চড়ুইপাখির অভিমান পর্ব ৪

চড়ুইপাখির অভিমান পর্ব ৪
লেখনীতে- নন্দিনী নীলা

পহেলা বৈশাখ উদযাপন করা হবে। প্রতিবছর আমাদের কলেজে নববর্ষের অনেক বড় আয়োজন করা হয়। এ বছর ও সেই নিয়ে কলেজের মাঠে স্টেজ সাজানো হচ্ছে আমরা পাঁচ বান্ধবী ঘুরে ঘুরে তাই দেখছি। ক্লাস আজ হচ্ছে না। অর্ধেক স্টুডেন্ট অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করছে তাই নিয়ে কেউ গান তো কেউ নাচ, কবিতা ইত্যাদি নিয়ে একেক ক্লাসে আলোচনা প্রাকটিস করছে। আমরা পাঁচ বান্ধবী একজন ও কিছুতেই নাই। আমরা শুধু দেখার জন্য। উপভোগ করতে।

আমাদের মধ্যে শুধু এখন একটা আলোচনা হচ্ছে কাল কে কেমন করে সাজবে কি ড্রেস পরবে এই নিয়ে। মিষ্টি তো লাল বৈশাখী শাড়ি পরবে। ও এখন বাকিদের রাজি করাচ্ছে। ধারা, সিনথি রাজি হয়ে গেল। নিঝুম আমতা আমতা করে রাজি হলো। কারণ ওর নাকি লাল শাড়ি নাই ওকে ম্যানেজ করে দিবে মিষ্টি। এখন এই চারজন পরেছে আমার পিছনে আমি তো পরবোই না। এক কান দিয়ে ওদের কথা শুনছি আরেক কান দিয়ে বের করছি।
আমার এমন হেলাফেলা রিয়েক্ট দেখে ওরা চারজন কি যেন নিজেদের ইশারা করে থামলো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আমরা পাঁচ জন স্টেজের কাছে চলে এলাম আমি লুকিয়ে ফুল চুরি করে নিলাম। আমার দেখাদেখি বাকি গুলো ও করলো স্কাইপের নিচে লুকিয়ে ক্লাসে চলে এলাম। সবাই চলে গেছে ক্লাস হবে না বলে। আমাদের পাঁচজনের ব্যাগ পাঁচ সিটে অবহেলায় পরে আছে। আহারে। আমাকে সেই দিনের পর থেকে প্রথম সিটের বসতে হয় ওরা ওদের ব্যাগ নিয়ে আমার পাশে এসে বসলো। আমি গোলাপ ফুল কানে দিয়ে বসে আছি।আর বেশুরা গলায় গান গাইছি‌। ফাকা ক্লাসে মাস্তি করছি আর কি। হঠাৎ আমার চোখ গেল বারান্দায়। একজোড়া চোখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি গান গাইতে গাইতে সিটের উপরে বসে পরেছিলাম। তারাতাড়ি নেমে এলাম। স্পর্শ সাথে সাথে কানে ফোন ধরে চলে গেল অন্য দিকে। আমি হতবিহ্বল হয়ে সেদিকে তাকিয়ে দেখলাম।

পরদিন আমি লাল রঙা গাউন বের করেছি এটা পরেই যাব কলেজে। ওরা যেহেতু শাড়ি লাল পরবে আমিও ওদের সাথে ম্যাচ করে লাল পরবো।
কিন্তু আমার আশায় জল ঠেলে শয়তানি গুলো হাজির আমার বাসায় হয়েছে শাড়ি পরে রেডি হয়ে।
‘ এই তোরা আমার বাসায় আসবি কাল বললি না তো।’
আমি অবাক গলায় নিঝুম, মিষ্টি ,ধারা ও সিনথি ওদের বললাম।‌ বর্তমানে ওরা আমার বাসায় শাড়ি পড়ে বসে আছে।

