গোপন কথা শেষ পর্ব

গোপন কথা শেষ পর্ব
অনন্য শফিক

ওর সাথে এমন ভাবে মিশবি যেন ও ভাবে তুই তার আপনের আপন!তুই প্রথমেই তাকে বলবি তোর ভাইয়ার সাথে ও কী করেছে না করেছে সব তুই দেখেছিস। তারপর তুই বলবি,তুই তাকে হেল্প করতে চাস। বিনিময়ে সে যেন তোকে ওই বাসার তুষারের সাথে দেখা করার সুযোগ করে দেয়।আই মিন,তুই ওর সাথে এমন ভাবে কথা বলবি যেন ও ভাবে তুইও ওর মতোই। চরিত্রহীন।’
কথাগুলো বললো নোরা।

তিশা যেন অবাকের শেষ সীমানায় গিয়ে পৌঁছালো।সে বললো,’এসব কী বলছো না বলছো তুমি? ওই তুষার বেটারে দেখলেই তো আমার জীবন যায় যায়!চ্যাচড়া একটা!আর আমি কি না ওর সাথে দেখা করার কথা বলবো দীপার কাছে! অসম্ভব!পারলে সেই দেখা করুক গিয়ে তুষারের সাথে।এতে তার লাভ হবে। প্রেমিকের সংখ্যা একটা বাড়বে!’
নোরা বললো,’ধুর।ভাল্লাগে না।অত মাথামোটা কেন তুই? তুই কী সত্যি সত্যি ওর সাথে দেখা করবি নাকি!তুই জাস্ট ওর কাছে এটা বলবি।যেন ও তোকে তার সম পর্যায়ের ভাবে।মনে রাখিস,ও তোকে যতক্ষণ পর্যন্ত তার মতো না ভাববে ততক্ষণ কিন্তু সে তোর কাছে কিছুই শেয়ার করবে না। এই জন্য তোকে এই অভিনয়টা করতে হবে।’
তিশা এবার বুঝতে পারলো।সে হেসে বললো,’এখন বুঝতে পেরেছি।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘তারপর তুই ওকে বলবি আগামীকাল তুই তাকে সুযোগ করে দিবি। বিনিময়ে এর পরদিন সে তোকে সুযোগ করে দিবে।’
তিশা বললো,’ও মা,আমি আবার সুযোগ করে দিবো কী করে? বাড়িতে অন্য মানুষ আছে না?মা, তুমি?’
নোরা বললো,’এটা তুই বলবি।আমি মাকে নিয়ে মার্কেটে চলে যাবো। কাপড় কিনতে।’
তিশা বললো,’তারপর?এতে তোমার কী লাভ?’
নোরা বললো,’লাভ আছে।আমি দীপার ছেলেকেও নিয়ে যাবো সাথে।ওরা দুজন থাকবে শুধু।আর তুই থাকবি পাহারায়। কিন্তু পাহারায়‌ থেকেই তুই সি আইডির ভূমিকাটা পালন করবি!’
তিশা চমকে উঠলো।বললো,’কীভাবে?’
নোরা বললো,’আমরা বাসায় কেউ থাকবো না।এই সুযোগে ওরা নোংরামোতে মেতে উঠবে।তুই আগে ভাগেই ক্যামেরা তাক করে রেখে আসবি। টেবিলের উপর যে বইগুলো আছে। এই বইগুলোর মাঝে রাখবি। ছোট্ট ক্যামেরা।লাইটারের মতো দেখতে।’
তিশা অবাক হয়ে বললো,’তোমার ক্যামেরা আছে আর এই পর্যন্ত তুমি বললেও না পর্যন্ত? বাই দ্যা ওয়ে। তুমি ভিডিও করতে চাও তাই তো?’

