সায়েবা আসক্তি পর্ব ৩১

সায়েবা আসক্তি পর্ব ৩১
লেখিকা সানজিদা বিনতে সফি

ফিনাইলের গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসছে সায়েবার। তার উপর এই থমথমে পরিবেশ আরো বেশি উদগ্রীব করে তুলছে তাকে।ভয়ার্ত চোখে আদিবের দিকে তাকিয়ে আছে সায়েবা।যে এই মুহুর্তে তার মায়ের সামনে হাটু গেরে বসে আছে। তখন থেকে একটা কথা ও বলে নি আদিব। আদিবের নিস্তব্ধতায় ভয়ের সঞ্চার হচ্ছে আফরিন বেগমের মনে।
— বুঝ হওয়ার পর থেকে ফায়জা কে ভালোবাসি আমি। যাকে বলে চোখে হারানো ভালোবাসা।

এস এস সি পরিক্ষার পরে ফায়জা কে নানান ভাবে বোঝাতে চেয়েছি আমার ভালোবাসার কথা। তখন সে মেডিকেল এডমিশনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমার সমস্ত চেষ্টা যখন ব্যার্থ হলো তখন তাকে জ্বালাতে শুরু করলাম।সে হয়তো বুঝতে পেরেছিলো আমার মনে কি চলছে!তাই পড়াশোনার নাম করে আমেরিকা চলে গেলো। তুমি জানো আম্মু ফায়জা কে আমি কতটা ভালোবাসি?যতটা ভালোবাসলে তাকে ছাড়া আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে ঠিক ততটা।যেমন এই মুহুর্তে তাকে ছাড়া আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।তার কোন দোষ নেই আম্মু।তোমার ছেলে তার পিছনে পরে ছিলো।সে নয় তোমার ছেলে তাকে ভালোবাসার জালে ফাসাতে চেয়েছে।বার বার বারণ করা সত্ত্বেও রাস্তার কুকুরের মতো তার পেছনে পরে আছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

এই যে আজ সে এভাবে মৃত্যুর দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে! সেটাও তোমার ছেলের জন্য। এই তোমাদের কথার ভয়ে সে বিয়ে করে আমার থেকে দূরে যেতে চেয়েছিল। ও আমাকে ভালোবাসে আম্মু। আমি জানি।তবুও দূরত্ব মেনে নিয়েছিলো। কিন্তু আমি তাকে হারানোর কথা চিন্তা ও করতে পারি না। আমার বুকে ব্যাথা শুরু হয়ে যায়। যদি বলো কাওকে ছাড়া কেউ মরে যায় না তাহলে সেটা কারোর ক্ষেত্রে ঠিক। এই আদিবের ক্ষেত্রে নয়।আমি তাকে ছাড়া মরে যাবো। তাকে ছাড়া বাচা তো অনেক দূর।সে আমার নয় এটা ভাবলেই আমি মরে যাবো। তুমি আমার মা।আমাকে এই পৃথিবীর আলো দেখিয়েছো।আমি তোমাকে ত্যাগ করতে পারবো না। কিন্তু আজ থেকে তুমি তোমার ছেলে কে হারালে। যে তোমাকে খুব ভালোবাসতো।এখন থেকে যাকে তুমি পাবে সে শুধু একজন মানুষ। যার তোমার উপর দায়িত্ব আছে।সে শুধু তার দায়িত্ব পালন করবে। আমি জানি না এর পরেও ফায়জা আমার হবে কি না?তবে আমি সারাজীবন তাকে চেয়ে যাবো। আমি কথা দিয়েছি তাকে।একবার সুস্থ হয়ে গেলে আমি আর তার সামনে যাবো না। আর সেটা এখানে থাকলে সম্ভব না। আব্বু,,,(ফরিদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে)

