চিলেকোঠায় সমাপ্তি গল্পের লিঙ্ক || লেখিকাঃ মিহি

চিলেকোঠায় সমাপ্তি পর্ব ১+২
লেখিকাঃ মিহি

-“মিস.চাশমিশ! আপনি বাড়িওয়ালি, ভাড়াটিয়ার ঘরে অনুমতি ছাড়া মাঝরাতে আসছেন। এখন আমি চুমু-টুমু খেয়ে বসলেই তো ধর্ষণের মামলা দিবেন।”
আয়াশ দুষ্টু হাসি দিয়ে কথাটা বললেও পরক্ষণেই সিদ্ধির অগ্নিঝড়া চোখটার নেশায় ডুবে যায়। কিছু মানুষকে রাগলে মারাত্মক লাগে, সিদ্ধি হলো সেই ধরনের। সিদ্ধি রাগান্বিত দৃষ্টিতে আয়াশের দিকে একবার তাকালো, একবার আয়াশের ঘরটার দিকে। আয়াশ ভেবেছিল সিদ্ধি একা এসেছে কিন্তু পরক্ষণেই খেয়াল করলো দরজার ওপাশে সিদ্ধির বাবা সায়ন সাহেবও দাঁড়িয়ে আছেন। যদিও সায়ন সাহেবের সাথে আয়াশের সম্পর্কটা বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ তবুও একটু আগে সিদ্ধিকে বলা কথাটার জন্য লজ্জিত হয় আয়াশ।
-“আয়াশ সাহেব, প্রথম থেকেই আমি আপনাকে এই চিলেকোঠা ঘরটাতে থাকতে দেওয়ার বিরুদ্ধে ছিলাম তবুও থাকতে দেওয়া হয়েছে। তার মানে এই না যে আপনি ছাদে বসে যা ইচ্ছে তাই করবেন।”

-“আমি করেছি-টা কী?”
-“আপনার রুমের জানালার কাছে আমি সিগারেট পেয়েছি। তার চেয়েও বড় কথা আপনি আমার গাছ থেকে ফুল ছিঁড়েছেন।”
-“এসবের কোন প্রমাণ আছে?”
-“আমি স্বচক্ষে দেখেছি।”
-“আমিও স্বচক্ষে আপনাকে সিগারেট খেতে দেখেছি, মিস.চাশমিশ। কিন্তু কাউকে বলিনি কারণ প্রমাণ নেই।”
-“বাবা, তুমি কিছু বলবে না এই লোকটাকে?”
সিদ্ধির কথা শুনে সায়ন সাহেব আমতা আমতা করতে লাগলেন। অনেক দ্বিধা-সংকোচের পর বললেন,” ছোটখাটো ভুল করেছে, মাফ করলাম। পরেরবার কিছু হলে দেখবো।” নিজের বাবার কথা শুনে বেশ রেগে গেলো সিদ্ধি। সে ছেলেটাকে বাড়ি থেকে বের করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে আর তার বাবা কী-না ছেলেটাকে কিছুই বললো না। সায়ন সাহেব হাসতে হাসতে চলে গেলেন।
-“তোমায় আমি বাড়ি থেকে বের করেই ছাড়বো আয়াশ সাহেব।”
কথাটা বলেই আয়াশের দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে গেল সিদ্ধি। আয়াশ হাসলো। মনে মনে বললো,” বাড়ি থেকে বের করতে গিয়ে মনে না ঠায় দিয়ে ফেলেন মিস.চাশমিশ।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ভোরবেলা থেকেই প্রচুর ব্যস্ততা সিদ্ধির। মা মারা গেছেন চার বছর হলো, এই চার বছরে নিজেকে আর বাবাকে নিয়েই তার নতুন জগতের সৃষ্টি। সকালবেলা বাবাকে খাওয়ায়ে নিজে খেয়ে তারপর কলেজে যাওয়া। এখন অবশ্য আয়াশ ছেলেটার জন্যও রান্না করতে হয়। রান্না করতে সিদ্ধির কোন আপত্তি নেই কিন্তু আয়াশ ছেলেটার সবকিছুতে আপত্তি। চায়ে চিনি খাবে না, কফিতে চিনি বেশি, তরকারিতে ঝাল সহ্য হবে না আবার লাউ দিয়ে মিষ্টি তরকারিও খাবে না। সিদ্ধির মাঝেমধ্যে ইচ্ছে হয় আয়াশকে করলা, বেগুন, পটল একসাথে ভেজে বেশি করে ঝাল-লবণ দিয়ে মেখে ভর্তা করে খাওয়াতে। আয়াশ এসব খেতে চায় না। এক মাস হলো বাড়িতে থাকে অথচ ভাবটা এমন যেন যুগ যুগান্তরের সম্পর্ক।