‘হ্যা চাই।এটাই আমার প্লান।’
কিন্তু এতে তোমার লাভ কী হবে?এই ভিডিও দিয়ে কী করবে তুমি?’
‘এই ভিডিও দিয়েই ওদের পাপের খেলাটার সমাপ্তি ঘোষণা করবো। ইনশাআল্লাহ!’
তিশা জানে না এই কাজ করে সে ধরা পড়ে যাবে কি না!হতেও তো পারে ওরা ক্যামেরা দেখে ফেললো। তাছাড়া ওরা যে তার এই ফাঁদে পা রাখবে এরও তো কোন নিশ্চয়তা নাই!
তবুও সে চেষ্টা করবে।সে নোরাকে বললো,’ভাবী,ক্যামেরাটা দেখি একটু দেও তো!’
নোরা খানিক রাগ দেখিয়ে বললো,’আমায় আর ভাবী ডাকিস না। খারাপ লাগে। তাছাড়া আমি নিজেকে তোর ভাইয়ের স্ত্রী হিসেবেও আর মানি না।তুই আমায় বুবু বলে ডাকবি।’
তিশা বললো,’ডাকবো।ক্যামেরাটা দেও দেখি বুবু।’
নোরা বললো,’ক্যামেরা তো নাই এখন।’
তিশা বললো,’নাই মানে?’
নোরা বললো,’ক্যামেরা আজ বিকেলে একজন এসে দিয়ে যাবে।বিকেল বেলা আমি যখন তোকে বলবো তখন তুই গেট খুলে গিয়ে ওর হাত থেকে নিয়ে আসবি।ও এসেই আমায় ফোন দিবে।’
তিশা বললো,’আচ্ছা।’

বিকেল বেলা ক্যামেরা দিয়ে গেল একজন এসে।তিশা তাকে চেনে না। চেনার প্রয়োজনও নাই। তবে এটা যথেষ্ট পরিমাণ ছোট।ওরা টের পাবে বলে মনে হচ্ছে না।’
এবার তিশা তার দায়িত্বে নেমে পড়বে।এটা তার আপন ভাই এবং খালাতো বোনের বিরুদ্ধে একটি মিশন। দুজনই তার রক্তের। যার জন্য সে এটা করছে সে তার রক্তের না।অন্য কোন মেয়ে হলে এটা কখনোই করতো না। বরং ভাইয়ের স্ত্রীর বিরুদ্ধে অবস্থান করতো।বলতো,তার ভাই নির্দোষ।খালাতো বোন নির্দোষ। কিন্তু তিশা এই ধাঁতের মেয়ে না।সে জানে পাপ যে করে সে যদি নিজের ঔরস জাত পিতা কিংবা জন্মদাত্রী মাতাও হয় তবুও তাকে ছাড় দেয়া যাবে না!

তিশার মোটেও খারাপ লাগছে না। বরং তার এতে আনন্দ হচ্ছে। শরীরের রক্ত শিরশির করছে। সে মনে মনে ভাবছে,যেন সে আজ মহৎ একটা যুদ্ধে নামছে। এই যুদ্ধে সে জয়ী হবে। শুধু সে একা না।এই জয় পৃথিবীতে আর যতো মানুষ সত্যের পক্ষে আছে তাদের সকলের জয়। এই জয় একজন অবলা নারীর জয়। এই জয় বিদেশবিভুঁইয়ে পড়ে থেকে দেশে থাকা নিজের স্ত্রীকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করা এক আভাগা স্বামীর জয়!এই জয় মজলুমের।আর পরাজয় সমস্ত জালিমের।
তিশা বুকে প্রবল সাহস নিয়ে এগিয়ে গেল দীপার কাছে।দীপা তখন ট্যাব দিয়ে কী একটা গেইম খেলছে। খুব আনন্দিত সে। ঠোঁটে ঝুলে আছে মিষ্টি হাসি।