ফরিদ সাহেব অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে আছে ছেলের দিকে।
— আমি কানাডা যেতে চাই।এখন থেকে ওখানকার বিজনেস আমিই দেখবো।
— ঝোকের মাথায় কোন সিদ্ধান্ত নিস না আদিব।আমি কথা বলবো ফায়জার সাথে।অন্য কারো ভুলের শাস্তি তুই কেন পাবি?ফায়জার বিয়ে তোর সাথেই হবে।আমি সানোয়ার আর ফারহানার সাথে কথা বলবো। ফায়জা কে একবার সুস্থ হতে দে।যে অপরাধ করেছে সে তার অপরাধের শাস্তি পাবে।আর যদি তুই দেশ ছাড়ার কথা চিন্তা ও করিস তাহলে তোর মায়ের সাথে ও আমার আর সংসার করা হবে না। অনেক ছাড় দিয়েছি আর নয়। দিন দিন তার ঔদ্ধত্য বেড়েই চলেছে। এর একটা বিহিত হওয়া উচিত।

আফরিন বেগমের চোখ লাল হয়ে আছে।বিশ্ববিদ্যালয়ে কান্না করে যাচ্ছে সে।এখন বুঝতে পারছে কতো বড় ভুল করেছে। ফারহান আর ফরহাদ এখনো রেগে আছে। তা তাদের রক্তিম চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু নিজেদের রাগ প্রকাশ করতে পারছে না। যাকে রাগ দেখাবে সে নিজেই তো বিদ্ধস্ত। আদিব অপরাধী চোখে ফারহানের দিকে তাকিয়ে বললো,
— মাফ করে দিস ভাই। আমার ভালোবাসা ওর জীবনে এভাবে কাল হয়ে দাঁড়াবে তা আমি ভাবতেও পারি নি। তোর বোনের এই অবস্থার জন্য আমি দায়ী। যে শাস্তি দিবি তা আমরা মাথা পেতে নিবো।
আদিব মাথা নিচু করে বসে আছে। টপটপ করে চোখ থেকে পানি পরছে ওর।বুকের ভিতর হৃদয় নামক মাংসপিন্ড শত আঘাতে ছিন্নভিন্ন হচ্ছে বারবার। বুকের এই অসহ্য ব্যাথা একটু একটু করে বেড়েই চলেছে। দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো আদিব। সবার চোখ ছলছল করছে।ফরিদ সাহেব আগলে নিলেন ছেলেকে।
হঠাৎ করে থাপ্পড়ের শব্দে সবাই চমকে গেলো।

আফরিন বেগম রাগে ফুসছেন।তার সামনেই গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লিজা।আফরিন বেগম চিৎকার করে বললো,
— মিথ্যা বলেছিস কেন?আমাকে এই দুই বছর ভুল বুঝিয়েছিস কেন বল?
শাহানা বেগম আফরিন বেগমের সামনে থেকে সরিয়ে নিলো লিজা কে। কর্কশ গলায় বললো,
— আপনার সাহসের প্রশংসা না করে পারছি না। আমার মেয়ের গায়ে হাত তুললেন কোন সাহসে?
— সাহস আমার প্রশংসা করার মতোই।আপনার এই কুলাঙ্গার মেয়েকে জিজ্ঞেস করুন কেন তার গায়ে হাত তুলেছি।অসভ্য মেয়ে।মুখ খোল, না হলে তোর এই মুখ আমি ভেঙে দিবো এখন।
আফরিন বেগমের হুংকারে কেপে উঠলো লিজা।মায়ের সাপোর্ট পেয়ে ন্যাকা কান্না শুরু করলো।
— আপনি কি বলছেন আন্টি। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনি আমাদের সবার সাথে অন্যায় করছেন কিন্তু।
আফরিন বেগমের রাগ এবার আকাশ ছুলো। দাত কিড়মিড় করে বললো,
— নাটক করিস হ্যা?নাটক? তোর এই সস্তা নাটক আমার কাছে চলবে না। ভালোয় ভালোয় সত্যি টা বলে দে।নাহলে আজ তোকে খুন করে আমি জেলে যাবো।
সবাই হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফরহাদ এগিয়ে এসে বললো।

