চৈত্রিকা পর্ব ৩৭

চৈত্রিকা পর্ব ৩৭
বোরহানা আক্তার রেশমী

বৈশাখ মাস পেড়িয়ে জৈষ্ঠ্যের আগমন ঘটে গেছে। গ্রীষ্মকালের ভ্যাপসা গরম। এই রোদ তো আবার এই আকাশে মেঘ জমে আছে। অর্থির মাধ্যমিক পরীক্ষার আজই শেষ দিন। আকাশের অবস্থা গুমোট হয়ে থাকলেও ভ্যাপসা গরমে মানুষের অবস্থা খারাপ। কোনো রকমে শেষ পরীক্ষা দিয়ে বাহিরে এসে আশে পাশে তাকায় অর্থি। নির্দিষ্ট মানুষটাকে চারদিকের কোথাও দেখতে না পেয়ে মনটা খারাপ হয়ে যায়।

সেদিনের পর থেকে অর্থি পড়ায় ফাঁকি দেয়নি কিন্তু নিবিড়ের কঠোর আচরণে ছোট্ট মনে ভীষণ আ’ঘাত পেয়েছে। নিবিড় এ ক’দিনের সবগুলো পরীক্ষাতেই এসেছিলো কিন্তু আজ আসেনি দেখে ভীষণ মন খারাপ হলো। স্কুল থেকে বের হয়ে গুটিগুটি পায়ে সামনে এগোতে শুরু করে অর্থি। হুট করেই পেছন থেকে ডাকে নিবিড়। অর্থি চমকে পেছনে তাকায়। ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠে চমৎকার হাসি। নিবিড় সে হাসি দেখেও না দেখার ভান করে। গরমে ঘেমে একাকার হয়ে গেছে। দ্রুত পায়ে অর্থির কাছে এগিয়ে এসে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘শেষ হয়ে গেছে? কেমন হলো পরীক্ষা?’
‘ভালো হয়েছে মাষ্টারমশাই।’
‘আচ্ছা চলো!’
অর্থি মাথা নাড়িয়ে নিবিড়ের পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটতে থাকে। অর্থির মন খচখচ করে কথা বলার জন্য কিন্তু নিবিড়ের সাথে কথা বললে আবার নিবিড় রেগে যায় যদি! ভয়েই চুপ থাকে। নিবিড় নিজেই ফের জিজ্ঞেস করে,
‘পাশ করতে পারবে তো!’
অর্থি গাল ফুলিয়ে বলে, ‘পারবো।’

এরপর অনেকটা সময় দুজনের মাঝে নীরবতা। গ্রামের অর্ধেক রাস্তাতে এসে অর্থি মুখ খোলে, ‘আপনি কি আর আমাকে পড়াবেন না মাষ্টারমশাই?’
নিবিড় ভ্রু কুঁচকায়। এমন বোকার মতো প্রশ্ন করার কোনো মানে আছে! পরক্ষণেই ভাবে এই মেয়ে তো এমনেই আস্ত গা’ধা। সবসময় বোকা বোকা প্রশ্ন করাাটা ওর জন্মগত অভ্যাস। তাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
‘তোমাকে আর পড়াতে যাবো কেনো? তোমার তো মাধ্যমিক শেষ।’

অর্থি দাঁড়িয়ে যায়। কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে, ‘তবে কি আর আপনার সাথে দেখা হবে না মাষ্টারমশাই?’
নিবিড় নিজেও দাঁড়িয়ে যায়। শান্ত দৃষ্টিতে অর্থির কাঁদো কাঁদো মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটা অবুঝ ভীষণ। তবে তার প্রতি যে এই মেয়েটার অনুভূতি প্রখর হচ্ছে তা বুঝতে বাকি রয় না। শীতল কন্ঠে তবে কঠোর হয়ে বলে,
‘তোমার সাথে আমার দেখা হওয়া লাগতেছে কেনো অর্থি? তোমাকে পড়ানোর দায়িত্ব নিয়েছিলাম তা শেষ হয়ে গেছে। তাই তোমার সাথে আমার দেখা হওয়ার তো কোনো প্রয়োজন নেই।’