ওর পায়ের শব্দ পেয়ে দীপা চোখ তুলে তাকালো। তারপর বললো,’ওরেব্বাবা,তিশা যে আমার কাছে এলো!আমি তো ভেবেছিলাম তুই বুঝি আমায় চিনিসই না।আসার পর থেকে তো তোকে কাছেই পাই না একদম।’
তিশা মনে মনে বললো,আমায় কাছে পাবে কী করে?সব সময় তো আমার ভাইটিকেই কোমড়ের সাথে বেঁধে রাখো!
কিন্তু মুখ দিয়ে বললো সে অন্য কথা। হাসি হাসি মুখ করে সে বললো,’আপু, তুমি তো জানোই আমি এ বছর এইচএসসি ক্যান্ডিডেট। খুব প্রেশারে থাকি। পড়াশোনা করতে হয়।’
দীপা বললো,’আচ্ছা ‌। খুব ভালো। পড়াশোনা কর। এইচএসসি পাশ কর।তোর দুলাভাইকে বলে রেখেছি তোর জন্য যেন একটা ভালো ছেলে দেখে। ইতালিতে ওর বন্ধু বান্ধব কিংবা ছোট ভাই থাকলে দেখবে।পরে তুইও ওখানে চলে গেলি।’
তিশা ঠোঁট টিপে হাসলো।আর মনে মনে বললো, তুমি গিয়ে আরেকটা বিয়ে করে ফেলো। আরেকটা না আরো দশটা করে ফেলো। নোংরা মহিলা কোথাকার!

তিশা এরপর আমতা আমতা করছে। কিছু একটা বলতে চেয়েও থেমে যাচ্ছে।
দীপা বললো,’কিছু বলতে চাচ্ছিস কিন্তু বলতে পারছিস না তাই তো?বলে ফেল।প্রেম টেম হয়ে গেছে নাকি? খালাকে রাজি করাতে হবে?’
তিশা লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গি করে বললো,’এক্ষুনি না আপু। আমার তো পড়াশোনাই বাকী!’
‘তাহলে?তাহলে কী চাস তুই?’
তিশা ফট করে তখন বলে ফেললো,’আপু, ভাইয়ার সাথে তোমার —
কথাটা শেষ করলো না তিশা।ভয় এবং লজ্জা এসে তাকে গ্রাস করে ফেললো।
দীপা বললো,’কী?তোর ভাইয়া আমি কি!’
তিশা একদমে এবার বলে ফেললো।
বললো,’তোমরা যা করো এর সব আমি দেখেছি।রোজই দেখি!’
কথাগুলো বলে সে লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো।

দীপা শোনে খানিক সময় চুপ করে নিজেকে স্থির করে নিলো।সে কী উত্তর দিবে তা ভাবছে। ভেবে একটা জিনিস বুঝতে পেরেছে যে তিশা ভয়ংকর টাইপের মেয়ে। ওকে সাত পাঁচ দিয়ে বুঝানো যাবে না। এছাড়াও আরেকটা বিষয় সে যা বুঝলো তা হলো,তিশা তার কাছে একটা হেল্প চাইতে পারে। এবং এই হেল্পটা সে চাইবে ওদের দুজনের সম্পর্কের অযুহাতটা দেখিয়েই!
তাই সে বলেই ফেললো,’সম বয়সী দুজন মানুষ মত থাকলে যা ইচ্ছে তাই করতে পারে।এটা উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করলেই বুঝতে পারবি।এর আগে বুঝবি না।’
তিশা কথা বললো না।সে মাথা নিচু করেই বসে রইল।

দীপাই এবার আগ বাড়িয়ে কথা বলছে।বলছে,’এসব আবার কারোর কাছে বলে বেড়াসনি তো?খালা কী জানে কিছু?’
তিশা আস্তে করে বললো,’আমি কী বোকা নাকি যে জনে জনে এসব বলে বেড়াবো!কেউ জানে না। এমনকি ভাবীও না!’
‘ভালো।কারোর কাছে কিছু বলিস না।ওরা মূর্খ সুর্খ। এইসবের কিছুই বুঝবে না। কুসংস্কারে এদের আজো পর্যন্ত আচ্ছন্ন করে আছে।আমি বুঝতে পারি না এই দেশ যে কবে এসব কুসংস্কার থেকে মুক্ত হবে!’
তিশা হাসলো। হেসে বললো,’আপু, সবাই যেদিন তোমার মতো উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করবে সেদিন হবে।’
কথাটা কিন্তু সে ইনসাল্ট করে বলেছে দীপাকে। কিন্তু দীপা ভেবেছে প্রশংসা।গর্বে ফুলে ফেঁপে উঠে সে একেবারে জাপটে ধরলো তিশাকে। তারপর বললো,’এই না আমার ছোট বোন।লক্ষ্মী বোন!কিউটি বোন’
তারপর তিশার গালে চুমু খেলো দীপা। তিশার বমি এসে যাওয়ার উপক্রম হলো যেন। তবুও কষ্ট করে নিজেকে সামলে নিলো। তারপর আসল কথাটা বললো।বললো,’আপু,তোমায় আমি একটা হেল্প করবো আর এর বিনিময়ে তুমি আমায় একটা হেল্প করবে। তুমি যদি এতে এগ্রি করো তবেই আমি সবকিছু খুলে বলবো!’

