ছদ্মবেশে লুকানো ভালোবাসা গল্পের লিঙ্ক || মৌমি দত্ত

ছদ্মবেশে লুকানো ভালোবাসা পর্ব ১+২+৩
মৌমি দত্ত

৫ ফুট ১ ইঞ্চি উচ্চতা,,, পড়নে ব্ল্যাক জ্যাকেট সাদা টিশার্ট,,, টাইট জিন্স,, মুখে মাস্ক,, মাথায় হুডি তোলা এক ছেলে । তাড়াহুড়ো করে সদ্য পাওয়া নিউজ বসের কানে দিতে তার রুমের দিকে ছুটছে ইনায়াত চাঁদ। দ্রুত দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়লো। ” স্যার ” বলে ডাক দিতেই খাটের দিকে চোখ গেলো ইনায়াতের। খাটে একটা মেয়ের সাথে মিলিত হতে ব্যস্ত আফিম আহসান। বসকে এভাবে দেখেও ভাবান্তর হলো না ইনায়াতের। শুধু লজ্জায় মাথা নিচু করে এগিয়ে গেলো খাটের কিছুটা কাছে।

– স্যার!! মিস তানিয়া আপনার প্রোপোজাল রিজেক্ট করেছে।
কথাটা কানে হয়তো পৌছালো না আফিমের। তাই সব লাজ লজ্জা ভুলে ইনায়াত কাঁপা কাঁপা হাতে ছুঁয়ে দিলো আফিমের পিঠে। কারোর স্পর্শ পেয়ে আফিম বিরক্তি নিয়ে মাথা তুলে তাকালো। ইনায়াতকে দেখে বিরক্তির একটা নিঃশ্বাস ফেললো। হাত বাড়িয়ে বিছানার পাশের টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা মোটা টাকার বান্ডিল নিয়ে মেয়েটার গায়ে ছুড়ে দিলো। এরপর নেমে আসলো উলঙ্গ অবস্থায় খাট থেকে। ইনায়াত চোখ মুখ চেপে বন্ধ করে রাখলো। হার্টবিট এতো দ্রুত হচ্ছে যেন সে এক্ষুনি হার্ট এট্যাক করবে। ইনায়াতের এমন মেয়েলি ব্যবহার দেখে বিরক্ত হলো আফিম। ওয়াসরুমের দিকে যেতে যেতে ছোট করে বললো,, ” ফলো মি “। ইনায়াত কাঁদো কাঁদো মুখ করে নিজের হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে নিলো। চোখ বেয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে গেল ওয়াসরুমের ভেতর। আফিম শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে আছে না দেখেই বুঝে নিলো ইনায়াত।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

– তুমি জয়েন করেছো সবে মাত্র ৩ সপ্তাহ। বাট তুমি এতো কাজ করেছো যে আমার পাস্ট কোন পিএ এতো কাজ করেনি। আমার সব ফাইল কমপ্লিট করে ফেলো,, আমার সব বলার আগে রেডি করে ফেলো। কেমনে ম্যান?? তোমার কি এঞ্জয় করতে মন চায় না?? আমি খাটে যে মেয়েটার সাথে ছিলাম,,, ঐ মেয়ে যে কারোর শরীরে আগুন লাগাতে যথেষ্ট। কিন্তু তুমি তাকালেও না ভালো করে। আরে ওর কথা বাদ দাও,, তুমি কাপড় ছাড়া আমার দিকেই তাকাতে পারো না।
এতোটুকু বলেই আফিম সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালো ইনায়াতের দিকে।
– তোমার নাম মেয়ের মতো,, কাজকর্ম মেয়ের মতো,, সামহাউ তুমি মেয়ে না তো??
এমন কথা শুনে ঝট করে মাথা তুলে তাকালো ইনায়াত। ফাঁটা ফাঁটা চোখে তাকালো আফিমের দিকে। আফিম ইনায়াতের দিকে ভ্রু নাচিয়ে তাকালো,,

– আই মিন টু সে,,, তুমি গে না তো?? ওহ শিট!! আমার মাথায় এলো না কেন তুমি গে হতে পারো।
ইনায়াত দ্রুত গলা খুকখুক করে কেশে পরিষ্কার করে বললো,,
– আমি গে না মোটেও স্যার।
আফিমের সন্দেহ ভরা দৃষ্টি এখনো আটকে আছে ইনায়াতের উপর। ইনায়াতের থেকে দৃষ্টি সড়িয়ে মাথার চুলগুলোয় হাত চালিয়ে পেছনে ঠেলে দিলো আফিম।
– এখন জলদি বলো কি বলতে এসছো। তুমি তো কাজ ছাড়া কিছুর জন্য দেখা দাও না।
– স্যার!! মিস তানিয়া আপনার প্রোপোজাল রিজেক্ট করেছে। সে আমাদের সাথে ডিল করবে না জানিয়েছে। আর,,,
এটুকু বলেই থেমে গেলো ইনায়াত। ভয়ে ভয়ে ঢোক গিললো। কারণ এর পরবর্তী কথাগুলো বলতে তার যথেষ্ট সাহস প্রয়োজন।
– আর??

ইনায়াতকে থেমে যেত দেখে চোখ বন্ধ অবস্থায় জানতে চাইলো আফিম।
– আর বলেছে আপনাকে যেন বলে দিই যে,, আপনার খাট কাঁপানোর শক্তি যেমন আছে তার থেকেও বেশি উনার রূপের আগুন। আপনার *** যেন আরেকটু লম্বা করে নেন।
আফিম ধপ করে চোখ খুলে ফেললো। লালচে চোখগুলো স্পষ্ট জানান দিচ্ছে তার মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়া রাগের। ইনায়াত ভয়ে ভয়ে দুই কদম পিছিয়ে গেলো। আফিম নিজের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দেওয়ালে জোরসে এক ঘুষি মারলো।
– আমার টাকায় নিজের লাইফ লিড করতো যে মেয়ে,, আমার জন্য মডেলিংয়ে আসলো যে মেয়ে,, সেই মেয়ে আমাকে রিজেক্ট করে ওয়ার্নিং পাঠাচ্ছে কোন সাহসে?? কোন সাহসে ড্যামইট!!
আরো একটা ঘুষি মারলো আফিম জোরসে দেওয়ালে। বাধ্য হয়ে ইনায়াত এগিয়ে গেলো বাথরোব নিয়ে। শাওয়ার অফ করে বাথরোব পড়িয়ে দিলো একপ্রকার জোড় করে আফিমকে। অবশ্য এই কাজের জন্য আগে তার প্রচুড় সাহস যোগাড় করতে হতো। এখন করতে হয় না।

বাথরোব পড়িয়ে আফিমকে টেনে আনলো ওয়াসরুমের বাইরে। মাথা মুছে দিলো ভালো করে টাওয়েল দিয়ে। এরপর ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে আফিমের হাতে ব্যান্ডেজ করে দিতে লাগলো আফিমের পাশে বসে।
ধীরে ধীরে ফুঁ দিয়ে দিয়ে ব্যান্ডেজ করতে ব্যস্ত ইনায়াত খেয়াল করেনি আফিম তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। একটু বাদে আফিমের দিকে চোখ পড়তেই একটা শুকনো ঢোক গিললো ইনায়াত।
– তুমি এতো ভালো কেন ইনায়াত?? আর ভালোই যখন হলে,, তখন মেয়ে হলে না কেন?? ওহ গড!! আমার বাবা মায়ের বিয়ে নামক প্যারা থেকে বাঁচতে আমি তোমাকে ইউস করতে পারতাম। আফসোস তুমি মেয়ে হলে না।
ইনায়াত শুকনো একটা ঢোক গিলে জলদি উঠে পড়লো আফিমের কাছ থেকে।
– স্যার!! প্লিজ এখন ঘুমাবেন না প্লিজ। আমি ডিনার আনছি,, করে নিন ডিনার। আমিও বাসায় ফিরবো।
– বাসায় ফিরবে মানে?? আজকে থেকে যাও।
ইনায়াত পানির গ্লাসে পানি ঢেলে নিচ্ছিলো খাওয়ার জন্য। কিন্তু আফিমের থেকে যাও কথায় হাত থেকে পানির গ্লাস পড়ে গেলো তার। আফিম দ্রুত উঠে দাঁড়ালো।

