গোধূলি লগ্নের সেই তুমি পর্ব ২০

গোধূলি লগ্নের সেই তুমি পর্ব ২০
লেখনীতে জেনিফা চৌধুরী

নিজের রক্তের বোন’কে কেউ এত’টা নির্মম ভাবে মা/রতে পারে ভাবতে পারছেনা ফাইজা। নিস্তব্দ হয়ে আছে। চোখ থেকে নোনা জল গড়িয়ে পড়ছে। উপস্থিত প্রত্যেকের চোখে পানি। ফারদিন আজ নিজের ভেতরের জমানো কষ্ট গুলো চোখের জলে বিসর্জন দিচ্ছে। ফারদিন’কে স্বান্তনা দেওয়ার মতো ভাষা বা শব্দ ওর জানা নেই। কি স্বান্তনা দিবে এই ছেলে’টাকে? যে ছেলে কিনা সাত বছর বয়সে নিজের মা’কে চোখের সামনে খু/ন হতে দেখেছে তাও নিজের বাবা আর আপন খালার হাতে। তাকে স্বান্তনা বা বুঝানোর মতো ভাষা আদৌ আছে কিনা ফাইজার জানতে ইচ্ছে করছে। তাহলে, অন্তত ছেলে’টাকে ওই ভাষায় স্বান্তনা বানী দিতে পারতো। ফারদিন ফাইজা’র বুকে মাথা রেখে শব্দ করেই ফুঁপিয়ে কাদঁছে। যে ছেলে’টাকে প্রথম দিন থেকে হাসি খুশি দেখেছে সেই ছেলে’টার ভেতর এতটা কষ্ট জমানো ছিলো কেউ বুঝতে পারে’নি। ফাইজার চোখ থেকে জল টপটপ করে পড়ছে। ফাইজা কাঁপা কাঁপা হাত’টা ফারদিনের পিঠে রাখতেই ফারদিন কান্না থামিয়ে দিলো। নিচের দিকে তাঁকিয়ে তড়িঘড়ি করে চোখের জল মুছে নিয়ে ফাইজার দিকে তাঁকিয়ে মুখে হাসির রেখা টেনে দাড়িয়ে পড়লো। চোখের জল টুকু লুকাতে একটু দূরে সরে গিয়ে পেছন ফিরে আবারো বলা শুরু করলো..

–সেদিন আমাকে আর আমার মৃত মা’কে ওইভাবে রেখে এই লোক’টা আর এই মহিলা দুজনেই বেড়িয়ে গিয়েছিলো। একটা সম্পূর্ণ রাত কাঁদতে কাঁদতে আর মুখ বাঁধা থাকায় আমি কখন সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলাম জানিনা। যখন চোখ খুলি তখন নিজেকে দীদার পাশে আবিস্কার করি। দীদা কাঁদতে ছিলো আর আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো। আমাকে চোখ খুলতে দেখেই দীদা আরো কান্নায় ভেঙে পড়ে। রাতের ঘটনা মনে পড়তেই আমি কান্না শুরু করে দিয়ে দীদা’কে সব বলতে থাকি। তখন জানতে পারি। সকালে কাজের আন্টি এসে মা’কে মৃ’ত অবস্থায় মেঝে’তে পায় আর আমাকে অন্য রুমে সেন্সলেস অবস্থায় পায়। আর সেই সবাই’কে ডেকে এনে দীদা’কে খবর দেয়। আরো জানতে পারি সেদিনের পর আমার টানা ত্রিশ ঘন্টা সেন্স ছিলোনা। মা’কে যে মা’র্ডার করা হয়েছে তা মা’য়ের লা’শ দেখেই বুঝে গিয়েছিলো সবাই। দীদা আমার বাবা আর খালার বিষয় কিছু জানতো না। এমন’কি এটাও জানতো না যে বাবা মা’কে কত’টা অত্যা’চার করতো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তাই পুলিশ’কে খবর দেওয়া হয়। কাজের আন্টি সেদিন সরল স্বীকারোক্তি দিয়েছিলো বলেই সবাই আমার বাবা আর খালা’র আসল চেহারা জানতে পেরেছে। পুলিশ ওদের দুজন’কেই এরেস্ট করেছিলো কিন্তু ওই যে আমাদের দেশে এখন ক্ষমতার অপব্যবহার করে বেশিরভাগ দোষী ছাড়া পেয়ে যায়। সেদিন ও ঠিক এই জঘন্য মানুষ দুটো টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করে দিয়েছিলো সবার। আমার দীদা একা লড়াই করে পেরে উঠে’নি ওদের সাথে। আর আমি সে তো সাত বছরের একটা বাচ্চা ছিলাম সে কিই বা করতে পারতো বলো তো? ওরা নিজেদের দোষ আড়াল করে দিয়ে দেশ ছেড়েই পালিয়ে গেলো। মা’য়েরা দুই বোন ছিলো। আমার মা’তী ছিলো মাটির মানুষ। যার হাসি’টা ছিলো মুগ্ধ করার মতো। জানো আমার মা চোখ ধাধানো সুন্দর ছিলো কিন্তু এই লোক’টা(রেজওয়ান) আমার মায়ের কদর করতে পারলো না। এই মহিলা(কাকন) ছোট থেকেই উৎশৃঙ্খল ছিলো তাই দীদা সমস্ত সম্পত্তি আমার নামে আর মায়ের নামে করে দিয়েছিলো। আর অল্প কিছু দীদার নামে ছিলো। তাই রাগে, হিংসায় প্রতিশোধ তুলতে সে আমার মা’কেই কেড়ে নিলো। অপর দিকে এই লোক’টার(রেজওয়ান) বিশাল বাড়ি, গাড়ি, সম্পত্তি ছিলো। আবার এই লোক’টার(রেজওয়ান) যে মেয়ের নেশায় পড়ে সব করতে পারে তা এই মহিলা(কাকন) খুব ভালো করে জানতো। তাইতো এই দিক’টাই কাজে লাগালো। দুজন বিয়ে করে নিলো৷ আর সমস্ত সম্পত্তি নিজের নামে করে নিলো।

