চিলেকোঠায় সমাপ্তি পর্ব ৩+৪ || লেখিকা মিহি

চিলেকোঠায় সমাপ্তি পর্ব ৩+৪
লেখিকা- মিহি

-“আমাকে ঐখান থেকে ডেকে আনার মানে কী? আপনি কি বুঝতে পারছেন যে ওরা আমাদের গার্লফ্রেন্ড-বয়ফ্রেন্ড ভাবছে?”
-“ভাবলে ক্ষতি কি মিস.চাশমিশ?”
-“আপনার স্পর্ধা দেখে আমি অবাক হচ্ছি। আপনার সাহস কী করে হয় আমার সাথে পাবলিক প্লেসে ফাজলামি করার।”
-“এখানে বিশ মিটার দূরত্বেও কেউ নেই, পাবলিক প্লেস তো দূরের কথা। আসলে বাসায় দম বন্ধ হয়ে আসছিল। ভাবলাম আপনার সাথে একটু ঘুরে আসি কোথাও থেকে।”

সিদ্ধির ইচ্ছে করছিল রাগের মাথায় আয়াশকে দু-চারটে কথা শুনিয়ে দিতে কিন্তু সিদ্ধি তা করলো না। সে চেষ্টা করছে আয়াশকে ঠাণ্ডা মাথায় হ্যান্ডেল করতে। সিদ্ধি মুচকি হেসে বললো,”আগামী এক ঘণ্টা এই রোদের মধ্যে এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবেন, বসবেনও না। থাকতে পারলে আপনার সাথে ঘুরতে যাবো।” আয়াশ মাথা নেড়ে সায় দিল।
আয়াশকে রোদের মধ্যে দাঁড় করিয়ে সিদ্ধি নিজের বন্ধুদের কাছে ফেরত এলো। ততক্ষণে রোদের তাপে সবাই ক্যান্টিনে এসে বসেছে। সিদ্ধিকে আসতে দেখেই সবাই চা অর্ডার করে হাত-পা ছেড়ে বসলো। তানভী কিছুটা গোয়েন্দা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সিদ্ধির দিকে। সিদ্ধি বসতেই সে ঝটপট প্রশ্ন করে ফেলে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-“কীরে! ছেলেটা কে? মনে হইতেছে বহুত ভাব তোর লগে। তলে তলে টেম্পু চালাচ্ছো মামা আর আমরা বললেই হরতাল?”
-“জুতা চিনিস তুই? বাটার জুতা দিয়ে পিটাবো তোকে।”
-“আগে বল ঐ ছেলে তোর বয়ফ্রেন্ড কিনা!”
-“ধুর! ঐ আমার বয়ফ্রেন্ড হতে যাবে কেন? আর তাছাড়া ঐ আমাদের বাড়ির নতুন ভাড়াটিয়া।”
-“বলিস কী! ছেলে কী করে রে?”
-“তোর অতো ওকালতি কিসের? চা আসছে, খা চুপচাপ।”

