গোধূলি লগ্নের সেই তুমি পর্ব ৩৭

গোধূলি লগ্নের সেই তুমি পর্ব ৩৭
লেখনীতে জেনিফা চৌধুরী 

সময় সময়ের তালে বয়ে চলেছে। সব বিষন্নতা কষ্ট ভুলে শুরু হতে চলেছে নতুন অধ্যায়। আজ ফাইজা আর ফারদিনে’র মেহেন্দী। দুজনের মেহেন্দীর অনুষ্ঠান ফারদিনের বাড়ি’তে’ই আয়োজন করা হয়েছে। গায়ে হলুদ মেহেন্দী দুই’টাই ফারদিনের বাড়ি’তে হবে। আর বিয়ে’টা দুজনের বাড়িতে। ফারদিন আজ সাদা আর কালো কম্বিনেশনে পাঞ্জাবী পড়েছে। চুল গুলো শ্যাম্পু করায় আরো বেশি সিল্কি হয়ে গেছে। হাতে একটা কালো ঘড়ি। মুখে রয়েছে সেই ভুবন ভুলানো হাসি।

যা দেখে কোনো মেয়ে ক্রাশ খেলেও খেতে পারে। জেহের ও ফারদিন’কে আজ মনে হচ্ছে জমজ ভাই। দুজনেই সেম ড্রেস,ঘড়ি,জুতা। ওরা দুজন সব ঠিক ঠাক সাজানো হয়েছে কিনা তা তদারকি করছে। উপরের রুমে সাজানো হচ্ছে ফাইজা’কে। ফাইজা সিল্কের একটা সাদা শাড়ি পড়েছে। সাথে তাজা লাল গোলাপ ফুলের গহনা। মুখে হালকা সাজ। দেখতে বেশ মিষ্টি লাগছে। কাকতালীয় ভাবে আজ আরজা’কেও ফাইজা’র মতো সাজানো হয়েছে। সেদিনের পর আরজা আর জেহের সামনে আসে’নি। জেহের কয়েকবার গিয়েছিলো ওদের বাড়ি।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কিন্তু, আরজা জেহেরের সামনে আসে’নি। আজ যত’ই হোক বেস্ট ফ্রেন্ড এর মেহেন্দী না এসে কি থাকা যায়। আরজা প্রথমে আসতে রাজি হয়’নি৷ কারন, জেহের’কে দেখে নিজেকে সামলাতে পারবে না। কিন্তু, ফাইজা তো আর শুনবার পাত্রী নয়। পার্লার থেকে লোক এসে ওদের সাজিয়ে দিয়েছে। আরজা প্রথমে বুঝতে পারে’নি। সাজানোর আগে অনেক বার বারন করেছে। কিন্তু কেউ শুনে’নি। তাই সাজানো শেষ হতে’ই ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে নিজের সাজ দেখে মুখ হা করে অবাক স্বরে বলে উঠলো…..

—আজ কার মেহেন্দী। আমার নাকি তোর তাই তো বোঝা যাচ্ছে না। সবাই তো ভাববে আমাদের দুজনের এই বিয়ে?
আরজার কথা শুনে ফাইজা মুখ টিপে হেসে জবাব দিলো…..
— হ্যা, দুজনের এই তো বিয়ে…..
এইটুকু বলেই মুখে হাত দিয়ে থেমে গিয়ে মনে মনে বলে উঠলো….
–এই রে এক্ষুনি সত্যি ফাঁস হয়ে যাচ্ছিলো৷ ভাইয়া আমাকে গনোধোলাই দিবে। ফাইজা, কন্ট্রোল কন্ট্রোল……
ফাইজা পূর্নরায় কিছু বলতে যাবে তার আগেই আরজা সন্দিহান দৃষ্টি’তে ফাইজার দিকে তাঁকিয়ে বলে উঠলো…..
–থেমে গেলি কেনো? দুজনের বিয়ে মানে?
এইবার ফাইজা থতমত খেয়ে আমতা আমতা করে বললো…..
–ইয়ে হ্যাঁ। মানে না। ধুর হ্যাঁ, দুজনের এই তো বিয়ে আমার আর উনার।
বলেই লাজুক হাসলো ফাইজা। এই প্রথম ফাইজা ফারদিন’কে উনি বলে সম্মোধন করলো। এতে আরজা চোখ বড় বড় তাঁকিয়ে থেকে বললো…..
–আরে বাহহ। উনি আহা কি মধুর প্রেম। দোয়া করি তোরা সারাজীবন এমন করে’ই সুখে থাক।

