সায়েবা আসক্তি পর্ব ৪০

সায়েবা আসক্তি পর্ব ৪০
লেখিকা সানজিদা বিনতে সফি

শোয়েবের রক্তাক্ত দেহের ছবির নিচে একটা এড্রেস লেখা।সাহেরা বেগম এখনো হাউমাউ করে কেদে যাচ্ছে। ফারহান হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে স্ক্রিনের দিকে।সাহেরা বেগম আর্তনাদ করতে করতে ফ্লোরে বসে পড়েছেন।আকুতি ভরা কন্দনরত গলায় বলল,
— আমার ছেলেকে এনে দাও ফারহান।আমার শোয়েব কে এনে দাও।ওরা আমার ছেলেকে কেন এভাবে রক্তাক্ত করেছে!আমার মানিক কে এনে দাও ফারহান।

সাহেরা বেগমের আহাজারি তে পরিবেশ ভাড়ি হয়ে উঠেছে। সায়েবা তড়িঘড়ি করে বেড়িয়ে এসেছে বাথরুম থেকে। দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে জরিয়ে নিয়েছে সাহেরা বেগম কে।উদ্বিগ্ন গলায় বার বার জিজ্ঞেস করছে কি হয়েছে। সাহেরা বেগম চিৎকার করে কেদে যাচ্ছে। ফারহান অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে সাহেরা বেগম আর সায়েবার দিকে। সায়েবা বিচলিত চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।ফারহান সরাসরি ওয়াশরুমে ঢুকে ওজু করে বেড়িয়ে গেলো রুম থেকে। পিছনে সায়েবা চিৎকার করে ফারহান কে ডাকছে,,
— কি হয়েছে ফারহান?মা কাদছে কেন?আমাকে বলুন প্লিজ। আমার বুক কাপছে।কি হয়েছে মা?আমাকে বলো”
সায়েবার চোখের পানি গড়িয়ে পরছে সাহেরা বেগমের মুখে। সায়েরা বেগম চিৎকার করে কান্না করে বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— ওরা আমার শোয়েব কে মেরে ফেলেছে।আমার মানিক কে কেন মারলো?আমার শোয়েব কে এনে দে সায়েবা।আমার ছেলের কিছু হলে আমি নিজেকে শেষ করে দিবো।
— শোয়েব কোথায় মা?আমার ভাই কোথায়?
সায়েবা চিৎকার করে বলছে সাহেরা বেগম কে।সমস্ত শরীর কাপছে তার।সাহেরা বেগম ইশারায় নিজের ফোন দেখালো সায়েবা কে। সাহেরা বেগম কে ছেড়ে সায়েবা উঠে গেলো ফোন নিতে।ফারহান তাড়াহুড়ায় সাহেরা বেগমের ফোন ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখেই চলে গেছে।

শোয়াবের রক্তাক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে মাথা ঘুড়তে লাগলো সায়েবার। পা টলে উঠলো তার।মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না।কান্না গুলো দলা পাকিয়ে গলায় আটকে গেছে। ফ্লোরে ঢলে পড়তেই সাহেরা বেগম ছুটে গিয়ে আগলে নিলো সায়েবা কে।নিজেকে পাগল পাগল লাগছে তার।বাড়ি তে কেউ নেই।সবাই ফরহাদের বিয়েতে গেছে।পুরো বাড়িতে শুধু তারা দুজন। সাহেরা বেগম সায়েবা কে ডেকে যাচ্ছে বারবার। হন্তদন্ত হয়ে রুমে ঢুকলো ফারহানা বেগম। ফারহান কল করে তাকে সক্ষেপে সব বলেছে।তাই দেড়ি না করে সে বাসায় ফিরেছে। সায়েবা কে অজ্ঞান অবস্থায় দেখে তাকে তারাতাড়ি বেডে তোলার তাড়া দিলো ফারহানা বেগম। ভয় হচ্ছে তার,সায়েবা বা তার অনাগত সন্তানের কিছু হলে ফারহান কে সামলানো যাবে না।শোয়েবের জন্য ই পাগলের মতো হয়ে গেছে ফারহান।সায়েবা কে বেডে তুলে জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করতে লাগলো ফারহানা বেগম।সায়েবার মা এখনো বিলাপ করে কেদে যাচ্ছে।