আয়াশ নিচে নামলো। নীলরঙা শার্টটার উপর মেডিকেলের সাদা এপ্রোন। যে ছেলেটা একবছর ডাক্তার হবে, সে কিনা এই সামান্য দোতলা বাড়িতে একঘর নিয়ে থাকছে। ভাবতেই মাঝেসাঝে রহস্য উঁকি দেয় সিদ্ধির মনে তবে পাত্তা দেয়না সে।
-“এই যে চাশমিশ, খাবার দেন তো। লেইট হচ্ছে।”
-“আজব! আমি কি আপনার বউ নাকি? অর্ডার করেন কোন সাহসে? আপনাকে আমি নাস্তা দিবো না। নিজে বানিয়ে খান।”
-“উফ! সিদ্ধি প্লিজ। আমার এক্সাম আছে আজ আর আমি না খেয়ে থাকতে পারিনা। তাড়াতাড়ি দেন।”
-“বাইরে খান যান। টাকার তো অভাব নেই। আমার হাতের রান্না খাওয়ার যোগ্যতা সবার নেই।”
সিদ্ধি যদিও ইয়ার্কি করে বলেছিল তবে কথাটা শোনামাত্র আয়াশ উঠে দাঁড়ালো। কোন কথা না বলেই সোজা বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। একটু পর সায়ন সাহেব নিচে নামলেন। আয়াশের কথা জিজ্ঞাসা করলে সিদ্ধি কিছু বললো না। অফিসে কাজের চাপ থাকায় তাড়াহুড়ো করে তিনিও বেরিয়ে গেলেন। সিদ্ধির আর মন চাইলো না খেতে। কেন যেন তার মন পড়ে আছে সকালবেলা আয়াশকে বলা কথাগুলোর উপর।

কলেজে আর যাওয়া হলো না সিদ্ধির।ঘরদোর পরিষ্কার করে, চিলেকোঠার চারপাশটা পরিষ্কার করলো সে। বেশ অনেকটা সময় ছাদে কাটালো। ঘড়িতে বাজে বারোটা ছাপ্পান্ন অথচ আয়াশ তো বারোটার মধ্যেই বাড়ি চলে আসে। আজ হঠাৎ এত দেরি? দু’টো পেরোয়, আয়াশ আসে না। বাধ্য হয়ে আয়াশের নম্বরে কল দিতে নেয় সিদ্ধি। পরক্ষণেই মনে হয়,”আমার কি বাধ্যবাধকতা যে ওকে কল দিব? যা ইচ্ছে করুক।” অনেকক্ষণ বসে থাকার পর তার আর কোনকিছুতে মন বসে না। আয়াশ বাড়িতে থাকলে দুজনের অকারণে ঝগড়ার কারণে সময়টা বেশ ভালোই কাটে কিন্তু আজ যেন সময় কিছুতেই কাটছে না। আয়াশের অনুপস্থিতি ব্যথিত করছে সিদ্ধির মনকে।