বলতে’ই আরজার গলা আটকে এলো। চোখে জল এসে ভীড় করলো। বুকের ভেতর’টা চে’পে আসলো। অসহ্য যন্ত্রনা অনুভব হতে লাগলো। আজ যদি জেহের ও আমাকে ভালোবাসতো তাহলে আমাদের বিয়ে’টাও এত’টাই সুখের হতো। এইটুকু ভেবে’ই আরজা চোখের জল লুঁকাতে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো। আর ফাইজা ওর দিকে অসহায় চোখে তাঁকিয়ে থেকে বলে উঠলো…..
–আমি জানি তুই অনেক কষ্ট পাচ্ছিস। ভাইয়া’টা কেনো তোকে এত’টা কষ্ট দিচ্ছে কে জানে? তবে বিয়ের দিন যেই সারপ্রাইজ’টা পাবি সেদিন তোর সব দুঃখ ঘুঁচে যাবে…….
বলে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো।

আরজা সিড়ি সামনে এসে নিচে তাঁকিয়ে থেমে গেলো। জেহের’কে আজ কি সুন্দর লাগছে। মুখের হাসি’টা মন কেড়ে নেওয়ার মতো। আরজা ওর দিকে তাঁকিয়ে আনমনে বলে উঠলো…..
–কি হতো আমাকে একবার ভালোবাসলে জেহের ভাইয়া? আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আপনাকে ছেড়ে আমি অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারব না।
বলতে না বলতে ওর চোখ বেয়ে শ্রাবন ধারা নামতে শুরু করলো। কাঁধে কারোর হাতের স্পর্শ পেয়ে আরজা তাড়াতাড়ি চোখের জল মুছে মুখে হাসির রেখা টেনে পেছনে তাকালো। ফাইজা’কে দেখে মুখের হাসি’টা চওড়া করে কিছু বলতে যাবে তার আগেই কোথা থেকে তনুজা এসে তাড়া দিয়ে বলে উঠলো….
–তোরা এখনো এখানে দাড়িয়ে কেনো? ওইদিকে সবাই বসে আছে তোদের জন্য। তাড়াতাড়ি চল….
বলেই ওদের দুজন’কে নিয়ে নিচে নামতে লাগলো। আরজা’কে না চাইতেও মুখে হাসি ধরে রাখতে হচ্ছে।

ফারদিন আর জেহের পাশাপাশি বসে আছে। স্টেজের সোফায়৷ চারদিকে নানা রকম ফুল বাতি দিয়ে সাজানো। সিড়ি দিয়ে ফাইজা আর আরজা দুজন’কেই নামতে দেখে ওরা দুজনে’ই হাবলার মতো চেয়ে রইলো। ফাইজা নিচে নেমে এসে ফারদিনের দিকে তাঁকাতেই ফারদিন হাত দিয়ে ওয়াও দেখালো। ফাইজা লজ্জা মাখা হাসি দিয়ে উঠলো। ফারদিনের বরাবর অন্য একটা স্টেজে সোফা বিছানো। সেখানে আরজা আর ফাইজা’কে পাশাপাশি বসানো হলো। ওরা সবাই বসতে’ই জেহের মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বলতে শুরু করলো…….
–আজ সবাই’কে আরেক’টা খুশির খবর দিতে চাই। আমরা ভাই বোন মিলে একটা ডিসিশন নিয়েছি যে, আমরা দুজনে এক সাথে দুজনের ভালোবাসার মানুষ’টাকে বিয়ে করব। আশা করি সবাই বুঝতে পেরেছেন আমার কথা। মানে আজ আমার ও মেহেন্দীর অনুষ্ঠান হবে……