– কি হয়েছে ইনায়াত?? কোন সমস্যা??
ইনায়াত দ্রুত কাঁচ গুলো তুলতে গিয়ে হাঁত কেঁটে গেলো কাঁচে লেগে। আফিম সেদিকে তাকিয়ে দ্রুত ইনায়াতের কাছে এলো।
– হোয়াট ননসেন্স ইনায়াত!! সার্ভেন্ট আছে আমার ঘরে।
ইনায়াত দ্রুত নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো আফিমের থেকে।
– স্যার!! আপনার ডিনার হলে আমাকে ফিরতে হবে। আমার একটা কাজ আছে।
আফিম ভ্রু কুঁচকে তাকালো ইনায়াতের দিকে। এরপর দেওয়াল ঘড়ির দিকে চোখ যেতেই দেখলো সময় রাত সাড়ে বারোটা।
– রাত সাড়ে বারোটায় কাজ??
ইনায়াত কপালের বিন্দু বিন্দু ঘামগুলো মুছে নিলো হাতের উল্টোপিঠে। আফিমের সন্দেহ ভরা দৃষ্টি তীক্ষ্ম হলো। রুমের মিনি বারের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে আফিম বললো,,
– ইনায়াত!! আমি লাইফে কোন মানুষের সাথে এতো কথা বলিনা। তোমার সাথে বলছি কারণ আই ট্রাস্ট ইউ। তুমি আমার কেয়ার করো,, ছোট ছোট বিষয় খেয়াল রাখো,,, অলয়েজ আমাকে সামলে নাও,,, আমার রাগ মাথা নিচু করে সহ্য করো। এসেছো ৩ সপ্তাহ হয়ে গেলো। আমি এখনো তোমার মুখ দেখিনি। আমি জানিনা কেন!! আমার তোমার প্রতি জোড়টা আসে না। আশা করি তুমি তার মিসইউস করবে না।

কথাগুলো বলতে বলতে গ্লাসে মদ ঢেলে নিলো আফিম। ইনায়াত মাথা নিচু করে থাকলো স্বভাববশত। এমন সময় দরজায় টোকা পড়লো। আফিম পাত্তা দিলো না। সে মদ গিলতে ব্যস্ত। ইনায়াত এগিয়ে গেলো দরজার কাছে। দরজা খুলে সার্ভেন্টের থেকে ট্রলি নিয়ে ভিতরে আনলো ঠেলে। এরপর একটা প্লেইটে ডিনার রেডি করে এগিয়ে গেলো বারের কাছে। ইতোমধ্যেই এক বোতল শেষের পথে আফিমের। ইনায়াত গিয়ে বোতলটা ঢাকনা লাগিয়ে রেখে দিলো বারের তাকে। আফিম সেদিকে চোখ ছোট করে তাকালো একবার। হাতে থাকা গ্লাসটার মদগুলো খেতে যাচ্ছিলো সে। ইনায়াত গ্লাসটা নিয়ে নিলো দ্রুত। গ্লাসটা আফিমের নাগালের বাইরে রেখে হাতে ডিনারের প্লেইট তুলে নিলো। চামচে খাবার তুলে ফুঁ দিয়ে ঠান্ডা করলো। এরপর এগিয়ে নিলো আফিমের মুখের কাছে। আফিম মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। ইনায়াত আফিমের মুখ চেপে ধরে মুখে খাবার ঢুকিয়ে দিলো।
পুরো প্লেইট খাওয়ানো শেষে আফিমের মুখ মুছিয়ে দিলো ইনায়াত। এরপর আফিমকে ধরে নিয়ে গিয়ে খাটে শুইয়ে দিলো। আফিম একবার ইনায়াতের দিকে মুখ ফুলিয়ে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো।
– গুড নাইট স্যার!!
ইনায়াত রুমের নাইট লাইট অন করে বাদ বাকি সব আলো নিভিয়ে,, এসির পাওয়ার বাড়িয়ে,, বেড়িয়ে এলো।

দ্রুত গাড়ি চালিয়ে ৩৮ মিনিটের রাস্তা ২১ মিনিটেই পার করে বাসায় এলো ইনায়াত। গাড়িটা আফিমের দেওয়া। লাইসেন্স আগেই ছিলো ইনায়াতের। দোতলা একটা বাড়ির সামনে এসে গাড়ি পার্কিং এরিয়াতে পার্ক করে গেইট ঠেলে ঢুকে গেলো বিল্ডিংয়ের ভেতর। একদম ছাদে উঠে গেলো সিড়ি বেয়ে। ছাদের বিশাল একটা জায়গা জুড়ে বাসার মতো রুম বানানো। এই বাসায় থাকে ইনায়াত। মেইন দরজার তালা খুলে বাসায় ঢুকলো ক্লান্ত পায়ে। রুমের লাইট জ্বালালো হাত বাড়িয়ে। গোছানো খুব সুন্দর পরিষ্কার ড্রয়িং রুমটা দেখলেই মন ভালো হয়ে যায় তার। মাথার থেকে হুডি নামিয়ে ছেলেদের হেয়ারকাটের নকল উইগটা খুলে নিতেই ঝড়ঝড় করে পিঠ ছড়িয়ে পড়লো একরাশ কালো চুল যা কোমড় ছুঁয়েছে। মুখের মাস্ক খুলে গুছিয়ে রাখলো র‍্যাকে। কাঁধে টাওয়েল নিয়ে ১৮ বছর বয়সী ইনায়াত ঢুকে গেলো ওয়াসরুমে। ওয়াসরুমের আয়নায় নির্বস্ত্র ইনায়াত নিজেকে খুঁটে খুঁটে দেখলো ভালো করে। ফর্সা গায়ের রঙ,,,

গালে হালকা গোলাপী আভা বিদ্যমান,, ঘন চোখের পাপড়ি,, কোমড় ছাড়ানো চুল,, বিড়ালের মতো একজোড়া চোখ,, সরু নাক,, পাতলা সরু কিন্তু গোলাপী ঠোঁট। শরীরের আকার গঠনে অসাধারণ রূপের অধিকারী এক সুন্দরী মেয়ে ইনায়াত। অথচ ভাগ্যের কি উপহাস!! এই রূপের জন্যই যতো ভোগান্তি ভুগতে হলো তাকে। অচেনা,, অজানা একটা শহরে,, ছেলের বেশ ধরে থাকতে হচ্ছে তাকে। একজন নামকরা ব্যবসায়ীর মেয়ে আর নাতনী হওয়া স্বত্তেও সে অন্যের অধীনে ভুল পরিচয়ে চাকরি করছে।
এসব ভাবনার শেষে তাচ্ছিল্য হাসলো ইনায়াত। স্নান করে টাওয়েল জড়িয়ে বের হলো ইনায়াত। গায়ে একটা নাইট গাউন জড়িয়ে ফ্রিজ থেকে খাবার বের করে গরম করে নিলো ওভেনে। খাবার গরম হতেই খাবার নিয়ে ডাইনিংয়ে এসে বসে এক চামচ মুখ তুলে নিলো খাবার। একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো বুক চিরে। ডুবে গেলো অতীতে,,
৩ সপ্তাহ আগের কথা,,,

