চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ২

চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ২
Writer Asfiya Islam Jannat
“তোমরা মেয়েরা কি চিল্লানো ছাড়া কিছু পারো না? মান-সম্মান সব আমার এখনই যেত।”
কথাটা বলেই নিবার্ণ অন্ধকারে হাতড়ে লাইটের সুইচে জ্বালালো। অকস্মাৎ আঁধার কেটে যাওয়ায়, কৃত্রিম আলোর স্পর্শ সূঁচের মত বিঁধলো স্পর্শীর অক্ষিকাচে। খিঁচে চোখ বন্ধ করে ফেললো সে, বার কয়েক ভারি পল্লব ফেলার পর দৃষ্টি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলো। অতঃপর নিজের খুব নিকটে নির্বাণকে দেখতে পেয়ে হকচকিয়ে উঠলো সে, কণ্ঠনালী দিয়ে বেরিয়ে এলো উদ্ভট শব্দ। তা দেখে নির্বাণ স্পর্শীর মুখ থেকে হাত সরিয়ে খানিকটা পিছিয়ে গেল। নির্বাণের শক্ত হাতের বাঁধন থেকে ছাড়া পেতেই স্পর্শী লম্বা নিঃশ্বাস নিল। পরক্ষণেই  তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো নির্বাণের দিকে, “আপনি আমার রুমে কি করছেন?”
নির্বাণ কন্ঠে কঠোরতা মিশিয়ে বলে, “লুডু খেলছি, খেলবে?”
স্পর্শী শাণিত কন্ঠে বলল, “লাইট অফ করে?”
 নির্বাণ প্রত্যুত্তর না করে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো স্পর্শীর দিকে। অতর্কিত নির্বাণের এমন দৃষ্টির মানে বুঝলো না স্পর্শী, ভ্রু যুগল একত্রিত করে তাকালো। অতঃপর নির্বাণের দৃষ্টি অনুসরণ করে নিজের দিকে চোখ বুলাতেই লজ্জায় কুঁকড়ে উঠলো সে, গায়ে ওড়না নেই। স্পর্শী দ্রুত ভেজা চুলগুলো সামনে এনে মেলে দিল। একপলক নির্বাণের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে গেল খাটের দিকে। নির্বাণও ততক্ষণে নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছে। স্পর্শী গায়ে ওড়না জড়িয়ে নিতেই তার চোখ যায় বিছানার উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নির্বাণের পোশাকগুলোর দিকে। ক্ষণেই সে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় নির্বাণের দিকে। তার পড়নে নিজের বাবার পোশাক দেখে ভ্রু কুঁচকে আসে তার। কৌতূহল দমাতে না পেরে স্বগোতক্তি কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
— আপনি অন্ধকারে করছিলেনটা কি?
নিবার্ণ অন্যদিকেই মুখটা ঘুরিয়ে রেখে স্পষ্টবাক্যে উত্তর দেয়, “চেঞ্জ করছিলাম।”
“কিন্তু কেন?”
নির্বাণ একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলে, “আজ রাত আমি এইখানেই থাকছি। তাই আন্টি আঙ্কেলের পোশাক দিয়েছিল চেঞ্জ করতে।”
কথাটা কর্ণগোচর হতেই স্পর্শী বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকায় নির্বাণের দিকে। ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলে, “আপনি থাকবেন মানে? কি করতে?”
নির্বাণ নিজের রাগ সংযত করতে না পেরে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “বাসর করতে।”
নির্বাণের কথা শুনে স্পর্শীর মাথায় আগুন ধরে গেল, “কথার কি শ্রী। ছিহ! এই আপনার লজ্জা করলো না নিজের ছাত্রীকে বিয়ে করতে?”
নির্বাণের ত্যাড়া উত্তর, “তোমার লজ্জা করলো না নিজের শিক্ষককে বিয়ে করতে?”
“আমি জানতাম নাকি?”