আদিব আর ফারহান সেই ঠিকানায় পৌঁছে গিয়েছে।আসে পাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। সাহেরা বেগমের ফোনটা ও সাথে নিয়ে আসে নি।
— এখানে তো কেউ নেই ফারহান। ছবিতে কোথায় দেখেছিস।
— বুঝতে পারছি না।এখানেই ছিলো হয়তো। একটু সামনে এগিয়ে দেখি চল।
জনমানবহীন রাস্তায় হেটে চলেছে দুজন। ফারহান অনবরত ঘেমে যাচ্ছে। শোয়েবের কিছু হয়ে গেলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না কখনো। ওর মন বলছে এগুলো লিজার কাজ।তবে লিজা একা এসব করতে পারে নি। নিশ্চয়ই তাকে কেউ হেল্প করছে। পিচঢালা রাস্তার সাথেই লাগোয়া কাচা রাস্তা দেখে সেদিকে এগিয়ে গেলো ফারহান।শোয়েবের দেহ কাচা রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখেছে সে।আল্লাহ কে বারবার ডেকে যাচ্ছে যাতে শোয়েবের দেহে প্রাণ টা অবশিষ্ট থাকে। আল্লাহ সহায় হলে দুনিয়া এক করে ফেলবে শোয়েব কে বাচাতে।

ফারহানের উদ্বেগের মাঝেই আদিব দৌড়ে গেলো একটা ঝোপের সামনে।ওখানেই মুখ থুবড়ে পড়ে আছে শোয়েব।চারিদিকে রক্তের ছড়াছড়ি। আদিব নাকের কাছে হাত নিতেই চেহারা রক্তশূণ্য হয়ে গেলো ওর।নিশ্বাস পড়ছে না।শরীর ঠান্ডা হয়ে শক্ত হয়ে আছে।ফ্যাকাসে চোখে ফারহানের দিকে তাকাতেই ফারহান চোখ বন্ধ করে নিলো।সাথে সাথেই দু ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পারল চোখ থেকে।টলমল পায়ে এসে আকড়ে ধরলো শোয়েবের নিস্তেজ দেহ।আজ সকালে ও কতো হাসিখুশি ছিলো ছেলেটা। ঘন্টা খানেক তারা একসাথে সুইমিংপুলে সাতার কেটেছে।কয়েকঘন্টার মাঝে কি হয়ে গেলো!

পুলিশ এসে যায়গা টা ঘেরাও করে ফেলেছে।ফারহান কে সরিয়ে এনেছে আদিব।তার চোখেও পানি।শোয়েব কে সবাই অসম্ভব ভালোবাসতো।সবে ক্লাস নাইনে উঠেছে ছেলেটা।সায়েবা আর সাহেরা বেগমের কথা চিন্তা করে বুকে চিনচিন ব্যথা হচ্ছে আদিবের।ফারহান এখনো নিস্তেজ হয়ে বসে আছে কিছুটা দূরে।ফরেনসিক টিম সব কিছু তদন্ত করে দেখছে। ফরদাহ শেরোয়ানি পরে দৌড়ে নামলো গাড়ি থেকে। পিছনে সারোয়ার সাহেব আর নীল ও আসছে।বাড়িতে থেকে একের পর এক কল এসে যাচ্ছে। কেউ ফোন তোলার সাহস পাচ্ছে না।ফরহাদ শোয়েবের নিথর শরীরটা দূর থেকে দেখেই থমকে গেলো। সানোয়ার সাহেব আর নীল এগিয়ে গেলো সেদিকে।ফারহানের স্থির দৃষ্টি শোয়েবের রক্তাক্ত মুখের দিকে।খুব ভয়ংকর ভাবে মারা হয়েছে শোয়েব কে।মাথা টা থেতলে দিয়েছে।হাত পা গুলো ভেঙে মুচড়ে দিয়েছে।বুকের ভিতর আঘাতের চিহ্ন গুলো ফারহানের চোখের সামনে স্পষ্ট। সায়েবা কে কি বলবে সে!সাহেরা বেগম কেই বা কি জবাব দিবে?

— ভাই???
ফরহাদ ফারহানের কাধে হাত রাখতেই অশ্রুশিক্ত চোখে তাকালো ফারহান।চোখে ক্রোধের আগুন জ্বালিয়ে তাকিয়ে সে ফরহাদের দিকে।
— আমার সব কয়টা কে চোখের সামনে চাই ভাই।আইন লাগবে না,আদালত লাগবে না, রায় ও লাগবে না।ওদের আমার হাতে যা করার করবো।অনেক ছাড় দেয়া হয়েছে। আর না।
ফারহানের ভয়ংকর শান্ত গলায় ভয় পেয়ে গেলো ফরহাদ।আমেরিকা থেকে আসার পর ফারহান কে এতটা ভয়ংকর হতে কখনো দেখেনি ফরহাদ।ফরহাদ রেগে গেলেও ফারহান থেকেছে শান্ত। সেখানে আজ ফারহানের এই ভয়ংকর রুপ প্রলয় আনবে নিশ্চিত।
— লাশ নিয়ে যেতে হবে স্যার। পোস্টমর্টেম করে কালকের মধ্যে পেয়ে যাবেন আপনারা।
পুলিশের দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে ফারহান। দৃষ্টি শান্ত হলেও তার তীক্ষ্ণতা কাপিয়ে দিচ্ছে পুলিশের বক্ষস্থল।
–এক্সিডেন্ট বলে চালিয়ে দিন অফিসার। কোন পোস্টমর্টেমের প্রয়োজন নেই। আমরা নিয়ে যাচ্ছি ওকে।আপনারা আসতে পারেন।
— কিন্তু স্য,,,
— কিন্তু কিন্তু বাসায় গিয়ে বউয়ের সাথে করবেন অফিসার।আপনার কিন্তু শোনার সময় নেই আমাদের।আপনি থানায় চলে যান।বাকি টা আমরা বুঝে নিচ্ছি।চল ফারহান।

