চৈত্রিকা পর্ব ৮

চৈত্রিকা পর্ব ৮
বোরহানা আক্তার রেশমী

গোধূলির সময় তখন। বিয়ের পর সাথীদের বাড়ির ঝামেলা মিটাতে মিটাতেই বিকেল পেড়িয়ে গেছে। জমিদার বাড়িতে চৈত্রিকার বরণ হয় গোধূলির সময়। চৈত্রিকা তখন শান্ত। প্রহর আর চৈত্রিকাকে বরণ করে ঘরে তুলে পল্লবী। দুজনকেই বসিয়ে দেয় হল রুমের সোফায়৷ চৈত্রিকা বিনাবাক্য বেয়ে সবার নিয়ম মেনে চলছে। দুতলা থেকে এক পলক চৈত্রিকাকে বউ সাজে দেখেছে পিয়াস৷

রাগে, ক্ষো’ভে দরজা আটকিয়ে বসে আছে৷ নীরা অসন্তুষ্ট মনে সকল কাজ করে যাচ্ছে। শায়লা বরাবরই এসবের থেকে দুরে। চয়ন, শিমুল দু ভাই নিজের ঘরে চলে গেছে বেশ অনেকটা সময় আগেই৷ প্রহর এখনো বসে আছে দেখে বেশ অবাক হয় চৈত্রিকা। লোকটা তো এখনো থাকার কথা নয় তাহলে! অর্পিতা, অর্থি, অয়ন এসে চৈত্রিকার পাশে বসে। বেশ অনেকটা সময় ওভাবে বসে থাকার পর পল্লবী এসে চৈত্রিকাকে প্রহরের ঘরে নিয়ে যায়। প্রহর একপলক সেদিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসে। চিত্র এসে পাশে বসে। বেশ শান্ত স্বরে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘তুমি ঠিক কি চাইছো বড় ভাইজান?’
প্রহর জবাব না দিয়ে চৈত্রিকার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো৷ চিত্রও তার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকিয়ে থাকে। চৈত্রিকাকে প্রহরের ঘরে বসিয়ে দেয় পল্লবী। বলে,
‘রাতের সময় তো এখনো অনেক দেড়ি তাই তুমি চাইলে এগুলো বদলে নিয়ে বসতে পারো বড় বউ।’
চৈত্রিকা কোনো কথা বললো না। শুধু মাথা নাড়ালো। পল্লবী আলমারি থেকে শাড়ির প্যাকেট বের করে বেশ আফসোসের সুরে বললো,

‘ঘরটা আমার মহুয়া বউয়ের ছিলো। না জানি কার নজর পড়েছিলো আমার সংসারে! মেয়েটা অকালে চলে গেলো।’
‘এতো ভালোবাসতেন মহুয়া বুবুকে?’
পল্লবীর ঠান্ডা গলার প্রশ্নে পল্লবী মুখটা করুণ করলো। বেশ করুণ স্বরেই বললো, ‘বাসবো না? বাড়ির বড় বউ ছিলো ‘ও’। আমার বড় মেয়ে।’
চৈত্রিকা অদ্ভুত ভাবে হেঁসে বলে, ‘সেই বড় মেয়েরই মৃ’ত্যুর ৩ মাসের মাথায় আপনার বড় ছেলে বিয়ে করলো তাও আবার আমার মতো এমন একটা মেয়েকে যার আগেও কেউ নেই, পরেও কেউ নেই৷ মামা তো সবচেয়ে খারাপ মানুষ যাকে আপনারা খুব ঘৃ’ণা করেন তারই ভাগ্নীকে বিনা দ্বিধায়, কি সুন্দর করে মেনে নিলেন! একটু অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে না শ্বাশুড়ি মা?’

চৈত্রিকার বিচক্ষণ বুদ্ধি, চতুর প্রশ্নের কাছে ঘাবড়ে গেলো পল্লবী। ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বেশ ঝাঁঝালো স্বরে বললো, ‘আমার ছেলে তো আর আজীবন ম’রা বউয়ের শোক নিয়ে বসে থাকবে না তাই না! তুমি মেয়ে ছোট ছোটোর মতো থাকো। পাকামো করবে না একদম। ধরো! শাড়ি পড়ে নিও।’
চৈত্রিকার হাতে প্যাকেটটা দিয়ে গটগট করে রুম থেকে বের হয়ে যায়। চৈত্রিকা পল্লবীর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হেঁসে ওঠে। বিড়বিড় করে বলে, ‘আহারে জমিদার গিন্নি! গোপন আতে বুঝি ঘা লাগলো!’

