চৈত্রিকা পর্ব ২৪

চৈত্রিকা পর্ব ২৪
বোরহানা আক্তার রেশমী

পুরো জমিদার বাড়িতে হাহাকার উঠে গেছে। কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না চিত্রকে। পল্লবী হলরুমে বসেই আহাজারি করে কাঁদছে। চয়ন,সাদিক, শিমুল, প্রহর, পিয়াস চিন্তিত মুখে বসে আছে। অর্থি নিজেও কেঁদেই চলেছে। চৈত্রিকা তাকে সামলালেও কি থেকে কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। অর্পিতা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পল্লবীর কান্নারত মুখের দিকে। বার বার কাল রাতে চিত্রর কান্নারত মুখটা ভেসে উঠছে।

শায়লা পাশে বসে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। পল্লবীর কাছেই নাসিমা আর নীরা বসে আছে। সকাল বেলা চিত্রকে খাবারের জন্য ডাকতে গেলে অর্থি তাকে কোথাও খুঁজে পায়নি৷ তখন বিষয়টা স্বাভাবিক ভাবে নিলেও দিন পেড়িয়ে রাত হওয়ার পরও যখন চিত্রর দেখা মেলেনি তখন খোঁজ শুরু করে চয়ন আর প্রহর। তাদের সব লোককে খুঁজতে বলে। রাত ১০ টা পর্যন্ত চেনা পরিচিত এমনকি চিত্রর বিশ্ববিদ্যালয়ে খোঁজ নিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। তখন থেকেই চিন্তিত পরিবার বসে আছে হলরুমে। পল্লবীর কান্নায় বিরক্ত হয়ে চয়ন গম্ভীর স্বরে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘কান্নাটা একটু থামাবে গিন্নি? কি শুরু করলে! চিত্র ম’রে নাই এখনো।’
পল্লবী আর অর্পিতা আঁতকে ওঠে। পল্লবীর কান্না আপনা আপনিই বন্ধ হয়ে যায়। অর্পিতার শ্বাস ভারী হয়ে আসে। অর্থির কান্নার আওয়াজ বেড়ে যায়। চৈত্রিকা অর্থিকে বুকে আগলে নিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করলেও দৃষ্টি থাকে অর্পিতার মুখের দিকে। তার থেকে চোখ সরিয়ে পল্লবীর দিকে তাকাতেই পল্লবীর রাগী মুখ চোখে পড়ে। পল্লবী তেজী কন্ঠে বলে,

‘আমার ছেলেকে নিয়ে উল্টো পাল্টা বললে ঠিক হবে না চয়ন রেনওয়াজ। আমার ছেলেকে আজ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না তার একমাত্র কারণই তো আপনি আর আপনার ভাতিজি। ওই মেয়ের এতো অ’হং’কার! আমার ছেলেটা ওর খালা আর খালাতো ভাইয়ের উ’স্কানিতে ভুল করলো আর সেই ভুলের শা’স্তি হিসেবে আমার ছেলেটাকেই ‘ও’ নিখোঁজ করে ফেললো!’
অর্পিতা তাকিয়ে থাকে পল্লবীর মুখের দিকে। পল্লবী উন্মাদ হয়ে ওঠে। অর্পিতার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘শান্তি পাইছিস তুই? আমার ছেলেটা তো তোকে ভালোবাসতো! তুই নিজের জিদ ধরে রেখে শান্তি পাইছিস? আমার ছেলের কিছু হলে আমি তোকে শান্তিতে বাঁচতে দেবো না অর্পিতা। তোরা জমিদার বংশ পারিসই শুধু মানুষকে লু’টে নিতে! মায়ের বুক ফাঁকা করতে। কিন্তু আমার বুক ফাঁকা হলে আমি তোদের সবাইকে! তোকে আর চয়ন রেনওয়াজকে একদম বেঁ’চে থাকতে দেবো না। মনে রাখিস!’