সবাই চুপচাপ চা খেতে থাকলেও সিদ্ধির মনে চলছে অন্যকিছু। সে বুঝতে চাইছে আদৌ কি আয়াশ একঘণ্টা এই ভরদুপুরে রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে। আর যদি থাকেই তাহলে সিদ্ধিকে আয়াশের সাথে ঘুরতে যেতে হবে। ঘুরতে যাওয়াটা ব্যপার নাহ। ঘোরার বাহানায় আয়াশকে আরেকবার ঝামেলায় ফেলতে পারলে সে খুশিই হবে। চা শেষ করে সবাই নিজেদের মধ্যে আড্ডা দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আচমকা ক্যান্টিনে মোটামুটি হৈচৈ পড়ে গেল একটা ছেলে বাইরে রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে কার যেন স্কেচ করছে। প্রথমত ছেলেটা সুদর্শন হওয়ায় মেয়েদের মাঝে কথাটা ছড়াতে সময় লাগেনি। সিদ্ধির কেন যেন মনে হচ্ছিল ছেলেটা আয়াশই। ক্যান্টিন থেকে বের হয়ে বাইরে আসতেই বুঝতে পারলো সে যা ভেবেছিল তাই। সিদ্ধিদের এক ক্লাসমেট ক্যানভাসের দিকে তাকিয়ে আছে বোধহয় সে-ই এনেছিল এটা। আয়াশ একমনে স্কেচ করে যাচ্ছে। স্কেচের কাজ যত এগোচ্ছে, সিদ্ধির মনের ভয় তত বাড়ছে। কোন এক অজানা কারণে বারবার হৃদস্পন্দনের গতি বাড়ছে। আয়াশের থেকে ধ্যান সরাতে তানভী আর শ্রুতির সাথে কথা বলার চেষ্টা করলো সিদ্ধি কিন্তু দুইজনই গভীর মনোযোগ দিয়ে আয়াশের করা স্কেচটা দেখছে। মন-মেজাজ আরো খারাপ হয়ে গেল সিদ্ধির। তানভীকে জোরে একটা ধাক্কা দিয়ে বললো,”এই তোরা আমার বান্ধবী নাকি ওর? কখন থেকে ডাকছি তোদের, জবাব দিসনা ক্যান? চল তো কলেজের ছাদে উঠবো একটু।” তানভী কোনোরকম ইশারায় বললো,”তুই যা।” ব্যস ঐটুকুই! তানভীর মনোযোগ আয়াশের স্কেচটার দিকে। হওয়াটাই স্বাভাবিক কেননা আয়াশ যে স্কেচটা করছে তা যে সিদ্ধির তা নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই সিদ্ধির বন্ধুদের। ওরা শুধু স্কেচটা শেষ হওয়ার অপেক্ষায় আছে যেন সিদ্ধিকে জেরা করতে পারে যে ছেলেটা ওর স্কেচ কেন করলো?

-“দেখো তাহমিদ, জোর করো না আমায়। আমার নিজস্ব কিছু সমস্যা আছে। তোমায় আমি আর কতবার বোঝাবো যে সিদ্ধির সাথে তোমার বিয়েটা হওয়া সম্ভব নয়?”
-“আমি বুঝবো না আঙ্কেল, আপনি যতই বুঝান না কেন। আমি আপনার একমাত্র বেস্টফ্রেন্ডের ছেলে। বিপদে আমার বাবা আপনাকে এত সাহায্য করেছেন, তার এই সামান্য প্রতিদান আপনি দিতে পারছেন না?”
-“তুমি টাকার বদলে আমার মেয়েকে চাচ্ছো? সাহস তো কম না তোমার।”
-“না আঙ্কেল, ভুল বুঝছেন আপনি। আমি সিদ্ধিকে ভালোবাসি।”
-“ও বাসে না।”
-“আমি ওর সাথে কিছুটা সময় কাটালেই ও আমায় ভালোবেসে ফেলবে, আমার দৃঢ় বিশ্বাস।”
-“দেখো তাহমিদ, বোঝার চেষ্টা করো। সিদ্ধির বিয়ে ছোটবেলাতেই হয়ে গেছে।”
-“ঐটা কোন বিয়ে ছিল না আঙ্কেল, ঐটা একটা পুতুলখেলা ছিল যা আপনারা সিদ্ধির সাথে খেলেছেন।”
-“আমি আসছি।”

সায়ন সাহেব আর দাঁড়ালেন না। ভেবেছিলেন বন্ধুর অফিসে চাকরি করলে বন্ধুর সাথে সময়ও কাটানো যাবে, ব্যস্ততার খাতিরে মৃত স্ত্রীর স্মৃতিগুলিও আর তাড়া করে বেড়াবে না কিন্তু বোধহয় সিদ্ধান্তটা ভুল ছিল। বন্ধুর চাকরি করতে গিয়ে তিনি নিজের মেয়ের জীবনটা নষ্টের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। তাহমিদ ছেলে হিসেবে খারাপ না কিন্তু আয়াশের চেয়ে যোগ্য কেউ নয় সিদ্ধির জন্যে কিন্তু তাহমিদকে আয়াশের কথা বললে সে আরো উগ্র হয়ে উঠবে, আয়াশের ক্ষতি করে হলেও সিদ্ধিকে পাওয়ার জন্য মাতোয়ারা হয়ে উঠবে।

