গোধূলি লগ্নের সেই তুমি পর্ব ২৬

গোধূলি লগ্নের সেই তুমি পর্ব ২৬
লেখনীতে জেনিফা চৌধুরী

গাড়ির কাচ গুলো ভেঙে’ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে চারদিক। ফারদিন ফাইজা’কে নিজের থেকে ছাড়িয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো। ফাইজা’ চেষ্টা করে ও ফারদিন’কে আটকা’তে পারলো না। ফারদিন ওদের সামনে এগিয়ে যেতে’ই একটা লোক ওর হাতে ছু’ড়ি দিয়ে সামান্য আঁচড় দিয়ে উঠলো। তা দেখে ফাইজা ভেতর থেকে আতৎনাদ করে উঠলো। আঁচড়ের জায়গা থেকে সামান্য রক্ত বের হতে লাগলো। ফারদিন এক হাতে ক্ষত স্থান চেপে ধরে প্রশ্ন করে উঠলো….

–কি চাই?
ফারদিনের প্রশ্ন শুনে লোক’গুলো বলে উঠলো……
–একদম চালাকি করতে আসবিনা। বেশি ঝামেলা আমার পছন্দ নয়। তাই ঝামেলা না করে চুপচাপ সাথে যা আছে দিয়ে দে…….
এত ক্ষনে ফারদিন বুঝতে পারলো। এইগুলো আসলে ডাকা’ত। কি আশ্চর্য এরা দিনে দুপুরে ডাকা’তি করতে নেমে গেছে। এই রাস্তা’টার দুই দিকে সাড়ি সাড়ি গাছ। আর দুই পাশে বিশাল বিশাল মাঠ। পাঁকা ধানে সম্পূর্ণ মাঠ হলুদ হয়ে আছে। দিনের বেলায় ও এদিকে খুব একটা গাড়ি চলাফেরা করেনা। ওরা যেহেতু লং ড্রাইভে বেড়িয়েছে তাই ফারদিন এই রাস্তা বেছে নিয়েছে। এই রাস্তা’টা দিয়ে কিছু দূর যেতেই সব’টা গ্রামাঞ্চল।
কিন্তু এমন একটা বিপদে পড়বে বুঝতে পারে’নি। ফারদিন কোনো শব্দ না করে ওর সাথে যা টাকা পয়সা ছিলো তা সহ ওর ফোন’টাও দিয়ে দিলো। লোক গুলো ও কোনো শব্দ না করে চলে গেলো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

লোক গুলো চলে যেতে’ই ওরা দুজন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। ফারদিন একবার হতাশ চোখে নিজের প গাড়ি’টার দিকে তাঁকালো। মনে মনে ভাবছে” কি দরকার ছিলো গাড়ি’র কাচ’টা ভাঙা’র? আমাকে সুস্থ মাথায় বললেই দিয়ে দিতাম সব” ভাবতে ভাবতে গাড়ি’র জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে ফাইজা’কে নামার জন্য বলতে’ই ফাইজা গাড়ি থেকে নেমে ফারদিনের হাত’টা খামচে ধরলো। ওর মনে এখনো ভয় জমে আছে। ফারদিন ওর ভয়ার্ত মুখ’টা দেখে শান্ত কন্ঠে বললো…..
–ভয় পেও না। ওরা চলে গেছে।
ফাইজা চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো।ফারদিনের হাতের দিকে নজর দিতেই দেখলো রক্ত বের হচ্ছে। ফাইজা মুহূর্তেই অস্থির হয়ে পড়লো। অস্থির কন্ঠে বললো….
–আপনার হাত দিয়ে কত রক্ত বের হচ্ছে? কি করবেন এখন? খুব কষ্ট হচ্ছে তাইনা। কি করব এখন? কি করে রক্ত পড়া বন্ধ করব? আপনি কেনো নামতে গেলেন?
ফাইজা’কে অস্থির হতে দেখে ফারদিন ও’কে থামিয়ে গাড়ি খুলে টিস্যু বক্স এনে ফাইজার হাতে দিতেই ফাইজা টিস্যু নিয়ে রক্ত পরিস্কার করতে লাগলো। ওর চোখ দুটো অস্থির হয়ে আছে। ফারদিনের মনে হচ্ছে আঁচড়’টা ওর নিজের না ফাইজার লাগছে। কিছুক্ষন পর রক্ত পড়া বন্ধ হতে ফাইজা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। ভাঙা গাড়ি’টার দিকে একবার অসহায় চোখে তাঁকিয়ে ফারদিন’কে বলে উঠলো…..