” আমি মনে হয় কত জানতাম? সবটাই তো হঠাৎ হয়ে গেল।”
স্পর্শী প্রত্যুত্তরে কিছু বলতে যাবে তার আগেই দরজা ওপাশ থেকে সাহেলার ডাক শোনা যায়। স্পর্শীকে ডাকছেন তিনি। স্পর্শী নির্বাণের দিকে একপলক তাকিয়ে চুপচাপ দরজা খুলে বেরিয়ে গেল রুম থেকে।
ঘড়ির কাটা এসে থেমেছে একটার ঘরে। পুরো রুম জুড়ে পিনপতন নীরবতা। নির্বাণ বিছানার এক প্রান্তে বসে মোবাইল দেখছে আর স্পর্শী দাঁড়িয়ে আছে জানালার ধারে। দুইজনের মাঝেই বেশ অস্বস্তিকর পরিবেশ, জড়তা কাটিয়ে কথা বলে উঠতে পারছে না কেউ। দুইজনই ইতিমধ্যে বুঝে গিয়েছে, অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই তারা একে অপরের সাথে জুড়ে গিয়েছে। এখন কোন কিছু বলেও লাভ নেই, বিয়েটা তাদের মানতেই হবে। কিন্তু তবুও কোথায় যেন একটা কিন্তু থেকেই যায়।
কিছু প্রহর নিভৃতেই অতিবাহিত হয়ে যায়। অবশেষে নীরবতা ভেঙ্গে নির্বাণ বলে, “তুমি কি চাও?”
অকস্মাৎ নির্বাণ কথা বলে উঠায় স্পর্শী কিঞ্চিৎ ভড়কে যায়। গোলগোল চোখে তাকায় নির্বাণের দিকে, “কি চাই মানে?”
নির্বাণ মুঠোফোনটা বালিশের পাশে রেখে সোজা হয়ে বসে বলে, ” দেখো, আমাদের দু’জনের জন্যই সম্পর্কটা বেশ আগোছালো। পারসোনাল এবং প্রোফেশনাল দুই জায়গাতেই আমাদের বিয়ে প্রভাব ফেলছে। সবটা এখন গুছাতে হলে আমাদের দুইজনকেই কম্প্রোমাইজ করতে হবে। তাই আমি তোমার থেকে জানতে চাইছি তুমি কি সম্পর্কটা আগাতে চাও নাকি ডিভোর্স নিতে চাও?”
স্পর্শী মিনমিনে স্বরে বলে, “ডিভোর্স কেন চাইবো?”
“মেনে নিতে চাইছো?”
স্পর্শী ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে, “বিয়ে যেহেতু হয়েই গিয়েছে, সেহেতু মেনে নেওয়াই শ্রেয়। এমনেও, আমার বিয়েতে অমত ছিল না। তবে..”
সম্পূর্ণ বাক্য শেষ করলো না স্পর্শী, সংশয়ে দৃষ্টি নত করে নিল। নির্বাণ অর্ধাংশ কথাটুকু বুঝতে পেরে বলে, “আমাকে বর হিসাবে মানতেই সমস্যা হচ্ছে তাই তো?”