পল্লবীকে ঠান্ডা করার চেষ্টা করে নাসিমা। চয়ন রেনওয়াজ তাকিয়ে থাকে পল্লবীর মুখের দিকে। পল্লবী যে উন্মাদ হয়ে গেছে তা বুঝতে একটুও বাকি রয় না। সন্তান হারানোর চিন্তায় পল্লবী যে মনের ক্ষো’ভ প্রকাশ করছে তা ঢের বোঝা যাচ্ছে। অর্পিতা একটা কথারও জবাব দেয় না শুধু নিস্তব্ধের মতো তাকিয়ে থাকে পল্লবীর মুখের দিকে। চয়ন পল্লবীকে কিছু বলতে নিলে থামিয়ে দেয় প্রহর। নিজের কাঠিন্যতা ধরে রেখে কঠিন গলায় বলে,
‘চিত্র আপনারও নিজের রক্ত আব্বাজান তাই কি বলছেন এটা একটু ভেবে বলবেন! উনি নিজের সন্তানকে খুঁজে পাচ্ছে না তাই কান্নাকাটি, আহাজারি করবেই এতে আপনি ‘চিত্রর ম’রার’ কথা বলে তার ব্যাথিত হৃদয়ে আবারও ব্যাথা দেওয়ার অধিকার রাখেন না।’

চয়ন রেনওয়াজ চুপ করে যান। তিনি এতো ক্ষমতাশীল হলেও প্রহরের বেলায় চুপ করে যায়। তার চেয়ে বেশি তো কেউ প্রহরকে চিনে না! তাই সে সহজে প্রহরকে ক্ষে’পিয়ে তোলে না। প্রহর এগিয়ে আসে পল্লবীর কাছে। চৈত্রিকা পুরো বিষয়টাই দেখে। সে কিছু বলতে চেয়েও চুপ করে যায়। দেখতে চায় প্রহর কি করে! প্রহর নিজের মায়ের কাছে বসে তার মুখটা দুহাতের আজলে নেয়। কন্ঠস্বর নরম করে বলে,

‘দেখুন আম্মাজান! অর্পিতা তো একটা মেয়ে। আপনিও তো মেয়ে। আপনি তো শুধু মেয়ে না একজন মা’ও। আপনি নিজের জ্ঞান থেকে বলুন তো! আপনার সাথে যদি কোনো ছেলে এমন একটি ঘটনা ঘটাতো যা আপনার সম্মানে হাত দেয় আপনি কি তাকে সহজে ক্ষ’মা করতে পারতেন? আপনি কি পারতেন তাকে এতো সহজেই সব ভুলে মাফ করে দিতে!’

পল্লবী জবাব দেয় না। শুধু তাকিয়ে থাকে প্রহরের মুখের দিকে। প্রহর একটু থেমে ফের বলে, ‘অর্পিতা কিন্তু খুবই ভালোবাসে চিত্রকে। এটা চিত্র জানেও আর বুঝেও। ছেলেটা একটা অ’ন্যায় করেছে যার জন্য অর্পিতা তাাকে শা’স্তিস্বরূপ বিয়েও করেনি, কাছেও টেনে নেয়নি। একজনকে ভালোবেসে তাকেই আবার দুরে রাখাটা কি কষ্টের না আম্মাজান? আপনি যেমন আপনার ছেলেকে ভীষণ ভালোবাসেন তেমনই মেয়েটাও তার ভালোবাসার মানুষকে খুবই ভালোবাসে। তাহলে তাকে সব দোষ দেওয়াটা কি উচিত আম্মাজান? মানছি অর্পিতা চিত্রকে ক্ষমা করেনি। কাছেও টেনে নেয়নি। চিত্রর ব্যাথাটাও বুঝেনি কিন্তু আপনিও তো অর্পিতার দিকটা বুঝতেছেন না আম্মাজান? ওর সাথে যা যা ঘটেছে গত কয়েকদিনে তাতে ওর সবটা মানিয়ে নিতে, বুঝে নিতেও তো সময় লাগতো!’

