চড়ুইপাখির অভিমান পর্ব ২২

চড়ুইপাখির অভিমান পর্ব ২২
লেখনীতে- নন্দিনী নীলা

আমি স্পর্শের হুট করেই এমন বাইরে যাওয়ার নিয়ে ভেবেছিলাম। তখনকার কথার জন্যে হয়তো তিনি আমাকে আজকে প্রপোজ করবেন। এজন্যই বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। প্রথমে আমি আসার জন্য দ্বিমত পোষণ করলেও। পরে আমি সারাটা রাস্তা আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে থেকেছি। সারা রাস্তা আমি ভেবেছি স্পর্শ আমাকে কিভাবে প্রপোজ করবে। সেই ভেবে আমার মনে মনে লাড্ডু ফুটছে। স্পর্শ আমাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে এলো। আমি শুধু ভাবছি কেবল খেয়ে আসলাম।‌ আবার রেস্টুরেন্টে এনে কি খাওয়াতে চায়? নাকি এই রেস্টুরেন্টে ফিল্মি স্টাইলে সাজিয়ে আমাকে প্রপোজ করবে? হায় কি রোমান্টিক!
আমি মাথা নিচু করে ব্লাশিং হতে হতে এগিয়ে যাচ্ছি।

রেস্টুরেন্টে ঢুকে একটা সারপ্রাইজ পাওয়ার মতো করে তাকালাম‌। ভেবেছিলাম সামনে তাকিয়ে স্পর্শ কে জড়িয়ে ধরবো খুশিতে। কিন্তু একি আমি সামনে তাকিয়ে বিশ্মিত হলাম। রেস্টুরেন্টে মানুষের অভাব নাই‌। তার মধ্যে দূরের এক টেবিলে আমি স্পর্শের সাথে সেই দিন ঘুরা মেয়ে টাকে আরও ছেলে মেয়ে দেখতে পেলাম। স্পর্শ আমার হাত ধরে সেদিক নিয়ে যেতে লাগল। আমি মুখটা বাংলার পাঁচের মতো করে স্পর্শের সাথে পা মিলাচ্ছে। আমি কি জল্পনা-কল্পনা করছিলাম আর এখানে কি হচ্ছে? স্পর্শ টেবিলের সামনে আসার দুই সেকেন্ড আগে আমার দিকে ঝুঁকে আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘ ওইখানে আমার কলেজের বন্ধুবান্ধব আছে। ওরা তোমাকে দেখতে চেয়েছিল। মিট করার জন্য পাগল করে দিচ্ছিল। তাই তোমাকে এখানে নিয়ে আসা। ওদের সাথে সুন্দর করে কথা বলবে। আর বেশি কথা বলা দরকার নাই চুপ করে বসে থাকবে। ওকে!’
আমি রাগান্বিত চোখের স্পর্শের দিকে তাকালাম। আর বললাম,
‘ আমি বাচাল এর মত কথা বলব এখানে গিয়ে। একবার আমাকে নিয়ে যান না ওখানে। আমার স্বপ্ন বানচাল করার এইটাই শাস্তি আপনার।’ দাঁতে দাঁত চেপে বললাম।
স্পর্শ কপাল কুঁচকে তাকিয়ে র‌ইলো আমার দিকে,
‘ হোয়াট?’
‘কিছুনা।’
‘ তুমি কিন্তু আমার মান সম্মান ডুবায় ও না।’ স্পর্শ কড়া চোখে তাকিয়ে বলল।

আমি কিছু বলতে যাব তার আগে স্পর্শের বান্ধবী বন্ধুরা আমাদের দেখে ফেলল আর চিৎকার করতে আমাদের ডাকতে লাগলো।
আমি চুপ হয়ে গেলাম। স্পর্শ আমার হাত মুঠোয় বন্দি করে ওদের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।
একটা ছেলে কাছে যেতেই বলল, ‘ কিরে স্পর্শ তোরা ওইখানে দাঁড়িয়ে কি কথা বলছিলি। আমরা কখন থেকে ডাকছিলাম।’
স্পর্শ আমার দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় শান্ত থাকতে বলে বলল,
‘ তেমন কিছুই না। তোদের কে ওকে চিনিয়ে দিচ্ছিলাম। ও এসেই নাকি পরিচিত দের মতো করে কথা বলবে তাই।’
আরেকটা ছেলে বলল, ‘ তাই নাকি ভাবি। আমাদের চেনা কি শেষ নাকি আমরা নিজেদের পরিচয় দেওয়া শুরু করে দেবো।’
আমি বোকা চোখে স্পর্শের দিকে তাকালাম। তারপর চোখ সরিয়ে বাকি সবার দিকে তাকিয়ে হাসি‌ হাসি মুখ করলাম। কি বলবো বুঝতে পারছি না। স্পর্শ এমন ভাবে মিথ্যে বলল। এখন আমি ফেসে গেলাম। আমি তো এদের কাউকেই চিনিনা না নামটা পর্যন্ত জানি না।