নিবিড় কথাগুলো বলেই পিছু ফিরে দাঁড়ায়। অর্থি নিবিড়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। অবাক চোখেই তাকিয়ে থাকে। নিবিড় অর্থির দিকে না তাকিয়েই বলে,
‘তুমি এখনো অনেক ছোট। অনেক অবুঝ৷ নিজের মনকে অযথাই অন্যদিকে না নিয়ে নিজের পড়ালেখায় ভালো ভাবে মন দাও। আর তুমি কোনো রকম উল্টা পাল্টা ব্যবহার করলে আমি তোমার বাড়িতে জানিয়ে দেবো।’

অর্থি কোনো কিছু ভাবে না। নিবিড়ের কথার পিঠে সে হুট করেই জাপ্টে ধরে নিবিড়কে। নিবিড় চমকে ওঠে। অর্থি নিবিড়ের পিঠে মুখ গুজে দিয়ে কান্নারত স্বরে বলে, ‘আমার সাথে এতো কঠিন হচ্ছেন কেনো মাষ্টারমশাই? আপনি তো এমন ছিলেন না। আপনি তো আমাকে ভালোবাসেন বলেন!’

নিবিড় ছাড়িয়ে দেয় অর্থিকে। সোজা করে দাঁড় করিয়ে কাঠকাঠ গলায় বলে, ‘গায়ে পড়া স্বভাব আমার একদম পছন্দ না। আর কখনো এমন করলে আমি কিন্তু দেখবো না তুমি জমিদার বাড়ির মেয়ে! আর আমি কখনো তোমাকে বলেছি আমি তোমাকে ভালোবাসি! ভালোবাসার কি বুঝো তুমি! তুমি আর কখনো আমার সাথে কথাও বলবে না অর্থি। আমার থেকে সম্পূর্ণ দূরত্ব রাখবে।’

অর্থি দু পা পিছিয়ে দাঁড়ায়। ভাঙা ভাঙা স্বরে বলে, ‘আপনি বদলে গেছেন মাষ্টারমশাই। আপনি হারিয়ে গিয়ে সত্যিই হারিয়ে গেছেন। আপনি আমার সেই মাষ্টারমশাই নাহ। আপনি অন্য কেউ। আমার ছোট্ট মনে অনুভূতির জন্ম দিয়ে এখন সেগুলোকে নিজেই গলা টিপে মে’রে ফেলার চেষ্টা করছেন! যদি আমার থেকে দুরে সরে যাওয়ারই হয় তবে মনে এভাবে আশার প্রদীপ কেনো জ্বালিয়েছিলেন মাষ্টারমশাই? আপনি ভীষণ খা’রাপ মাষ্টারমশাই। ভীষণ খা’রাপ!’

অর্থি ছুটে চলে যায়। নিবিড় হাত মুষ্টিবদ্ধ করে চোখ নিচে নামিয়ে রাখে। সে অবস্থাতেই চোখের কোণ বেয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। বুকের ভেতরটা যেনো হু হু করে কেঁদে ওঠে। কোনো রকমে এলোমেলো পা চালিয়ে হাঁটতে থাকে। বিড়বিড় করে বলে,

‘আমি সত্যিই ভীষণ খা’রাপ অর্থি। তোমাকে ভালোবেসেও তোমাকে ভালোবাসা বারণ আমার। তোমার বিরহে যে দিনের পর দিন আমার মৃ’ত্যু হচ্ছে। এ তোমায় কি করে বোঝায়?’