নিঝুম বলল, ‘ তারাতাড়ি শাড়ি বের কর। দেখ আমার এক রঙের শাড়ি একরকম করে সেজেছি। কতো ভালো লাগছে।‌আমরা যে বেস্ট ফ্রেন্ড আমাদের সাজ দেখেই সবাই বুঝে যাবে। তারাতাড়ি তুই ও শাড়ি পর। নাহলে এই গাউনে কিন্তু তোকে আমাদের দলের লাগবে না।’
‘ তোরা কিন্তু জানিস আমি শাড়ি পরতে পারি না। তাই এটা নিয়ে জোর করবি না।’ আমি বললাম।
মিষ্টি বলল, ‘ এটা হবে না। আমরা পরিয়ে দেব‌ কিচ্ছু হবে না। আমরা আছি না। আমরা সামলাতে পারলে তুই পারবি না কেন। ঠিক পারবি।’
‘ পারবো না। আমি পরবো না।’
নিঝুম চলে গেছে আম্মুর থেকে শাড়ি নিয়ে এলো।

ওদের বলেও আমি নিস্তার পেলাম না। ওরা আমাকে শাড়ি পরিয়ে ক্ষান্ত হলো। এক প্রকার জোর করে ধরেই শাড়ি পরালো। আমি কাঁদো কাঁদো মুখ করে বসে আমি বিছানায়। ওদের মুখে বিশ্ব জয়ের হাসি।
‘ তারাতাড়ি চল দশটার উপরে বাজে। অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে।’ মিষ্টি বলল।
আমি ওকে একটা কিল মেরে বললাম, ‘ আমি যাব না। এই শাড়ি পরে আমি কিছু তেই যাব না।’
নিঝুম বলল, ‘ তোকে যেতেই হবে এতো কষ্ট করে পরিয়েছি এবার নিয়ে তো যাব‌ই।’
‘ তোদের আমি দেখে নেব। ‘
‘ ওকে দেখ এখনি দেখ। তাও এবার চল।’ নিঝুম বলল।
ওদের জন্য আমাকে সাজতে ও হলো। ওদের মতো চুল খোলা ও রাখতে হলো। তারপর কলেজে এসে পৌঁছালাম এগারোটায়।

আম্মু আপু তো আমার খুব প্রশংসা করেছে।
কলেজে আসতেই দেখা হলো আমার চির শত্রু কাব্যের সাথে। কাব্য আমার থেকে এক ইয়ারের সিনিয়র। গত বছর ইন্টার পাশ করেছে। স্যারদের সাথে তার ভালো সম্পর্কের জন্য সব অনুষ্ঠানে এখনো তার আনাগোনা থাকে। আমি কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকে ছেলেটা আমার পেছনে পরেছে। দুই বার প্রপোজ করেছে আমি বলেছি আমি বিয়ে ঠিক আমি এসব প্রেম করবো না কিন্তু ছেলেটা আমার কথা বিশ্বাস ই করে না। কলেজ থেকে চলে যাওয়ায় আমি শান্তি পেয়েছিলাম কিন্তু অনুষ্ঠান হলেই এনার আগমন আবার ঘটে আর আমার পেছনে ঘুরতে থাকে।
আমাদের দেখেই এক প্রকার দৌড়ে এলো আর ঝটপট জিজ্ঞেস করলো, ‘ হাই, তোমরা কেমন আছো সবাই?’
আমি বিরক্তকর চাহনী দিয়ে সরে গেলাম।

নিঝুম ধারা উওর দিল।
কাব্য আমার কাছে এসে আমার পথ আটকে ধরে বলল,
‘ হাই সুন্দরী। এই কোন রুপে আমার সামনে এলে আজ তো আমি পাগল হয়ে যাব তো তোমার রুপে।’
আমি অসহ্য বলে উল্টা ঘুরে হাঁটা দিলাম।
‘ আরে চলে যাচ্ছ কেন যাও পথ আটকাবো না।ভেতরে যাও!”
‘ আপনার মতো ছেচড়া আমি জীবনে দেখি নাই‌। আমি এনগেজড বলার পরো বেহায়ার মতন পেছনে পরে আছেন।’
‘ এটা কে বেহায়াপনা বলে টা সুন্দরী এটাকে ভালোবাসা বলে। তুমি আমার হাত থেকে বাঁচতে মিথ্যার আশ্রয় নাও আমি জানি‌।’
‘ ফালতু লোক।’