পল্লবী চোখ নামিয়ে নেয়। আসলেই তো! সেও তো মেয়ে অথচ অর্পিতার দিক তো সে এভাবে কখনোই ভাবেনি! উল্টো সবসময় অর্পিতাকে মনে মনে দোষ দিয়ে চিত্রকে নিয়ে ভেবে গেছে। তবে কি এই জমিদার বাড়ির স্বা’র্থ’পর গুলোর মতো সেও স্বা’র্থপর হয়ে গেছে! চৈত্রিকা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে প্রহরের দিকে। তার মনেও কথা গুলো স্পষ্ট ছিলো। কথাগুলো তো সেই বলতো অথচ সেগুলো কি সুন্দর গুছিয়ে বলে দিলো প্রহর!

সে তো প্রহরের থেকে এমন কিছুই আশা করেনি! সে ভেবেছিলো নিজের বাবা, মায়ের মতোই সেও অর্পিতার দিকে আঙুল তুলবে। কিন্তু তাকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত করে দিয়ে প্রহর তার থেকেও ভালো করে বুঝিয়ে দিলো অর্পিতার দিকটা। প্রথমবারের মতো প্রহর নামক জমিদার সাহেবকে তার মন্দ মনে হলো না। মনে হলো না এই ব্যাক্তি এতো বেশি পা’ষাণ হতে পারে! মনে হলো না এই মানুষটা কাউকে সর্বস্বহারা করতে পারে! চৈত্রিকা প্রহরের নতুন রুপ দেখে ভুলেই বসলো অতীতের কর্মকান্ড। পলকহীন তাকিয়েই রইলো প্রহরের মুখপানে। তার ভাবনার মাঝেই প্রহর পল্লবীকে নিজে আগলে নেয়। ছেলের বুকে মাথা রেখে নিঃশব্দে কাঁদে পল্লবী। প্রহর ফের নরম স্বরে বলে,

‘আপনার বড় ছেলে আপনাকে কথা দিচ্ছে আম্মাজান! আপনার ছোট ছেলের গায়ে একটা টোকাও পড়তে দেবো না। আপনার ছেলেকে সুস্থ ভাবে ফিরিয়ে দেবো আপনার কাছে।’
নরম স্বর হলেও কথার মাঝে ছিলো বিশাল কিছুর আভাস। চৈত্রিকা তখনো বোকার মতো তাকিয়ে আছে প্রহরের দিকে। অর্পিতা কৃতজ্ঞতা নিয়ে তাকাায় প্রহরের দিকে। যেখানে একজন নারী হয়ে অন্য এক নারী তাকে বুঝতে অক্ষম সেখানে একজন পুরুষ হয়ে কি সুন্দর, সাবলীল ভাবে তার মনের ব্যাথাটা, তার দিকটা বুঝিয়ে দিলো প্রহর! অর্থি কাঁদতে কাঁদতে সেখানে ঘুমিয়ে পড়েছে। চৈত্রিকা অর্থিকে আগলে রেখে নিচু স্বরে প্রহরের উদ্দেশ্যে বলে,

‘অর্থি তো ঘুমিয়ে পড়েছে! ওকে একটু ঘরে দিয়ে আসেন।’
প্রহর নীরার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ঈশারা করে। নীরা পল্লবীকে ধরতেই প্রহর উঠে গিয়ে অর্থিকে কোলে তুলে নেয়। কোনো শব্দ ছাড়াই ছোট্ট অর্থিকে নিয়ে যায় অর্থির ঘরে। চৈত্রিকা পিছু পিছু না গিয়ে আসে অর্পিতার কাছে। অর্পিতার পাশে বসে অর্পিতার থুতনীতে হাত রেখে চুল গুলো কানের পৃষ্ঠে গুজে দেয়। সহজ গলায় বলে,

‘নিজেকে দোষী ভাববেন না আপু। চিত্র ভাই হয়তো অভিমানে কোথাও চলে গেছে দেখবেন আপনার বড় ভাইজান ঠিকই তাকে ফিরিয়ে আনবে। উঠুন এখন! অনেক রাত হয়েছে। কাকিমা আপনি আজ আপুর সাথে ঘুমাবেন। আপুকে নিয়ে ঘরে চলুন!’