জেহের কথা শেষ হতেই চারদিকে কড়ো-তালির শব্দে মুখরিত হতে লাগলো। আরজা যেনো আকাশ থেকে পড়লো। মুহূর্তে’ই চারদিক ঘূর্নিপাকের মতো ঘুরতে লাগলো। গলায় এসে নিঃশ্বাস আটকে রইলো। চারপাশের কোনো শোরগোল ওর কান অব্দি পৌঁছালো না। কিছু সময়ের জন্য ও নিথর পাথরে পরিনত হলো। আরজা’কে নিস্তব্ধ দেখে জেহের ফাইজা’র দিকে অসহায় চাহনী দিতে’ই ফাইজা চোখের ইশারায় কিছু বুঝালো। তারপর আরজা’কে ধাক্কা দিয়ে খুশি মনে বলে উঠলো……
—কিরে তুই চুপ করে গেলি কেনো? আমার যে কি খুশি লাগছে। তোর খুশি লাগছে না।

ফাইজা’র কথায় আরজা নিজের ধ্যানে ফিরে এসে হকচকিয়ে বলে উঠলো….
–হ্যাঁ, খুশির খবর তো। আমার ও খুব খুশি লাগছে। দুটো বিয়ে খাবো……..
চেষ্টা করেও মুখে হাসি ফুটাতে পারলো না আরজা। ভেতরে যেই ঝড় বইছে তা কি করে বুঝাবে ও সবাই’কে। এই যন্ত্রনা বুঝার মতো কেউ নেই ওর। নিজের চোখের সামনে নিজের ভালোবাসার মানুষ’টাকে অন্যের সাথে বিয়ের পিরিতে বসতে দেখতে হবে। এই মৃ/ত্যু যন্ত্রনা ও কি করে সহ্য করবে? সব যন্ত্রনা ভেতরে চে’পে রেখে মুখে হাসি ফুটিয়ে শুরু করলো মেহেন্দী অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠান শুরু হলো ফারদিন আর ফাইজা’র কাপল ডান্স দিয়ে।

“Tumko paya hai to ”
jaise khoya hoon
kehna chahoon bhi
to tumse kya kahoon”

গান’টায় বেশ রোমান্টিক একটা ডান্স হলো ফারদিন ফাইজা’র। নাচ শেষ হতে’ই আরজা নিজেই ফাইজার হাতে খুব সুন্দর করে মেহেদী লাগিয়ে দিতে লাগলো। হাতের মাঝে ফারদিনের নামের অক্ষর’টা বসিয়ে দিলো। ফাইজা’র মেহেদী দেওয়া শেষ হতে’ই আরজা ফারদিনের হাতে মেহেদী লাগিয়ে দিলো। আর ওদের কিছু কাজিন আত্মীয় স্বজন মিলে গান বাজনা নাচে ব্যস্ত। সবাই মিলে তা উপভোগ করছে। ফারদিনের হাতে মেহেদী লাগানো শেষ হতে’ই আরজা স্টেজ থেকে নামার জন্য পা বাড়াতে’ই জেহের বলে উঠলো…..

–আজ তো আমার মেহেন্দী। তাহলে আমাকেও মেহেদী লাগিয়ে দাও তো বাচ্চা।
জেহের কথা শুনে আরজা ভেতর থেকে ভেঙে গেলেও মুখে চওড়া একটা হাসি ফুটিয়ে বলে উঠলো……
—হ্যাঁ দিচ্ছি জেহের ভাইয়া।
বলেই বুকের ভেতরে চা’পা যন্ত্রনা জেহেরের জাতে মেহেদী লাগিয়ে দিতে লাগলো। শেষ পর্যায়ে জেহের হাতে পিয়াঙ্কা নামের অক্ষর লিখতে গেলে জেহের বাধা দিয়ে বলে উঠলো…..
–আরে আরে কি করছো? “পি” লিখছো কেনো?
জেহের এই প্রশ্নে আরজা অবাক হয়ে জবাব দিলো