কোনভাবে পালিয়ে নতুন শহরে চলে এসেছে ইনায়াত মির্জা চাঁদ । বাস থেকে নেমে আড়মোড়া ভাঙ্গলো সে। জীবনেও গাড়ি ছাড়া চলাচল না করা ইনায়াতের জন্য বাস চড়া ছিলো অনেক কষ্টের। আশপাশে চোখ যেতেই বুঝলো নতুন শহরে কিছুই চেনা নেই তার। এমনকি মানুষগুলোর ধরন ধারণও জানা নেই তার। একটা মেয়ে এভাবে থাকতে পারে না রাস্তায় রাস্তায়। যাবেই বা কোথায় ইনায়াত??
জিন্সের পকেট থেকে মোবাইল বের করে বাবার নাম্বারে কল করলো ইনায়াত। তার বাবা ইরশাদ মির্জা ফোনটা ধরলো না। বুক কেঁপে উঠলো ইনায়াতের। তার বাবা তাকে বাঁচাতে গিয়ে বিপদে পড়েনি তো?? ঐ মানুষরুপী জানোয়ার,, মাফিয়া তাহজিব খান তার বাবাকে বাঁচিয়ে রেখেছে তো?? ভেবেই কলিজা শুকিয়ে এলো ইনায়াতের। তখনই কল এলো ইরশাদের পিএ রানার নাম্বার থেকে দ্রুত রিসিভ করলো ইনায়াত কলটা।

– হ্যালো ইনু আপামনি!!
– হ্যালো,, রানা আংকেল। বাবা কোথায়?? ঠিক আছে তো সে?? তাহজিব খান বাবাকে কিছু করেনিতো??
– তোমার আব্বা ঠিক আছে। মাত্রই একটু ঘুমালো। তাহজিব খান এখনো আসেনি বিদেশ থেকে। তুমি ঠিক আছো তো মা??
– আমি ঠিক আছি আংকেল। কিন্তু আমি কোথায় যাবো?? কিছু চিনি না। টাকাও নেই। কার্ডও ইউস করতে পারবো না টাকা তুলতে। তাহজিব ঠিক বুঝে যাবে।
– আপামনি!! মন দিয়ে শুনো। আমি তোমাকে একটা ঠিকানা পাঠাচ্ছি। ঐ ঠিকানায় যাও। ঐ বাড়ি আমার তৈরি। তুমি ওখানে থাকবে। আর শুনো এই সিম ভেঙ্গে নতুন সিম নাও। আমি আমার মানুষকে কল দিচ্ছি। সে টাকা দিয়ে দিবে। আর আমি কল না দিলে কখনো কল দিবা না। ওকে?? সবাই জানবে আমাদের এটাই লাস্ট যোগাযোগ।

সেদিনের দেওয়া ঠিকানায় চলে এসেছিলো ইনায়াত। দোতলা বাড়িটার কেয়ারটেকার জিদান ইনায়াতকে টাকা তুলে দিয়েছিলো। সেদিন থেকেই ছেলে বেশে ঘুরছিলো ইনায়াত রাস্তায় রাস্তায় একটা চাকরির জন্য।
শহরে আসার দুই কি তিনদিনের দিন একটা পার্কে গেছিলো ইনায়াত সন্ধ্যের দিকে। কখন যে রাত হয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি সে। রাতে ফিরবার সময় দেখলো একটা লোক আহত অবস্থায় পড়ে আছে রাস্তার ধারে। বুঝায় যাচ্ছে ড্রাংক অবস্থায় কোন গাড়ির সাথে টক্কর লেগেছে। এখনো মাতলামি করছে শুয়ে শুয়ে। ইনায়াত লোকটাকে সাবধানে হাসপাতালে ভর্তি করে দিলো। হাসপাতালে নিতেই সবাই এক দেখায় চিনে গেলো আফিম আহসানকে। নামকরা বিজনেসম্যান আর মডেল বলে কথা।

ব্যস!! আফিমের যখন জ্ঞান ফিরলো তখন সে ইনায়াতের কথা জানতে পারলো। ইনায়াতকে চাকরি দিলো নিজের পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট হিসেবে। অবশ্য এমন হঠকারিতার কাজ একমাত্র আফিমেরই হতে পারে।
বর্তমানে,,
খাওয়া শেষে ইনায়াত নিজের লম্বা চুলগুলো আঁচড়ে ঘুমানোর জন্য বিছানায় শুতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো আজকে আফিমের সাথে দেখা নতুন মুখটা। গা শিউরে উঠলো ইনায়াতের। দ্রুত বালিশ আর চাদর নিয়ে সোফায় গিয়ে শুয়ে পড়লো।

নামকরা বড়লোক ব্যবসায়ী জোসেফ আহসানের একমাত্র ছেলে আফিম আহসান। মায়ের নাম লাবিবা আহসান। বাবা মায়ের আদরের ছেলে বড়লোক হওয়ার অহংকারে ডুবে গেছে সেই ছোটবেলাতেই। বড় হতে হতে মদ আর মেয়ের নেশায় পুরোপুরি বিগড়ে গেছে আফিম। তবে একজন ভালো ব্যবসায়ী আর মডেল হিসেবে তার সম্মান রয়েছে। নিজের মনের মর্জি মতো জীবন কাটিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য আছে এই জনাবের। কিন্তু বাবা মায়ের প্রতি ভালোবাসার কারণে বিরক্তি স্বত্তেও ” বিয়ে করে নে না ” কথাটা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে সে। কোন বন্ধু নেই তবে শত্রু হাজার। লাবিবা আহসান আর এখন ইনায়াত ছাড়া কেও তাকে সামাল দিতে পারে না।
আফিম মনমর্জি করে বেড়ায় আর ইনায়াত বাবার আজ্ঞাকারী। আফিম মেয়েবাজি করে আর ইনায়াত ছেলেদের নিয়ে ভাবতেও লজ্জা পায়। আফিম বিশ্বাস করে জীবন এঞ্জয় করাতে। আর ইনায়াত বিশ্বাস করে ভালোবাসায় জীবন পার করাতে। কি হবে দুজনের ভবিষ্যত??ইনায়াতই কি আফিমের জীবনে ছদ্মবেশে লুকানো ভালোবাসা??

প্রতিদিন এক পর্ব করে পেয়ে যাবেন আপনারা। আর অবশ্যই পর্বে আগের ও পরের পর্বের লিংক প্রতিবার এড করে দেওয়া হবে। তবে আরো একটি কথা,,, লাইক কমেন্ট ও শেয়ার করতে ভুলবেন না যেন। সবাইকে ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।)
সকালবেলা খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠলো ইনায়াত। দ্রুত নামাজ পড়ে ব্রেকফাস্ট করে নিলো। মাঝে মাঝে নিজের জীবন নিয়ে নিজেই বিরক্ত হয়ে যায় সে। কখনো কখনো মনে হয় ঐ মাফিয়া খানকে বিয়ে করে নিলেই হয়। তবে পরমূহুর্তেই সে নিজেকে ১০১ টা গালাগাল দেয় বিড়বিড় করে। একটা মেয়ের কাছে তার নামটাও নিজের হয় না। আল্লাহ নিজের বলতে মেয়েদের দেয় দুটো অধিকার।

এক. নিজের ইজ্জত,, পবিত্রতা আর সম্মান। আর দুই হলো আল্লাহর প্রতি ইবাদত করার অধিকার। তাই তাহজিব খানের কাছে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া কখনোই একজন নারীর পক্ষে সম্ভব না বলে ভেবে নেয় ইনায়াত। যদি তাহজিব খানের মতো মানুষের কাছেই বিলাতে হতো নিজেকে বিয়ের নামে। তাহলে নিজের বস আফিমের মাঝে কোন খামতি সে দেখছে না। তাহজিবের থেকেও অধিক সুন্দর আর ধনসম্পদশালী ব্যক্তি আফিম আহসান। কিন্তু তার প্রতিও অফিশিয়াল ব্যাপারে সম্মান ছাড়া কোন অনুভুতি আসে না তো ইনায়াতের। আসবেই বা কেন?? তাহজিব আর ইনায়াত এক ঘাটের গরু। দুটোই মেয়েবাজ আর বিভিন্ন ভাবে আল্লাহর পথের থেকে সড়ে এসেছে।
ইনায়াত মাঝে মাঝে ভাবে,,, সকালে এতো জলদি,,