-“স্কেচ কেমন লাগলো বললেন না তো মিস.চাশমিশ।”
-“ফালতু! আপনার এই কীর্তিকলাপের জন্য এখন সারা কলেজে রটে যাবে আপনি আমার বয়ফ্রেন্ড আর আমি কিনা এখন আপনার সাথে বসে চা খাচ্ছি। বাহ!”
-“আমার কি দোষ? আপনি বেট হারছেন, ঘুরতে তো হবেই এখন। পরের বেটটাও হারবেন, তারপর কফিও খাবেন আমার সাথে।”
-“জীবনেও না! কফি খাওয়ার জিনিস হলো? আপনিই খান আপনার কফি।”
রাগে গা জ্বলছে সিদ্ধির। কেন যে এই ছেলেকে শর্ত দিতে গেছিল! এখন এই রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা খেতে হচ্ছে তাও এই ছেলের সাথে। চায়ে সমস্যা নেই কিন্তু খেতে হচ্ছে আয়াশের সাথে, এটাই সমস্যা।
দুপুরবেলা আকাশ রোদে ঝকমক করছিল অথচ এখন মেঘে ঢেকে আসছে। ভ্যাপসা গরমের পর বৃষ্টি আসার পূর্বাভাস এই ঘন কালো মেঘ। সিদ্ধির অবশ্য ভালোই লাগছে ঘুরে বেড়াতে। অনেকদিন হলো ঠিকমতো বাড়ি থেকে বেরই হয়নি সে। আয়াশের সঙ্গ এখন আর মোটেও বিরক্ত লাগছেনা তার বরং ভালোই লাগছে। অদ্ভুত রকমের সে ভালোলাগা, চিরতরে ঠায় নেয়না মনে আবার চিরতরে দূরেও ঠেলে দিতে পারেনা।

আয়াশ সামনে হাঁটছে, সিদ্ধি পিছনে। রাস্তায় তেমন গাড়ি নেই। কিছুটা শুনশানও বলা চলে। আচমকা ঝমঝম করে বৃষ্টি নামলো। আয়াশ চটজলদি একটা ছাউনির নিচে দাঁড়ালো। সিদ্ধিকে ডাকলো কিন্তু সে এলো না। বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা স্পর্শে ব্যস্ত সিদ্ধি। আয়াশ মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখলো সেই বাচ্চা মেয়েটাকে। তার পিচ্চিটা এখনো যে আগের মতোই রয়ে গেছে। অন্যমনস্ক হয়ে সিদ্ধিকে দেখতে দেখতে আচমকা আয়াশের মনে পড়ে এই তীব্র বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর হওয়া শতভাগ নিশ্চিত। অনেকটা টেনে-হিঁচড়েই ছাউনির নিচে নিয়ে আসলো সিদ্ধিকে।
-“আজব! গরুর মতো টানছেন কেন আমায়?”
-“গরুর মতো কাজ করলে টানবো না কী করবো? ভিজছেন তো শ্রদ্ধা কাপুরের মতো, জ্বর এলে কোন টাইগার শ্রফ বা অর্জুন কাপুর আসে দেখবোনি।”
-“আপনি একটা….”
-“ভালো মানুষ।”
-“নাহ! আপনি একটা বলদ।”

সিদ্ধির কথা শুনে বিরক্তিসূচক দৃষ্টিতে তাকালো আয়াশ। আয়াশের তাকানো দেখে হো হো করে হাসতে লাগলো সিদ্ধি। এত বছর পর এই প্রথম আয়াশ সিদ্ধিকে মন খুলে হাসতে দেখলো। মেয়েটার সাথে সচরাচর যখনই কথা হয়, মেয়েটা হয় রেগে থাকে নয়তো রাগ করার পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে থাকে অথচ আজ মেয়েটার মাঝে বিন্দুমাত্র রাগ নেই। সমস্ত রাগ-বিষাদ যেন বৃষ্টির ফোঁটায় বিলীন করে নবরূপের আচ্ছাদনে আবৃত এক সিদ্ধিকে দেখছে সে। সিদ্ধির হাসির মুগ্ধতায় ঘোরলাগা দৃষ্টিতে সেদিকে চেয়ে আছে সে। আচমকা সিদ্ধি আয়াশের চোখের সামনে তুড়ি বাজায়।
-“কী মি.? বৃষ্টি তো থামলো, যেতে হবে না?”
-“আপনার জামার যে অবস্থা, ডোন্ট মাইন্ড কিন্তু রাস্তায় এভাবে না ভিজলে হতো না?”
আয়াশের কথা শুনে সিদ্ধি ভ্রু কুঁচকায়। অতঃপর ব্যাগ থেকে একটা চাদর বের করে গায়ে বেশ ভালোভাবে জড়িয়ে নেয়। সিদ্ধির কাণ্ডে হা করে তাকিয়ে আছে আয়াশ।
-“আমার কাছে সবসময় ব্যাকআপ প্ল্যান থাকেই।”
-“এই গরমে চাদর কে রাখে ব্যাগে?”
-“আমি রাখি। কোন সমস্যা?”