–আপনার ভালোবাসার মানুষ’টার নাম তো পিয়াঙ্কা তাই “পি” লিখছি…
এইবার জেহের একটু বিরক্ত নিয়ে উওর দিলো…..
–তোমাকে কে বলেছে এক লাইন বেশি বুঝতে। ওর ডাক নাম পিয়াঙ্কা কিন্তু আসল নাম “এ” দিয়ে তাই “এ” লিখো……
এইবার আরজার বুক’টা খানিক’টা কেঁপে উঠলো। নিজের নামের অক্ষর’টা জেহের হাতে লিখতে ওর বুক কাঁপছে। কি আশ্চর্য নামের অক্ষর এক কিন্তু মানুষ দুটো ভিন্ন। এইটুকু ভেবে একিটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে জেহেরের হাতে সুন্দর করে “Aj” লিখে দিলো। মেহেদী দেওয়া শেষ হতে’ই আরজা নিচে নেমে সবার সাথে নাচে যোগ দিলো। চারদিকে সাউন্ডবক্সে গান বাজচ্ছে।
“mehendi hai Rachne waali”
haathon mein gehri lali”
গান’টা বাজছে। আর আরজা তালে তালে সবার সাথে নেচে যাচ্ছে। জেহের মুগ্ধ নয়নে ওর দিকে তাঁকিয়ে আছে।

সবার চোখের আড়ালে ফারদিন এসে ফাইজা’র হাত ধরে লুঁকিয়ে উপরে নিজের রুমে নিয়ে আসলো। এক হাত দিয়ে দরজা’টা বন্ধ করে ফাইজা’কে দরজার সাথে চে’পে ধরে মুগ্ধ নয়নে ওর দিকে তাঁকিয়ে রইলো। আর ফাইজা হা করে বলে উঠলো…..
–দিদা যদি দেখেছে আমরা একসাথে আপনাকে…..
আর বলতে পারলো না তার আগেই ফারদিন ফাইজা’র ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো। ডিপলি একটা চুমু খেয়ে নেশাময় কন্ঠে বলে উঠলো…..
–অর্ধেক পাগল তো আগে’ই করে দিয়েছিলে। এখন কি পুরো পা’গল করার ধান্দায় নেমেছো জান…..
বলে ফাইজা’র গলায় মুখ ডুবালো। ফাইজা মুহূতে’ই আবেশে চোখ বন্ধ করে নিলো। দুই হাত মেহেদী ভর্তি। তাই চাইলেও ফারদিন’কে সরাতে পারছে না।আর ফারদিন সে তার প্রেয়সীর শরীরের ঘ্রানে ব্যস্ত………

হলুদ লেহেঙ্গার সাথে লাল আর হলুদ কম্বিনেশনে গহনা পড়েছে ফাইজা। খোলা চুলে সৌন্দর্য দ্বিগুন বাড়িয়ে দিয়েছে। ফারদিনের আবদারে চুল খোলা রাখতে হয়েছে। আরজা আজো ফাইজার মতো সেম কালার লেহেঙ্গা আর গহনা পড়েছে। কিন্তু ওর চুল গুলো স্টাইল করে বেনুনী করে বাধা আর বিভিন্ন রঙিন ক্লিপ লাগানো চুলে। আরজা’কেও দেখতে খুব মিষ্টি লাগছে। কাল অনুষ্ঠান শেষে ফাইজা জোর করে আরজা’র হাতে মেহেদী পড়িয়ে দিয়েছিলো। হাতের মাঝে [AJ] খুব সুন্দর করে লিখে দিয়েছে। এতে অবশ্য আরজা’র খটকা লাগে’নি কারন আরজা যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে তার নাম ও J দিয়ে। আরজা’র মুখে আজ চওড়া হাসি। মনে হচ্ছে সব কিছু ঠিক ঠাক আছে আজ। খুব সহজে’ই মেনে নিয়েছে সব আরজা। কেনো যেনো এই ব্যাপার’টায় জেহেরের খটকা লাগছে। জেহের, ফারদিন আজ বাসন্তী আর লাল কম্বিনেশনে পাঞ্জাবী পড়েছে। হাতে আজ সিলভার কালার ঘড়ি। ফারদিন সব কিছুর তদারকি করছে আর জেহের মন ম’রা হয়ে এক কোনে চেয়ারে বসে বসে ভাবছে…..

–একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে। আমার ড্রামাকুইন’টা খুব কষ্ট পাচ্ছে। মুখের হাসি বিলিন হয়ে গেছে। চঞ্চল মেয়ে’টা শান্ত হয়ে গেছে। বিশ্বাস করো, আমার ও তোমাকে এই অবস্থায় দেখতে কষ্ট হচ্ছে খুব। কিন্তু, জানো তো, কষ্টের পর স্বস্তি আছে। আর এটা তোমার শাস্তি। কি শাস্তি জানো, আমাকে ভালোবেসেও অন্য একজনের সাথে টাইম পাস করার শাস্তি…….
কাঁধে হাতের স্পর্শ পেয়ে জেহের হকচকিয়ে উঠে ঘুরে তাঁকিয়ে দেখে আরজা’র মা দাড়িয়ে আছে। আরজা’র মা’কে দেখে’ই জেহের দাড়িয়ে পড়ে সালাম দিয়ে অন্য একটা চেয়ার তার দিকে এগিয়ে দিলো বসার জন্য। আরজার মা বসতে বসতে জেহের’কেও বসার জন্য ইশারা করলো। জেহের মাথা নিঁচু করে শান্ত কন্ঠে বললো….

–আমাকে ক্ষমা করবেন আন্টি। আমি জানি আমি আপনাদের মেয়ে’কে খুব বেশি কষ্ট দিচ্ছি। আর মাত্র একটা দিন তারপর আর কোনোদিন আপনার মেয়ে’কে কষ্ট দিব না আন্টি প্রমিস…
জেহেরে’র নিঁচু স্বর শুনে আরজা’র একটু হেসে জেহের’কে বলে উঠলো……
–আমি জানি বাবা তুমি আমার মেয়ে’কে খুব বেশি ভালোবাসো। আর, এই সারপ্রাইজ’টা পেয়ে আমার মেয়ে তোমার উপর রেগে থাকতে’ই পারবে না। আমি তো শুধু তোমার সাথে কথা বলার জন্য আসলাম।
আরজা’র মায়ের কথায় জেহের এইবার স্বস্তির হাসি হাসলো। ভেবেছিলো মেয়ের কষ্টে হয়তো উনারা ও কষ্ট পাচ্ছে। তাই আগেই অনুতপ্ত হয়ে কথা গুলো বলেছে।

তনুজা আর সায়মা খানম মিলে ওদের দুজন’কে নিয়ে নিচে নামলো। হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হলো। আজো কালকের মতো আরজা আর ফাইজা এক সোফায় আর ফারদিন জেহের এক সোফায়। জেহের’কে আজ খুব সুন্দর লাগছে। না চাইতেও আরজা’র চোখ বার বার ওই দিকে যাচ্ছে। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে ফারদিন মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে সবার উদ্দেশ্য হাসি মুখে বলে উঠলো…..
–আজ অনুষ্ঠান শুরু হবে আমার একমাত্র শা’লিকার একটা মন মাতানো গান দিয়ে সাথে সুর মেলাবে তার ওয়ান এন্ড অনলি জিজু ফারদিন। সবাই রাজি তো……..

ফারদিনের কথা শুনে সবাই এক সাথে কড়ো তালি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠে সম্মতি জানালো। আর আরজা অস্বস্তি’তে পড়েছে। গান’টা ও বরাবর খুব ভালো গায়। ছোট বেলা থেকে’ই গানের প্রতি জোঁক বেশি ওর। গান ও শিখেছে কয়েক বছর। কিন্তু অনেক দিন গানের সাথে ওর দেখা সাক্ষাত নেই। এই মুহূর্তে কি গান গাইবে তা নিয়ে খুব বেশি ভাবনায় পড়ে গেলো। ফারদিন স্টাইল করে গিয়ে আরজার দিক্ব হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে উঠলো……

