সায়েবা আসক্তি পর্ব ৪১

সায়েবা আসক্তি পর্ব ৪১
লেখিকা সানজিদা বিনতে সফি

গোধুলির আলো ম্লান হয়ে আসছে চারিদিকে। মানুষের সমাগম চোখে পরার মতো। বিভৎস মৃত্যু যেন লোকের উৎসাহ বাড়িয়ে দিয়েছে হাজার গুন।শাহানা বেগম আন্দাজ করতে পেরেছেন শোয়েবের সাথে কে করতে পারে এমন।মেদুর আলো তে ও ঘেমে নেয়ে একাকার সে।ফারহান কি কিছু বুঝতে পেরেছে!সন্দিহান চোখে কয়েকবার পরখ করারা চেষ্টা করলেও কিছু বুঝতে ব্যার্থ হচ্ছেন তিনি।ফারহান কে সে ভালো করে চেনে। বাজপাখির ন্যায় দৃষ্টি এই ছেলের।ফারহান কিছু বোঝে নি এটা ভাবা চরম বোকামি। এখান থেকে বেরুতে ও পারছেন না।সকলের সন্দেহের চোখে পরতে হবে। এবার বুঝি নিজের একমাত্র মেয়েটাকে হারাতে হয়।তার মেয়ে এমন সর্বনাশিনী কিভাবে হলো ভাবতে পারছে না সে।ছোট থেকে অতিরিক্ত ছাড় দেয়ার ফল এখন ভোগ করতে হচ্ছে।

শোয়েবের নিথর দেহ দেখে ভিতর থেকে আর্তনাদ বেড়িয়ে আসতে চাইছে বারবার। এই ছোট ছেলেটার সাথে এতটা নির্দয় কিভাবে হতে পারলো এরা।সাহেরা বেগমের পাগলপ্রায় অবস্থা দেখে একরাশ ভয় জেকে ধরলো মনে।এই রকম একটা দিন তার জীবনে ও আসবে না তো!
জ্ঞান ফেরার পর থেকেই সায়েবা অস্বাভাবিক আচরণ করছে।বারবার শোয়েব কে হাত পা নেড়ে ডেকে চলেছে।সকালে তার অনাগত চ্যাম্প এর জন্য ঘর সাজানোর এতো এতো প্ল্যান করলো তারা।এখন শোয়েব এভাবে পরে থাকলে তো চলবে না।এতো কাজ কি সায়েবা একা করবে নাকি?এই ফাকিবাজ ছেলেকে যেভাবেই হোক কাজে হাত লাগাতে হবে।না হলে মায়ের কাছে বিচার দিয়ে মার খাওয়াবে ও।নিজে তো আর মারতে পারবে না।একমাত্র আদরের ছোট ভাই ওর।মারতে গেলে যে কলিজা ছিড়ে যায়।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— শোয়েব, ভাই আমার।এই দেখ আমি কিন্তু সব কিছু ঠিক করে ফেলেছি।বাবুর জন্য একটা দোলনা ও অর্ডার করে দিয়েছি।এখন এভাবে পরে থাকলে তো চলবে না ভাই।আমি কিন্তু একটা কাজে ও হাত লাগাবো না বলে দিলাম।এভাবে এখানে শুয়ে আছিস কেন? মা যদি দেখে গায়ে এতো কাদা মাটি লাগিয়ে এসেছিস মার একটা ও নিচে পরবে না।তারাতাড়ি গিয়ে ফ্রেশ হ ভাই।
শোয়েবের মুখের র*ক্ত নিজের ওড়না দিয়ে যত্ন করে মুছে দিচ্ছে সায়েবা।থেতলে যাওয়া কপালের কাছে হাত যেতেই সামান্য কেপে উঠলো সায়েবার হাত।অশ্রুশিক্ত চোখে তাকিয়ে আদুরে ভঙ্গিতে বললো,
— এখানে কিভাবে ব্যাথা পেয়েছিস?আবার খেলেতে গিয়ে পড়ে যাসনি তো?ইসস,কতটা লেগেছে।আমার সাথে আয়,আমি ড্রেসিং করে দিচ্ছি।