অর্পিতা আর চিত্রর বিয়ের দিন করা হয়েছে শুক্রবার। হাতে আছে কেবল ৪ দিন। এর মাঝেই বিয়ের কেনাকাটা থেকে শুরু করে সবকিছু সেড়ে নিতে হবে। বাড়িতে একটা রমরমা পরিবেশ। মেহমান দাওয়াত করাা হয়ে গেছে। পল্লবীর, শায়লার বাবার বাড়ির লোকজন এখনই আসতে শুরু করেছে। বাড়ির বউরা ব্যস্ত অন্দরমহলের সবকিছু সামলাতে আর পুরুষরা বাহিরের সব কিছু ঠিকঠাক করে নিচ্ছে। সারাদিনে নীরা, চৈত্রিকা, সাথী, পল্লবী, শায়লা, নাসিমা কারোই একটুও বিশ্রাম নেওয়ার সময় হচ্ছে নাহ।

সবাই এখন থেকেই কাজের ওপরে রয়েছে। বাড়িতে তো আরো মেইডরা রয়েছেই। সারাদিনে প্রহর চৈত্রিকার দেখা পায় কেবল খাওয়ার টেবিলে। আর রাতে ঘুমানোর সময়। এর মাঝের সময়টুকু সে হাওয়া। প্রহর নিজেও ছোট ভাইয়ের বিয়ের সবকিছুর জন্য প্রচুর ব্যস্ততার মাঝে কাটাচ্ছে। আজ সবাই মিলে শহরে যাবে কেনাকাটা করতে। সবাই সেজন্যই তৈরী হতে ব্যস্ত। যদিও অন্যান্য সময় বাড়িতেই শাড়ি দিয়ে যায় ব্যবসায়ীরা কিন্তু এবার সবাই মিলে আবদার করেছে শহরে গিয়ে নিজেরা কেনাকাটা করবে।

সবার আবদারের কাছে হেরে গিয়ে প্রহর রাজি হয়েছে। চৈত্রিকা একটা লাল পাড়ের কালো শাড়ি পড়েছে। পায়ে আলতা, নুপুর, কানে দুল, চুলগুলো খোপা করা আর তাতে গুজে দেওয়া বেলী ফুল, হাতে চুড়ি।৷ প্রহর ঘরে এসে চৈত্রিকার সাজ দেখে থমকায়। মুখে কৃত্রিম কিছু বলতে কেবলই ঠোঁটের লাল রঙ আর চোখে কাজল। চৈত্রিকা তাড়াহুড়ো করে তৈরী হতে হতেই খেয়াল করে প্রহর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। চৈত্রিকা ব্যস্ত গলায় বলে,

‘সবাই তৈরী হয়ে গেছে জমিদার সাহেব? ইশশ আমি দেড়ি করে ফেললাম। আমারও হয়ে গেছে। একটু দাঁড়ান!’
প্রহর কোনো জবাব দেয় না। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে নিজের বউয়ের সৌন্দর্য। বিড়বিড় করে আওড়ায় ‘মাশাল্লাহ’। চৈত্রিকা প্রহরকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কয়েকবার ডাকে। প্রহর এবারও জবাব না দিয়ে এগিয়ে আসে চৈত্রিকার কাছে। চৈত্রিকা পায়ের নুপুর ঠিকমতো পড়ে পিছে ঘুরতেই বারি খায় প্রহরের প্রশস্ত বুকে। প্রহর সরে যেতে না দিয়ে আরো প্যাচিয়ে নেয় নিজের সাথে। চৈত্রিকা ব্যস্ত গলায় বলে,

‘ছাড়ুন ছাড়ুন! সবাই অপেক্ষা করছে তো!’
‘করুক!’
‘করুক মানে?’
প্রহর বাম হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে চৈত্রিকার ঠোঁটের লাল রঙ মুছে দেয়। চৈত্রিকা কিছু বলতে গেলেও সে থামিয়ে দেয়। নিজেই বলে, ‘এইসব দিতে হবে নাহ।’
চৈত্রিকা ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘দিলে কি হবে?’
‘আমি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবো।’

চৈত্রিকা চোখ বড় বড় করে তাকায়। প্রহরের সরাসরি বলা কথা বুঝতে তার দেড়ি হয় না। হাত দিয়ে ছুটার চেষ্টা করতে করতে বলে, ‘জলদি ছাড়ুন আমাকে। দিন দিন নিজের মুখের লাগাম হারিয়ে ফেলতেছেন।’
‘উহু ছাড়বো নাহ।’

চৈত্রিকা এবার ছোটাছুটি বন্ধ করে দেয়। বড় একটা শ্বাস নিয়ে পা একটু উচু করে প্রহরের শার্টের কলার টেনে নিয়ে নিজের ঠোঁট মুছে ভালো করে। প্রহর চৈত্রিকার কান্ডে ঠোঁট চেপে হাসে। চৈত্রিকা প্রহরের শার্ট ছেড়ে বলে,
‘আর নেই। এবার ছাড়ুন!’