প্রায় ভোরবেলায় কোন পিএ কাজ করে না। অথচ তাকে করতে হয়। সে এতোই স্পেশাল পিএ,, যার ফলে তাকে বসের বাসায় গিয়ে বসকে ঘুম থেকে তুলতে হয়। ছোট বাচ্চার মতো স্বভাবের ছেলেটার মেয়েবাজির মতো স্বভাব আছে। মাঝে মাঝে বিশ্বাস হতে চায় না ইনায়াতের। দ্রুত স্নান সেড়ে ব্রেকফাস্ট করে নিলো ইনায়াত। এরপর আয়নার সামনে গিয়ে বসলো। মুখটা বাংলার পাঁচের মতো করে রেখেছে সে।
– ধুর!! সারাদিন উইগ পড়ে মাথাটা ঘেমে যায়। কি যে করি!! ভাগ্যই তো সহায় নেই।
ছেলেদের সাজ নিতে নিতে প্রায় ৪০ মিনিটের মতো সময় লেগে গেলো ইনায়াতের। মুখে মাস্ক লাগিয়ে বের হয়ে এলো বাসা থেকে। প্রতিদিন আগে বেশ কিছু সময় সে পার্কে হাঁটাহাঁটি করে। আজকেও তার ব্যতিক্রম হলো না।

পার্কে হাঁটাহাঁটি করছে ইনায়াত মনের সুখে। প্রকৃতির মাঝে থাকলে সব চিন্তা উধাও হয়ে যায় তার। বিরক্তিরাও আর হাতছানি দেয় না। কিন্তু আজকে খুব করে একা একা লাগছে তার নিজেকে। এই শহরে এসেছে আজকে ২৩ দিন হতে চললো। অথচ এখনো নিজেকে একাই লাগে তার। কারোর সাথে বন্ধুত্ব করতে গেলেও ভয় হয়। কে জানে!! যদি তাহজিব জেনে যায়?? নিজের বাবা আর রানা আংকেলের সাথেও সেদিনের পর আর কথা হয়নি। তারা ঠিক আছে তো??

সকাল সকাল উঠে প্রকৃতি উপভোগ করতে পছন্দ করে ইনায়াত। আর আফিম!! সে ভোরবেলা নামাজই পড়ে না। ঘড়ির কাটায় সময় সকাল ৭ টা। অথচ এখনো আফিম বিছানায় এলোমেলো হয়ে ঘুমাচ্ছে। আফিমের বাবা মা ট্রিপের জন্য লন্ডনে গেছে। তাই ইনায়াতকেই এসে তুলে দিতে হবে আফিমকে। নাহয় হয়তো এমন পাহার ভাঙ্গার মতো কষ্টের কাজটা লাবিবা নিজেই করতেন। মহান সৃষ্টিকর্তার কি মর্জি তা তিনিই জানেন। একদিকে তার অনুগত বান্দা। আর অন্যদিকে তার পথবিচ্যুত এক মানব।

একদিকে নতুন শহরে ইনায়াতের একাকীত্ব,, আফিমের অগোছালো জীবন৷ অন্য শহরে তাহজিব এই সকাল সকাল গান হাতে দাঁড়িয়ে আছে বাগানে। রক্তলাল চোখ দেখেই বুকের ভেতর কেঁপে উঠবে সবার। বন্দুকের নল থেকে নির্গত মৃদু ধোঁয়া জানান দিচ্ছে সদ্য কারোর প্রান হারানোর। তাহজিবের সামনের বাগানের ঘাসের উপর নিথর দেহ পড়ে আছে ৩ টি। এই ৩ জনের উপর এই সপ্তাহের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো ইনায়াতকে খুঁজে আনার। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে তারা। তাই তাদের জীবনটা এখন তাহজিবের কাছে বেকার জিনিসের মতোই। আর বেকার জিনিস নিজের সাথে রাখা পছন্দ না তাহজিবের। জোড়ে এক হুংকার ছাড়লো তাহজিব।
– আমার রানী আমার চায়। আর তোরা এতোটুকুই পারলি না। আমি সব্বাইকে মেরে ফেলবো। আমার রানীকে না পেলে আমি সব্বাইকে মেরে ফেলবো।

তাহজিব ধুপধাপ পা ফেলে নিজের রুমে এসে দরজা লক করে দিলো। খাটের উপর বিশাল আকারের ছবি আছে ইনায়াতের। ছবিটা লুকিয়ে তোলা প্রফেশনাল হাতে। প্রথম যেদিন ইনায়াতকে দেখেছিলো তাহজিব সেদিন ছিলো বৃষ্টির দিন। ১৫ বছর বয়সী ইনায়াত বৃষ্টিতে লাফালাফি করছিলো। সাথে ছিলো সুরেলা খিলখিল হাসি। তাহজিব সদ্য একটা বিজনেস ডিল করে গাড়ি করে ফিরছিলো নিজের বাসায়। তখনই মাঝরাস্তায় গাড়ি খারাপ হয়ে যায়।
– ভাগ্যিস সেদিন গাড়িটা খারাপ হয়েছিলো মাই কুইন!!
অতীতের পাতায় ভেসে এই কথাটা বললো তাহজিব। ছবিটার কাছে গিয়ে আলতো করে হাত বুলালো।
বিশাল রাজপ্রাসাদের মতো বাসা তাহজিবের। তাহজিবের রুম বরাবর উপরের ফ্লোরে,, একটি রুমে খাটে শুয়ে আছে ইরশাদ মির্জা। চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে তার,, দৃষ্টি স্থির সিলিংয়ের দিকে। রানা এতোক্ষন জানলার কাছে দাঁড়িয়ে তাহজিবের হম্বিতম্বি দেখছিলো আর ভয়ে শিউরে উঠছিলো। তাহজিব রুমে ঢুকে যাওয়ার পর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে খাটের কাছে এসে দাঁড়ালো।
– স্যার!! কি ভাবছেন??

রানার প্রশ্নেও নিজের অবস্থার ভাবান্তর ঘটালো না ইরশাদ।
– আমার মেয়েটা বেঁচে আছে কিনা কে জানে!! কতোদিন দেখিনা,, কথা হয় না,, নিজ হাতে খাইয়ে দিইনা। খাওয়াদাওয়া নিয়ে মেয়েটা কতো হেলাফেলা করে তা তো তুমি জানোই রানা।
চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়া জলের ধারা পরিমানে বেড়ে গেলো। রানা দ্রুত এগিয়ে একটা টিস্যু নিয়ে চোখের জল মুছে দিলো ইরশাদের।
– স্যার!! এভাবে ভেঙ্গে পড়বেন না। মামনি যেখানেই থাকুক,, ঠিক থাকবে। আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখুন।
ধীর পায়ে খাটের থেকে উঠে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে ইরশাদের পায়ের কাছে বসলো রানা। আলতো করে বেডশিট উঠিয়েই অন্যদিকে চোখ সড়িয়ে ফেললো দ্রুত। ইরশাদ একবার রানার দিকে আর একবার নিজের পায়ের দিকে তাকালো। হাঁটুতে ব্যান্ডেজ করা। হাঁটুর পর আর পায়ের অংশ নেই।

যেদিন তাহজিব ইনায়াত পালানোর ৩ দিন পর ফিরে এলো। সেদিন নিজের ক্ষমতার প্রকাশ করতে ইরশাদের পায়ের হাঁটুর পরের অংশ কেটে নিয়েছে সে নিজ হাতে। রানার দুই হাতের কনিষ্ঠা আঙ্গুল কেটে দিয়েছে। নেহায়েত রানার আগে পিছে কেও নেই। নাহয় কি জবাব দিতো তার পরিবারকে ভাবতেই গা শিউরে উঠলো ইরশাদের। সেই দিন থেকে ইরশাদ আর রানা তাহজিবের এই প্রাসাদে বন্দী। এতোকিছুর পরেও রানা আর ইরশাদ আল্লাহর কাছে দুই হাত তুলে দোয়া চায় যেন ইনায়াত এই মানুষরুপী জানোয়ারের হাতে ধরা না পরে।
একদিকে তাহজিবের হিংস্রতা,, অন্যদিকে দুটো মানুষের মোনাজাতে করা আর্তনাদ আর হাহাকার। আল্লাহ কার সহায় হবে??