আয়াশ মাথা নাড়িয়ে না ইঙ্গিত করে। পরক্ষণেই মনে মনে গালি দেয় সিদ্ধিকে,”তারছিড়া মেয়ে! চাদর রাখছে ব্যাগে! ক্যান ভাই, আমি শার্ট দিতাম, সেটা গায়ে জড়াতি। আহা! কি সুন্দর রোমান্টিক সিন হইত, তা না উনি চাদর গায়ে দিলেন। কেন রাখা লাগবে চাদর? ওহ না! রাখা লাগবে, আমি না থাকতে যদি বৃষ্টিতে ভেজে কিন্তু আমি থাকতে ক্যান?” নিজের কথার জালে নিজেই ভ্যাবাচ্যাকা খায় আয়াশ। সময়টা বেশ ভালোই কাটছিল দুজনের কিন্তু তাদের জীবনে আসতে চলেছে এক অনাকাঙিক্ষত ঝড় যার পূর্বাভাস অবধি নেই তাদের।
বাড়িতে ফিরে সিদ্ধিকে আশেপাশে কোথাও দেখতে পেলেন না সায়ন সাহেব। পরক্ষণেই তার মনে হলো এই সময় তো মেয়েটা কলেজে থাকে, নিশ্চিন্ত হলেন। আজকাল সিদ্ধিকে নিয়ে তার প্রচুর ভয়। ৯ বছর আগের ভয়টা এখনো তাড়া করে বেড়ায় তাকে। আনমনে বসে দিনগুলোর কথা ভাবতে লাগলেন তিনি।

সিদ্ধির বিয়ের পর থেকেই চিন্তার শেষ নেই সায়ন সাহেবের। অতটুকু একটা বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। আশেপাশে কত শত্রু, হুট করে কেউ এসব জেনে গেলে বিপদের অন্ত থাকবে না। আশঙ্কাটা শেষ অবধি সত্যিই হলো সায়ন সাহেবের। ব্যবসায়িক শত্রুতার জের ধরে এক ব্যবসায়ী মাঝরাতে তাকে এবং তার পরিবারকে হত্যা করতে একটা গুণ্ডা পাঠায়। সায়ন সাহেব, তার স্ত্রী এবং সন্তান ছাড়া তখন কেউ নেই বাড়িতে। রফিকউদ্দিন সাহেব মাঝে মাঝেই বেড়াতে আসেন। সেদিনও এসেছিলেন, রাত অনেকটা হয়ে যাওয়ায় সায়ন সাহেব আবদার করেন আজ এ বাড়িতেই থেকে যেত। বেশ অনেকবার বারণ করার পরেও শেষমেশ একমাত্র বিয়াই সাহেবের কথা মেনে নিয়ে তিনি থাকতে রাজি হন। সে রাতটাই ছিল সায়ন সাহেবের জীবনের সবচেয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন রাত। মাঝরাতের দিকে এক গুণ্ডা দরজার ছিটকিনি ভেঙে বেশ সন্তর্পণে ঘরে ঢোকে। রফিকউদ্দিন সাহেব তখন গভীর ঘুমে। প্রধান দরজার পাশের ঘরেই তিনি ঘুমন্ত অবস্থায়।