চৈত্রিকার এতো সহজ স্বাভাবিক আচরণ দেখে শায়লা আর অর্পিতা তাকিয়ে থাকে। তারপর চৈত্রিকার কথা অনুযায়ী অর্পিতা কোনো শব্দ না করেই নিজ জায়গা থেকে উঠে পড়ে। শায়লা আর চৈত্রিকাই অর্পিতাকে তার ঘরে নিয়ে যায়। চৈত্রিকা অর্পিতাকে শুইয়ে দিয়ে মাথায় অল্প একটু হাত বুলিয়ে দিয়ে শায়লাকে থাকতে বলে নিজে উঠে আসতে নেয়। অর্পিতা তার হাত টেনে আটকে দিয়ে বলে,

‘চিত্র ভাই কাল আমার ঘরে এসেছিলো বড় ভাবীজান। আমি উনার কান্নাকে গ্রাহ্য না করে কঠিন গলায় তাকে তাড়িয়ে দিয়েছি। আজ তার নিখোজ হওয়ার জন্য সম্পূর্ণ দায়ীই কিন্তু আমি।’
চৈত্রিকা অবাক হয়। তবে নিজের অবাকতা দমিয়ে অর্পিতার হাত ছাড়িয়ে দেয়। তার মুখের দিকে তাকিয়েই বলে, ‘যা হওয়ার তা হয়ে গেছে তাতে নিজেকে দায়ী ভাবার দরকার নাই অর্পি আপু। আমরা বুঝি আপনার সাথে যা হয়েছে তা ঠিক না কিন্তু যেহেতু চিত্র ভাই মন থেকে ক্ষমা চেয়েছিলো তাই আপনার উচিত ছিলো তাকে একটা বার ক্ষমা করে সুযোগ দেওয়া।

কিন্তু আপনি নাা দিয়ে যখন নিজেদের মধ্যে দূরত্ব বাড়ালেন তখন না হয় আরেকটু এই দূরত্ব সহ্য করুন! সব ঠিক হয়ে যাবে ইন শাহ আল্লাহ। আর একটা কথা! কোনোকিছুতে নিজেকে দোষী ভাববেন না। আপনি তো জানেন আপনি কি পরিমাণ ভালোবাসেন তাকে! তবে নিজেই নিজেকে দোষ দিয়ে নিজেকে আর নিজের ভালোবাসাকে ছোট করবেন না।’
চৈত্রিকা মুচকি হেঁসে চলে যায়। অর্পিতা টলমল চোখে তাকিযে থাকে সেদিকে। আসলেও প্রহর রেনওয়াজের যোগ্য বউ। দুইজনের মাঝেই রয়েছে কাঠিন্যের, তেজের, সাহসের, নমনীয়তার এক অদম্য শক্তি। দুজনই ভীষণ অদ্ভুত তবুও দুজন ভীষণ রকম বুঝদার।

১ দিন, ২ দিন করে কাটলো পুরো ৭ দিন। সময় পেরোলো তবে চিত্রকে পাওয়া গেলো না আর। প্রহর হন্যে হয়ে খুঁজছে। বাহিরে সারাদিন চিত্রকে নিয়ে খোজাখুজি, চিন্তার শেষে যখন বাড়িতে ঢোকে তখন তার মা ছুটে এসে একটাই প্রশ্ন করে, ‘চিত্র কোথায়?’ এ প্রশ্নের জবাব সে দিতে পারে না। অর্পিতা ঘরবন্দী করে রাখে নিজেকে। অর্থির চঞ্চলতা একদম কমে গেছে। চৈত্রিকা আর নীরা পুরো বাড়িকে সামলাচ্ছে একা হাতে। দু জা মিলে বাড়ির মানুষের খেয়াল রাখা থেকে শুরু করে বাড়ির প্রতিটা ইটকেও যেনো খেয়ালে খেয়ালে রাখছে।

