চড়ুইপাখির অভিমান পর্ব ২৩

চড়ুইপাখির অভিমান পর্ব ২৩
লেখনীতে- নন্দিনী নীলা

সন্ধ্যার আগেই স্পর্শ আমাকে বাসায় রেখে চলে গেল। বাসায় আসার 5 মিনিট আগে আমি স্পর্শকে আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করছিলাম।
‘ আপনি কি কোন কারনে আমার উপর রেগে আছেন?’
স্পর্শ ড্রাইভ করতে করতে এক নজরে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কেন? রাগ করার মতো কিছু করেছ কি?’
আমি ইচ্ছে করেই এসব জিজ্ঞেস করার নাম করছি। কারণ আমি চাইছি। তখন অন্য একটা ছেলের সাথে আমাকে দেখে স্পর্শের রাগ হয়নি জেলাস ফিল হয় নি। সেটা আদৌ কি সত্যি? নাকি লুকিয়ে রাখছে পেট থেকে বের করার জন্য আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম।
‘ না মানে এমনি। মনে হচ্ছে আপনি আমার উপর কোন কারনে রেগে আছেন?’

‘ তুমি যে কারনে আমাকে এসব জিজ্ঞেস করছ। সেখানে এমন কিছু হয়নি যে আমায় রাগ করতে হবে। তেমন কিছু হলে আমি রাগ করতাম না তোমার উপর। যে তোমাকে আমার থেকে ছিনিয়ে নিতে আসত আমি তাকে গেট আউট করে দিতাম। তাই ঐসব করার কথা আর ভেবো না তুমি এসব করায় কাঁচা। তুমি এত সুন্দর অ্যাক্টিং করতে পারো না। তুমি কোন অ্যাক্টার্স না। বান্ধবীদের সাথে মিশবা ঠিক আছে ভালো কিন্তু তাদের ব্যাড হেবিটস গুলা মাথা ঢুকাবে না।’
‘আচ্ছা।’ গাল ফুলিয়ে মন খারাপ করে বললাম।
এতটুকু কথাই হয়েছে আমাদের মাঝে। বাসায় এসে আমি গ্রুপ কল দিলাম মিষ্টি দের। সবাই অনলাইনে ছিলনা কিন্তু যারা ছিল সবাই আসলো হারামি দের বলা স্পর্শের বলা সব কথা বললাম। ওরা স্পর্শের কথা শুনে রাগে কাঁপতে লাগলো।
‘তোর জামাই আমাগো বুদ্ধি রে এইভাবে অপমান করল! তুই চাইয়া চাইয়া শুনলি খালি কিছুই বললি না হারামি। তুইতো বন্ধু নামের কলঙ্ক আর জীবনে কোন কিছু নিয়ে আমাদের কাছে আসিস!’ নিঝুম রেগে বলল।
‘তদের প্লান ত সত্তি ফেল করেছে তাই এত গলা উঁচু করে কথা বলবি না। আজাইরা পরিকল্পনা করেছিলি কাজের কাজ কিছুই হয়নি মাঝখান থেকে আমি ফাঁসতে ছিলাম।
মিষ্টি চিৎকার করে বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘ মারুর বাচ্চা তোকে একবার সামনে পাই। দুই জামাই বউ মিলে এখন আমরা খারাপ।’
‘একদম মারুর বাচ্চা বলবি না। আমি আমার বাচ্চা কিভাবে হব? খালি উল্টাপাল্টা কথা বলা।’
ওদের সাথে তুমুল ঝগড়া হলো আমার। আমি তো ছাড়লাম না তিন জন এক জোট হয়ে আমাকে আলাদা করে রেখে ঝগড়া করল। আমি একাই একশো এমন ভাবে ঝগড়া করে ফোন কেটে শান্ত হলাম।
টেস্ট পরীক্ষা শেষ হয়ে কলেজ বন্ধ দিয়ে দিল এখন শুধু কোচিং হবে। পরীক্ষা একদম হাতের নাগালে চলে এসেছে এজন্য সমস্ত বান্দরী পানা বাদ দিয়ে আমি একটু সিরিয়াস হলাম।
দেখতে দেখতে ফেব্রুয়ারি মাস চলে গেল পরীক্ষা আছে দুই মাস। ফেব্রুয়ারি মাস প্রেমের মাসটা চলেই এলো। কিন্তু আমার সাথে এমন কিছু ঘটলো না। আমার একটা থাকা সত্ত্বেও আমাকে না রোজ ডেতে রোজ দিল। আর না প্রপোজ ডে তে প্রপোজ করল। নিরামিষ ভাবে আমার দিনগুলো চলে গেল।