আফিমের খাটের পাশে দাঁড়িয়ে একমনে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছে ইনায়াত। দেওয়াল ঘড়িতে আটটা বাজতেই সে আফিমকে ডাকতে শুরু করলো।
– স্যার,, উঠুন,,, স্যারররররর। ও স্যার!! অফিসের দেরি হয়ে যাবে তো!! স্যার উঠুন!!!!!
ইনায়াতের ধাক্কাধাক্কি উপেক্ষা করে শুয়ে থাকা আফিমের পক্ষে সম্ভব না তা জানা হয়ে গেছে আফিমের এই কয়েক সপ্তাহে। আফিম মুখে ” চ ” জাতীয় শব্দ করে নিজের বিরক্তির জানান দিলো শুয়ে থেকেই। এরপর উঠে বসলো।

– ইউ আর ফায়ার্ড চাঁদ। ইউ আর ফায়ার্ড।
– ওকে স্যার!! পড়ে আগুন পানি ফায়ার্ড ওয়াটার্ড করা যাবে। আগে আপনি খাট থেকে নামুন।
আফিমকে একপ্রকার টেনে হিচড়ে ওয়াসরুমে নিয়ে শাওয়ার অন করে দিয়ে হাঁফাতে লাগলো ইনায়াত প্রতিদিনকার মতো। আফিমের ঘুমের ঘোরে বলা ” ইউ আর ফায়ার্ড ” কথাটা প্রথম প্রথম ভয় পেতো ইনায়াত। কিন্তু এখন এটা তার অভ্যেস হয়ে গেছে।
– স্যার!! আমি টাওয়েল দিয়ে যাচ্ছি। আপনি ব্রাশ করে একেবারে ফ্রেশ হয়ে দরজায় টোকা দেবেন প্রতিদিনের মতো। ওকে??
এই বলেই ইনায়াত বের হয়ে আসছিলো। তখনই হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো। ” ওহ শিট!! ” বলে চিৎকার করে উঠলো ইনায়াত। আফিম ঘুমের ঘোরে ঢুলুঢুলু হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো শাওয়ারের নিচে। ইনায়াতের চিৎকারে তড়াক করে লাফিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো সবটা। কোন সমস্যাই পেলো না আফিম। শুধু ইনায়াতের মুখে চোখে চিন্তার ছাপ। কিছুটা রাগ উঠে গেলো আফিমের।
– হোয়াট ননসেন্স ইনু!! চিৎকার করলে কেন??

আফিমের চিৎকারে এতোক্ষনের ধ্যান ভাঙ্গলো ইনায়াতের। দ্রুত পা চালিয়ে বের হয়ে এলো ওয়াসরুম থেকে। এরপর রুম থেকে,, আর সবশেষে বের হয়ে এলো এই বিশাল বাড়ির মেইন দরজা দিয়ে। আসার আগে একজন সার্ভেন্ট কে টাওয়েল ও জিনিসপত্র নিয়ে আফিমের রুমে দাঁড়াতে বলে সে দ্রুত গাড়িতে উঠে একটা ফার্মেসিতে চলে এলো দূরের। সিটবেল্ট খুলতে খুলতে নিজের উপর রাগ ঝাড়তে লাগলো ইনায়াত।

– তুই মেয়ে না ডাফার ইনায়াত মির্জা চাঁদ। তুই একটা হিজরা। মেয়ে হয়ে কেমনে মাসিকের তারিখ ভুলে গেলি ইডিয়ট কথাকার।
ফার্মসিতে গিয়ে দ্রুত প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে পাশেরই একটা পাবলিক টয়েলেটে নিজের কাজ সেড়ে নিলো ইনায়াত। কিন্তু এখন মাথায় অন্য চিন্তা। মাসিক মানেই পেট ব্যাথায় রীতিমতো কান্নাকাটি অবস্থা হয় ইনায়াতের। এখন সারাদিন অফিস করা আর আফিমকে সামলানোর মতো দুঃসহ কাজ সে কিভাবে করবে??
কি আর করার!! চাইলেই তো ছুটি নিতে পারবে না। গাড়িতে বসে গাড়ি ঘুড়িয়ে সোজা গেলো আহসান মঞ্জিলে। আফিম তখন ব্রেকফাস্ট টেবিলে মদের বোতল খুলছিলো। লাবিবাও নেই,, ইনায়াতও কোথায় জানি চলে গেলো। তাই সে একদম ফ্রি বোধ করছে। বিরক্ত করবার কেও নেই।

ইনায়াত দরজা দিয়ে ঢুকে আফিমকে গ্লাসে মদ ঢালছে দেখে দৌড়ে গিয়ে তা টেনে নিলো। কেও মদের বোতল নিয়ে ফেলেছে দেখে রাগী চোখে সেদিকে তাকিয়ে ইনায়াতকে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললো আফিম বিরক্তিতে।
– কোথায় গিয়েছিলে?? আর গেলে যখন এলে কেন?? এলে যখন দু মিনিট পর এলে না কেন??
আফিমের কথার উত্তর দিতে গিয়েই তলপেটে ব্যাথায় মোচড় দিয়ে উঠলো ইনায়াতের। তলপেট খামচে ধরে ধপ করে সে বসে পড়লো চেয়ারে। ইনায়াতকে এভাবে বসে পড়তে দেখে আফিম চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।

– হেই?? আর ইউ অলরাইট?? কোন সমস্যা ইনায়াত??
ইনায়াত দ্রুত কোনমতে নিজেকে সামলে নিলো।
– স্যার!! আপনি কি আমাকে ৪ দিনের ছুটি দিতে পারবেন?? প্লিজ স্যার!!
আফিম ভ্রু কুঁচকে তাকালো ইনায়াতের দিকে।
– ওকে,, দিলাম নাহয়। কিন্তু তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?? খারাপ লাগছে?? ডক্টর ডাকবো??
– নো নো স্যার!! আমি ঠিক আছি। আমি বাসায় যেতে চাই। ৪ দিনের জন্য একটু বাইরে যাবো এক জায়গায়।
– কোথায়??