প্রহর হাত আলগা করে দেয়। চৈত্রিকা বের হয়ে চলে যেতে নিলে পেছন থেকে প্রহর ফের বলে, ‘আমি যদি এখন এই শার্টেই বাহিরে যাই তাহলে কেমন হবে চৈত্র?’
চৈত্রিকার পা থেমে যায়। চোখ বড় বড় করে দৌড়ে আসে প্রহরের কাছে। শার্টের এক কোণা চেপে ধরে বলে, ‘পা’গল হলেন নাকি! সবাই কি ভাববে?’

‘আমি কি জানি! তুমি মুছলে কেনো আমার শার্টে?’
প্রহরের কন্ঠে দুষ্টুমি। কিন্তু চৈত্রিকা আতঙ্কিত। প্রহর যদি সত্যি সত্যিই এই শার্ট পড়েই বের হয় তাহলে লজ্জায় মাথা কা’টা পড়বে। এটুকু ভাবতেই তার কান গরম হয়ে যাচ্ছে৷ মাথা দুদিকে নাড়িয়ে বলে,
‘আপনি মুছতে বলেছেন তাই মুছেছি। কিন্তু এখন আপনি জলদি শার্ট পাল্টে নেন।’
‘যদি না পাল্টাই?’
‘জমিদার সাহেব!’

প্রহর শব্দ করে হেঁসে ওঠে। চৈত্রিকা ফ্যালফ্যাল করে মুগ্ধ হয়ে সে হাসির দিকে চেয়ে থাকে। প্রহরের শার্ট আরো শক্ত করে ধরে মুগ্ধ কন্ঠেই বলে, ‘আপনি হাসলে আপনাকে ভীষণ সুন্দর দেখায় জমিদার সাহেব। আমার হৃদপিণ্ডের গতি থেমে যায়।’
প্রহর হাসি থামিয়ে অবাক হয়ে তাকায়। এই প্রথম হয়তো চৈত্রিকা প্রহরের প্রশংসা করেছে নিজ মুখে। চৈত্রিকা চট করে সরে যায়। লজ্জায় লাল হওয়া মুখটা ঢাকতে ঘুরে দাঁড়িয়ে ছুট লাগায়। ছুটতে ছুটতেই জোড়ে বলে,
‘শার্টটা কিন্তু বদলে আসবেন জমিদার সাহেব!’

চৈত্রিকার যাওয়ার পানে তাকিয়ে মুচকি হাসে প্রহর। নিজের শার্টের কলার টেনে তা দেখে শার্ট খুলতে শুরু করে। আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজের প্রতিবিম্বকে নিজেই বলে,
‘তুমি শেষ প্রহর রেনওয়াজ। এই চৈত্রের সৌন্দর্য, লজ্জায় রাঙা মুখ, খোলা চুল, নুপুর আর চুড়ির শব্দ সাথে তার বিখ্যাত ‘জমিদার সাহেব’ বলা সবকিছুতেই তুমি শেষ। শেষ পর্যন্ত এক সপ্তদশী কন্যা তোমার প্রাণ নিয়ে চলে গেলো!’

গ্রাম ছেড়ে সুদুর শহরে এসেছে সবাই কেনাকাটা করতে। প্রহর যদিও অনিমকে পছন্দ করে না তবুও আগেই খবর পাঠিয়েছিলো যেনো সে তার সবকিছু গুছিয়ে সোজা দোকানে চলে আসে। ঠিকানাও আগেই দেওয়া ছিলো তাই অনিম আগে ভাগেই এসে দাঁড়িয়েছিলো। চৈত্রিকারা এসে নামতেই অনিম এসে গাল ফুলিয়ে বলে,