সন্ধ্যের ঠিক আগ মুহূর্তে আয়াশ আসে। আয়াশের সাথে একজন মেয়ে আসে। মেয়েটা আয়াশকে দরজা অবধি ছেড়ে নিজের খেয়াল রাখতে বলেই চলে যায়। মেয়েটাকে দেখে অজ্ঞাত কারণে সিদ্ধির মন খারাপ হয়ে যায়, রাগের মাত্রা তীব্র হয়।
আয়াশ ঘরে ঢুকেই বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। সারাদিন শরীরের উপর দিয়ে যে ঝড় গেছে তা কেবল সে-ই জানে। আয়াশের ইচ্ছে হলো সিদ্ধিকে একটু দেখবে। দরজা খুলেই সেই যে মেয়েটা ঘরে ঢুকেছে আর বেড়োচ্ছেও না। কিন্তু এইমুহূর্তে উঠে সিদ্ধিকে দেখতে যাওয়ার মতো শক্তি পাচ্ছে না আয়াশ।
রাত দশটার পর সায়ন সাহেব আসেন আয়াশের ঘরে। তাকে দেখেই আয়াশ উঠতে ধরলেও ঠিকমতো উঠতে পারে না।
-“আয়াশ, আজ খেতে আসোনি যে?”
-“আ..আমি বাইরে থেকে খেয়ে আসছি আঙ্কেল।”
-“বাড্ডি থেকে আঙ্কেল হয়ে গেছি? কি হলো কি আমার বন্ধুর?”
-“কিছুনা আঙ্কেল। এইতো শরীর খারাপ ছিল।”
-“বুঝিনা ভাবছো? আয়াশ, দেখো, সিদ্ধির কিছুই মনে নেই। ওর উপর রাগ করো না তুমি। ওকে সব মনে করিয়ে দেওয়ার দায়িত্বটা তোমারই বাবা।”

সায়ন সাহেব উঠে যেতেই আয়াশের মুখে হাসি ফুটে উঠে যেন বুকের উপর থেকে পাথর নামলো তার। আসলেই তো সিদ্ধির কিছুই মনে নেই। মনে থাকলে হয়তো সে এমন করতো না। সায়ন সাহেব চলে যাওয়ার মিনিট পাঁচেক পর সিদ্ধি একটা প্লেট হাতে আয়াশের ঘরে ঢুকলো।
-“বাবার মুখে শুনলাম আপনার নাকি শরীর খারাপ?”
-“জ্বী! আসলে না খেয়ে থাকতে পারিনা আর বাইরের খাবার সহ্য হয় না। সেজন্যই খাবার নিয়ে এত বাছাবাছি করি।”
-“কথাটা জানালেই পারতেন। এখানে খাবার আছে, খেয়ে নিয়েন।”
-“আমি তো খেয়ে এসেছি।”
-“বাইরের খাবার নাকি খান না?”
-“বান্ধবীর বাসায় খেয়েছি। তারপর ও আমায় ড্রপ করে গেছে।”
-“খাবার দিছি, খাওয়ার হলে খান নাহলে রেখে দেন।”
বলেই আয়াশের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে সিদ্ধি। “হুহ! বান্ধবীর বাসায় খেয়ে এসেছে! তো রোজ ওখানেই যা, ওখানেই থাক, আমার বাড়িতে কেন?” রাগান্বিত স্বরে কথাটা বলার পর তার মনে হয় সে আসলে রাগ করছে কেন। আয়াশের উপর তো তার কোন অধিকার নেই। যেখানে অধিকারই নেই, সেখানে অভিমানের প্রত্যাশা কেন?

স্কুল লাইফটা তখন শেষের দিকে। হাত বাড়ালেই কলেজের পথ, পা বাড়ালেই চৌকাঠে কদম। তখন কেবলমাত্র পরীক্ষা নামক কেন্দ্রবিন্দুতে আটকে ছিল আয়াশের সামনে এগোনোর পথটা। এরই মধ্যে ঘটে গেলো দুর্ঘটনাটা। আয়াশের জীবনে আগমন ঘটলো দুই বিনুনীওলা, চিকন ফ্রেমের চশমা পড়া এক মেয়ের। আয়াশের জীবন থমকে দাঁড়ালো, থমকে গেল সময়। টেনে পড়া আয়াশ প্রেমে পড়লো এক ফোরের বাচ্চা মেয়ের। মেয়েটার লম্বা চুলের মায়ায় বেঁধে ফেললো সে আয়াশকে। আয়াশ না পারছিল সামনে এগোতে আর না পারছিল পিছনে ফিরতে। হাতে সময় ছিল মাত্র চার মাস। এই চার মাসের মধ্যে পিচ্চিটাকে তার মনের কথা জানাতেই হবে।