ইনায়াত কোনমতে একের পর এক মিথ্যা বলে যাচ্ছে কষ্ট করে। কিন্তু এখন তো ফেঁসে গেলো। কারণ ইনায়াত শুরুর দিকে বলেছে তার এই জীবনে কেও নেই। এখন কোথায় যাচ্ছে বলবে?? হঠাৎ মাথায় যা এলো তাই বলে ফেললো,,
– স্যার!! গার্লফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে যাবো।
ইনায়াতের কথা শুনে আফিম হা। সে কি ভাবতো আর কি হলো আসলে। সে ভাবতো ইনায়াত গে হবে হয়তো। কিন্তু এখানে যে তার গার্লফ্রেন্ড আছে কে জানতো??
– ওকে!! কালকে থেকে ৪ দিনের ছুটি তোমার।
– না না স্যার!! আজকেই লাগবে ছুটি!!
পেট খামচে ধরে উত্তর দিলো ইনায়াত। আফিম ভ্রু কুঁচকে পেট খামচে থাকা হাতের দিকে তাকালো।

– ওকে!!
– দীপ!! দীপ!!
ইনায়াত আফিমের হ্যাঁ শুনেই একজন সার্ভেন্টকে ডাকতে লাগলো। আফিম ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে ইনায়াতের দিকে। সেকেন্ডের মধ্যেই দীপ হাজির ইনায়াতের সামনে।
– ইয়েস স্যার
– আমার নাম্বার আছে তোমার কাছে??
– ইয়েস স্যার
– ঘরে যদি তোমার স্যার কোন অনিয়ম করে আমাকে কল করবে। ব্রেকফাস্ট,, লাঞ্চ,, ডিনার যদি না করে। মদ যদি আধা বোতলের বেশি খায়। তাহলে সোজা আমাকে কল করবে। ওকে??
– ওকে স্যার
দীপ চলে গেলো। আর আফিম বিরক্তিকর দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে।
– হোয়াট ইজ দিস??

– আপনার অফিসরুমের সিসিক্যামেরার সাথে আমার মোবাইল কানেক্ট করা আছে। তাই অফিসের খেয়াল আমি রাখবো। কোন অনিয়ম হলেই কল করবো। রিসিভ না হলে বিরক্ত করতে বাধ্য হবো স্যার। বাই,,,
ইনায়াত দ্রুত পেট চেপে বের হয়ে এলো বাসা থেকে। গাড়িতে বসে দ্রুত গাড়ি চালিয়ে ইনায়াত চললো বাসার উদ্দেশ্যে।
আফিম দরজার দিকে তাকিয়ে টেবিলে বসতেই মদের বোতলের দিকে চোখ গেলো তার। মদের বোতলটা হাত বাড়িয়ে নিতে যাবে। তখনই মোবাইল শব্দ করে বেজে উঠলো। আফিম বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলো ইনায়াতের কল। রিসিভ করলো আফিম।

– হ্যালো!! কি আবার??
– মদের বোতল টা রাখুন স্যার!!
– হোয়াট!! তুমি কিভাবে জানলে??
– আমি আপনাকে ভালো ভাবেই চিনি স্যার।
আফিম বিরক্তি নিয়ে ফোন কেটে মদের বোতল ঠেলে দূরে সড়িয়ে দিলো।
– এই ছেলে কি যাদুকর নাকি!! বিরক্তিকর!!!
দীপ ব্রেকফাস্ট নিয়ে আসলো। আর আফিম বিরক্তি নিয়েই খাওয়া শুরু করলো। ইনায়াতের কথার নড়চড় করলে যদি ইনায়াতের কানে যায়। তাহলে তা লাবিবার কানে যাবে। মায়ের কাছে বকা শুনার কোন ইচ্ছে নেই আফিমের।
আফিম,, তাহজিব আর ইনায়াত!! তিনজনের ভবিষ্যত অনিশ্চিত!! কতোদিন চলবে ইনায়াতের ছেলে সাজবার খেল?? কতোদিন তাহজিব ইনায়াতের জন্য পাগলামি করবে?? আর আফিম কি জানবে ইনায়াতের কথা??

#ছদ্মবেশে_লুকানো_ভালোবাসা
#মৌমি_দত্ত
#৩য়_পর্ব

( এই যে আপু ও ভাইয়ারা,,, রিয়েক্ট বাড়ে না কেন?? আর প্লিজ ইনবক্সে জানতে চাইবেন না কি হবে সামনে। গল্পতে অবশ্যই জানবেন। আর হ্যাঁ!! রিয়েক্ট কমেন্ট ও শেয়ার করতে ভুলবেন না যেন। পাশে থাকবেন,, সাথে থাকবেন।)
বিরক্তি নিয়ে মিটিং রুম থেকে বের হয়ে এলো আফিম। ইনায়াতের অভাব সে বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছে। একটাদিনও পার হয়নি ইনায়াতের ছুটি নেওয়াতে। অথচ আফিমের মনে হচ্ছে কতোদিন হয়ে গেছে। অফিসের সব কাজ ইনায়াত দেখে নিতো। এখন আফিমকে দেখতে হচ্ছে। ফাইলস আর কাগজি কাজসব শুধু সাইন করবার জন্য আফিমের কাছে আসতো,, বাদবাকি চেকিং ইনায়াত করতো। কিন্তু এখন আফিমের টেবিল জুড়ে শুধু ফাইল জমছে। আফিমের কফি,, ল্যাপটপের ফাইলগুলো,,, পুরো রুম,,, টাইমের মধ্যে লাঞ্চ সব কিছু ইনায়াত ৩ টা সপ্তাহ এমন ভাবে গুছিয়ে খেয়াল রেখেছে যে,, অফিসটাই এখন ইনায়াতের বলেই মনে হচ্ছে আফিমের। এতো প্রেশারে সে বিরক্ত। নিজের কেবিনে ঢুকে সফট মিউজিক ছেড়ে দিলো মৃদু আওয়াজে। আফিমের কেবিনেও গেস্টদের কথা ভেবে একটা মিনিবার রাখা হয়েছে। যদিও এখানকার বেশির ভাগ মদের বোতল আগে আফিমই শেষ করতো আর মাতাল হয়ে পড়ে থাকয়ো কেবিনের কোনায়। কিন্তু গত ৩ সপ্তাহে ইনায়াত বাসায় ছাড়া তাকে আর কোথাও মদ খেয়ে মাতলামি করতে দেয়নি। যার ফলে আফিমের সম্পর্কে বদনামিগুলো অনেকাংশে কমে এসেছে। বিজনেসে তার ভালো এফেক্ট দেখা দিয়েছে।

– ইশশ!! ছেলেটার কেন যে গার্লফ্রেন্ড জুটলো!! আমার পুরা লাইফ শিডিউল নড়বড়ে হয়ে গেছে।
মাথা চেপে ধরে নিজেকেই নিজে শুনিয়ে বললো কথাগুলো চেয়ারে বসে আফিম। চোখ খুলে একবার মিনিবারের দিকে তাকালো। তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে একটা গ্লাস নিয়ে মদের বোতল খুলতে লাগলো। তখনই মোবাইল রিং হলো। বুঝতে বাকি নেই কলটা ইনায়াতের। মদের বোতলটা আবারও সেখানটায় রেখে টেবিলের উপর থাকা জুসের ঢাকনা দিয়ে রাখা গ্লাসটা তুলে নিলো। সিসি ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে গ্লাস উঁচু করে ধরে বললো,,

– দেখো!! খাচ্ছি জুস। মদ খাচ্ছি না। শান্তি!!
নাক মুখ কুঁচকে আপেলের জুসটা খেয়ে নিলো আফিম। এরপর গায়ের কোর্ট খুলে চেয়ারে রেখে শার্টের হাতা ফোল্ড করে ফাইল নিয়ে বসলো। একের পর এক চেক করতে থাকলো।
প্রায় দুপুর একটার দিকে মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠলো আফিমের। আফিম কাজে এতোটাই ডুবে গেছিলো যে সে প্রথমবার কল খেয়ালই করেনি। দ্বিতীয়বারের কলে সে বিরক্ত হয়ে ” চ ” জাতীয় আওয়াজ করে তাকালো মোবাইলের দিকে। রিং হতে হতে কেটে গেলো। তখনই দরজায় কেও টোকা দিলো।
– কাম ইন!!