কিন্তু ভালোবাসা দিবসের দিন স্পর্শ এসে হাজির হলো রাতে আমাদের বাড়িতে। আর রাত আমাদের বাড়ীতেই থাকবে বলল। সেদিন স্পর্শ আমাকে অনেক জিনিস উপহার দিয়েছে। পরদিন সকালে স্পর্শ চলে গিয়েছিল। রাতটা আমার জন্য সারপ্রাইজ ছিল। সেদিন স্পর্শ নিজের মনের অনেক অনুভূতি আমাকে জানিয়েছে আমাকে অনেকবার ভালোবাসি বলেছে।
দেখতে দেখতে পরীক্ষা দিন চলে আসলো। পরীক্ষার দিনগুলোতে আমার সাথে একদিন স্পর্শের দেখা হলো না। কিন্তু ফোনে প্রতিদিনই স্পর্শ আমার খোঁজ নিয়েছে। পরীক্ষা কেমন হয়েছে? ঠিকমতো পড়ছি কিনা! ফোন দিয়ে খোঁজ নিয়েছে।
দেখতে দেখতে পরীক্ষা নামক প্যারাটা অবশেষে শেষ হলো। বিয়ের গুঞ্জন শুনছি। পরীক্ষা শেষ হয়েছে এখন কথা মতো আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠানটা হবে। দু পরিবার আবার একত্রিত হয়ে ডেট ফাইনাল করে ফেলল। ডেটের দুইদিন আগে চলে আসলো। বাড়িতে বিয়ের আমেজ লেগে গেছে এখন। শপিং করা অলরেডি শেষ। আমারতো খুশির সীমা নাই। অবশেষে স্পর্শ কে আমি হাতের নাগালে পাব তার কাছাকাছি থাকতে পারবো।
হলুদ সন্ধ্যা

মিষ্টিটা সবাই এসেছে একদম শাড়ি পরে সেজেগুজে। ওরা আসার পর শুধু একটা কথাই বলেছে অবশেষে তোর অপেক্ষার অবসান হচ্ছে। আমি শুধু মিষ্টি করে হেসেছি।
আজ আমি আমার ইচ্ছেমত সেজেছি। বিয়ে সম্পন্ন শপিং আমি নিজের পছন্দমত করেছি। স্পর্শ আমার সাথে ছিল তাকেও দেখিয়েছি তার আর আমার দুজনের পছন্দে করে কেনা হয়েছে।
আমার একমাত্র ননদ সীফা আব্বু আম্মুর পর সবার আগে আমাকে গায়ে হলুদ ছুঁয়ে দিল। একে একে সবাই হলুদ দিল। স্পর্শের সাথে কথা বলেছি তিনি প্রকাশ না করলেও জানি তিনি অনেক খুশি।
তার প্রত্যেকটা কথায় বুঝেছি। এখন মনে হয় আমি তাকে একটু হলেও বুঝতে পারি।
হলুদ অনুষ্ঠান শেষ হল বর পক্ষের লোক চলে গেল।
সবাই তখন নাচ গান শুরু করলো আমিও ওদের মানে মিষ্টি দের সাথে নাচানাচি করতে লাগলাম লাফালাফি করতে লাগলাম । আমি তো এরকম মেয়ে না যে বিয়ের কনে বলে নতজানু হয়ে লজ্জায় কাপাকাপি করবে। লজ্জা কাপাকাপি তো শুধু আমি স্পর্শের সামনে করি।এছাড়া এতো লজ্জা বতী না আমি।

রাতে দুই ঘন্টা ঘুমানো হলো আর দিনের অর্ধেক বেলা ঘুমিয়ূ থেকে উঠে আবার বিয়ের কনের সাজতে বসতে হলো। ঘুম থেকে উঠার পর আর আমি স্পর্শে সাথে কথা বলতে পারিনি কারণ আমি অনেক বেলা করে উঠেছি। আমি পরে কল দিয়েছিলাম তখন সে বলল তিনি নাকি আমার জন্য কি সারপ্রাইস এরেঞ্জ করতে যাচ্ছে।আমার জন্য নাকি বিশেষ সারপ্রাইজ। আমি বললাম সেই সারপ্রাইজটা কখন পাবো?
স্পর্শ বলেছে, ‘আমাদের বাড়িতে আসার পর পাবে!’
‘ওই বাসায় বেড়াতে যাব।’
‘তাহলে রাতেই পাবে!’
‘ ওকে।’

