জুতো দিয়ে লা/থি মা/রা শুরু করে। মা যন্ত্রনায় ছটফট করতে থাকে।

দৃশ্য’টা সহ্য করতে না পেরে জোরে চেঁচিয়ে গিয়ে মাকে ঝাপটে ধরেছিলাম। কিন্তু ওরা আমার মায়ের থেকে আমাকে টেনে ছাড়িয়ে নিলো। বার বার কান্না করতে করতে বলছিলাম” বাবা মায়ের কষ্ট হচ্ছে। মা’কে মে/রো না। মা ম/রে যাবে। বাবা মা/কে খালামনি মা/রছে কেনো? তুমি একটু থামাও? “কিন্তু না এই নির্দয় মানুষ দুটো আমার কথা শুনলো না। বাবা আমার হাত ধরে টেনে রুম থেকে নিয়ে আসার সময় মা আহত অবস্থায় বাবার পা জড়িয়ে ধরেছিলো। বাবা মা’কে সেই অবস্থায় লা/থি মে/রে দূরে সরিয়ে দিলো। রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে অব্দি দেখলাম যে এই মহিলা মায়ের তল পেটে এমন ভাবে লা/থি মে/রেছে যে মা একটা চিৎকার করে শান্ত হয়ে গেলো। আর শব্দ পাইনি মায়ের। ছটফটানি থেমে গিয়েছিলো মায়ের। মস্তিষ্ক জানান দিচ্ছিলো “তোর মা আর বেঁচে নেই ফারদিন। চলে গেছে দূর আকাশের তারা হয়ে” বাবা আমার হাত ধরে টেনে পাশেফ রুমে এনে আমার হাত পা এমন’কি মুখ বেঁধে দরজা আটকে দিয়ে চলে গিয়েছিলো। সেদিন বদ্ধ ঘরে এক অসহায় মা আর তার ছেলের চিৎকার কেউ শুনে’নি। চলে গিয়েছিলো তখনি আমার মা আমাকে ছেড়ে বহু দূরে। আমার থেকে খুব জঘন্য ভাবে আমার মা’কে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। মায়ের শেষ চিৎকার আমি এখনো শুনতে পাই……

গোধূলি লগ্নের সেই তুমি পর্ব ১৮

বলেই ফারদিন হাটু ভেঙে ফাইজার সামনে বসে পড়লো। ওর চোখ দিয়ে অশ্রু ধারা বইছে। কথা গুলো বলতে বলতেই ফারদিন ফাইজার সামনে এসেছিলো। এইটুকু বলেই আর বলতে পারলো না। হাটু ভেঙে ফাইজার বুকে মাথা রেখে জোরে কান্না করে উঠলো। ছেলেরা এমন করে কাঁদতে পারে বুঝি?

গোধূলি লগ্নের সেই তুমি পর্ব ২০