অর্পিতা থেকে শুরু করে সবার সব বিষয়ে খেয়াল রাখে দুজনে। সামনেই অর্থির মাধ্যমিক এজন্য নিজেরাই সময় করে অর্থিকে পড়তেও বসায়। নিবিড়ও আসে। চিত্র নিখোঁজ এটা সেও জানে। ভেতরে ভেতরে খারাপ লাগলেও অর্থিকে শান্ত্বনা দেওয়ার মতো ভাষা তার কাছে নেই। আজও পড়াতে এসেছে নিবিড়। অর্থি বই খাতা নিয়ে বসে আছে। বইয়ের ওপর মাথা রেখে জানালার বাহিরে দিয়ে তাকিয়ে আছে। চোখ মুখ মলিনতায় ভরে উঠেছে। নিবিড় এসে তাকে অন্যমনষ্ক দেখে প্রথমে হতাশার শ্বাস ফেললেও চুপচাপ এসে বসে তার সামনের চেয়ারে। অর্থি এক পলক নিবিড়ের দিকে তাকিয়ে নিজের অঙ্ক খাতা খুলে বসে। মন মেজাজ কোনোটাই খুব বেশি ভালো নেই। নিবিড় শান্ত স্বরে বলে,

‘পড়েছো কিছু অর্থি?’
অর্থি দুপাশে মাথা নাড়ায়। নিবিড় দীর্ঘশ্বাস নেয় কিন্তু কিছু বলে না। ধৈর্য সহকারে বলে, ‘এখন তাহলে একটু পড়ো!’
অর্থি সে কথা শুনেও শুনে না। নিবিড়ের দিকে তাকিয়ে নিজেই প্রশ্ন করে, ‘আচ্ছা মাষ্টারমশাই! আপনি তো মিথ্যা বলেন না তাই না! আপনি একটু বলেন না আমার ছোট ভাইজান ফিরবে তো? আবার আগের মতো আমাকে ভালোবাসবে তো? ছোট ভাইজান না আসলে তো আমি মাধ্যমিকে বসবো না। এবার ছোট ভাইজান আসলে আমি প্রতিদিন তাাকে নিয়ম করে পড়া দেবো, ঠিক মতো তার সব কথা শুনবো। আমার ছোট ভাইজান আসবে তো মাষ্টারমশাই?”

নিবিড় কিছু বলতে পারে না। গলা কেঁপে ওঠে। কোনো রকমে কাঁপা কাঁপা শব্দে বলে, ‘চিন্তা করো না অর্থি। দেখবে তোমার ছোট ভাইজান ঠিক ফিরে আসবে!’
অর্থি টেবিলের ওপর মাথা নত করে শুয়ে পড়ে। বাহিরে চোখ বুলিয়ে নিজ শব্দে আওড়ায়, ‘ছোট ভাইজান তবে ফিরে আসে না কেনো?’
নিবিড় কিছুক্ষণ চুপ থেকে কাঁপা কাঁপা হাতে ছোট্ট অর্থির মাথায় হাত বু্লিয়ে দেয়। মিনিট খানেক না যেতেই অর্থি ফুঁপিয়ে ওঠে। ভয় পেয়ে নিবিড় নিজ জায়গা ছেড়ে উঠে এসে দাঁড়ায় অর্থির সামনে। এক হাত অর্থির গালের ওপর রেখে ব্যস্ত গলায় বলে,

‘কি হলো অর্থি? তুমি…’
কথা শেষ হওয়ার আগেই অর্থি জাপ্টে ধরে নিবিড়কে। মুখ গুজে দেয় নিবিড়ের পেটে। নিবিড় চমকে ওঠে। অর্থি কাঁদতে থাকে। নিবিড় কি করবে বুঝে ওঠে না৷ এই অবস্থায় তাদের কেউ দেখলে সর্বনাশ হয়ে যাবে কিন্তু মেয়েটার যা অবস্থা তাতে হুট করে ঠেলে সরিয়ে দিলেও ভীষণ কষ্ট পাবে। দ্বিধাদন্দ মন নিয়েই অর্থির মাথায় কাঁপা কাঁপা হাতে হাত বুলায়। বিড়বিড় করে বলে,
‘তোমার স্পর্শে, তোমার হাহাকারেই আমার সর্বনাশ অর্থি।’