বিরক্তি নিয়ে বললো আফিম। রুমের ভেতর ঢুকলো দীপ। তার হাতে লাঞ্চ বক্স। আফিম দীপকে এখানে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললো। পরক্ষনেই লাঞ্চবক্স দেখে মৃদু হাসলো। ইনায়াত ছেলেটা আসলেই অসাধারণ ব্যাপারটা আবারও উপলব্ধি করলো। মোবাইল জোড় শব্দে আবারও বেজে উঠলো। আফিম হাত বাড়িয়ে মোবাইল নিলো। ইনায়াতের নাম জ্বলজ্বল করছে স্ক্রিনে। আফিম মৃদু হেসে কল রিসিভ করলো।
– হ্যালো!!
– আপনার খাবার চলে এসছে স্যার!! খেয়ে নিন।
– হুম। অফিসে না এসেও জ্বালাতে ভুলছো না ভাই!! আমার জীবনটা তুমি কখন ছাড়বে ইনায়াত??
– স্যার!! যেদিন লাবিবা ম্যাম আপনাকে বিয়ে দিয়ে আমাকে মুক্তি দেবে।
– হেই!! ভালো কথা মনে পড়েছে। তোমার কোন বোনটোন আছে। বা কাজিন,, যে তোমার স্বভাবের।
– কেন স্যার??

– না মানে বিয়েটা সেড়ে নিতাম। অন্তত পক্ষে কয়েকদিন অফিস আসা লাগতো না।
– সরি স্যার!! আমি আমার ব্যবসায়ী বড়লোক বাবার অনেক আদরের একটামাত্র রাজকন্যা। নো বোন ,, নো কাজিন আর আনফরচ্যুনেটলি নো ফ্রেন্ড।
ইনায়াতের কথা শুনে চোখ বড় বড় হয়ে গেলো আফিমের।
– বড়লোক?? ব্যবসায়ী?? রাজকন্যা?? মানে কি এসবের??
– স,,স্যার,, আম,,আমার সি,,সিগ্ন্যাল,, পা,,না
অপরপাশ থেকে ফোনটা কেটে গেলো চট করে। আফিম ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো মোবাইলের দিকে। ইনায়াতের কথাগুলোর মানে বুঝলো না সে কিছুই। অবশ্য ইনায়াত মানে ছাড়া এমন হাজারটা কথা হুটহাট প্রায়ই বলে ফেলে। এসবই ভাবছিলো আফিম। তখনই দীপ ডাক দিলো।
– স্যার খাবার রেডি। খেয়ে নিন।
– হাহ!! হুম। খেয়ে নিচ্ছি।
মাথার সব চিন্তা ঝেড়ে খেতে বসলো আফিম। চামচটা তুলে সিসি ক্যামেরায় দেখালো যে সে খাওয়া স্টার্ট করছে।

আজকে সারাটাদিন পেট ব্যাথায় পুরো খাট গড়াগড়ি করে কাটিয়েছে ইনায়াত। আবার পাশাপাশি খেয়ালও রেখেছে আফিমের দিকে। আফিমের জন্য তার বিশেষ কোন মাথাব্যাথা নেই। আফিমকে নিয়ে সে সবসময় ব্যস্ত থাকে লাবিবার জন্য। খুব ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছে ইনায়াত। ইরশাদ সবসময় তাকে ভালোবাসা ও স্নেহে মুড়ে রাখলেও কোন দিক দিয়ে ঠিকই একটা মায়ের কমতি সে অনুভব করেছে সারাটা জীবন। যদিও কাওকে বুঝতে দেয়নি সে বিষয়টি। আফিমকে বাঁচানোর পর যখন লাবিবার সাথে দেখা হলো তখন যেন বুঝলো সে কমতিটা খুব করে। অফিসের কাজে প্রায়ই তাকে যেতে হয়েছে আফিমের বাসায়। তখন সে আফিমকে নিয়ে অতো বেশি নাক গলাতো না। এমনিই বস আর পিএর সম্পর্ক ছিলো। কিন্তু লাবিবার সাথে দেখা হতে থাকায় লাবিবার প্রতি দূর্বল হয়ে পড়ে ইনায়াত। লাবিবারও স্নেহ মায়া মমতা তৈরি হলো ইনায়াতের প্রতি। দিন যেতে লাগলো ইনায়াত লাবিবার মনের কথা জানতে পারলো। লাবিবার মনে সারাদিন আফিমকে নিয়ে কষ্ট সহ্য হলো না ইনায়াতের। তাই তো সে আফিমের ব্যাপারে এখন এতোটা মাথা ঘামায়। আফিমকে কোনভাবে যদি সে ঠিক করতে পারে তাহলে লাবিবা খুশী হবে।
– ভাগ্যিস জলদি ফোনটা কেটে দিয়েছি। চাঁদ,, তোকে আরো সতর্ক হতে হবে। আরো সতর্ক হতেই হবে।
নিজেকে নিজে কথাটা বললো ইনায়াত। কোন ধরনের ভুল সে করতে ইচ্ছুক না।

তাহজিব নিজের রুমে বসে আছে। চোখের নিচে কালি,, দৃষ্টি নিবদ্ধ ইনায়াতের বিশাল ছবিটায়।
– চাঁদ!! ফিরে আসো প্লিজ। একটা খোঁজ দাও নিজের। আমি ভালোবাসি তোমাকে। অনেক ভালোবাসি। কেন আমার থেকে শুধু পালাও তুমি চাঁদ?? কেন?? আমার হয়ে যাও না প্লিজ। হয়ে যাও না আমার রাণী।
চোখটা বন্ধ করে বসে থাকা ইজি চেয়ারটায় দুলতে লাগলো তাহজিব খান।

– রানা!! এস.এ কে খবর দিতে হবে মনে হচ্ছে।
ইরশাদ সাহেবের কথা শুনে চমকে উঠলো জানলার ধারে বসে থাকা রানা।
– কি বলছেন আপনি স্যার?? এস.এ?? ও তো ভয়ানক অনেক। ওকে কেন খবর দেবেন??
– ইনায়াতকে বাঁচাতে এস.এ কে খবর দিতেই হবে।
– স্যার!! আপনি ইনায়াত মামনিকে নিয়ে যাই সিদ্ধান্ত নিবেন ভালোই নিবেন জানি আমি। কিন্তু এস.এ?? সে তো খুবই বাজে একটা মানুষ। কোনভাবে যদি ইনায়াত মামনি তার নজরে পড়ে। তাহলে তো কেলেংকারী,,,,
ইরশাদ থামিয়ে দিলো রানাকে।
– রানা!! তাহজিবকে ওর লেভেলের উঁচুতে থাকা কাওকে দিয়ে মাত দিতে হবে। ইনায়াতকে এস.এ’র চোখে পড়তে দিলাম না। ও তো আর এখানে নেই। কিন্তু তাহজিব যদি খুঁজে পায় একবার আমার মেয়েকে। তাহলে যে,,
আর বলতে পারলেন না তিনি। রানা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,,
– ঠিক আছে। আমি কোনভাবে কল করবার ব্যবস্থা করছি।
– হুম। করো। জলদি করো।