দীপা হেসে বললো—-
দীপা হেসে বললো,’আমায় হেল্প করতে হবে না।তোরে কী হেল্প করতে হবে তা বল।’
তিশা বললো,’ভাবীর কাছে শুনেছি মাকে নিয়ে নাকি সে আগামীকাল মার্কেটে যাবে। আমাকেও বলেছিল যেতে।আমি বলে দিয়েছি আমার সময় নাই। পড়াশোনা আছে।’
দীপা বললো,’বুঝলাম। কিন্তু ওরা মার্কেটে গেলে তোর কী লাভ?’
‘লাভ তোমাদের। তুমি আর ভাইয়া ইচ্ছে মতো প্রেম করবা।আর আমি থাকবো পাহারায়। পরদিন তুমি ভাইয়া সহ সবাইকে নিয়ে মার্কেটে চলে যাবা।বাসা থাকবে খালি।’
কথাটা বলে মৃদু হাসলো তিশা। আবার লজ্জায় তাকে আগলে নিয়েছে।সে নিচ দিকে তাকিয়ে আছে।
দীপা ওর থুতনি ধরে উপরের দিকে উঁচু করে নিয়ে এবার বললো,’অত লজ্জা পেলে তো চলবে না মেয়ে।আমরা বন্ধুর মতো।মেচ্যুয়ূরডদের জন্য বয়সটা কোন ব্যপার না।বুঝলি?’
তিশা মাথা কাঁত করে সম্মতি দিলো।সে এই কথাই বিশ্বাস করে তাই বুঝালো।
তারপর দীপা বললো,’এই, সত্যি নাকি কথাটা ওরা যে মার্কেটে যাবে কাল?’
তিশা বললো,’হুম সত্যি।’

‘তোর ভাইয়াকেও যদি যেতে বলে?’
‘এটা তো আমি জানি না আপু। তুমি ভাইয়াকে নিষেধ করে দিও।’
দীপা বললো,’ওকে। কিন্তু এর পরদিন আমরা সবাই মিলে বাসা খালি করে চলে গেলে তোর কী লাভ?কেউ আসবে নাকি?’
তিশা লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে উঠে বললো,’হুম।’
তারপর সে উঠে চলে গেল জল ফড়িংয়ের মতো।
দীপা মনে মনে ভাবলো,আহা ওর বয়সটা যদি তার থাকতো তবে আরো মিষ্টি সময় কাটতো তার!সে খুব আফশোস করলো মনে মনে। প্রকৃতির বিচারটা সে বুঝে না।বয়স দিনে দিনে বাড়ার কী প্রয়োজন ছিল?কমলে হতো না।এতে কী দোষ হয়ে যেতো!