সেই দিন যে মেয়েটা স্পর্শের সাথে ঘুরছিলো সেই মেয়েটা এবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ আমার নাম কি বলতো?’
আমি শুকনো ঢোক গিলে তাকিয়ে আছি। কি বলবো এখন। স্পর্শ হয়তো আমার ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে। পারার‌‌ই কথা কারণ তিনি জানেন আমি এখানকার কাউকে চিনিনা।
স্পর্শ ওই মেয়েটা বলল,
‘ ঐশি কি শুরু করলি। আমাদের বসতে দিবি না। দাঁড়িয়েই সব শুনবি নাকি‌ তোরা।’
স্পর্শের কথা শুনে সবাই আমাদের বসার জন্য দুইটা পাশাপাশি সিট খালি খালি দিল। আমি আর স্পর্শ সেখানে বসে পড়লাম। তারপর কেউ কিছু বলার আগেই স্পর্শ সবার নাম বলে পরিচয় করিয়ে দিল। আমি সবার নাম টা মাথার মধ্যে ভালো করে গেঁথে নিলাম। এখানে মোট আটজন আছে। পাঁচটা ছেলে তিনটা মেয়ে আমাদের নিয়ে দশ জন। এক টেবিলে তো হবেই না দুই টেবিলের না তিন টেবিলের চেয়ার এনে উল্টা পাল্টা করে সবাই ফ্লাপ করে বসেছে।
জিসান নামের ছেলেটা বলে উঠলো, ‘ এটা কি হলো। স্পর্শ তুই না বললি আমাদের আগেই চিনিয়ে দিয়েছিস। তাহলে এখন আবার চিনালি কেন?’

স্পর্শ বলল, ‘ আগে চিনিয়ে আনতে চেয়েছিলাম কিন্তু তার আগেই তো তোদের চিল্লাচিল্লি। তাই আর তা করা হলো না। ‘
‘ ও আচ্ছা। ভাবি কেমন আছেন?’
‘ আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনারা কেমন আছেন ভাইয়া, আপু?’
সবাই এক সাথে বলল, ভালো আছি। শুধু ওই ঐশি কিছু বললো না। সে নিজের ফোনের দিকে তাকিয়ে ফোন টিপে যাচ্ছে কানে তার ইয়ারফোন।
আমি ও তাকে আর তেমন লক্ষ করলাম না ঐদিন স্পর্শ এর সাথে দেখেছিলাম বলে আজ একটু বেশি লক্ষ্য করেছি কিন্তু আজ স্পর্শের দিক থেকে তেমন কিছু পেলাম না। স্পর্শ সবার সাথেই একভাবে কথা বলেছে। সবাই তার দিক থেকে যে ফ্রেন্ড সেটা বুঝতে অসুবিধা হলো না। এদের ভেতর যায়‌ই থেকে থাকুক। সবাই খাওয়ার জন্য পাগল করলো আমি আর স্পর্শ কেবল খেয়ে এসেছি তাই আমরা খেলাম না অনেক জোড়া জোড়ি করে তাদের মানানো গেল। বাপরে আমার এই ভরা পেটে আবার খাইয়ে না মারার দশা করে ফেলছিল। আমি আর স্পর্শ কোল্ড কফি নিয়ে বসে আছি আর সবাই খাওয়া-দাওয়া করছো। সেখান থেকে আমরা বেরিয়ে এলাম দেখলাম কেউ বিল দিল না সবার জন্য এইটা ছিল বিয়ে ট্রিট। স্পর্শ দিল বিল।

সেখান থেকে সবাই আমরা এলাম একটা জায়গায়
এখানে নাকি তারা কলেজ লাইফ থাকতে অনেক এসেছে বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিয়েছি। তাদের জন্য জায়গাটা স্পেশাল। সেই স্পেশাল জায়গায় আমাকে ও নিয়ে আসলো। জায়গাটা মোটামুটি সুন্দর একটা ছোট নদী আছে। সেখানে একটি নৌকা বাঁধা যে নৌকায় চড়ে ঘুরলাম আমরা। নৌকায় উঠার পরে সেখান থেকে এক বন্ধু গলা ছেড়ে গান গাইতে লাগল। খুব সুন্দর কন্ঠ তার। সেই গান গাইলো তখন গানের মাঝখানে গান থামিয়ে বলল,
‘ দোস্ত তাদের প্রেমকাহিনী কিছুই তো আমরা না দেখি নাই। তুই এই ছোট ভাবীকে পাগলের মতন ভালবাসতি সেটা জানতাম। কখনো তোদের ফোনেও কথা বলতে দেখি নাই। ভালো তো অনেক দিন থেকে বাসিস। কিন্তু কখনো ভাবি কে আমাদের দেখাস নি সাক্ষাৎ করাস নি। আজ একেবারে বিয়ে করে দেখাতে নিয়ে এসেছি। বিয়ের দাওয়াত ও দেস নি‌। আমরা সবাই তোর উপর অনেক রেগে আছি। কি বলিস তোরা ঠিক না?’