‘এতোক্ষণ লাগে! সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি বল তো! বাবাগো আমার পা শেষ।’
অর্থি চৈত্রিকার পেছন থেকে মাথা বের করে বলে, ‘পেট মোটা অনিম ভাই! এখন কি পা ছাড়া অনিম ভাই বলে ডাকবো!’
অনিম ফুঁসে উঠে বলে, ‘এই মেয়ে তুমি সামনে আসো খালি!’
অর্থি ভেংচি কে’টে দৌড় দেয়। চৈত্রিকা হেঁসে বলে, ‘তোমরা দুজন এমন সা’প আর নেউলের মতো করো কেনো? চলো ওদিকে!’

অনিম মনে মনে অর্থিকে বকতে শুরু করে। চৈত্রিকা আর অনিমকে আগে আগে যেতে দেখে প্রহর ভ্রু কুঁচকায়। তাকে না নিয়ে চৈত্রিকা এই ছেলের সাথে আগে আগে কেনো যাবে! বিষয়টা এমন যে প্রহরের বউ শুধু প্রহরের আশে পাশেই থাকা লাগবে। অন্য কারো ধারে কাছেও ঘেষা যাবে না। যাবে না মানে একদমই যাবে না। প্রহর ফোঁস করে শ্বাস নিয়ে হাঁটা লাগায়।

সবাই নিজেদের পছন্দ মতো শাড়ি, গহণা নিয়েছে। চৈত্রিকার ওপর দায়িত্ব পড়েছে অর্পিতার বিয়ের শাড়ির আর গহণার। চৈত্রিকা নিজেরটা না দেখে আগে অর্পিতার জন্য সব নিলো। যদিও অর্পিতার পছন্দমতোই সব নিয়েছে। প্রহর, চিত্র, অনিম আর নিবিড় মিলে চিত্রর জন্য পাঞ্জাবি, পাজামা, জুতো নিয়ে নিজেদের জন্যও নিয়েছে। ওহ হ্যাঁ! প্রহর নিজেই নিবিড়কে এসবের মাঝে এনেছে এবং বিয়েতেও থাকতে বলেছে। নিবিড় প্রথমে অনেক বাহানা করলেও প্রহরের কাছে পেরে ওঠেনি। ছেলেদের সব কেনা শেষ হলেও মেয়েদের এখনো অনেক বাকি। অর্থি একবার এটা নিচ্ছে তো আরেকবার অন্যটা। কোনোটাই পছন্দ করতে না পেরে কাঁদো কাঁদো মুখ করে বসে আছে। অনিম এগিয়ে এসে গলা পরিষ্কার করে বলে,

‘কি ব্যাপার বোকা বাচ্চা! কোনোটা পছন্দ হচ্ছে না নাকি!’
অর্থি ফোঁস করে উঠে বলে, ‘বোকা বাচ্চা কাকে বললেন?’
‘তুমি ছাড়া আর কার সাথে কথা বলতেছি আমি?’
‘তার মানে কি আমাকে বলছেন!’
‘এখনো বোঝোনি!’

অর্থি ছ্যাত করে উঠলেও কিছু না বলে চুপ করে শাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে। অনিম অর্থির হঠাৎ চুপ থাকার বিষয়টা হজম করতে পারে না। তাই ফের বলে, ‘কি হয়ছে?’
‘আমার মন ভালো নেই তাই আপনার সাথে ঝগড়া করবো না আমি।’
‘মনের কি হয়ছে?’
‘আপনাকে বলবো কেনো?’
‘বলবে না কেনো?’
‘আপনি দুরে যান আমার থেকে!’