পরদিন দুপুর বেলা নোরা আর ফিরোজা বেগম মার্কেটে চলে গেল। ফিরোজা বেগম নাকি ডাক্তারও দেখাবেন।ফিরতে দেরি হবে।বলে গেলেন বাসায়।
ফিরোজা বেগম আর নোরা যাওয়ার সময় গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছিলো দীপা , ফাহাদ। এই সুযোগে তিশা গিয়ে ছট করে জায়গামতো ক্যামেরাটা তাক করে রেখে এলো। এবং ঘরে এসে টেবিলের সামনে বসতে পড়তে শুরু করে দিলো।

‘এমন একটি দিন ঈদের চেয়ে কম কী গো!’
দীপা বললো।
ফাহাদ বললো,’বউটা বোকাসোকা আছে। এমন একটা লক্ষ্মী বউয়ের জন্য কুরবান হওয়া যায়!’
দীপা হাসলো। হেসে বললো,’আসলে তোদের বাড়ির সবকটা মানুষই বোকা।দিন দুপুরেই এদের চোখে ধুলো দেয়া যায়।টেরও পায় না!’
ফাহাদ আর কথা বললো না।সে কথা বলে সময়টা নষ্ট করার পক্ষে নয়। বরং উঠে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এলো।এই বাড়িতে ওরা দুজন এক ঘরে গিয়ে এই প্রথম বারের মতো দরজা বন্ধ করলো।

তিশা টেবিলের সামনে বসে থেকেই ভয়ে কাঁপছে।ভয় পাচ্ছে এই জন্য যে যদি ক্যামেরাটা ওরা দেখে ফেলে!
মনে মনে সে আল্লাহকে ডাকছে।যেন বিপদ না ঘটে।
এরপর সে দু তিনবার দরজার সামনে দিয়ে পায়চারিও করেছে।গলা খাঁকারি দিয়েছে। এসব করে দীপাকে আশ্বস্ত করেছে যে সে পাহারায় লিপ্ত আছে। কোন ভয় নেই!
এই সময় একটা বিষয় ভেবে খুব কষ্ট পেলো তিশা।সে ভেবে পায় না একটা মানুষ কতোটা অমানুষ হলে পরে নিজের বোনটিকেও লজ্জা পায় না।বোনের পায়চারি শুনেও কেঁপে উঠে না ওর হৃদয়। ছিঃ!
এরমধ্যেই সে একটি কথা শুনতে পায়। ফাহাদের কাছে দীপা বলে,’তিশা কিন্তু আজকের সুযোগটা এনে দিছে।’
ফাহাদ কথা বলে না।

তারপর দীপা আবার বলে,’বিনিময়ে আগামীকাল ওকেও আমাদের সুযোগ করে দিতে হবে।’
ফাহাদ এবার কথা বলে।বলে,’কিসের সুযোগ?’
দীপা বলে,’ওই বাসার তুষার আছে না ,ওর সাথে ডেইট করবে তিশা। এখানেই।আমরা মার্কেটে চলে যাবো।’
ফাহাদের কথাটা শুনে মাথা নষ্ট হয়ে যায়।সে সঙ্গে সঙ্গে দীপার গালে চড় বসিয়ে দেয় ঠাস করে।আওয়াজটা শুনতে পায় তিশা।
তারপর ফাহাদ রেগেমেগে আগুন হয়ে উঠে গর্জন করে বলে,’আমি ওরে মেরে ফেলবো। আমার বোন অত্ত নোংরা! ছিঃ!’
সে থুউক করে একদলা থুথুও ফেলে মেঝেতে।