–কাম ইন মাই হাফ-ঘাড়ওয়ালি…..
সবাই আরেকবার করোতালি দিয়ে উঠলো। আরজা’র অস্বস্তি নিয়ে ফারদিনে’র হাত ধরে স্টেজ থেকে নেমে এলো। মাইক্রোফোন’টা হাতে নিয়ে জেহেরের দিকে একবার নজর দিলো। জেহের এক দৃষ্টি’তে ওর দিকে তাঁকিয়ে আছে তা দেখে তাড়াতাড়ি আরজা দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। ফারদিনের কাছে গানের’ নাম’টা বলতে’ই ফারদিন অসহায় ফেস করে ফিসফিসিয়ে আরজা’র কানে বললো…..
–আজ এত সুন্দর একটা দিনে তুমি এই ছ্যাকা খাওয়া মার্কা গান গেয়ে সবাই’কে ইমোশনাল করে দিবে তো শা’লিকা…….

ফারদিনের কথা আরজা স্বশব্দে হেসে উঠলো। দুষ্টুমি ভঙ্গিমাতে বলে উঠলো….
–আমি তো আর আমার জিজুর মতো রোমান্টিক নই যে রোমান্টিক গান গেয়ে সবাই’কে রোমান্টিক বানিয়ে দিব। এই দায়িত্ব’টা বরং আমার জিজুর থাকুক আর আমি না হয় দুঃখ বিলাশ করার জন্য এই গান’টাই গাইলাম……..
আরজার এহেতুক কথা শুনে ফারদিনের মুখ’টা চুপসে গেলো। উওর দেওয়ার শব্দ খুঁজে পেলো না। হাফ ছেড়ে বললো…..
–যথা আজ্ঞা। আপনি যাহা বলিবেন তাহা’ই হইবে…..

বলে দুজনে’ই একসাথে হেসে উঠলো। আরজা’র কথা মতো ফারদিন গিটারে সুর তুলতে লাগলো। আর আরজা মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে গান’টা শুরু করতে যেয়েও কয়েকবার থেমে গেলো। ওর বুকের ভেতরে সুনামি শুরু হয়েছে। এলোমেলোহীন ঢৈউ এসে বার বার তীরে আছড়ে পড়ছে। চোখের পাতা দুটো নোনা জল দ্বারা ভারী হতে লাগলো। তাও মুখে হাসি ফুটিয়ে জেহেরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে গাইতে শুরু করলো……

“তুমি যাকে ভালোবাসো”
স্নানের ঘরে বাষ্পে ভাসো
তার জীবনে ঝড়…
তোমার কথায় শব্দ দূষন
তোমার গলার স্বর
আমার দরজায় খিল দিয়েছি
আমার দারুন জ্বর
তুমি অন্য কারোর সঙ্গে বেঁধো ঘর….
তুমি অন্য কারোর সঙ্গে বেঁধো ঘুর….
এইটুকু গেয়ে থেমে গেলো ওর গলার স্বর আটকে আসচ্ছে। বুকের ভেতর চে’পে আসচ্ছে। জেহেরের দিকের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অন্য দিকে দিয়ে আবার গাইতে শুরু করলো…….

তোমার নৌকোর মুখোমুখি আমার সৈন্য দল
বাঁচার লড়াই…..
আমার মন্ত্রী খোয়া গেছে
একটা চালের ভুল
কোথায় দাড়াই……?
কথার উপর কেবল কথা
সিলিং ছুঁতে চায়..
নিজের মুখে আয়না আদল
লাগছে অসহায়….
তুমি অন্য কারোর ছন্দে বেঁধো গান….
তুমি অন্য কারোর ছন্দে বেঁধো গান……

এইটুকি গেয়ে আর গাইতে পারলো না আরজা। চোখ থেকে নেমে এলো অথৈজল। চোখের নোনা জল সবার থেকে আড়াল করার জন্য গান’টা এইটুকু গেয়েই দৌড়ে অন্য দিকে চলে গেলো। আরজা’কে ওমন ভাবে দৌড়ে যেতে দেখে উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে আছে। আর জেহের নিস্তব্দ হয়ে মাথা নিঁচু করে আছে। ওর চোখ থেকেও টুপটাপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে। ফারদিন অসহায় চোখে ফাইজা’র দিকে তাঁকাতে’ই দেখলো ফাইজা’র চোখেও জল। ফারদিন তাড়াতাড়ি পরিস্থিতি সামলানোর জন্য চেঁচিয়ে বলে উঠলো…..
–আমার শা’লিকার দুর্দান্ত পারফরম্যান্স এর জন্য একটা হাত তালি অবশ্যই প্রয়োজন………