কথাটা বলেই সবাইকে নিয়ে চেয়ার টেনে বসলাম। আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে স্পর্শ কে খুঁজছি। অবশেষে তার দেখা পেলাম। আমাদের সব চেয়ে রাগী ম্যাম আফরোজা ম্যাডামের সাথে কি যেন কথা বলছে। আজকে স্পর্শ পাঞ্জাবি পরেছে লাল টকটকে। ভারী চমৎকার লাগছে।
‘ দোস্ত আমার জামাইটারে কি সুন্দর লাগছে রে!’
আমি আবেগ পুলক হয়ে বললাম।
মিষ্টি বলল, ‘ বজ্জাত স্যার সুন্দর হলে কি হবে? তিনি আমাদের জীবন টা ত্যানা ত্যানা করে দিছে।’
‘ ওই শয়তান্নী একদম আমার জামাইরে বকবি না। নয়তো তোর নাকে ঘুসি দিমু।’
মিষ্টি আমারে ভেংচি কাটলো।

ফার্স্ট ইয়ারে একদল নাচ শুরু করলো আমরা সবাই তা দেখতে মগ্ন হয়ে উঠলাম। তখন আমার কানে এলো পেছনে বসা ফার্স্ট ইয়ারে কয়েকটা মেয়ের কথোপথন। তারা স্পর্শ কে নিয়ে কথা বলছে। ওই গুলা নাকি স্পর্শের উপর ক্রাশ খাইছে। স্যার বলে নাকি কিছু করছে না নাহলে প্রপোজ করে বসতো। আরেকজন বলছে স্যার তাতে কি।
আমি কান খাড়া করে নিজের হবু বরকে নিয়ে মেয়েদের কাড়াকাড়ি শুনছি। রাগে গজগজ করতে করতে পেছনে আগুন দৃষ্টিতে তাকালাম। আমার তাকানো দেখেই মেয়েদের আলোচনা সমাপ্তি ঘটেছে। তারা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার রাগে কারণটা তারা বুঝতে পারছে না। আমি নিজের মতো না বুঝিয়ে না বলেই চোখ দিয়ে রাগ ঝাড়লাম।

অনুষ্ঠান চললো সন্ধ্যা পর্যন্ত। শাড়ি পড়ে ঘুরঘুর কম করেছি। তাই ঠিক ছিলাম। আর ওই কাব্য আমার পেছনে সারদিন ঘুরছে। আসার আগে আমার মনে হলো কাধের পিন শরীরে গেঁথে গেছে কারণ আমার কাঁধ ব্যাথা করছে। আমি আর মিষ্টি ছাড়া তিনজন চলে গেছে। মিষ্টি কে নিয়ে ওয়াশ রুমে এসে কাঁধের পিন ঠিক করে লাগালাম। তারপর কুচি আর একটু ঠিক করে নিতে লাগলাম একা একা‌ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। তখন মিষ্টি বাথরুমে গেছে। কমন রুমে আমরা দুজনেই ছিলাম। হঠাৎ একটা পা আমার দিকে আসছে মনে হলো। বাইরে অন্ধকার হয়ে আসছে। তাই আমি আচমকা ভয় পেয়ে যায় তড়িৎ গতিতে পেছনে তাকিয়ে দেখি কাব্য আমি চমকে উঠে বললাম,
‘ একি আপনি এখানে কি করছেন? মেয়েদের কমন রুমে এসেছেন কেন? এটা কেমন ভদ্রতা। বের হোন।’ চেঁচিয়ে উঠলাম।

‘ তোমার ওই বান্ধবী ক‌ই মারিয়া?’
‘ কেন আপনি ওকে দিয়ে কি করবেন?’
‘ কিছুই না ওকে দিয়ে আমার কি কাজ আমার তো তোমাকে দরকার। আজ তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে মারিয়া এতো সুন্দর লাগছে যে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।’
বলতে বলতে কাব্য আমার একদম কাছে চলে এলো। আমি ভয়ে মিষ্টি বলে চিৎকার করে উঠলাম। মিষ্টি সাথে সাথেই বাথরুমে থেকে বেরিয়ে এলো আর কাব্য কে দেখে রেগে গেল। মিষ্টি কে দেখে আমার ভয় কেটে গেল আর সাহস ফিরে এলো।
কাব্য মিষ্টি কে দেখে বলল, ‘ আরে মিষ্টি আমি তো তোমাদের একটা ইমপর্টেন্ট কথা বলতে এসেছি কিন্তু তোমার বান্ধবী তো সব সময় আমাকে দেখলে চেঁচামেচি করতে থাকে। কথা শুনতেই চায় না।’
আমি রেগে বললাম, ‘ একদম মিথ্যা বলবেন না। আপনি কোন খারাপ মতলবে এসেছেন আমি জানি এখন মিষ্টি কে দেখে অন্য সুর গাঁইছেন।’