দীপা ওকে টেনে ধরে পেছন থেকে। তারপর বলে,’পাগলামো করিস না বা*ল। সবকিছুতেই মাথা গরম করে দেস। মেয়ে এডাল্ট।যা ইচ্ছা তাই করুক।তুই করতেছস না?আমি করতেছি না?করলে সমস্যা কী?এই বিষয়ে অত রাগ দেখানো লাগবে কেন?মাথা ঠান্ডা করে এখন এইখানে আয়।সময় গেলে আর সাধন হবে না!আয় গুরু আয়!’
ফাহাদ একটা অশ্লীল গাল বকে ওকে। তারপর বলে,’তুই আসলেই একটা খারাপ। আমারে নষ্ট বানাইছস। এবার আমার বোনটার পেছনেও লাগছস!তুই কালকের ভেতর এই বাড়ি ছাড়বি।’
দীপা বিছানা থেকে নেমে এলো। তারপর পেছন থেকে জাপটে ধরলো ওকে। তারপর পায়ের আঙুলের উপর ভর দিয়ে মুখটা আরো উঁচুতে তুলে ফাহাদের কাঁধে চুমু খেলো।
ফাহাদ নিজের রাগ সংবরণ করতে না পেরে কুনুই দিয়ে গুঁতো দিয়ে ওকে ফেলে দিলো পেছন দিকে। ভাগ্য ওর ভালো।দীপা গিয়ে পড়লো বিছানায়।নরম গদিতে।ফস করে শব্দ হলো পড়ে গিয়ে।
ফাহাদ অবশ্য তখনও দরজা খুলেনি। তবে খুলতে এগিয়ে যাচ্ছে। দরজা খুলে সে যাবে তিশার কাছ। তিশাকে মারবে।
কিন্তু এক্ষুনি এমন কিছু হতে দিতে চায় না দীপা।সে ভয় দেখালো ফাহাদকে।বললো,’তিশা কিন্তু সব জানে। খালাকে বলে দিলে তখন বুঝবি কত ধানে কতো চাল!’

ফাহাদ কথাটা শুনে যেন মুহূর্তে অসহায় হয়ে পড়ে। এবং নিজের কৃত কর্মের জন্য লজ্জিত হয়। বুঝতে পারে সে কত বড় ভুল করে ফেলেছে। তার এই ভুলের মাশুল এখন তার বোনকে দিয়ে দিতে হবে।
সে দীপার গলা চেপে ধরে এবার। শক্ত করে ধরে। তারপর বলে,’শুধুমাত্র তোর জন্য খানকি!তোর জন্য আমার বোনটা তার লাইফটা নষ্ট করবে।একটা ফুলের মতো মেয়ের গায়ে কলঙ্কের কালিমা লাগবে!’
দীপাও কম জানে না। বারংবার তাকেই দোষারোপ করে যাচ্ছে ফাহাদ।সে এবার বলেই ফেললো,’নিজের বোনটা ষোলো আনা আর অন্যের বোনের কোন মূল্য নাই।তোর বোন মেয়ে আর আমি কী ছিলাম? হিজড়া?

শালা কুত্তা,তোরা সব ছেলেই একরকম। নিজের বোনের জামা কেউ খুলুক এটা চাস না। কিন্তু পরের বোনেরটা খুলতে বড় আরাম পাস।বলেই থুউক করে একদলা থুথু ছিটিয়ে দিয়ে বসলো সে ফাহাদের চোখে মুখে।
ফাহাদ আর নিজেকে সামলাতে পারলো না। খাটের ওপাশেই ছিল পাথরে তৈরি শেক্সপিয়ারের একটা মূর্তি।এটা তার বাবার কেনা । ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক ছিলেন তার বাবা।তাই
প্রিয় কবির মূর্তি অনেক মূল্য দিয়ে কিনে এনে রেখেছিলেন ঘরে। ফাহাদ নিজেকে আর দমিয়ে রাখতে না পেরে পাথুরে মূর্তিটা দিয়ে তার শরীরের সবটুকু শক্তি প্রয়োগ করে আঘাতটা করলো দীপার মাথায়। এরপর আর দীপার মরতে খুব একটা দেরি হলো না।
ফাহাদ ভয়ংকর কাজটা করে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই দীপার ভব লীলা সাঙ্গ হয়ে গেল!

তিশা বুঝতে পেরেছিল ভয়ংকর কিছু একটা হয়ে গেছে।কারণ শেষ বারের মতো একটা ভয়ানক চিৎকার দিয়ে উঠেছিল দীপা। সেই চিৎকার স্বাভাবিক কোন চিৎকার নয়।অনেকটা গোঙানির মতো ছিল শেষ দিকে। মনে হয় এই একটা মাত্র চিৎকার দেয়ার সুযোগই সে পেয়েছিল কেবল। এরপর আর শ্বাস টুকুও টেনে নিতে পারেনি। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিল দীপা।
তিশা সঙ্গে সঙ্গে দরজায় জোরে জোরে করাঘাত করে বলতে লাগলো,’দরজাটা খুলো।প্লিজ দরজাটা খুলো।’
ফাহাদ ভয়ে ভয়ে এসে দরজাটা খুলে দিলো।তিশা ভেতরের দৃশ্যটা দেখেই ভয়ে একেবারে জমে গেল। চিৎকার দিতে গিয়েও মুখে ওড়না চেপে ধরলো।জ্যান্ত মানুষটিকে এভাবে মেরে ফেলেছে তার ভাই!