গুণ্ডাটা সবার প্রথমে তার পেটেই ছুরি চালায়। রান্নাঘরে পানি খেতে আসা ছোট্ট সিদ্ধি দৃশ্যটা দেখে ফেলে। ছুরি নিয়ে ছুটে আসে গুণ্ডাটা। সিদ্ধি হাত-পা ছুঁড়ে গুণ্ডাটার হাত থেকে ছুরি কেড়ে নেয়। গুণ্ডা লোকটা পাশে থাকা ফুলদানি দিয়ে সজোরে আঘাত করে সিদ্ধির মাথায়। মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে মেয়েটা। সায়ন সাহেবের ঘুম ভাঙে তৎক্ষণাৎ। কী করবেন বুঝে উঠতে পারেন না। রফিকউদ্দিন সাহেব ততক্ষণে প্রাণ ত্যাগ করেছেন। এই মুহূর্তে আফসোসের শেষ নেই সায়ন সাহেবের কিন্তু নিজের পরিবারের জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে চাননা তিনি। সর্বোচ্চ চেষ্টা করে গুণ্ডাটাকে এক ঘরে বন্দি করে স্ত্রী-অজ্ঞান সন্তানসহ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান রাতের অন্ধকারে। চলে আসেন শহরে, আশ্রয় নেন বন্ধু তারেকের কাছে। সিদ্ধি তখনো অসুস্থ, চিকিৎসা চলছিল তার। দীর্ঘসময় চলে চিকিৎসা।

অবশেষে ডাক্তার জানান সিদ্ধি আগের সব কথা ভুলে গেছে। মাথায় গভীর আঘাতের দরুন পুরনো স্মৃতিশক্তির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশও তার কাছে অস্পষ্ট এখন। সায়ন সাহেব ভেঙে পড়েন পুরোপুরি। ভেবেছিলেন আবারো গ্রামে ফিরে যাবেন কিন্তু বন্ধু তারেকের মাধ্যমে জানলেন গ্রামের সবাই সায়ন সাহেবকে খুনী ধরে নিয়েছে, গ্রামে ফেরাটা মোটেও নিরাপদ নয়। রফিকউদ্দিন সাহেবের মৃত্যুর দায়ভার তখনো তার অন্তরকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল। সিদ্ধিকে নিয়ে শুরু হয় তার পরিবারের নতুন পথচলা, পুরনো সব স্মৃতি মুছে এক নতুন স্মৃতি গড়ে তোলার প্রচেষ্টা। এই প্রচেষ্টার মাঝপথে এসে হাত ছেড়ে দিলেন স্ত্রী সুবহা। চিরতরে পৃথিবী ছেড়ে পরলোকে পাড়ি জমালেন। সায়ন সাহেবও চেষ্টা করে চলছিলেন পুরনো সমস্ত স্মৃতি মুছে ফেলার কিন্তু তার এ দীর্ঘ ন’বছরের প্রচেষ্টা বিফলে গেল যখন আয়াশ এসে উপস্থিত হলো তার কাছে, ভালোবাসার দাবি নিয়ে। সায়ন সাহেব ভেবেছিলেন আয়াশ হয়তো নিজের পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে চাইবে কিন্তু নাহ! গ্রামবাসী না বুঝলেও আয়াশ ঠিকই বুঝেছিল সেদিনের পরিস্থিতিটা। সব শোনার পর আয়াশ কেবলমাত্র একটু সময় চায় সিদ্ধিকে সব মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য। সায়ন সাহেবের তখন আর কিছুই করার নেই। তিনিও চাইতেন সিদ্ধির সব মনে পড়ুক। এতকিছুর মাঝে যে তারেকের ছেলে তাহমিদ সিদ্ধিকে ভালোবাসে উন্মত্ত হয়ে উঠবে তা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি তিনি।