–ইস গাড়ি’টার কি অবস্থা হয়েছে? এখন কি হবে? আমরা কি করে ফিরবো? এদিকে তো কাউকেই দেখছি না। জায়গা’টা খুব নিরিবিলি। ভয় করছে আবার যদি কোনো বিপদ হয়…….
ফাইজার চিন্তিত স্বর শুনে ফারদিন পকেট থেকে ফোন বের করে কাউকে ফোন দিলো। ওপাশ থেকে ফোন’টা রিসিভ করতে’ই ফারদিন ও’কে সব’টা বলে ফোন রেখে দিয়ে ফাইজার দিকে তাঁকিয়ে বললো….
–রাফি আসচ্ছে…..
ফাইজা মুখে একটু হাসির রেখা টানলো। ফারদিন চারদিকে তাঁকিয়ে বলে উঠলো…..
–জায়গা’টা কিন্তু খুব সুন্দর। চলো রাফি আসতে আসতে আমরা একটু ঘুরে আসি…..

ফাইজা ও ফারদিনের হাত’টা ধরে সামনে পা বাড়ালো। দমকা হাওয়ায় খোলা চুল গুলো উড়ছে আপন মনে। প্রকৃতি সুন্দর। এমন মনোরম পরিবেশে একবার আসলে বার বার ছুটে আসতে মন চাইবে প্রকৃতির টানে। দুই পাশে সাড়ি সাড়ি গাছ। আর তার পাশে ধান ক্ষেত। পরিবেশ’টা চোখ জুড়িয়ে যাওয়ার মতো। আকাশে কালো মেঘের দাপটে সূর্যের আলো ক্ষীনপ্রভ। কালো মেঘের আধারের ফাঁকে ফাঁকে সূর্য’টা মাঝে মাঝেই উঁকি দিচ্ছে। পরিবেশের বর্ননা দেওয়ার মতো শব্দ খুঁজে পাচ্ছে না ও? এত সুন্দর একটা পরিবেশ গাড়ি’তে করে গেলে মিস করে যেতো। মনে মনে ডাকাত’গুলো’কে একটা ধন্যবাদ দিয়ে উঠলো ফাইজা। আকাশের দিকে তাঁকিয়ে মনে মনে খুব করে চাইছে। এক্ষুনি এই কালো মেঘের বুক চিড়ে বৃষ্টি রাশি নামুক। জলধারায় সব’টা স্রোতময় হয়ে যাক।

এসব ভাবতে ভাবতে’ই ফাইজা আনমনে ফারদিনের থেকে হাত’টা ছাড়িয়ে নিলে হিজাব’টা ওড়নার মতো নিয়ে দুই হাত মেলে সামনে দৌড়ে গিয়ে রাস্তার মাঝে ঘুরতে লাগলো। বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে ফাইজা ঘুরছে। খোলা চুল গুলো উড়ে মুখ পড়ছে। চোখ বুঝে ঘুরছে। মুখে লেগে আছে মিষ্টি হাসি। এত’টা স্নিগ্ধ লাগছে মেয়ে’টাকে? মায়া ভরা মুখ’টায় হাসি’টা বেশ মানিয়েছে। ফারদিন সামনে এগুলো না। একটা গাছের সাথে হেলান দিয়ে পকেটে হাত গুঁজে মুগ্ধ নয়নে তাঁকিয়ে রইলো ফাইজার দিকে। ফাইজা কিছুক্ষন ঘুরে দুই হাতে মেলেই দাড়িয়ে আকাশের দিকে চেয়ে আপনমনে। আর এই মুহূর্ত’টাকে আরো সৌন্দর্যে ভরপুর করে তুলতে সবুজের সমারোহে সমৃদ্ধ করতে নেমে এলো শ্রাবন ধারা। এটা শ্রাবন মাস চলছে। তাই তো প্রতিদিন একবার না একবার বৃষ্টির দেখা মিলছে শহর জুড়ে। বৃষ্টির জল ফাইজার মুখমন্ডলে পড়তেই খুশিয়ে লাফিয়ে উঠলো ফাইজা।