অর্থি ছুটে চৈত্রিকার কাছে যায়। চৈত্রিকার আঁচল ধরতেই চৈত্রিকা জিজ্ঞেস করে, ‘কি হয়েছে অর্থি?’
‘ভাবীজান আমাকে শাড়ি পছন্দ করে দেন। আমি কোনোটাই পছন্দ করতে পারতেছি না।’
চৈত্রিকা মাথা নাড়িয়ে অর্থিকে শাড়ি পছন্দ করে দেয়। অর্থি খুশিতে গদগদ হয়ে বলে, ‘আমার বিয়েতেও আপনাকে শাড়ি পছন্দ করতে দেবো তখন আপনি অন্নেএএএকক সুন্দর একটা শাড়ি পছন্দ করে দেবেন৷ কেমন!’
চৈত্রিকা আর অর্পিতা হেঁসে ওঠে। অর্পিতা অর্থির মাথায় গাট্টা মে’রে বলে, ‘বয়স হয় নাই তোর বিয়ের। আরো ৫/৭ বছরের আগে তোর বিয়ে টিয়ে দেবো না।’

অর্থি ভেংচি কাটে। সবার কেনাকাটার মাঝেই প্রহর একটা প্যাকেট হাতে এগিয়ে আসে। সবার সামনেই চৈত্রিকার দিকে এগিয়ে দিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে, ‘এটা দেখো!’
চৈত্রিকা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে প্রহর চোখ দিয়ে ঈশারা করে। চৈত্রিকা প্যাকেট খুলতেই বের হয়ে আসে সুন্দর ৩টা শাড়ি আর ৩ রকমের গহণা। শাড়ি ৩ টা দেখেই চোখ ধাঁধিয়ে যায়। অর্পিতা আর অর্থি একসাথে বলে, ‘কত্তো সুন্দর শাড়ি!’

চৈত্রিকা প্রহরের দিকে তাকাতেই প্রহর কোনো কথা না বলে চলে যায়। সবার বোঝা হয়ে যায় এগুলো চৈত্রিকার জন্যই কেনা। অর্পিতা, নীরা, সাথী চৈত্রিকাকে খোঁচাতে থাকে। চৈত্রিকা লজ্জা পায়। সবার কেনাকাটা শেষে নিজেদের গাড়ির কাছে এগিয়ে যায়। সবাই আগে চলে গেলে প্রহর হাত টেনে ধরে চৈত্রিকার। হাত ধরেই এগোতে এগোতে বলে,
‘শাড়ি পছন্দ হয়েছে?’

চৈত্রিকা ঠোঁট চেপে বলে, ‘জমিদার সাহেব পছন্দ করে দিয়েছে তাহলে আমার পছন্দ না হয় কেমন করে!’
প্রহর আর কিছু বলে না। একসাথে এসেই গাড়িতে ওঠে। সবার বসার পর শুধু জায়গা থাকে একটা সিট। তাও অর্থির পাশে। নিবিড় এসে জায়গা পায় ওই একটাই। দুজন দুজনের দিকেই এক পলক তাকায়৷ কিছু না বলেই বসে পড়ে অর্থির পাশে।

পুরো রাস্তাতেই দুজন দুজনের সাথে কোনো কথা বলে নাহ। বেচারী অর্থির নিবিড়কে দেখলেই কান্না পায়। কোনো রকমে কান্না গিলে হাতে হাত চেপে বসে থাকে। যেতে যেতে রাস্তাতেই সন্ধ্যা হয়ে যায়। অর্থি গাড়িতেই ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের ঘোরে মাথা রাখে নিবিড়ের কাঁধে। নিবিড়ের হার্টবিটের গতি দ্রুত হয়। হাতে হাত ঘষতে ঘষতে চোখ পিটপিট করে বন্ধ করে নেয়। মনে মনে আওড়ায়,

চৈত্রিকা পর্ব ৩৬

‘এভাবে আমার কাছে এসো না অর্থি। আমি আর তোমার মায়া বাড়াতে চাই নাহ। আমার হৃদয়ের ক্ষ’ত আর বাড়াতে চাই নাহ।’
অর্থি আর নিবিড়ের ইতস্তত থেকে শুরু করে নিবিড়ের অস্বাভাবিক আচরণ পুরোটা কেউ খেয়াল না করলেও চৈত্রিকার চোখ ঠিকই পড়ে। প্রথমে ভ্রু কুঁচকে থাকলেও পরে যখন আন্দাজ করতে পারে তখন নিজ মনেই বলে ওঠে, ‘স’র্ব’না’শ!’

চৈত্রিকা পর্ব ৩৮