‘ আমি তোমাকে পছন্দ করি। ভালোবাসি তাই বলে আমি চরিত্র হীন না যে তোমার সাথে খারাপ কিছু করতে আসবো। আমি তোমাদের এটাই বলতে এসেছিলাম। যে মিষ্টির বাবা এক্সিডেন্ট করেছে এই তো এখ‌নি মিষ্টির বাসা থেকে কল এসেছিল অফিসে। মিষ্টি কে তারাতাড়ি বাসায় যেতে বলেছে। তোমাকে প্রথমে আমি মিষ্টির কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম এজন্য ই।’
আমি কিছু ভাবার সময় ই পেলাম না। মিষ্টি ওর বাবার এমন খবর শুনে কেঁদে ফেলেছে আমার হাত ধরে মাঠে এলো। আমি ওকে শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করছি‌। অফিসে গিয়ে সঠিক নাকি খোঁজ নেওয়ার কথাও ভুলে গেছি মিষ্টির কান্না দেখে। আমিও কাঁদছি বান্ধবীর কষ্ট দেখে। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। মিষ্টি আর আমার বাসা দুই দিকে আমি ওর সাথে যেতে চাইছি কিন্তু ও আমাকে বলল,
‘ দোস্ত তুই সাবধানে বাড়ি চলে তা আর আমার বাবার জন্য দোয়া করিস। তোকে আর এই সময়ে যাওয়ার দরকার নাই। কাল যাস আজ বাড়ি চলে যা সবাই চিন্তা করবে।’
মিষ্টি কে গাড়িতে তুলে দিলাম।

আমি একা এবার দাঁড়িয়ে আছি। আরো কয়েকজন স্টুডেন্ট আছে তখন আমি কাব্য কে দেখলাম আমার দিকে কেমন করে জানি তাকিয়ে আছে।আমি অন্য দিকে চোখ দিলাম।
একটা অটো আসতেই উঠে পরলাম কোন দিকে না তাকিয়ে। গাড়িতে যে আমার বিপদ লুকিয়ে আছে একটু খেয়াল ও করলাম না।
অটোতে উঠে সামনে তাকাতেই দেখি কাব্য বসে আছে।
কাব্যকে দেখেই আমার বুক কেঁপে উঠলো। আমি ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলছি থামাচ্ছে না। ড্রাইভার কাব্যর সাথে আছে বুঝতে অসুবিধা হলো না।একটু পর গাড়ি থামল আমি নামতে যাব কাব্য নেমে পেছনে এলো আর টেনে আমাকে ভেতরে নিল আমি চিৎকার করে ওকে বকছি। কাব্য আমাকে ভেতরে নিয়ে দুই হাত শক্ত করে ধরে কাছে টেনে বলল,

চড়ুইপাখির অভিমান পর্ব ৩

‘ মারিয়া জান তোমাকে আমি সেই কবে থেকেই পছন্দ করি তুমি তো জানো। কতো প্রপোজ করলাম। সারা দিলা না। আজ তোমাকে এই শাড়ি পড়া দেখে আমি পাগল হয়ে গেছি। এতো হট লাগছিল তোমাকে। তোমার ওই নরম তুলতুলে পেট যখন দেখলাম আমি উন্মাদ হয়ে গেলাম একবার না ছুঁয়ে দেখলে আমি মরেই যাব। একটু আমার তৃষ্ণা মিটাতে দাও না। আমি তোমাকেই বিয়ে করবো তাই ছুঁতে দিতে ভয় পেয়ে না কেমন জান। লাভ ইউ।’
ওর মুখে এমন বিচ্ছিরি করা শুনে আমার কান গরম হয়ে গেল। রাগে ঘৃণায় শরীর আমার রি রি করে উঠলো। কাব্য ওর মুখ আমার দিকে এগিয়ে আনছে আমি হাত দিয়ে ওকে আটকাতে পারছি না পা তো আছে পা দিয়ে ওকে লাথি মারলাম নিজের সর্ব শক্তি দিয়ে ও গাড়ি থেকে বাইরে পরে গেল। আমি গাড়ি থেকে নামতে যাব তখন ওই শয়তান ড্রাইভার আমার পথ আটকালো।

চড়ুইপাখির অভিমান পর্ব ৫