পড়নের সাদা পায়জামা’টা খানিক’টা উপরে তুলে বৃষ্টির জলে পা ভিজাতে লাগলো। ঝুমঝুম করে বৃষ্টির শব্দে চারদিক’টা ভরে উঠছে। ছোট ছোট ঘাসের উপর বিন্দু বিন্দু পানির ফোটা দেখে মনে হচ্ছে মুক্ত বিছিয়ে রাখা হয়েছে। চঞ্চল মনে আনমনে নেচে বেড়াচ্ছে ফাইজা। আর ফারদিন ঘোর লাগা চাহনী নিক্ষেপ করে আছে ওর দিকে। এত সুন্দর মনোমুগ্ধকর দৃশ্য এর আগে কখনো দেখা হয়নি ওর। শ্যামবর্নের গোল স্নিগ্ধ মুখ’টা বৃষ্টির জলে সিক্ত হয়ে উঠেছে৷ হাওয়ার তোড়ে ভেজা ভেজা চুল গুলো এসে গালে লেপ্টে রয়েছে। দীর্ঘ কালো রেশমি চুলগুলো দিয়ে টুপটাপ পানি পড়ছে। শ্রাবন ধারার সিক্ত হাওয়ার আর সিক্ত জলে ভেজা সাধারন মুখ’টা দেখতে অসাধারণ লাগছে এই মুহূতে। এত বছর জীবনে এই প্রথম এই অসাধারণ সৌন্দর্যে ঘেরা শ্রাবন ধারা’র পরিবেশ অতুলনীয় সুন্দর করে তুলেছে সামনে থাকা মানুষ’টা। ফারদিনের চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে। আনমনে সামনের চঞ্চল মেয়ে’টার দিকে তাঁকিয়ে বলে উঠলো””

–“আমার শ্রাবনধারিনী” আমার জলধারার রানী” আমার মনোহরিনী” আমার শ্রাবন রানী…….
এই মুহুর্তে ফাইজার সাথে এই নাম গুলোই মিলে রয়েছে। অনেক ক্ষন যাবৎ ঝুম বৃষ্টি’তে ভিজচ্ছে ওরা দুজন। একজন প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে ব্যস্ত আরেক জন শ্রাবন রানী’কে দেখতে ব্যস্ত। অনেকক্ষন ভেজার ফলে ফাইজা জোরে হাচি দিয়ে উঠতে’ই ফারদিনের ধ্যান ফিরে আসে। হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে গেলো ফাইজার দিকে। বৃষ্টি থামার নাম গন্ধ ও নেই। ফাইজা’কে হাচি দিতে দেখেই ফারদিন ব্যস্ত কন্ঠে বললো…..
–আর বৃষ্টিতে ভেজার দরকার নেই। চলো আমরা গাড়ি’তে বসে অপেক্ষা করি।
বলেই ফাইজা’র হাত ধরে পা বাড়ালো। ফাইজা হাচি দিতে দিতে বলে উঠলো….
–আমি যাব না। এত সুন্দর একটা মুহূর্ত এই ভাবে নষ্ট করে দিচ্ছেন? আমি আরো কিছুক্ষন ভিজব প্লিজ। আমাকে ছাড়ুন না…