ফোন কেটে আমি বসে আছি। স্পর্শ আমাকে ছবি সেন্ড করতে বলেছিল। আমি করিনি। আজ একদম সামনাসামনি দেখব আমাকে। আগে থেকে দেখা দেবো না। বর যাত্রী আসার কথা ছিল 3 টার ভেতর কিন্তু তারা এলো পাঁচটায়। আমাদের বাড়িতে তো হইচ‌ই লেগে গেছিল। আমিও ভয় পেয়ে গেছিলাম। কি হলো এত লেট করছ কেন? আর আমি স্পর্শকে তারপর দুই ঘন্টা যে কত শত ফোন দিয়েছি হিসাব নাই। কিন্তু বারবার ফোন বন্ধ বলেছে। এই 2 ঘন্টা আমার কাছে দুই মাসের সমান হয়ে গিয়েছিল। কতশত খারাপ কথা যে আমার মাথায় এসেছে আশেপাশের লোক ও অনেক বলেছে। স্পর্শরা এমন করল কেন জানিনা। আব্বু কতবার ফোন দিয়েছে তারা শুধু বলেছে আসছি, আসছি, একটা সমস্যা হয়েছে! কিন্তু কি সমস্যা সেটা কেউ বলেনি!
আমি সেই সমস্যা টার কথা জানতে চাই।

আমার হাসিখুশি মুখটা কালো হয়ে গেছিল। আমি আমার এত সুন্দর করে সাজ সব কান্না করে নষ্ট করে ধুয়ে মুছে ফেলেছি। জানিনা তারপর আমাকে কেমন দেখা গেছে। কারন আমি আর আয়নার সামনে যায়নি‌। যাওয়ার ইচ্ছে হয়নি। স্পর্শটা পাঁচটার দিকে আসলো। তার মুখটা একটু খানি হয়েছিল। কারণ তার মাথায় চিন্তা পাহাড় জমেছে আমি তার মুখ দেখেই বুঝতে পেরেছি। আমি কখনোই স্পর্শ কে দেখলে তার মনের খবর বুঝতে পারি না। কিন্তু আজকের যেন তাকে এক ঝলক দেখে তার ভেতরে কষ্টের চিন্তার পাহাড় দেখতে পেয়েছি। আমি অবাক নয়নে তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। স্পর্শ একবারও আমার চোখের দিকে তাকাই নি।
স্পর্শ আব্বু আম্মু সবার সামনে সবার কাছে ক্ষমা চাইলো হাতজোড় করে। এটা যদি স্পর্শের বদলে অন্য কেউ থাকতো তাহলে বোধহয় আমার আব্বু ক্ষমা করতেন না। তিনি প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিলেন। ক্ষমা না করো তো লাভ না। বিয়ে তো আগেই দিয়ে দিয়েছে। আগে যদি বিয়েটা না হতো। তাহলে আজকে বিয়েটা ভেঙে যেতো আমি নিশ্চিত। কিন্তু আমাদের কপাল ভালো যে আমাদের বিয়েটা হয়ে গিয়েছিল।

চড়ুইপাখির অভিমান পর্ব ২২

বিদায় নিয়ে স্পর্শের পাশে বসলাম গাড়িতে। সামনে ড্রাইভার ড্রাইভিং করছে পেছনে আমি আর স্পর্শ শুধু। আমি আড়চোখে স্পর্শকে পরোক্ষ করছি।
মনে মনে অনেক সাহস যুগিয়ে স্পর্শের দিকে ঘোরে সরাসরি প্রশ্ন করলাম,
‘আপনার কি হয়েছে বলুন তো আমাকে? এতো চিন্তা কিসের আপনার?’
স্পর্শ আমার দিকে তাকালো না। অন্য দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ আমার কিছু হয়নি।’
‘ আমার দিকে তাকান! অন্য দিকে তাকিয়ে আছেন কেন?’
‘ মাথা ব্যাথা করছে। একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে?’
‘ আচ্ছা দিচ্ছি।’
স্পর্শ ওইভাবেই আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল আমি ওনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম।

চড়ুইপাখির অভিমান পর্ব ২৪