আয়াশ চেষ্টা করে বারবার কী করে মেয়েটাকে নিজের মনের কথা জানানো যায়। ব্যর্থ চেষ্টা। ফোরের বাচ্চা কী আর তখন ভালোবাসার অনুভূতি বুঝতে শিখেছে? যে মেয়েটাকে তখনো তার মা আদর করে খাইয়ে দেয়, সে কী করে বুঝবে তার জন্য কোন একজনের নাওয়া-খাওয়া মাথায় উঠেছে। দিন যত যেতে লাগলো, ততই পিচ্চিটার প্রতি আয়াশের অনুভূতি প্রখর হতে লাগলো। প্রথম দেখায় সেই ভালোবাসার অনুভূতিটা কয়েকগুণ হয়ে ধরা দিতে থাকলো আয়াশের মনে। এই অনুভূতির শিকলে জড়িয়ে ছাত্রজীবনের প্রথম বড় ধরনের ভুলটা করে ফেলল আয়াশ। সকলকে লুকিয়ে ঐ পিচ্চির জন্য জমানো নিজের অনুভূতিগুলো লিপিবদ্ধ করলো কিন্তু সুযোগ হচ্ছিল না চিরকুটটা মেয়েটাকে দেওয়ার। একদিন সুযোগ বুঝে মেয়েটার পিছু নিল সে। কিছুদূর যেতেই মেয়েটাকে ডাকলো। পিচ্চি মেয়েটা আয়াশের ডাক শুনে পিছু ফিরতেই আয়াশ চিরকুটটা মেয়েটার হাতে দিয়ে দৌড়ে চলে গেল। আয়াশ ধরেই নিয়েছিল সে তার মনের কথাটা নিরাপদে জানাতে পেরেছে মেয়েটাকে কিন্তু নাহ! মেয়েটার হাতে আয়াশের এই চিরকুট ধরিয়ে দেওয়ার প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী ছিল আরেকজন ব্যক্তি, আয়াশের বাবা স্কুলমাস্টার রফিকউদ্দিন।

রফিকউদ্দিন সাহেব আয়াশের গালে সজোরে থাপ্পড় বসিয়ে বললেন,”তোর লজ্জা করলো না ক্লাস ফোরের একটা বাচ্চা মেয়েকে উত্যক্ত করতে?” আয়াশ কিছুই বললো না। বলার মতো মুখ নেই তার। আসলেই তো সে ভুল করে ফেলেছে। তার উচিত ছিল ধৈর্য ধরে উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষা করা।

“এই যে ভাড়াটিয়া সাহেব, শুনুন।” সিদ্ধির ডাকে ঘোর কাটলো আয়াশের। মুচকি হেসে বলে উঠলো,”জ্বী বলেন, মিস.বাড়িওয়ালি।” আয়াশের কথা শুনে সিদ্ধির ঠোঁটেও অকারণে হাসি ফুটে উঠলো।
-“কি জন্য ডাকছিলেন বলুন।”
-“আসলে আয়াশ সাহেব, আমি দুঃখিত। খাবারের ক্ষেত্রে বাছবিচার বিষয়টা আমার তেমন পছন্দ না তাই কাল একটু বেশিই রূঢ় ব্যবহার করে ফেলেছিলাম। স্যরি!”
-“হায় আল্লাহ্! এ কী দেখছি আমি? আমি কি স্বপ্ন দেখছি?
-“ঢঙ একটু কম করা যায় না?”
-“আরেকবার বলবেন প্লিজ। আমার না খুব খুশি খুশি লাগছে।”