— এটা হসপিটাল। ঝামেলা না করে যা বলার পরিস্কার করে বলুন।
— এই মেয়ে দুই বছর আগে ফায়জা যখন দেশে আসে তখন আমার কাছে এসেছিলো। ফায়জার কিছু আপত্তিকর ছবি দেখিয়ে বলে ফায়জা আমেরিকা অনেক ছেলেদের সাথে অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত আছে।আর এখন আদিব কেও ফাসাচ্ছে।আমি প্রথমে বিশ্বাস করি নি। কিন্তু ও অনবরত আমাকে বিভিন্ন ছেলেদের সাথে ফায়জার অশ্লীল ছবি পাঠাতো। একটা সময় আমি ও বিশ্বাস করে নেই।আর এই বিশ্বাসের ফায়দা নিয়ে আমাকে বার বার উস্কে দিচ্ছিল ও।রাগে বোধ জ্ঞান হারিয়ে এমন নিকৃষ্ট কাজ করে ফেলেছি আমি।(কান্না করে)
সবাই বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে লিজার দিকে। ফারহান তো পারলে কাচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলে ওকে।
— মিথ্যা কথা। আমি এসব কিছুই করি নি। কি প্রমাণ আছে আপনার কাছে?আম্মু এই মহিলা আমাকে ফাসাতে চাইছে।
লিজার কুমিরের কান্নায় কারোর মন গললো না।
— প্রমাণ চাই তো?প্রমাণ আছে আমার কাছে।দেখাচ্ছি দাড়া।
সায়েবা এগিয়ে এসে বললো,
— আমাকে দিন মামী।

আফরিন বেগম কয়েকটা ছবি বের করে সায়েবার হাতে দিল।ছবির দিকে তাকিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে সায়েবা।সায়েবার হাত থেকে ফোন একপ্রকার ছিনিয়ে নিলো আদিব। ছবির দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো সাথে সাথে। ফরহাদ আর ফারহান সাহস করলো না সেই ছবি দেখার।হোক নকল।তবুও ফেস তো ফায়জার।শাহানা বেগম অবাক চোখে তাকিয়ে আছে লিজার দিকে।
আদিব নিজের সমস্ত ধৈর্য হারিয়ে ফেললো। সবার সামনে কষিয়ে একনাগাড়ে চ*ড় লাগালো লিজার গালে।তাতে ও শান্তি হলো না ওর।দেয়ালের সাথে ধাক্কা দিয়ে গলা চেপে ধরলো।

— তোকে আজ আমি খু*ন করে ফেলবো। তোর সাহস কিভাবে হলো আমার ফায়জার নামে এসব বলার।নোংরা মেয়ে।
আদিবের চিৎকারে হাসপারালের পরিবেশ থমকে গেছে। ফারহান আর ফরহাদ নির্লিপ্ত ভাবে দাড়িয়ে আছে।সায়েবা হতভম্ব হয়ে ওদের দেখছে।সাবা নীতি কেউ এগিয়ে আসছে না। ফরিদ সাহেব আর শাহানা বেগম টেনে আদিব কে সরাতে পারছে না। লিজার চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে।এভাবে আর কিছুক্ষণ থাকলে সত্যি সত্যিই মরে যাবে।
এতক্ষণ পরে তৃপ্তির হাসি হাসলো ফারহান।চেয়ারে আয়েশ করে বসে সাথে ফরহাদ কেও টেনে বসিয়ে দিলো। আদিবের দিকে তাকিয়ে উৎসাহিত গলায় বললো,

সায়েবা আসক্তি পর্ব ৩০

— মেরে দে।সেটেলমেন্ট আমি করে নিবো।আমার বাবার অনেক টাকা।গলা টিপে মারা হয়ে গেলে এই পাচ তালা থেকে আরো দুই বার ফেলবি।একা না পারলে বলিস।আমি লোকের ব্যবস্থা করে দিবো। হসপিটাল আমাদের, ডাক্তার ও আমাদের।সুইসাইড কেস বলে চালিয়ে দিবো।আই উইটনেস ও আছে।কি বলো শালিকারা?
— প্রেমে ছ্যাকা খেয়ে এভাবে আত্মহত্যা করবে ভাবতে পারিনি দুলাভাই।আহা বেচারি!

সায়েবা আসক্তি পর্ব ৩২