ফাহাদ ভয় পাচ্ছে।তার চোখে মুখে প্রবল আতংক। বাসা থেকে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া তার আর কোন উপায় নাই। নয়তো পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যাবে। ফাঁসি টাসি হয়ে যাবে।
সে কাঁপা কাঁপা গলায় তিশাকে বললো,’তিশা, কোথায় যাবো রে আমি! বুঝতে পারিনি রাগের মাথায় এটা করে ফেলেছি!’
তিশা ভয়ে রক্তশূন্য মুখে ওর দিকে তাকালো। তারপর দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বাইরে থেকে দরজাটা আটকে দিলো।

গোপন কথা পর্ব ৫+৬

বাড়িতে পুলিশ এসেছে।থানায় ফোন করেছে তিশা নিজেই। পুলিশ আসার পর পরই ফিরোজা বেগম আর নোরা এসেছে মার্কেট থেকে। ফিরোজা বেগম ডাক্তারও দেখিয়েছেন। তাদের সাথে দীপার ছেলেটাও আছে।ওর জন্য নোরা বেগুনি রঙের সুন্দর একটা পাঞ্জাবি কিনে দিয়েছে।সে এতে খুব খুশি। কিন্তু বাসায় ফিরেই সে জীবনের সবচেয়ে বড় আঘাতটা পেলো। তার মা খুন হয়েছে।ছেলেটা মায়ের লাশের সামনে বসে গগণবিদারী চিৎকার করে কাঁদছে।

পুলিশ ফাহাদকে এরেস্ট করেছে। তাদের হাতে এখন শক্ত প্রমাণ আছে খুনির।ক্যামেরায় সবকিছুর ভিডিও রেকর্ড হয়েছে। ফাহাদ ফেঁসে গেছে। ফেঁসে গেছে দীপাও।পাপীদের জন্য এই দুনিয়া এবং আখেরাত কোনটাই কল্যাণকর নয়। যদিও এটা তারা ভাবে না। তবে এটাই সত্য যে এদের শেষটা সব সময় কষ্টের হয়। পরাজয়ের হয়।যেমন করে এই গল্পের ফাহাদ আর দীপার হলো।দুটি জীবন নষ্ট।এর সাথে আরো অনেক কিছুই নষ্ট হয়েছে। দীপার তিন বছরের ছোট্ট ছেলেটির জীবন।এই বয়সেই মাতৃ হারা সে।আর তার বাবার বিশ্বাস ভঙ্গ। কিশোরী কালে নোরার দেখা সুন্দর স্বপ্নগুলোর জলসমাধি হলো।কতো কী ভেবে রেখেছিলো।একটি লক্ষ্মী বর হবে তার।যার সাথে এক ছাদের নিচে একটা জনম কাটিয়ে দিবে সে। তাদের সন্তান সন্ততি হবে। এদের সুন্দর সুন্দর নাম দিবে।এইসব কিছু কল্পনাই রয়ে গেল।দুঃখী হয়ে গেলেন বৃদ্ধা ফিরোজা বেগম।সারা জীবনের জন্য কান্না তার সাথী হলো।আর তিশা?সারা জীবন তাকে এই একটি প্রশ্ন খুঁড়ে খুঁড়ে খাবে।প্রশ্নটি হলো সে যে ফাঁদ টা পেতেছিলো দুজন কট্টর পাপিষ্ঠের জন্য তা তার ঠিক হয়েছে না ভুল হয়েছে?

(পাঠক, তিশার প্রশ্নের উত্তর দিন।)
—সমাপ্ত—