অর্থি এই সাঁঝের বেলায় বেড়িয়েছে বাড়ি থেকে। উদ্দেশ্য নিবিড়ের বাড়ি। পেটের মধ্যে কথার ফুলকি ফুটছে কাকে বলবে ভেবে ভেবে শেষে পেয়েছে নিবিড়কে। চুপিচুপি বাড়ি থেকে বের হয়ে ছুটে গেলো গ্রামের পথ ধরে। বেশ খুশি মনেই এগোতে এগোতে নিবিড়ের বাড়ির সামনের রাস্তাতেই দেখা হয় দুজনের। এই সময় অর্থিকে দেখে নিবিড় ভ্রু কুঁচকে তাকায়। অর্থি ছুটে এসে নিবিড়ের সামনে দাঁড়ায়। নিবিড় গম্ভীর স্বরে বলে,

‘এই মেয়ে! এই সময় এখানে কি করো? তোমার বাড়িতে জানে তুমি এই সময় বেড়িয়েছো? আজ না তোমার ভাইয়ের বিয়ে ছিলো!’
‘হ্যাঁ ছিলো তো। ওদের তো বিয়ে হয়ে গেছে। জানেন বড় ভাবীজানকে না অনেক সুন্দর লাগছিলো। আমি তো হা করে তাকিয়ে ছিলাম।’
‘তোমার মুখে হাতি ঢুকে যায়নি তো অর্থি?’

অর্থি কিছু বলতে নিয়েও চুপ করে যায়। কোমড়ে হাত রেখে বলে, ‘আমার মুখ কি অতো বড় নাকি যে মুখে হাতি ঢুকে যাবে! আপনাকে মাষ্টারমশাই কে বানিয়েছে বলেন তো! আপনার মাথা তো দেখি আমার মাথার থেকেও ফাঁকা।’
নিবিড় কেশে ওঠে। ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকে অর্থির মুখের দিকে। মেয়েটা এতো গা’ধা কেন? ইচ্ছে করলো মেয়েটার মাথায় দুটো গাট্টা মা’রতে। কিন্তু নিজের ইচ্ছে দমিয়ে কপালে ভাজ ফেলে চোখ মুখ কুঁচকে বললেন,
‘কোথায় যাচ্ছো তুমি? যাও তো নিজের রাস্তায়! মাথা খারাপ করো না আর।’

অর্থি গাল ফুলালো। হাত বগলদাবা করে বললো, ‘আমি আপনার মাথা খারাপ করি মাষ্টারমশাই? এটা আপনি বলতে পারলেন? আমি তো আপনার কাছে একটা কথা বলতে আসছিলাম।’
‘আমাকে? তোমার আবার আমার সাথে কি কথা?’
অর্থি পেছনে ঘুরে তাকায়। অভিমানী স্বরে বলে, ‘আর বলবো না। আপনি ভীষণ পঁচা!’
নিবিড় পাত্তাই দিলো না। নিজের মতো রাস্তায় হাঁটা লাগিয়ে বললো, ‘তো বলো না। বাড়ি চলো যাও!’
অর্থি নিবিড়কে যেতে দেখে নিজেও ছুট লাগায়। নিবিড়ের হাত আঁকড়ে ধরে বলে, ‘আপনি তো দেখি খুব পঁচা! সত্যি সত্যিই আমাকে ফেলে চলে যাচ্ছেন!’

‘তো কি করবো? আর তুমি যখন তখন আমার হাত ধরো কেন? ছাড়ো!’
অর্থি আলগোছে হাত ছেড়ে দেয়। মাথা নিচু করে পাশাপাশি হাঁটতে থাকে নিবিড়ের। নিবিড় জমিদার বাড়ির পথে হাঁটছে। এই সন্ধ্যা বেলা তো আর মেয়েটাকে একা ছাড়া যায় না। অন্তত নিবিড়ের পিছু পিছু হলেও নিজের বাড়ির দিকেই যাক। অর্থির চিন্তা ভাবনা অন্য জায়গায়। নিবিড়ের ধমকে সে মুখ ফুলিয়েছে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছে আর কখনোই সে মাষ্টারমশাইয়ের সাথে কথা বলবে না। না মানে না। লোকটা শুধু শুধু তাকে বকে! সন্ধ্যার হালকা আলোয় অর্থির মুখ ফুলানো নিবিড় আড়চোখে দেখলো। সাথে সাথেই ঠোঁট কামড়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো। অর্থি জানেই না সে নিবিড়ের পিছু পিছু নিজের বাড়ির দিকেই যাচ্ছে। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতেই নিবিড় প্রশ্ন করে,