তিন ভাই কে পুলিশ অফিসারের কাছে এক একটা আগুনের গোলা মনে হচ্ছে। কি ভয়ংকর তাদের চাহনি। শোয়েবের বডি নিয়ে বাসার দিকে রওনা হলো ফারহান। তার সাথেই এম্বুল্যান্সে আদিব আর ফরহাদ ও উঠেছে।বাসায় এখনো কিছু জানানো হয় নি।সায়েবা যে এখনো জ্ঞানহীন সেই সম্পর্কে অবগত নয় ফারহান।সবাই একের পর এক কল করেই যাচ্ছে। ফরহাদ বউ বাসায় পৌঁছে দিয়েই এখানে ছুটে চলে এসেছে।ফারহানের গাড়ি আর ফরহাদের গাড়ি নীল আর সানোয়ার সাহেব নিয়ে আসছেন।সানোয়ার সাহেব বিমর্ষ মনে ড্রাইভ করে যাচ্ছেন। তার চোখের কোনে ও পানি ছলছল করছে।নীল একটু পর পর নিজের চুল খামছে ধরে কান্না আটকানোর চেষ্টায়।মনের মধ্যে ভয়েরা বাসা বেধেছে তার।অনিশ্চিত সময়ের কথা চিন্তা করে বুক হাহাকার করে উঠছে। আল্লাহ এতটা ভয়ংকর মৃত্যু শোয়েবের নসিবে দিলেন! হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে বারবার। ঝাপসা চোখে ফারহানদের ফলো করে যাচ্ছে সে।

বাইরে এম্বুল্যান্সের শব্দে কলিজা মুচড়ে উঠল সবার।সাহেরা বেগম শুধু শোয়েবের নাম ধরে বিরবির করে যাচ্ছে। ফারহানা বেগম আন্দাজ করে নিলেন আসন্ন বিপদ। কম্পনরত বক্ষ নিয়ে বারান্দায় গিয়ে নিচে তাকালেন তিনি। সাথে সাথেই দুই পা পিছিয়ে গেলেন। তার অবস্থা দেখে সায়েবা কে রেখে ফায়জা ও এগিয়ে এসেছে।নিচে স্ট্রেচারে করে শোয়েব কে নামাচ্ছে ফারহান আর আদিব।মুখ চেপে ডুকরে কেঁদে উঠলো ফায়জা।সাহেরা বেগম পাগলপ্রায় হয়ে ছুটে আসলেন বারান্দায়। শোয়েবের নিথর দেহখানা দেখে চিৎকার করে বারান্দা থেকে লাফিয়ে পরতে চাইলে তাকে ধরে ফেললো ফায়জা আর ফারহানা বেগম। ছেলের কাছে যাওয়ার জন্য বোধশক্তি হাড়িয়েছেন তিনি।তাদের থেকে বারবার ছাড়িয়ে নিতে চাইছেন নিজেকে,

সায়েবা আসক্তি পর্ব ৩৯

— ছাড়ো আমাকে।আমার ছেলেকে এভাবে শুয়িয়ে রেখেছে কেন? শোয়েব,বাবা আমার।আমি আসছি বাবা।এখুনি তোমাকে হাসপাতাল নিয়ে যাবো। ছাড়ো আমাকে।ওরে কে এভাবে রক্তাক্ত করলো আমার সোনা কে।
সাহেরা বেগমের চিৎকারে আকাশ বাতাস ও ভাড়ি হয়ে উঠেছে। ফারহান বেগম সামলাতে লাগলেন তাকে,
— নিজেকে সামলান আপা।আমি আপনাকে নিচে নিয়ে যাচ্ছি।
— আমার ছেলের কিছু হলে আমি সবকিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিবো।আমার বুকের ধন কে কে এভাবে মেরেছে।সায়েবা, ও সায়েবা উঠ মা।আমার শোয়েব কে নিয়ে এসেছে।
বাগানের পাশেই রাখা হয়েছে শোয়েব কে।তার পাশেই হাত পা ছড়িয়ে বসে আছে ফারহান।সাহেরা বেগম এখনো নিচে আসে নি।নীতি সাবা সহ বাকি সবাই নেমে এসেছে।সবাই কাদছে শোয়েবের জন্য।সায়েবা উঠলে তাকে সামলাবে কি করে তা নিয়ে চিন্তিত নীতি আর সাবা।

সায়েবা আসক্তি পর্ব ৪১