দেখতে দেখতে কেটে গেলো ৪ দিন,,
ইনায়াতের ছুটি শেষে আজকে অফিসে যাবে। এই কয়েকদিনে সে অফিসে না আসলেও আফিমের পিছু ছাড়েনি। দীপকে দিয়ে খাওয়ার হাজির করিয়েছে ফোনে বলেই,, মদ খাওয়া থেকে আটকেছে অফিসে,, সকালে সকালে কল দিয়ে দিয়ে বিরক্ত করেছে আফিমকে ঘুম থেকে উঠাবার জন্য।
ইনায়াত গাড়ি ছুটিয়ে চলে এলো আহসান মঞ্জিল। দীপ ইনায়াতকে দেখেই মাথা নুইয়ে সম্মান দেখিয়ে নিজের কাজে মন দিলো। ইনায়াত সোজা চলে গেলো আফিমের রুমের উদ্দেশ্যে। গলা খাকাড়ি দিয়ে একবার নিজের গলার আওয়াজ মোটা করে ” হ্যালো হ্যালো ” সহ আরো কিছু কথা বলে দেখে নিলো ছেলেদের মতো শুনাচ্ছে কিনা। এরপর নিজের মাস্ক,, হুডি আর উইগ ঠিক আছে কিনা খেয়াল করে রুমের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলো। আফিম অগোছালো হয়ে ঘুমাচ্ছে।
– স্যার!!!!! ও স্যাররররর!! স্যার উঠুনননন!! স্যার!!! উঠুন।
– থ্যাংক গড। এট লাস্ট আমি তোমার গলার আওয়াজ পাচ্ছি সকাল সকাল।
আজকে কোন কাহিনী করা ছাড়াই উঠে পড়লো এক লাফে আফিম। অবাক হলো ইনায়াত। আফিমের কপালে হাত ছুঁইয়ে দেখে নিলো জ্বর এসেছে কিনা।

– জ্বর তো আসেনি। তাহলে আজকে এই একটু ডাকে লাফিয়ে উঠে পড়লেন যে স্যার!!
– আই মিসড ইউ ইয়ার!! তুমি যেভাবে বুকের পাটা দেখিয়ে আমাকে বিরক্ত করো। ওইরকম সাহস সবাই দেখায় না। তুমি এই কয়দিন আমাকে বিরক্ত করোনি বলেই যেন আমি বিরক্ত হচ্ছিলাম। ফাইনালি আমার অফিসে কাজ কম করলেও চলবে,,, খাবারের জন্য দীপ অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে থাকবে না পলকহীন,,, এন্ড আমি মন ভরে মদ খেতে পারবো।
আফিমের কথাগুলো যেন মাথার উপর দিয়ে গেলো ইনায়াতের। আফিম আর কোন কথা না বাড়িয়ে টাওয়েল নিজে নিজেই ঢুকে গেলো ওয়াসরুমে। ইনায়াত কিছুক্ষন হা হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থেকে আফিমের বিছানা গুছিয়ে রাখায় মন দিলো। দীপকে কল দিয়ে ব্রেকফাস্ট টেবিলে রেডি করতে বলে দিলো।

আফিম ওয়াসরুম থেকে বের হলো টাওয়েল পড়ে। তা দেখে ইনায়াত মাথা নিচু করে ফেললো। আফিম মৃদু হাসলো।
– ব্রো!! তোমার গফ ছাড়া কাওকে দেখবে না ভেবেছো ওকে মানলাম। বাট আমি ছেলে। সো ব্যাপার না।
ইনায়াত নাক মুখ শিটকালো। তখনই আফিম আবার বলে উঠলো।
– তো!! গার্লফ্রেন্ড কেমন?? হট এন্ড সেক্সি?? নাকি সহজ সরল কিউট টাইপ??
– ইয়াক!!
ইনায়াত সহ্য করতে না পেরে বলে ফেললো। ইয়াক শুনে আফিম অবাক। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করছিলো আফিম। হা হয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো ইনায়াতের দিকে।
– হেই!! তোমার গার্লফ্রেন্ডকে কি বোনের মতো ট্রিট করো নাকি??
বলেই আফিম হো হো করে হেসে ফেললো।

ব্রেকফাস্ট টেবিলে ব্রেকফাস্ট করছে আফিম আর ইনায়াত বিভিন্ন বিষয়ে ডিসকাস করতে করতে। তখনই কল এলো আফিমের মোবাইলে। আফিম ফোন রিসিভ করলো। আর ইনায়াত খাওয়ায় মন দিলো। না চাইতেও আফিমের সাথে ব্রেকফাস্ট করতে হয় ইনায়াতকে। তখন মাথার উপরের হুডিটক বেশ ভালো করে টেনে তারপরেই মাস্ক খুলে সে। হুডিটা লম্বা করে টেনে দেওয়ার ফলে মুখটা অন্ধকার থাকে তার কিছুটা। মুখের আকার আন্দাজে বুঝা যায়। কিন্তু মুখ দেখা যায় না।
আফিমের ফোনে কল এসছে তার মায়ের। মৃদু হেসে কল রিসিভ করলো সে।
– হ্যালো!! কেমন আছো মা??

– আমি আপাতত ভালো আছি। থাকবো নাই বা কেন?? ইনায়াত আছে তো তোর খেয়াল রাখার জন্য।
– মা!! এই বয়সে ছেলের জন্য বৌ রেখে যায়। মায়েরা বলে ” বাবা আমার বৌমা আছে তো!! চিন্তা কিসের “। আর তুমি বলছো ইনায়াত আছে তো!! আই মিন ও কি বৌ আমার?? বিয়ে করে নিই ওকে??
আফিমের এমন কথা শুনে হিচকি উঠে গেলো ইনায়াতের। আফিম ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলো ইনায়াতের দিকে।
– যাহ পাগল!! শোন!! তোরা ভালো আছিস তো??
– আরেহ মা!! একদম ফিট এন্ড ফাইন। তোমাদের কি খবর??
– আরেহ!! এক জ্বালা তোর বাবাকে নিয়ে। এখানে এসেও তার সব কাজ আমাকে কর‍তে হচ্ছে।
– ওটা বাবার ভালোবাসার স্টাইল।

– যাহ পাকা ছেলে!! বিয়ে করিয়ে দিই?? তারপর বুঝা ভালোবাসার স্টাইল।
– আমি তো বলেছি মা!! একটা এমন মেয়ে খুঁজো যে আমাকে আমার কথা মেনে আগলে রাখবে। আই মিন!! উদাহরন হিসেবে ইনায়াতকে দেখো। আমার খেয়াল রাখে,, আমাকে বাঁচিয়ে রাখে খারাপ মিডিয়া থেকে,,, আমাকে আগলে রাখে। আর মোস্ট ইম্পর্টেন্টলি আমাকে সব ভয় জয় করে ফেস করে ও। আমাকে বশে আনতে পারে তোমার মতো। এমন মেয়ে খুঁজে দাও। আমি নেচে নেচে যাবো বরযাত্রীর একদম সামনে থেকে।

– পাগল ছেলে আমার!! আচ্ছা শোন!! আমি এখন ফোনটা রাখছি। শান্তিতে যে একটু কথা বলবো তারও জো নেই। তোর বাবা আছে এর সাথে ওর সাথে পরিচয় করানো নিয়ে। নিজের খেয়াল রাখিস বাবা।
– ইনায়াত আছে তো মা!! বাই। নিজের খেয়াল রেখো।
আফিম ফোন রেখে ইনায়াতের দিকে তাকালো। ইনায়াত ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে আফিমের দিকে। আফিম নিজের এটিট্যুড নিয়ে বললো,,

– হোয়াট?? সত্যিই তো আর বিয়ে হচ্ছে না আমাদের। আই এম নট গে!!
ইনায়াত থতমত খেয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। তখনই আফিম আবারও বললো,,
– আচ্ছা ইনায়াত!! আমি তোমাকে কখনোই দেখিনি। হুডিটা খুলো না আজকে। লেট মি সি!!
ইনায়াত চমকে তাকালো আফিমের দিকে। আফিম আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে ইনায়াতের মুখ দেখার জন্য। আর ইনায়াত একরাশ ভয় নিয়ে তাকিয়ে আছে আফিমের দিকে। তবে কি আজকে শেষ রক্ষা হবে না ইনায়াতের??
ইনায়াতের সত্যি কি তাহলে শেষমেশ জেনে গেলো আফিম?? তাহজিব আর কি কি পাগলামী করবে ইনায়াতের জন্য??

ছদ্মবেশে লুকানো ভালোবাসা পর্ব ৪+৫