সায়েবার সাথে বসেই সায়েবার দিকে নিস্পলক ভাবে তাকিয়ে আছে ফারহান।চোখ গুলো রক্তজবার মতো লাল হয়ে আছে।পলকহীন চোখে সায়েবার পাগলামি দেখে যাচ্ছে ফারহান।ইচ্ছে করছে না সায়েবাকে বাস্তবতা বোঝাতে।সে এভাবে খুশি থাক।বাস্তবতা যে বড়ই ক্রুর। সাহেরা বেগম কান্না করতে করতে গলা ভেঙ্গে ফেলেছেন। এখন আর গলা থেকে স্বর বের হচ্ছে না। ঝিঝি পোকার মতো হালকা শব্দ করে কাদছে সে।
শেষ গোসলের প্রস্তুতি শেষ। শোয়েব কে নিতে হবে এখন। সানোয়ার সাহেব এসে ফারহান কে জানালো শোয়েব কে নিয়ে যাওয়ার কথা। এদিকটায় কোন ছেলে মানুষ নেই।বাগানের অপর পাশে সবাই আছে।নীল আর আদিব কে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। ফরহাদ শেরোয়ানি পরেই সব কিছু সামলাচ্ছে। ফারহান এখন কিছু করার অবস্থায় নেই। আগের মতো এক ভাবে বসে আছে।
— উঠো আব্বু।গোসল দিতে হবে ওকে। এভাবে বেশিক্ষণ রাখা যাবে না।সায়েবা মামনী কে সামলাও বাবা।ওর অবস্থা খুব একটা ভালো লাগছে না আমার।
সানোয়ার সাহেবের গলা কেপে কেপে উঠছে।বিয়ে মানেই তার কাছে আতংক মনে হচ্ছে। সব দুর্ঘটনা বিয়ের দিন ঘটছে তাদের সাথে।

ফারহান আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলো সায়েবার দিকে।সে এখনো একমনে শোয়েবের ক্ষত স্থানে আলতো হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। ফারহান কে নিজের কাছাকাছি আসতে দেখে অভিযোগের স্বরে বললো,
— দেখুন না ফারহান,এভাবে চোট পেয়েও এখানে পরে আছে ও।মায়ের ভয়ে বাসায় যেতে চাইছে না।আরে আমি আছি তো,আমি মাকে ঠিক সামলে নিবো।ওকে উঠতে বলুন না।ও আমার কথা শুনছে না কেন?
আস্তে আস্তে সায়েবা উত্তেজিত হয়ে পরছে। অস্থির চোখে কাউকে খুজে চলেছে। ফারহান বুকে আগলে নিলো সায়েবা কে।মাথায় হাত বুলিয়ে ধরা গলায় বলল,

— নিজেকে সামলাও সায়েবা।শোয়েব কে নিয়ে যেতে হবে।ওর শেষ বিদায়ের প্রস্তুতি নিতে হবে তো।সরে এসো এখান থেকে।
সায়েবা এক ঝটকায় সরিয়ে দিলো ফারহান কে। রক্তলাল চোখে চেয়ে কর্কশ গলায় বলল,
— একদম বাজে বকবেন না ফারহান।আমার ভাইয়ের কিছু হয় নি।ও একদম ঠিক আছে। একটু ব্যাথা পেয়েছে এই যা।কেউ আসবে না আমার ভাই এর কাছে।(চিৎকার করে)ছাড় আমাকে ফারহান।আমার ভাইয়ের কষ্ট হচ্ছে। শোয়েব,উঠ ভাই।দেখ এরা তোকে নিয়ে যেতে চাইছে।
সায়েবার চিৎকার করে কান্না ফারহানের বুকে ব্যাথার মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে।

