অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ২৯

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ২৯
জিন্নাত চৌধুরী হাবিবা

বারান্দার শীতল হাওয়া শরীরে শিরশিরে অনুভূতির জন্ম দিচ্ছে। একহাতে অপরহাতে ঘষে চলেছে তরী। কতগুলো দিন পেরিয়ে গেল, অথচ তাদের সম্পর্কের উন্নতি হলোনা। তরীর প্রেমে ব্যাকুল মাহমুদ একটিবার দেখা করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। বাবা বাসায় থাকেন না বললেই চলে। তরী ঠিক করলো অরুকে স্কুল থেকে নিয়ে আসার পথে একবার দেখা করবে মাহমুদের সাথে। বারান্দা ছেড়ে ছুটে এলো ঘরে। মুঠোফোন হাতে তুলে চিরপরিচিত নাম্বারে ডায়াল করলো। খানিক সময়ের মাঝেই রিসিভ হলো। শোনা গেল গভীর সেই কন্ঠস্বর।

-“তরী!”
তরী চুপটি করে শুনলো। জবাব দিলোনা। ছোট্ট এই ডাকে যেন হৃদয় নিংড়ানো সবটুকু ভালোবাসা প্রকাশ পায়। তরী আবার শুনতে চায় তার নাম।
নিরবতার অবসান ঘটলো না দেখে মাহমুদ ফের ডাকলো,
-“তরী!”
তরী চোখ বুজলো। অতঃপর অনুরাগী স্বরে জবাব দিলো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-“হুঁ।”
-“কথা বলছো না যে?”
-“শুনছি।”
তরীর ছোট্ট জবাবে মাহমুদ শুধালো,
-“কি শুনছো?”
-“আপনাকে।”

তরীর প্রেমময় স্বরকে উপেক্ষা করলো মাহমুদ। নিচুস্বরে বলল,
-“পরে কথা বলছি। ক্লাসে আছি আমি।”
তরীকে বলার সুযোগ না দিয়েই মাহমুদ খট করে লাইন কে*টে দিল।
তড়িৎ বার্তা পাঠালো তরী।
❝ছুটি নিন। অরুকে নিতে যাবো, তখন দেখা করবো আপনার সাথে।❞
ফোন রেখে কাজে লেগে পড়লো তরী।

মাহমুদ ফোনের স্ক্রিনে ভেসে আসা বার্তা পড়লো। তার ঠোঁটের কোন প্রসারিত হলো। বহুল আকাঙ্ক্ষিত মুহূর্তটি যেন আজ পেতে চলেছে! চোখেমুখে লেগে আছে নজরকাড়া নিটোল হাসি।
ছাত্র-ছাত্রীরা ফিসফাস করছে মাহমুদকে নিয়ে। যার কিছু কিছু মাহমুদের কর্ণধারের বাড়ি খাচ্ছে।
-“হ্যাঁ স্যার নিশ্চয়ই প্রেম করে। দেখলিনা কিভাবে কথা বলেছে। আবার মিটিমিটি হাসছে।”

অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়লো মাহমুদ। দ্রুত ফোন পকেটে ঢুকিয়ে গলা পরিষ্কার করে একটু কঠোর হলো। অথচ কঠোরতা তার স্বভাবের সাথে যায় না। এতেও যেন তার বিব্রতভাব কাটছেনা। হুট করেই ক্লাস থেকে বিনা বার্তায় বেরিয়ে গেল। মিনিট পাঁচেক বাইরে ঘুরেফিরে নিজেকে ধাতস্থ করে ক্লাসে ফিরলো।

ক্লাস শেষ হতেই ইমার্জেন্সি বলে ছুটি নিয়ে বেরিয়ে গেল মাহমুদ। রিকশায় চড়ে অরুর স্কুলের সামনে এসে থামলো। এখনো স্কুল ছুটি হতে ত্রিশ মিনিট বাকি। শীতের নরম রোদ মিষ্টি ভালোলাগার জন্ম দিচ্ছে। ঠিক ত্রিশ মিনিট নয়,গুণে গুণে পঁচিশ মিনিট যেতেই তরীর অবয়ব দেখা গেল। মাহমুদের হৃদয় শীতল হলো যেন। তরী এসে রিকশা থেকে নামলো।
কিছুক্ষণ যেতেই স্কুল ছুটি হলো।

একে একে বাচ্চারা গেইট দিয়ে বেরিয়ে আসছে। অরু তরীকে দেখেই ছুটে এসে ছোটো ছোটো হাত দুটো দিয়ে কোমর আঁকড়ে ধরলো। তরী অরুর কাঁধ থেকে ব্যাগ খুলে নিল। হুট করেই পেছন থেকে কেউ কোলে তুলে নেওয়াতে ভড়কে গেল অরু। কোলে চড়ে দেখলো মাহমুদ। এতক্ষণ তাকে নজরে আসেনি। অরু গাল ফোলালো। নেমে যেতে চাইলো কোল থেকে। মাহমুদ আদুরে স্বরে বলল,