“আমার কিছুটা সময়ের প্রয়োজন সবটা মেনে নিতে। “
“আচ্ছা।”
স্পর্শী এইবার ইতস্তত সুরে বলে, “তবে আমি চাই আমাদের বিয়ের বিষয়টা আপাতত গোপন রাখতে। ভার্সিটিতে জানাজানি হলে সমস্যা আছে।”
“সেটা তুমি না বললেও আমি জানি। আর এমনেও আমি আমার পারসোনাল আর প্রোফেশনাল লাইফ আলাদা আলাদা রাখতে চাইছি। আশা করি বুঝবে।”
স্পর্শী মাথা দুলিয়ে বলে, “হুম”
নির্বাণ আর কোন কথা বললো না, চুপচাপ বালিশে মাথা হেলিয়ে শুয়ে পড়লো। স্পর্শী কিছুক্ষণ ইতস্তত করল, নির্বাণের পাশে শুবে কি-না তা নিয়ে দ্বিধার শেষ নেই তার। অস্বস্তি কাজ করছে তার মধ্যে বেশ।  সুদীর্ঘ সময় সে আকাশ-কুসুম ভেবে কার্বাড থেকে পাশবালিশ বের করলো। সেটা বিছানার মাঝ বরাবর রেখে লাইট অফ করে কিনার ঘেষে শুয়ে পড়লো। মিনমিনে স্বরে বলল, “ভুলেও এই পাশে আসবেন না। নাহলে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।”
প্রভাতের আলো ফুটেছে ঘন্টাখানেক হলো। মেঘে মেঘে খেলা করছে দুরন্তপনা রোদ্দুর। আকাশে উড়ছে বেড়াচ্ছে চড়ুইপাখির দল, রোদ মাখাচ্ছে গায়ে। নির্জীব শহরটি হয়ে উঠছে ব্যস্ততায় পরিপূর্ণ। নিত্যদিনের তুলনায় আজ ঘুমটা আগেই ভেঙে গেল স্পর্শীর। না নিজ থেকে নয়, ফোনের কর্কশ ধ্বনিতে।  স্পর্শী ঘুমের ঘোরেই হাতড়ে মোবাইলটা খোঁজার চেষ্টা করলো কিন্তু পেল না কোথাও। এইদিকে ফোনটা অনাবরত ফোনটা বেজেই চলেছে, অবশেষে বিরক্ত হয়ে চোখ খুললো সে। হঠাৎ মুখের সম্মুখে পুরুষালী চেহেরার কাউকে শুয়ে থাকতে দেখে ভড়কে গেল সে।
মিনিট কয়েক তার লাগলো বুঝতে আসলে মানুষটি কে? নির্বাণের ঘুমান্ত মুখশ্রীর দিকে একধ্যানে তাকিয়ে থাকার পর নিজের অবস্থান সম্পর্কে অবগত হতেই হকচকিয়ে উঠলো সে। রাতে স্পর্শী যে পাশবালিশ দুইজনের মাঝে বোর্ডার হিসাবে দিয়ে নিবার্ণকে তা অতিক্রম না করার হুমকি দিয়েছিল। তা সে নিজেই ভঙ্গ করে বসে আছে। পাশবালিশের উপর দিয়েই নির্বাণের গায়ে পা উঠিয়ে ফেলেছে স্পর্শী।
 সেই সাথে, নির্বাণের গা ঘেষেই শুয়ে আছে সে। মুহূর্তেই এক ঝাঁক লজ্জা ভীড় করলো তার মনের দুয়ারে। নির্বাণ জাগার আগেই দ্রুত সরে আসলো সে, ভরাট গাল দু’টিতে ছেঁয়ে আছে রক্তিমা ভাব। সে ভেবেই কূল পাচ্ছে না, তার আগে যদি নির্বাণ জেগে যেত তাহলে কি হতো? একটুর জন্য বেঁচে গিয়েছে সে, নাহলে এই মুখ লুকানোর আর জায়গায় থাকতো না।
পুনরায় ফোন বেজে উঠতেই স্পর্শী আপন ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে। চারদিকে চোখ বুলিয়ে খুঁজতে থাকে নিজের ফোনটা। অতঃপর স্টাডি টেবিলের উপরে ফোনটা দেখতে পেয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সে। এগিয়ে যায় সেদিকে, ফোন হাতে নিতেই দেখতে পায় কলটা অপরিচিত নাম্বার থেকে আসছে। ক্ষণেই স্পর্শীর ভ্রু কুঁচকে আসে, সে ফোন রিসিভ করতেই কেউ উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে উঠে,
— এট লাস্ট তুমি ফোনটা ধরেছ স্পর্শী।
সদ্য ঘুম থেকে উঠায় নিম্প্রভ মস্তিষ্ক কন্ঠটা সনাক্ত করতে ব্যর্থ হলো। তাই সে জিজ্ঞেস করলো, “কে?”
“আমি রুদ্র।”