কে শুনে কার কথা? গাড়ির সামনে এনে ফাইজা’কে জোর করে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে নিজেও উঠে পড়লো গাড়ি’তে। সাদা ড্রেস’টা ভিজে একদম শরীরের সাথে লেপ্টে রয়েছে। তা দেখে ফারদিনের একটু অস্বস্তি বোধ হলো। হুট করে গাড়ির পেছনের কিছু খোঁজা শুরু করলো। ফাইজা’র যেনো হাচি কিছু’তেই থামছে না। আবার বাতাসে শরীরে ঝাঁকুনি সৃষ্টি হচ্ছে। ঠান্ডার প্রভাবে ঠোঁট জোড়া কাঁপছে খানিক’টা। আগের বারের মতো একটা শার্ট বের করে ফাইজা’কে পড়ে নিতে বললো। নিজেও একটা টি-শার্ট বের করে পড়ে নিলো। ফাইজার শরীর ভিজে একাকার অবস্থা। ঠান্ডা শরীর জমে যাবে মনে হচ্ছে। গাড়ির সামনের কাচ’টা ভাঙা তাই বৃষ্টি এসে বার বার ছুঁয়ে দিচ্ছে ওদের? ফাইজা শীতে কেঁপে উঠছে তাই ফারদিন ফাইজা’কে জড়িয়ে নিলো নিজের সাথে। কিছুক্ষন এভাবেই কেটে যায়। ফাইজা বার বার নাক টেনে যাচ্ছে। ফারদিনের ও মাথা ভার হয়ে আসচ্ছে। আজ দুই’টার অবস্থা খারাপ হবে তা বেশ বোঝা যাচ্ছে। প্রায় ঘন্টা খানিকের মাথায় আরেক’টা নীল রঙের কার এসে থামলো ওদের পাশে। জানালা খুলে রাফি ওদের ইশারা করতে’ই ফারদিন আর ফাইজা দুজনে’ই ওর গাড়ি’তে গিয়ে উঠে পড়লো। রাফি কে ফারদিন ওর গাড়ি নিয়ে ঠিক করে দেওয়ার জন্য পাঠালো।

রাতে একটা ভারী কম্বল গায়ে জড়ানো তাও জ্বরে কাপছে ফাইজা। আসার পর থেকে হাড় কাপুঁনি দিয়ে জ্বর উঠেছে। আর হাচি ঠান্ডায়। ওর পাশেই চিন্তিত মুখে বসে বসে জলপট্টি দিচ্ছে নাদিয়া বেগম। কিছু’তেই জ্বর নামছে না। জ্বরের চোটে চোখ মুখ লাল হয়ে উঠেছে।

ফারদিনের ছোট থেকেই ঠান্ডার অতিরিক্ত সমস্যা। ঠান্ডায় এলার্জি রয়েছে ওর। একটু বৃষ্টির পানি গায়ে লাগলে ওর ঠান্ডায় শ্বাসকষ্ট উঠে যায়। আজকেও তার ব্যাতিক্রম নয়। গায়ে যেমন জ্বর আর কিছুক্ষন পর পর শ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছে খুব। সায়মা খানম চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছে। একা একা কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা। ফারদিনের অবস্থা ও ভালো হচ্ছেনা। নাকের মাথা’ টকটকে লাল হয়ে আছে। মুখ’টা একদম লাল হয়ে আছে। মনে হচ্ছে রক্ত জমেছে।

গোধূলি লগ্নের সেই তুমি পর্ব ২৫

রাতে একটা গুদাম ঘরের মেঝেতে চার-পাঁচটা ছেলে র’ক্তা’ক্ত হয়ে পড়ে আছে। ওদের সামনেই হিংস্র চেহারায় বসে আছে তিথী। মুখে লেগে আছে বাঁকা হাসি। তিথী’র পাশে দুইজন ২৬/২৭ বয়সী ছেলে দাড়িয়ে। তিথী’ওদের দিকে ইশারা করতেই ওরা পড়ে থাকা ছেলেগুলো’কে টেনে রুম থেকে বের করতে লাগলো। তা দেখে তিথী একটু মুচকি হেসে বলতে লাগলো…..
–আমার ফারদিনের গায়ের রক্ত বের করেছিস। তোদের তো বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই……

গোধূলি লগ্নের সেই তুমি পর্ব ২৭