‘কি বলতে এসেছিলে? কিছু হয়েছে?’
অর্থি জবাব দেয় না। নিজের গাল আরো ফুলায়। সে কোনোমতেই কথা বলতে রাজি নয়। নিবিড় ভ্রু কুঁচকে হাঁটা থামিয়ে দেয়। অর্থি একবার নিবিড়ের দিকে তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করে সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করে। নিবিড় বোঝে অর্থির অবস্থা। নিঃশব্দে হাসে। অর্থির পাশাপাশি হেঁটে যখন জমিদার বাড়ির সামনে আসে। তখন ফের বলে,
‘বড় ভাইজানের বিয়ে দেখে কি তোমারও বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে নাকি অর্থি? তোমার আব্বাজানের সাথে কথা বলবো?’

অর্থি ফট করে মাথা তুলে তাকায়। নিজের মনে মনে করা প্রতিজ্ঞা ভুলে গিয়ে গড়গড় করে বলে, ‘আপনি সত্যিই কথা বলবেন আব্বাজানের সাথে? আপনি আমাকে বিয়ে করবেন মাষ্টারমশাই?’
সাথে সাথেই নিজে নিজের মুখ চেপে ধরে। চোখ বড় বড় করে একবার নিবিড়ের দিকে তাকিয়ে দৌড়ে নিজের বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ে অর্থি। নিবিড় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কি বললো এটা অর্থি? এই মেয়ের মাথায় আসলে চলছে টা কি?

গভীর রাতে যে যার কক্ষে ঘুমে বিভোর। শুধু চৈত্রিকার চোখে ঘুম নেই। প্রহর এখনো আসেনি নিজের ঘরে। চৈত্রিকা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে বাতাস অনুভব করছে। মাথার মধ্যে হাজারও চিন্তা ভাবনা। সে সময় দরজা খোলার শব্দ পেয়েও চৈত্রিকা কোনো রকম ভ্রুক্ষেপ করে নাহ। চুপচাপ নিজ জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে। পুরো ঘরে চৈত্রিকাকে না দেখতে পেয়ে প্রহর উঁকি দেয় ব্যালকনিতে। সেখানে কারো অবয়ব দেখেই বুঝে যায় ওটা চৈত্রিকা।

নিঃশব্দে সে নিজেও এসে দাঁড়ায় চৈত্রিকার পিছে। চৈত্রিকা টের পায় কারো উপস্থিতি। নিজের খুব কাছে কারো উষ্ণতা টের পেয়ে চমকে পেছনে তাকাতে নিলে ধাক্কা খায় প্রহরের সুঠাম বক্ষের সাথে। চৈত্রিকা মাথাটা সরাসরি প্রহরের বুক বরাবর পড়ে। চৈত্রিকা মাথা উঁচিয়ে তাকিয়ে প্রহরের গম্ভীর মুখ দেখে নিজেকে সামলায়। সরে আসতে নিলে প্রহর টেনে ধরে। হাত ঠেকায় চৈত্রিকার উদরে। চৈত্রিকা কেপে উঠে চোখ বড় বড় করে তাকায়। দ্রুত কন্ঠে বলে,

‘কি করছেন?’
প্রহরের ঠোটের কোণে হাসি৷ চৈত্রিকার চোখের দিকে তাকিয়েই বললো, ‘কি করছি?
চৈত্রিকা কোনোরকমে বলে, ‘দুরে সরুন!’
‘সদ্য বিবাহিত নতুন স্ত্রীর কাছ থেকে দুরে সরবো? বিষয়টা ভালো দেখায় না চৈত্রিকা। তাছাড়া বিয়ে করেছি কি বউয়ের থেকে দুরে থাকার জন্য?’