-“বাবা শুনছো?”
সিদ্ধির ডাকে ঘোর কাটল সায়ন সাহেবের। কিছুক্ষণের স্মৃতিচারণেই চোখ বেয়ে পানি গড়াতে শুরু করেছে।
-“কি হয়েছে বাবা তোমার?”
-“কিছু না রে মা। তোর মায়ের কথা মনে পড়ছিল।”
মায়ের নাম শুনে সিদ্ধির মুখটাও অনেকখানি মলিন হয়ে যায়। সায়ন সাহেব লক্ষ করলেন সিদ্ধি আয়াশের সাথে এসেছে। ভ্রু কুঁচকে মুখ টিপে হাসলেন তিনি।
-“বাব্বাহ! আজ আদা আর কাঁচকলা দেখি একসাথে? কী খিচুড়ি পাকাচ্ছেন শুনি?”
-“তেমন কিছু না আঙ্কেল, আপনার মেয়েকে বৃষ্টিভেজা রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা খাওয়া শিখালাম।”
-“তাই নাকি? বেশ তো। ফ্রেশ হও তোমরা। আজকের রান্না আমি করবো ভাবছি।”
আয়াশ মাথা নেড়ে সায় দিল। অতঃপর নিজের ঘরের দিকে এগোলো। সিদ্ধি ঘরে এসে বসতেই বিশ্রি একটা গন্ধে গা গুলিয়ে আসলো তার। পরক্ষণেই মনে পড়লো আয়াশের ঘরে মদ রাখার কথা ছিল। কিন্তু এখন যে তীব্র গন্ধ আর তাছাড়া আয়াশও নিজের ঘরে, এখন বোতলটা চিলেকোঠা ঘরে রাখার কোন উপায় নেই কিন্তু নিজের ঘরেও রাখা যাবে না। সিদ্ধি ওয়াশরুমে ঢুকে বোতলের ভেতরের সমস্ত তরল পানীয় ফেলে দিয়ে বোতলটাকে বেশ ভালোমতো ধুয়ে নিলো। বোতলটা ধুয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই দেখে সামনে সায়ন সাহেব দাঁড়িয়ে। সায়ন সাহেব হা হয়ে সিদ্ধির হাতে থাকা বোতলটা লক্ষ করছেন। বাবার এমন তীক্ষ্ম দৃষ্টি দেখে ভয়ে সিদ্ধির হাত থেকে বোতলটা মেঝেতে পড়ে কয়েক টুকরো হয়ে গেল।

-“বাবা বিশ্বাস করো আমি এসব ছাইপাশ খাইনা।”
-“তাহলে এই বোতল তোমার ঘরে কোথা থেকে এলো?”
-“বাবা আ..আমার বোতলের ডিজাইনটা ভালো লেগেছিল, ঘরে সাজিয়ে রাখার জন্য এনেছিলাম।”
-“তা হলে বোতলটার গা থেকে বিশ্রি গন্ধ বের হচ্ছিল কেন? আর সাজানোর জন্য আনা বোতল ধুতে হয়? কি এমন ছিল এই বোতলে?”
-“বাবা, তুমি আমায় সন্দেহ করছো?”
-“না, তোমার কীর্তিকলাপে সন্দেহ করছি। যা ইচ্ছে হয় করো। আমার কী! তোমার স্বামী বুঝবে সব।”
বলেই সায়ন সাহেব ঘর ছেড়ে বের হলেন। সিদ্ধি তার বাবার কথার তাৎপর্য বোঝার চেষ্টা করতে লাগলো,”আমার স্বামীর কথা বলে গেল কেন বাবা? আমায় বিয়ে দিতে চাচ্ছে নাকি? এর পিছনেও নির্ঘাত ঐ চিলেকোঠার ভাড়াটিয়ার কুমন্ত্রণা আছে। বজ্জাত ব্যাটা! তোকে আমি বাড়ি থেকে বের করতে চাচ্ছি আর তুই কিনা আমায় শ্বশুরবাড়ি পাঠাতে চাচ্ছিস? নির্ঘাত এই ছেলে আমাদের বাড়ি কব্জা করতে চায়। একে আমি বাড়ি থেকে বের করেই ছাড়বো যাই হয়ে যাক না কেন।”