তারপর কেটে যায় বিশ বছর। আস্তে আস্তে দীদার সাহায্যে সব ভুলে যেয়ে নতুন করে বাঁচতে শিখলাম। দীদার হাত ধরে বড় হয়ে উঠলাম। কিন্তু ওইযে, চোখের সামনে সব মেয়েদের নোংরা চেহারা দেখে মেয়েদের প্রতি ঘৃনা আমার মনে যে রয়ে গিয়েছিলো সেটা কিছু’তেই ভুলতে পারি। যত বড় হচ্ছিলাম তত মেয়ে শব্দ’টাকে ঘৃনা করতে শুরু করেছিলাম। আমি তো চোখের সামনে যাদের দেখেছি তারা সবাই নোংরা মেয়ে ছিলো। তাহলে আমি কি বিশ্বাস করব বলো তো যে সব মেয়েরা এক না? সেই থেকে বাবা আর মেয়ে এই দুটো শব্দ যেনো আমার কাছে বিষাক্ত হয়ে উঠলো। জানো স্কুল কলেজ এমন’কি ভার্সিটি লাইফে আমার কোনো মেয়ে বন্ধু ছিলোনা। মেয়েদের থেকে সব সময় দূরে থাকতাম। মেয়েদের দিকে কখনো ঘৃনার দৃষ্টি ছাড়া অন্য দৃষ্টি’তে তাঁকাই’নি। ভার্সিটি শেষ করে দীদার বিজন্যাসে জয়েন করলাম। আমি জয়েন হওয়ার পর একজন মেয়ে’কেও অফিসে রাখি’নি। সাত বছর থেকে যেই চাপা কষ্ট আর ঘৃনা একাকিত্ব নিয়ে আমি বড় হয়েছি তা যেনো কোনো মানুষ’কে ফেস করতে না হয়। সব কিছু ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করেছি মাত্র ভুলি’নি। মনের কোনে ঘৃনা প্রতিশোধের আগুন দাউদাউ করে জ্বলেছে প্রতি মুহূর্ত। ওদের অনেক খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছি কিন্তু পাই’নি৷ পৃথিবী’টা তো আর ছোট না যে আমি চাইলেই সবাই’কে পেয়ে গেলাম। কিন্তু কিছুদিন আগে যখন ওরা দেশে ফিরলো তখন বুঝেছিলাম এ দেশে ফেরার একটাই কারন ওরা জানতে পেরেছে যে আমার দূর্বল’তা তুমি। আমার থেকে হয় তোমাকে কেড়ে নিবে নয় আমাকে মে/রে ফেলবে। দেখো তাই হলো প্রথমে আমাকে এক্সিডেন্ট করালো আমি ম’রে গিয়েও বেঁচে ফিরলাম তাই তোমাকে সরানোর কাজে নেমেছিলো। কিন্তু ওরা বোধহয় ভুলে গেছে সেদিনের সাত বছরের ছেলে’টা এখন আটাশ বছরে পা রাখবে কিছুদিন পর…..