আয়াশের মুখে বাক্যটা শুনে ভ্রু কুঁচকায় সিদ্ধি। মনে হয় বাক্যটা সে আগেও শুনেছে, খুব সম্ভবত আয়াশের মুখেই শুনেছে কিন্তু সেটা কিভাবে? আয়াশ তো এলোই মাত্র একমাস হলো আর এই একমাসে তো আয়াশ এমন কোন কথাই বলেনি সিদ্ধিকে। বিষয়টা বেশ ভাবাতে থাকে তাকে। সিদ্ধিকে অন্যমনস্ক দেখে আয়াশের মাথায় দুষ্টুমি ভর করে। সিদ্ধির চুল ধরে টান দেয় আয়াশ। সামান্য ব্যথা পেয়ে সিদ্ধির ঘোর কেটে যায়। আয়াশের দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকাতেই আয়াশ সিদ্ধিকে মনে করিয়ে দিল,”তুমি কিন্তু স্যরি বলতে এসেছো। তাই তোমার কিন্তু আবার রাগ করা যাবে না।” সিদ্ধি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় এ কথায়।
-“তাহলে তুমি আর আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করবে না?”

-“চেষ্টা তো চলবেই। তোমায় তিনমাসের মধ্যে আমি বাড়ি থেকে বের করেই ছাড়বো।”
-“বেট?”
-“জিতলে কী দিবেন?”
-“তুমি জিতলে আমি আর কোনদিন তোমায় মুখ দেখাবো না। আর আমি জিতলে?”
-“কি চান বলেন।”
-“একটা সন্ধ্যে, আমার সঙ্গে, এককাপ কফি উইথ সুগার।”
-“আমি কফি খাইনা।”
-“ট্রাই তো করতেই পারেন মিস.চাশমিশ।”
-“জিতে দেখান আগে।”
মুচকি হেসে চলে গেলে সিদ্ধি। আয়াশ আনমনে চুলে হাত ঘুরাতে ঘুরাতে হাসতে লাগলো। রাতের আকাশ, তারায় ভরপুর। সিদ্ধির পায়ের নূপুরের শব্দ ধীরে ধীরে মৃদু হচ্ছে। সে শব্দের মাদকতায় নিজেকে বিলীন হতে দেখছে আয়াশ। জীবনের সবটুকু প্রশান্তি বুঝি ঐ মেয়েটার বাহুডোরেই আবদ্ধ।

রফিকউদ্দিন সাহেব বিজ্ঞ স্কুলমাস্টার। তিনি জানেন চাইলেই আয়াশের মন থেকে এখন মেয়েটাকে বের করা সম্ভব না। উল্টো মেয়েটার জন্য আয়াশের ভবিষ্যতে প্রভাব পড়বে। এর চেয়ে না-হয় ওদের সম্পর্কটাকে হালাল করা হোক। তিনি মেয়ের বাবার সাথে কথা বলতে গেলেন। সায়ন সাহেব প্রথম প্রথম বেশ কটাক্ষভাবেই রফিকউদ্দিন সাহেবকে মানা করলেও রফিকউদ্দিন সাহেব তাদের বিষয়টা বোঝায়। অতঃপর সায়ন সাহেব এবং তার স্ত্রী সুবহা বেগম ঠিক করেন আয়াশের সাথেই সিদ্ধির বিয়ে দেওয়া হবে। রফিকউদ্দিন সাহেব কাবিন করিয়ে রাখতে চান কিন্তু ঐটুকু বয়সে একটা ফোরের বাচ্চা মেয়ের বিয়ের কাবিন করানো সহজ কথা নয়।