রাতে সব কাজ শেষ করে চৈত্রিকা পল্লবীকে ঘরে দিয়ে নিজের ঘরে আসে। প্রহর তখন মাথা নিচু করে বসেছিলো বিছানার ওপর। তার এমন বসে থাকায় চৈত্রিকার ভ্রু কুঁচকে যায়। ধীর পায়ে এগিয়ে আসে প্রহরের সামনে। শান্ত গলায় বলে,
‘এখানে এভাবে বসে আছেন কেনো জমিদার সাহেব? খাবেন না?’
প্রহর চোখ তুলে তাকায়। চৈত্রিকা ভয় পেয়ে যায় প্রহরের চোখ দেখে। লাল টকটকে চোখ যেনো চৈত্রিকাকে কিছুর আভাস দিচ্ছে! চৈত্রিকা তাকিয়ে থেকে বুঝার চেষ্টা করে। তবে বরাবরই এই রহস্যময় পুরুষকে বুঝে ওঠে না। প্রহর চৈত্রিকার দিকে তাকিয়ে কন্ঠস্বর নিচু করে বলে,

‘ক্ষুধা নেই। তুমি খেয়েছো?’
চৈত্রিকা উপরনীচ মাথা নাড়ায়। প্রহর ‘আচ্ছা’ বলে আবার মাথা নিচু করে নেয়। চৈত্রিকা ওভাবেই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে কি মনে করে যেনো জিজ্ঞেস করে বসে, ‘মন খারাপ জমিদার সাহেব?’
প্রহর প্রথমে চুপ থাকলেও পরমুহূর্তে চোখ তুলে তাকায়। করুণ কন্ঠে বলে, ‘আমি কখনো এতোটা অসহায় হয়ে পড়িনি চৈত্রিকা। নিজের আপন মানুষদের বিশ্বাসঘা’তকতাও আমাকে বাঁকা করতে পারেনি তবে আজ আমি ভেতর থেকে বাঁকা হয়ে যাচ্ছি৷ কত খুঁজেছি চিত্রকে৷ কিন্তু পাচ্ছি না।৷ প্রতিদিন যখন আম্মাজান কাছে এসে চিত্রর কথা জানতে চায় তখন নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হয়। আম্মাজানকে দেওয়া কথা আমি রাখতে পারছি না চৈত্রিকা।’

চৈত্রিকা কোনো কথা বলে না। চুপচাপ নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে তাাকিয়ে থাকে প্রহরের মুখের দিকে। পায়ের নখ দিয়ে খুঁটতে থাকে মেঝে। কতটা সময় এভাবেই যায়। হুট করেই প্রহর উঠে আসে চৈত্রিকার একদম কাছে। চৈত্রিকা চমকায় না। মাথা উচিয়ে তাকিয়ে থাকে প্রহরের মুখপানে। প্রহর ছোট্ট করে বলে,
‘আমি তোমাকে একটুখানি জড়িয়ে ধরি চৈত্রিকা?’

চৈত্রিকা পর্ব ২৩

চৈত্রিকা এপর্যায়ে চমকায়। গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়। তার অনুমতির আশা না করেই প্রহর শক্ত করে চৈত্রিকা নিজ বাহুডোরে আনে। জড়িয়ে ধরে বড় করে শ্বাস টানে। শ্বাস আটকে থাকে চৈত্রিকার। দৃষ্টি এদিক ওদিক করে মনে মনে আওড়ায়,
‘নিজ অসহায়ত্বে আমাকে টেনে নিবেন না জমিদার সাহেব। আমি যে নিজের অসহায়ত্বটাই ভুলে যাবো!’

চৈত্রিকা পর্ব ২৫