চৈত্রিকা প্রহরের কথায় ভেতর ভেতর বেশ চমকায়। তবুও নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলে, ‘বিয়ে তো করেছেন লুকিয়ে! গ্রামের কেউও বোধহয় ঠিক মতো জানে না যে আপনি ২য় বিয়ে করেছেন। সেখানে আবার বউয়ের কাছে, দুরে থাকা নিয়ে কি সমস্যা!’
প্রহর ভ্রু কিঞ্চিত কুঁচকে তাকায়। বুঝলো না চৈত্রিকার কথার মানে। তবে ধরে থাকা হাতটা ঠিকই আলগা করে দিলো। চৈত্রিকা মনে মনে হাসলো। দুরে সরে এসে বেশ ব্যাঙ্গাত্মক স্বরে বলে,

‘জমিদারের বড় পুত্র ২য় বিয়ে করেছে অথচ তেমন কেউই জানে না। এই বিয়ের কি মূল্য?’
‘এখন কি লোক গণনা করে বিয়ের মূল্য করবে নাকি? আল্লাহর কালাম পড়ে বিয়ে করেছো আর তুমি সেখানে কয়েকজন লোককে গণনা করে বিয়ের মূল্য দেখাচ্ছো!’
চৈত্রিকা পাত্তা দিলো না। চুপচাপ ঘরের মধ্যে এসে বসলো। প্রহর কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে চুপচাপ নিজেও রুমে আসলো। চৈত্রিকার পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে বললো,

‘কি চাচ্ছো বলো তো!’
‘কি চাইবো? আমি যে আপনার স্ত্রী এটা পুরো গ্রামসহ আপনি আপনার সমস্ত আত্মীয়-স্বজন সবাইকে জানান। আমাদের বিয়ের বউভাতের অনুষ্ঠান করুন বড় করে। নাকি অতোটুকু সাহসও নেই? লোকসমাজে বুঝি বলতে পারবেন না যে আপনি ২য় বিয়ে করেছেন!’

প্রহর বেশ জ্বলে উঠে। তবে চৈত্রিকার উদ্দেশ্য ধরতে পেরে নিজেকে ভেতরে শান্ত করে বাঁকা হাসে। ধীর পায়ে চৈত্রিকার পাশে এসে বসে চৈত্রিকার চুলে ফুঁ দেয়। চৈত্রিকা বুঝে উঠে না প্রহরের এমন ব্যবহারের কারণ। প্রহর একদম কাছ ঘেঁষে বসে। চৈত্রিকা ফাঁকা ঢোক গিলে উঠে যেতে নিলে প্রহর আটকে দেয়। সরাসরি নাক, মুখ ডুবিয়ে দেয় চৈত্রিকার ঘাড়ে। চৈত্রিকা চমকে ওঠে। ফ্রিজড হয়ে যায় মুহুর্তেই। বেশ কয়েকবার ঢোক গিলে বড় বড় শ্বাস নেয়। প্রহরের হাত দৃঢ় হয়। হাতের বিচরণের সাথে সাথে সে ঠোঁট নাড়িয়েও বলে,

‘তুমি যদি এটাই চাও তবে হোক তা। কিন্তু অনুষ্ঠান হবে দুদিন পর। তাই বলে আমি কি আমার বাসর রাত মাটি করবো? উহু। কখনোই নাহ।’
চৈত্রিকা হাত দিয়ে সরানোর চেষ্টা করে। কিন্তু প্রহর না সরে আরো চেপে ধরে। প্রহরের উদ্দেশ্য এতটুকুও টের পেলো না চৈত্রিকা। বার বার কেঁপে কেঁপে মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকে। প্রহর বেশ মজা নেয়। একটা সময় যখন আরো খানিকটা ঘনিষ্ঠ হয় তখন প্রহর হুট করেই ছেড়ে দিয়ে উল্টো পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে।

চৈত্রিকা পর্ব ৭

চৈত্রিকা আটকে রাখা শ্বাস ছেড়ে দেয়। বড় বড় করে শ্বাস নিয়ে আড়চোখে একবার প্রহরের দিকে তাকায়। মনে মনে বেশ করে বকা দেয়। তবে প্রহরের এহেন ব্যবহারের আগা মাথার কোনোটাই তার বুঝে আসলো না। কি মনে করে কাছে আসলো আর কি মনে করেই বা সরে গেলো! এই লোকটার মধ্যে এতো রহস্য কেনো? কি চলছে প্রহরের মনে!

চৈত্রিকা পর্ব ৯