বলেই হেসে দিলো ফারদিন। ফাইজা নির্বাক চাহনী’তে তাঁকিয়ে আছে। রেজওয়ান আর কাকনের চোখে ভয় দেখতে পারছে শুধু। কি আশ্চর্য এত কিছুর পর ও এই লোক দুটোর মনে একটু অনুতাপ হচ্ছে না। ঘৃনা হচ্ছে লোক দুটোর উপর। এতটা নিকৃষ্ট পিতা আর খালা যেনো কারোর না হয়। নিজের সন্তান’কে কেউ মে/রে ফেলতে চায়। ভাবতে পারলো না ফাইজা। ছুটে গিয়ে ফারদিন’কে ঝাপটে ধরে কেঁদে দিলো হাউমাউ করে। ফারদিন ও ফাইজা’কে বুকের সাথে চে’পে ধরে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছে। ফাইজার কান্না থামাতে ফাইজা’কে নিজের থেকে ছাড়িয়ে ওর দুই গালে হাত রেখে চোখের পানি টুকু মুছিয়ে দিতে দিতে একটু জোরালো কন্ঠে বললো……
–কতদিন বলেছি কাঁদবে না। তাও কাঁদতে হবে তোমার অনেক দিন বুঝি থা’প্প’ড় পড়েনা। থা’প্প’ড় খে’তে ইচ্ছে করছে জান।
এইটুকু বলে ফাইজার কানের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো…..
–নাকি চু’মু খেতে ইচ্ছে করছে জানননন……

এই পরিস্থিতিতে কেউ এমন কথা বলতে পারে তা ভাবতেই ফাইজা এক প্রকার ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছে। ছেলে’টা যে নিজের কষ্ট লুকাতে মজা করছে তা বেশ বোঝা যাচ্ছে ওর চোখ দুটো দেখে৷ ফাইজা কোনো শব্দ না করে ফারদিনের দুই গালে আলতো করে হাত রাখলো। ফাইজার স্পর্শ পেতেই ফারদিন মুখে হাসির রেখা টানার চেষ্টা করলো। ফাইজা ফারদিনের গালে হাত দিয়ে ওর চোখে চোখ রাখলো। ফারদিনের চোখের কোন’টা যে রক্তের মতো লাল হয়ে আছে তা স্পষ্ট দেখতে পেলো। চোখে পানি ও টলমল করছে কিন্তু মুখে হাসি। কোন ধাতু দিয়ে গড়া এই ছেলে’টা। এত কষ্ট এত বছর ধরে কি করে সহ্য করলো? ফাইজার টলমল চোখের চাহনী’তে ফারদিনের মুখের হাসি’টা মিলিয়ে যেতে লাগলো। বুকের ভেতরের হাহা’কারের শব্দ গুলো ভেসে আসচ্ছে। ফাইজা করুন স্বরে ফারদিনের চোখে চোখ রেখেই প্রশ্ন করে উঠলো…..

গোধূলি লগ্নের সেই তুমি পর্ব ১৯

–এত বছর ধরে এই ভয়ংকর কষ্ট গুলো কি করে সহ্য করেছেন?
বলতে বলতেই ওদের দুজনের চোখ বেয়ে পানির ফোটা গড়িয়ে পড়লো। ফারদিন নিজেকে সামলে নিজের গালে থাকা ফাইজার হাতের উপর নিজের হাত রেখে বললো….
–তিন বছর আগে এক গোধূলি লগ্নে তুমি এসে আমার সব কষ্ট ভুলিয়ে দিয়েছিলে। মা’কে হারিয়ে অতীত ভুলে বেঁচে থাকতে শিখেছিলাম। কিন্তু তুমি হারিয়ে গেলে বেঁচে থাকা’টা সম্ভব হয়ে উঠবে না……

গোধূলি লগ্নের সেই তুমি পর্ব ২১