-“অরু পাখি কি আমার সাথে কথা বলবে না?”
অরু ফুলো ফুলো গালে, পিটপিট চোখে তাকিয়ে বলল,
-“নাহ্!”
-“আমার দো*ষ কোথায়?”
-“তুমি আমাদের বাড়ি থেকে চলে গিয়েছো কেন?”
মাহমুদ অপরাধী চোখে তাকালো। বলল,
-“সেখান থেকে আমার কলেজ দূরে হয়ে যায় যে।”

তবুও অরুর রাগ কমলোনা। মাহমুদ ব্যস্ত হয়ে পড়লো তার রাগ ভাঙাতে। বলল,
-“আচ্ছা কী করলে রা*গ কমবে? চকলেট? চিপস? নাকি অন্যকিছু?”
অরু আড় চোখে তাকালো। তার রাগ একটু একটু কমছে বোধহয়। তবুও চুপ করে রইলো। মাহমুদ দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,

-“কী খাবে?”
এবার কথা বলল অরু। ফুলকো ফুলকো গাল দুটো স্বাভাবিক হয়েছে। তবুও একটু ভাব ধরে চিপস, চকলেট দেখিয়ে দিয়ে বলল,
-“এগুলো নেবো।”
মাহমুদ নিঃশব্দে হেসে কিনে দিল। তাকে কোলে নিয়ে তরীর হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে সামনে এগিয়ে গেল।
রিকশায় চড়ে মাহমুদ বলল,
-“চলুন মামা।”
মৃদুমন্দ বাতাসে সামনের ছোটো চুলগুলো বেশ বিরক্ত করছে তরীকে। মাহমুদ একহাতে সেগুলো সরিয়ে দিল। অরু তার চিপস, চকলেট নিয়েই ব্যস্ত। তরী বা মাহমুদ পাশ ফিরে তাকালে হয়তো তাদের সর্ব*নাশ দেখতে পেত।

ফুটপাতের ভ্যানে একজন লোক জামাকাপড় বিক্রি করছেন। মিঠুর অত রাখঢাক নেই। যখন যেখানে যা পছন্দ হয়,নিঃসংকোচে কিনে নেয়। রাতে ট্রাউজার পরে ঘুমাতে আরাম পাওয়া যায়। মিঠু ধরে দেখলো ট্রাউজার ভালোই আছে। দামাদামি করার পর ভ্যানের লোকটি বললেন,
-“আরো বিশ টাকা বাড়তি দিন।”
মিঠু বলল,

-“এই দামে দিলে দিন। না দিলে আমি যাচ্ছি। আপনার লস হলে দিতে হবেনা।”
লোকটি বললেন,
-“আর দশ টাকা বাড়তি দিন। কথা বাড়িয়েন না।”
মিঠু বলল,
-“আপনি যদি বলেন ’ ফ্রি-তে তোমার পিঠ চুলকে দেব’
তবুও আমি দশ টাকা বাড়তি দেব না।”

শেষমেশ নিজের ঠিক করা দামেই ট্রাউজার কিনে সামনে এগোলো দুই বন্ধু। রামি এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মিঠুর কাজ দেখলো। সে হেসে কুটিকুটি। বলল,
-“আমি তোর পিঠ চুলকে দেব। আমাকে দশ টাকা দে। তুই না জমিদারের বংশধর? তাহলে এত ছ্যাঁচড়ামো করলি কেন?”
মিঠু ভাবলেশহীনভাবে বলল,
-“যদি ছ্যাঁচড়ামি করতাম, তাহলে আরো কম দামে নিতে পারতাম।”
রামি বলল,

-“তুই এক কাজ কর। ভালো ইনকাম হবে। ছ্যাঁচড়ামো কোর্স সেন্টার খুলে ফেল। সবাই তোর কাছ থেকে শিখবে ছ্যাঁচড়ামো কিভাবে করতে হয়।”
-“বুদ্ধি ভালো দিয়েছিস।”
রামি খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,
-“এই খুশিতে আমাকে ট্রিট দে।”

রামি পকেটে হাত দিল। একশ টাকার নোট বেরিয়ে এসেছে। টাকাটা পকেটে রেখে আফসোসের সুরে বলল,
-“পকেটে দুই টাকা নেই বলে তোকে ট্রিট দেওয়ার মতো রিস্ক নিতে পারলামনা।”
মিঠু বলল,
-“তুই আসলেই ছ্যাঁচড়া।”

এতে মিঠুর খুব একটা এসে গেল না। সে নির্বিকার ভঙ্গিতে হেঁটে এগিয়ে গেল। হঠাৎই থেমে গেল। চোখদুটো লাল হয়ে এলো। একটু একটু পানি জমছে। রামি তার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালো। তাদের বয়সি একটি ছেলে মায়ের বয়সি একজনের হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। মাঝেমাঝে দুষ্টুমি করছে। সাথে ভদ্রমহিলা হেসে উঠে কানমলা দিচ্ছেন। মিঠুর কাঁধে হাত রাখলো রামি। সংবিৎ ফিরতেই শার্টের হাতায় চোখ মুছে নিলো মিঠু। রামির উদেশ্যে বলল,