সবাই তখন হই হই করে উঠলো যে সবাই রেগে আছে।
তিনি আবার বলে উঠলো, ‘ আমাদের রাগ কমাতে চাইলে এখন এই মুহূর্তে আমাদের সবার সামনে তুই ভাবীকে প্রপোজ করবি। নিজের মনের অনুভূতি প্রকাশ করবে নির্দ্বিধায় সব বলবি তারপর বিয়ের প্রপোজাল দিবি যেহেতু তোদের বিয়ে আরেকবার হবে অনুষ্ঠান করে।’
স্পর্শ অবাক গলায় বলল, ‘হোয়াট? ইম্পসিবল! আমি তোদের বিয়ের ট্রিট দিয়েছি। আর সেই বিয়েটা কিছুই হয়নি তুই যদি আমাদের বিয়েতে আসতি না খেয়েই যেতে হতো। হুট করেই ঘটনাটা ঘটেছে সেটা তোরা খুব ভালো করে জানিস। এখন আমাকে ফাসাতে পারিস না! আবার নেক্সট বার তো তোরা সবাই আসবি আনন্দ-ফূর্তি করবি।’
‘নো এক্সকিউজ দোস্ত! তোকে আমাদের কথা রাখতেই হবে। তুই তোর কোন কথা আমাদের বলিস না। শুধু একজনকে ভালোবাসি সেটা বলেছিস। আর আমরা আমাদের গার্লফ্রেন্ড কে কতো বার ভালোবাসি বলেছি, কতোবার কিস, হাত করেছি , সব তোকে বলেছি কিন্তু তুই। আজ তোকে ভাবিকে আমাদের সামনে প্রপোজ করতেই হবে। এটা তো আর তোর গার্লফ্রেন্ড না ব‌উ তাই এতো সংকোচ করছিস কেন?’

সবার মধ্যে স্পর্শ পরেছে বেকায়দায়। আমি মিটিমিটি হাসছি পাশে দাঁড়িয়ে।স্পর্শ ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো তারপর রাজি হলো সবার কথায়। রাজি না হয়ে ও উপায় ছিল না তার।
যে ভাবে চেপে ধরেছে রাজি না হয়ে যাবে কোথায়।
প্রপোজ করতে তো ফুল লাগবে এখন ওরা সবাই ফুলের সন্ধান করছে। পুকুরের একপাশে লাল পদ্ম ফুল দেখা যাচ্ছে দূর থেকে নৌকা নিয়ে সেখানে চলে এলো‌ সবাই। স্পর্শের হাতের ফুলটা দিয়ে বলল,
‘নে শুরু কর এবার!’
এতো গুলো মানুষের সামনে আমাকে প্রপোজ করবে ভাবতে আমার লজ্জা লাগছে কিন্তু তবুও আমি খুশি। খুব খুশি!
স্পর্শ দাঁড়িয়ে থেকেই আমার দিকে ফুল বাড়িয়ে দিলো কিন্তু মুখে কিছু বললো না। আমি বিরক্তকর মুখে তাকিয়ে আছি স্পর্শের দিকে কোথায় হাঁটু মুড়ে বসবে তা না দাঁড়িয়ে। আর একটা কেমন প্রপোজ করা ভালোবাসি তো কিছুই তো বললে না।
‘ কি হলো ফুলটা নাও।’

স্পর্শের বন্ধুরা আমাদের দিকে ক্যামেরা সেট করে দাঁড়িয়ে আছে কারণ তারা বন্ধুর প্রপোজ করা ভিডিও করবে, ছবি তুলবে। কিন্তু স্পর্শের কান্ড কারখানা দেখে ক্যামেরা রেখে স্পর্শের কানে কানে কি যেন বলে চোখ রাঙাতে রাঙাতে চলে গেল একজন। তার নাম নাদিম ভাইয়া। আমি গাল ফুলিয়ে তাকিয়ে আছি স্পর্শের দিকে। স্পর্শ আমার সামনে হাঁটু মুড়ে বসলো। আমি তাকিয়ে আছি। তারপর ওই লাল পদ্মফুল টা দিয়েই প্রথম কোন প্রেমিক মনে হয় প্রেমিকাকে প্রপোজ করল।
স্পর্শ বেশি কিছু বললো না কয়েকটা কথা বললো তাতেই আমার মেরুদন্ড বইয়ের শীতল হাওয়া বয়ে গেল। হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। অসীম ভালোবাসা আমি তার দুই কথায় অনুভব করতে পারলাম।

চড়ুইপাখির অভিমান পর্ব ২১

‘ আমার জীবনে যদি ভালোবাসার সংজ্ঞা আসে তাহলে সেই ভালোবাসার প্রতীক তুমি। আমি পাগলের মতো ভালোবাসা দেখিনি। বুঝি না, জানি না। কিন্তু তোমার প্রতি আমার ভালোবাসার কোনো শেষ নাই আছে‌, আছে শুরু আমি বার বার তোমার প্রেমে পড়তে চাই, ভালোবাসতে চাই শেষ নিঃশ্বাস অবধি।’

চড়ুইপাখির অভিমান পর্ব ২৩