ছাদের কিনারা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে আয়াশ। সায়ন সাহেব আয়াশকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এলেন। ছেলেটার উদাসীন মুখ দেখলে বুকের ভেতরটা খাঁ খাঁ করে তার। যে ছেলেকে তার ঘরে বসিয়ে জামাই-আদর করার কথা, সে ছেলেটা কি না চিলেকোঠায় থাকছে?
-“কিছু বলবেন আঙ্কেল?”
-“না বাবা। এমনিই আসছিলাম।”
-“আপনি কি আমার থেকে কোন বিষয় লুকিয়েছেন?”
-“এমনটা কেন মনে হচ্ছে তোমার?”
-“ভুল বুঝবেন না আঙ্কেল কিন্তু ঐ রাতের পর সবার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলেন আপনি কিন্তু কেন? চাইলেই তো আপনারা গ্রামে ফিরতে পারতেন, গুণ্ডাটা তো মরেই গিয়েছিল।”
-“মরে গেছিল মানে? কে মারলো ওকে?”
-“গ্রামবাসী যতদূর ধারণা করেছে গুণ্ডাটা আপনার বাড়িতে ঢুকে আমার বাবাকে মারার পর জঙ্গলের দিকে পালিয়েছে। জঙ্গলের অভিমুখে তার ছিন্ন-বিছিন্ন লাশ দেখে মনে হয়েছিল কয়েকটা নেকড়ে অতর্কিত আক্রমণ করেছিল।”
-“গ্রামবাসী এখনো তোমার বাবার মৃত্যুর জন্য আমাকে দোষারোপ করে, তাই না?”
-“মানে? আপনাকে কেন দোষারোপ করবে?”

-“সবাই তো এটাই ভাবে যে আমি তোমার বাবাকে মরতে দেখে পালিয়ে এসেছি কিংবা এই খুনের সাথে আমার যোগসূত্র আছে।”
-“একদমই না। গ্রামবাসী আপনাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করে। আপনি চলে আসার পর সবাই অনেক চেষ্টা করেছে আপনাকে খোঁজার কিন্তু কোন হদিস পাওয়া যায়নি বলে সবাই আশা ছেড়ে দিয়েছে।”
-“কিন্তু তারেক যে বললো গ্রামবাসী আমায় খুনী ভেবেছে আর গ্রামে যাওয়া মোটেও নিরাপদ না।”
-“তিনি কে?”
-“আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু।”
-“বুঝলাম না তিনি এসব কথা আপনাকে কেন বললেন। এমন কিছুই তো গ্রামে ঘটেনি আর ঘটার কথাও না। বাবার মৃত্যুর পর বেশ কয়েক বছর আমি নিয়মিত যাতায়াত করেছি গ্রামে। মেডিকেলে এডমিশনের পর মা আর নাফছীকে নিয়ে শহরে আসা এবং বাবার রেখে যাওয়া সঞ্চয় আর নিজের সামান্য উপার্জন দিয়ে বাড়ি করা।”

চিলেকোঠায় সমাপ্তি পর্ব ১+২

-“নাফছী কেমন আছে আর জোহরা আপা?”
-“মা আর নাফছী ভালোই আছে। ভাবছি সিদ্ধিকে নিয়ে দেখা করে আসবো একদিন।”
-“নিজের বাড়ি রেখে এখানে থাকছো যে? সিদ্ধি সন্দেহ করবে এসব জানলে।”
-“সন্দেহ করে যদি সত্যি জানার চেষ্টা করে আমার জন্য সুবিধা তবে তারেক সাহেবের বিষয়টা কিন্তু ক্লিয়ার না আঙ্কেল।”
-“আমার কাছেও। আমি ভাবছি এটা নিয়ে। তুমি খেতে এসো।”

সায়ন সাহেব খেতে ডাকলেন বেশ সাবলীলভাবে। তারেক সাহেবকে সন্দেহ করছেন না তিনি। তার বিশ্বাস তার বন্ধু বোধহয় পরিস্থিতিটা ভুল বুঝেছে কিন্তু আয়াশ প্রখরভাবে সন্দিহান এই তারেক নামক ব্যক্তিটাকে নিয়ে। কেননা এই ন’বছরে তার কাছে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে সে রাতে যা হয়েছিল তা কোন কাকতালীয় ব্যপার ছিল না, সম্পূর্ণ ঠাণ্ডা মস্তিষ্কের মাস্টারমাইন্ড প্ল্যান ছিল যার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল হয় সায়ন সাহেবকে সপরিবারে মেরে ফেলা অথবা গ্রামছাড়া করা। বেশ মনোযোগ দিয়েই বিষয়গুলোর উপর এবার দৃষ্টি দিল আয়াশ। ন’বছর আগের রহস্যের প্যাঁচটা বোধহয় এবার খুলতে সক্ষম হবে সে।

চিলেকোঠায় সমাপ্তি পর্ব ৫+৬