-“চল, দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
কন্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে আসছে। রামির কাছে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কোন শব্দ বা বাক্য নেই। সেও আর কথা বাড়ালোনা। সামনে এগিয়ে গেল। মুহুর্তের হাসিহাসি বন্ধুত্বের মাঝে কালো মেঘ জমলো। হৈ-হুল্লোড় থেমে নিস্তব্ধ হলো সবকিছু।

বাবা বাড়ি ফেরার পর থেকেই থমথমে মুখে বসে আছেন। কোন কথা বলছেন না তরীর সাথে। তরী যাই জিজ্ঞেস করছে, জবাব পাচ্ছে না। আবার জিজ্ঞেস করলো,
-“কী হয়েছে বাবা। আমি কোন দো*ষ করেছি? এভাবে চুপ করে আছো কেন?”
বাবা আরো গম্ভীর হলেন। তরীর ভেতরে ত্রাসের রাজত্ব। বড়ো কোন দোষ না করলে বাবা এমন চুপচাপ থাকেন না তাদের সাথে। তরী অস্ফুট স্বরে আরেকবার ভয়ে ভয়ে ডাকলো,

-“বাবা!”
বাবা অরুকে কোলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
-“স্কুল ছুটির পর কোথায় গিয়েছিলে, মা?”
অরু মাহমুদের কথা বলে দিল। তরী ঢোক গিললো। বাবার যা জানার তা জানা হয়ে গেল। তার মানে তিনি মিথ্যে শোনেননি। তিয়াসের বাবাই আজ কল দিয়ে উনাকে ডেকে তরীর ব্যাপারে কথা বললেন।
মাহমুদের সাথে দেখা ঘটনা রংচঙ মিশিয়ে বাড়িয়ে বললেন। অপমানিত হলেন তরীর বাবা। থমথমে ভাব নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। মেয়েকে ছোটো থেকে যেভাবে দেখে এসেছেন তা যেন এক পলকেই মিথ্যে হয়ে গেল।
এবার ভয়ার্ত তরীর মুখোমুখি হলেন। কঠিন স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়লেন,

-“কতদিনের সম্পর্ক?”
তরী মাথা নিচু করে আছে। বাবা হুংকার ছাড়লেন,
-“প্রশ্ন করেছি আমি।”
কেঁপে উঠলো তরী। কন্ঠস্বর রোধ হয়ে এলো। ভয়ে মুখ দিয়ে একটা শব্দও উচ্চারিত হচ্ছেনা। থরথর করে হাত পা কাঁপছে। প্রস্তুতি নিচ্ছে সত্যিটা বলার। বাবা আবারও ধমকে উঠলেন। তরী হুট করেই বলে ফেললো,
-“আমরা বিয়ে করে ফেলেছি বাবা।”

তরীর বাবা থমকে গেলেন। এতক্ষণের তেজ মলিন হয়ে এলো। শরীরের ভর ছেড়ে দিলেন। তরীর কথাটুকু বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। শান্ত গলায় একবার জিজ্ঞেস করলেন,
-“কবে বিয়ে করলি?”
তরী কাঁপা কাঁপা স্বরে জবাব দিল,

-“যেদিন চাচা-চাচি আংটি পরিয়ে গিয়েছেন, সেদিন।”
বাবা আর কিছুই বললেন না। মেয়ের এত অধঃপতন মেনে নিতে পারলেন না। শুধু বললেন,
-“চলে যেও তোমার ঠিকানায়। আমার অনুমতি ছাড়া যখন বিয়ে করতে পেরেছো, তখন সংসারও করতে পার। আমি বাঁধা দেবো না।”
বাবার শান্ত কথায় স্পষ্ট রাগ, অভিমান খুঁজে পেল তরী। একবার ডাকলো,

-“বাবা!”
-“পারলে আজই চলে যাও।”
কথাটুকু বলেই বাবা চলে গেলেন।
যদি বিয়ের ব্যাপারটা সামনে না আসতো, তবে মাহমুদ -তরীর জন্য সবটা সহজ হতো। বাবাও হয়তো মেনে নিতেন। তরীর বাবার কষ্টটা হলো তাদের অমতে তখনই কেন মেয়ে বিয়ে করলো?

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ২৮

তিয়াসের বাবার কাছে ছোটো হলেন তিনি। বাবার এই অভিমান না তরীকে বাবার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়!
তরী ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। বাবা রাতে আর খেলেন না। সকালে তরীকে যেতেও বললেন না, কথাও বললেন না। সোজা না খেয়ে বেরিয়ে গেলেন।

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ৩০

1 COMMENT

Comments are closed.