ফারদিনের কথায় সবাই এক সাথে হাত তালি দিয়ে উঠলো। কেউ কেউ শিষ বাজালো। নিরবতা কেটে গেলো সাউন্ড বক্সের গানে। ফাইজা স্টেজ থেকে নেমে আরজা পেছন পেছন গেলো। আরজা এক কোনে দাড়িয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ফাইজা গিয়ে আরজার কাঁধে হাত রাখতে’ই আরজা আচমকা ফাইজা’কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো। ফাইজা কি বলে স্বান্তনা দিবে খুঁজে পাচ্ছেনা। নিজেকে অপরাধী লাগছে। কাল আরজা’র কষ্ট দেখতে না পেরে অর্ধেক সত্যি’টা আরজা’কে বলে দিয়েছিলো। আরজা’কে বলে ছিলো জেহের কাউকে ভালোবাসেনা। আর বিয়েও অন্য কাউকে করবেনা। আর এটা বলেছে একটু অপেক্ষা কর তোর জন্য বিরাট একটা সারপ্রাইজ আছে। আরজা ফাইজা’র কথা ভাবার্থ পুরো বুঝতে পারেনাই। তাই আরজা কষ্ট পাচ্ছে কারন জেহের আরজা’র থেকে দূরে দূরে থাকছে তাই। আরজা কাঁদতে কাঁদতে বললো……

–জেহের ভাইয়া কেনো আমাকে কষ্ট দিচ্ছে ফাইজু। আমার সত্যি অনেক বেশি কষ্ট হচ্ছে। এর থেকে ম’রে যাওয়া ও বোধহয় ভালো। আমার ম’রে যেতেই ইচ্ছে করছে……
ফাইজা এইবার রেগে আরজা’কে নিজের থেকে ছাড়িয়ে বলে উঠলো….
–ম’রে যাবি তাইনা। কেনো ম’রে যাবি। কেনো এত কষ্ট পাচ্ছিস?
এইবার আরজা চুপ করে গেলো। আরজা কখনো ফাইজা’কে বলে’নি ও জেহের’কে ভালোবাসে। তাও কাল ফাইজা নিজেই বলেছিলো আরজা’কে অর্ধেক সত্যি। আজো আরজা’র নিশ্চুপ থাকা’টা ফাইজা মেনে নিতে পারছেনা। আরজা কথা এড়িয়ে যেতে চোখের জল মুছে নিয়ে বললো……

–গান গাইতে গাইতে আমি বেশি ইমোশনাল হয়ে গেছি ফাইজু। কি বলতে কি বললাম এইসব নিয়ে ভাবিস না। চল চল ওইদিকে সবাই কি ভাবছে কে জানে? তাড়াতাড়ি আয়……
বলে আরজা সামনে পা বাড়ালো। আর ফাইজা ওর দিকে তাঁকিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে বললো…..

গোধূলি লগ্নের সেই তুমি পর্ব ৩৬

—কাল তোর সব দুঃখ,যন্ত্রনা ঘুঁচে যাবে। আমার ভাই’টা ও কষ্ট পাচ্ছে। তাও কেনো এমন করছে কে জানে? হয়তো কিছু সারপ্রাইজ এমন বিষাদময় হয়…….
বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেও পা বাড়ালো সেদিকে।
আরজা স্টেজের সামনে এসে জেহের চুপসানো মুখের দিকে তাঁকিয়ে নিজে নিজে’ই হালকা হেসে বললো……
–ভালোবাসারা থাকুক হৃদয়ে লুকায়িত…
প্রকাশ হোক অশ্রুধারার বিষাদিনী যন্ত্রনা…….

গোধূলি লগ্নের সেই তুমি বোনাস পর্ব