বাল্যবিবাহের কেইস তো থাকেই। তাছাড়াও, গ্রামাঞ্চলে সায়ন সাহেবের শত্রুর অভাব নেই। ব্যবসার কারণে বেশ অনেকটাই শত্রু কামিয়ে ফেলেছেন তিনি। অবশেষে অনেকটা লুকিয়ে লুকিয়েই আয়াশ আর সিদ্ধির কাবিন করানো হয়। সিদ্ধি অবশ্য তখন কিছু না বুঝলেও এটুকু বুঝেছিল এই আয়াশ নামক ছেলেটা তাকে ভালোবাসে। বুঝতে বুঝতেই বাকি তিনটা মাস চলে গেল। আয়াশ পরীক্ষা দিল। এডমিশন হলো ঢাকার কলেজে। বাবার স্বপ্ন ছেলে ডাক্তার হবে, ঢাকার কলেজে তো পড়তেই হবে। সায়ন সাহেবও আর আপত্তি করেননি। বাঁধ সেধেছিল সিদ্ধি। প্রায় কান্নাই করে ফেলেছিল মেয়েটা। তার কথা একটাই আয়াশ যদি তাকে ভালোবাসে তাহলে কেন রেখে যাচ্ছে। আয়াশ বুঝিয়ে-সুঝিয়ে চুপ করায় সিদ্ধিকে। ফলাফলটা খুব সন্তোষজনক হয় না। পরবর্তী দিনগুলোতে হাসি-খুশি সিদ্ধি মূর্ছে যায় যেন সে একটা প্রিয় খেলার সঙ্গী হারিয়ে ফেলেছে। আয়াশ সময় পেলেই সিদ্ধির সাথে কথা বলে কিন্তু সামনে সিদ্ধিরও বোর্ড পরীক্ষা। পরিবারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কথাবার্তা কমিয়ে আনা হয়। দূরে বসে সিদ্ধির জন্য জমানো অনুভূতি আকাশের বুকে জড়িয়ে রাখে আয়াশ। আ এ প্রান্তে বসে বইয়ের পৃষ্ঠাগুলোয় নিজের আর আয়াশের নামে ভরে ফেলে সিদ্ধি। যে মেয়েটা একবছর আগেও ভালোবাসার মানে বুঝতো না, সেও এখন একজনকে ভালোবাসে এবং যাকে ভালোবাসে সে ব্যক্তিটা একান্তই তার। ভাবতেই লজ্জায় লাল হয়ে উঠে সিদ্ধির গালদুটো।

আযানের ধ্বনি শুনতেই আয়াশ কল্পনা থেকে বাস্তবে ফেরে। সে এখনো ছাদের এককোণে দাঁড়িয়ে। অতীতের স্মৃতিচারণ করতে করতে ভোর হয়ে গেছে। একেবারে নামায পড়ে সামান্য পড়াশোনা করে ঘুমোতে যায় আয়াশ।
সকাল দশটা পেরোয়। আয়াশকে ঘর থেকে বেরোতে না দেখে ভ্রু কুঁচকায় সিদ্ধি। পরক্ষণেই তার মনে পড়ে আয়াশকে বাড়ি থেকে বের করার বাজি ধরেছে সে। কী করা যায়, কী করা যায় ভাবতে ভাবতে সিদ্ধির মাথায় একটা শয়তানি বুদ্ধি আসে। সিদ্ধি পাশের দোকান থেকে একটা কাঁচের বোতল নিয়ে আসে। বোতলের শেইপটা অনেকটা মদের বোতলের মতো। বোতলটা বাসায় এনে বোতলে শরবত ঢালে, তারপর বোলটাতে টাইগার ড্রিংক মেশায় স্মেল আনার জন্য। কিছুক্ষণ ঝাঁকানোর পর সিদ্ধির ঠোঁটে ফুটে উঠে শয়তানি হাসি। সায়ন সাহেব মদ জিনিসটা দু’চক্ষে সহ্য করতে পারেন না। একবার কলেজ ফাংশনে সায়ন সাহেবকে শরবতের গ্লাসে মদ মিশিয়ে খাওয়ানোর জন্য তিনি দীর্ঘ আট বছরের বন্ধুত্ব ভেঙেছেন। মদ জিনিসটা তিনি মাত্রাতিরিক্ত ঘৃণা করেন আর এবার যদি তিনি আয়াশের ঘরে মদের বোতল পান, তাহলে তিনি নিশ্চিতরূপে আয়াশকে বাড়ি থেকে বের করেই ছাড়বেন। কথাটা ভাবতে ভাবতেই সিদ্ধির ঠোঁটে আবারো আগের শয়তানি হাসিটা ফুটে উঠে।