— শোয়েব আর নেই সায়েবা।পাগলামি বন্ধ করো।সামলাও নিজেকে।এভাবে কান্নাকাটি করলে আল্লাহ তায়া’লা নারাজ হবেন।
ফারহানের শক্ত কথার কোন ইফেক্ট পরলো না সায়েবার উপর। শোয়েবের থেতলানো মুখের দিকে তাকিয়ে ছটফট করতে লাগলো। নিজেই নিজের গায়ে আচড় কাটতে লাগলো। সায়েবার পাগলামি দেখে ফারহান ফায়েজা কে ইশারা করলে সে এসে ঘুমের ইঞ্জেকশন পুশ করে দেয় সায়েবা কে।কয়েক মুহুর্তে ঢলে পরে সায়েবা ফারহানের বুকে। সায়েবা কে বুকে আগলে চোখ বুজে ফেললো ফারহান। চোখ থেকে ঝরে পারল দু ফোটা তপ্ত জল।ঘুমন্ত সায়েবার কানে ফিসফিস করে বললো,
— কেউ ছাড় পাবে না বউ।সবাইকে তার হিসেব কড়ায় গন্ডায় বুঝিয়ে দিবে তোমার বর।বিভৎস মৃ*ত্যুর ভয়ে চোখ লুকিয়ে ও এক দন্ড স্বস্তি পাওয়ার সময় দিবো না।বার বার মৃ*ত্যুর জন্য আহাজারি করলেও মৃ*ত্যুর নসিব হবে না তাদের।মানুষ হয়ে জন্মে যারা পশুর মতো আচরণ করেছে তাদের মানুষ হয়ে বাচার কোন অধিকার নেই। প্রতি মুহুর্ত নিজের ভয়ং*কর পরিনতি দেখবে তারা।কথা দিলাম।ফারহান সাদিক তার কথা খুব শীঘ্রই পুরন করবে।

সায়েবা রুমে শুয়িয়ে দিয়ে শোয়েবের শেষ বিদায়ের আয়োজন করতে চলে গেলো ফারহান।সাহেরা বেগম ফারহানা বেগমের বুকে মাথা রেখে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে শোয়েবের খাটিয়ার দিকে।ফায়জা আদিব কে খুজে চলেছে বারবার।পুরো বিষয় টা কারো কাছে পরিস্কার নয়।ফারহান বলেছে শোয়েবের এক্সিডেন হয়েছে।কিন্তু লাশ অন্য কিছু বলছে।একজন ডাক্তার হওয়ার দরুন সে বোঝে কোনটা এক্সিডেন্ট আর কোনটা মা*র্ডার।কেউ মুখ খুলবে না সে জানে।আদিব কিছু খোলসা করে বলবে কিনা তাও সন্দেহ।তবে চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে।শোয়েবের দিকে তাকিয়ে চোখের কোনার পানিটুকু সন্তপর্ণে মুছে ফেললো ফায়েজা।পাশেই নীতি আর সাবা থম মেরে বসে আছে। নীতির গায়ে এখনো ভারি শাড়ী।কান্নার ফলে কাজল লেপ্টে একাকার অবস্থা। সাবা অ বিধ্বস্ত হয়ে বসে। ফায়েজা নীতি আর সাবা কে সায়েবার কাছে পাঠিয়ে দিলো।মেয়েটার একা থাকা ঠিক হবে না।

সায়েবা আসক্তি পর্ব ৪০

ফারহান,ফরহাদ, আদিব আর নীল শোয়েবের খাটিয়া কাধে নিয়ে তাকে তার অন্তিম ঠিকানায় নিয়ে যাচ্ছে। সকালের প্রানবন্ত ছেলেটি কি জানতো সন্ধ্যায় তাকে মাটির নিচে থাকতে হবে।অথচ আমরা কত অবলিলায় মৃ*ত্যু কে ভুলে বসে আছি।হায় আফসোস!
জ্ঞান ফেরার পরে সায়েবা স্তব্ধ হয়ে বসে আছে।পলকহীন চোখে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে।সাবা আর নীতি অনেক কথা বললেও সায়েবা একটা শব্দ ও করে নি।এখন রাত দশ টা। ফারহান শোয়েব কে দাফনের কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরে নি।ফরহাদ ফিরে এলে ও আদিব, ফারহান আর নীল গায়েব।সাহেরা বেগম কে ঘুমের ঔষধ দিয়ে ঘুম পারিয়ে রাখা হয়েছে।সে এখন ঘুমাচ্ছে।
ফারহানের জন্য সবাই টেনশন করলেও ফরহাদ রিলাক্স মুডে আছে এতক্ষণে তার মুখে কিছুটা স্বস্তির আভাস দেখা যাচ্ছে। কাল সকালের সুর্যদয় হয়তো নতুন কিছুর সুচনা নিয়ে আসবে।

সায়েবা আসক্তি শেষ পর্ব