ঘুম ভাঙতেই আয়াশ লক্ষ করে বেলা হয়েছে অনেক। প্রায় বারোটা নাগাদ বাজে। ঘুম থেকে উঠে গোসল করে সিদ্ধিকে খুঁজতে থাকে সে। পরক্ষণে মনে পড়ে সিদ্ধি বোধহয় কলেজে। আয়াশের খুব ইচ্ছে করে সিদ্ধিকে একনজর দেখতে যাবে কিন্তু সাহস হয়ে উঠে না। মেয়েটা যে গুণ্ডী হয়ে উঠেছে এখন। আগে কী সুন্দর লজ্জা পেত, লজ্জায় লাল হত গালদুটো। আর এখন? এখন খালি দিনরাত গুণ্ডাগিরি, মারপিট আর রাগ? সে তো সারাটাক্ষণ নাকের ডগায়। আয়াশ বুঝে উঠতে পারেনা নম্র-ভদ্র-সরল মেয়েটার হঠাৎ এমন পরিবর্তন কী করে হলো? সায়ন সাহেব হয়তো প্রতিবাদী মনোভাবটা শিখিয়েছেন কিন্তু নাকের ডগায় রাগ নিয়ে ঘুরে বেড়ানোটা যেন সিদ্ধির চরিত্রের বিপরীত।

কলেজে মন বসছে না সিদ্ধির। বাড়িতে আজ একটা বড়সড় ঝড় উঠবে ভাবতেই তার মধ্যে রোমাঞ্চ ভর করছে। একা একাই হাসছে সে। পাশ থেকে তানভী ফিসফিস করে বলে উঠলো,”এই কীরে! তুই হাসছিস কেন একা একা? জ্বীন ধরলো নাকি?” ব্যস! ঘটে গেল গণ্ডগোল। সিদ্ধিকে দুচোখে সহ্য করতে না পারা প্রফেসর রাহী চক ছুঁড়ে মারলো ওদের দিকে।
-“গেট লস্ট!”
-“কিন্তু ম্যাম আমরা গল্প করছিলাম না।”
-“তোমার পুরো গ্রুপটাকে নিয়ে ক্লাস ছেড়ে বের হও।”

অযথা তর্ক করে না সিদ্ধি। গ্রুপের সবাই বের হয় ক্লাস থেকে। অয়ন, তানভী, শ্রুতি, শ্রাবণ আর সিদ্ধি। গ্রুপে তিনজন মেয়ে, দুজন ছেলে। শ্রুতি মেয়েটা অনেকটা শান্ত স্বভাবের, তানভী চঞ্চল আর উশৃঙ্খলতা তার রগে রগে বিরাজমান। অয়ন পড়াশোনায় বেশ ভালো, সুদর্শনও। গ্রুপের সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং বান্দা হলো শ্রাবণ। তিনি এত গুরুত্বপূর্ণ হয়েছেন কেবলমাত্র ভুল সময়ে ভুলভাল প্রবাদবাক্য ব্যবহারের কারণে অথচ তার স্বপ্ন কিনা ভবিষ্যতে তিনি এসব প্রবাদ ব্যাকরণে সংযুক্ত করবেন।

-“এই তানভীর বাচ্চার জন্য এখন এই রোদে বসে থাকা লাগবে।”
-“আমি কী করছি?”
-“কিছুই করো নাই তুমি, চুপ থাক শালা।”
সিদ্ধির রাগে গা জ্বলছে। এমন সময় শ্রাবণ বলে উঠলো,” আরে সমস্যা নাই তো। একে মিলে করি কাজ, দশে মিলে ভুলি লাজ।” সিদ্ধি রাগে কটমট করতে করতে শ্রাবণের দিকে তাকালো। ভয় পেয়ে বেচারা চুপ হয়ে গেল। আচমকা তানভীর চোখ পড়লো কলেজ গেটের দিকে। হা করে সেদিকে তাকিয়ে রইল সে। শ্রুতি আর সিদ্ধির সামনে হাত ইশারা করে বলল,”দেখ দেখ, ছেলেটা কী সুন্দর! আহা, আমার স্বপ্নের রাজকুমার পেয়ে গেছি। এই তোরা সর তো।” তানভীর ইশারা অনুযায়ী সামনে তাকাতেই গেটে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটাকে দেখে আঁতকে উঠে সিদ্ধি।

চিলেকোঠায় সমাপ্তি পর্ব ৩+৪