জলকাব্য পর্ব ১০ || লেখিকা:সুরাইয়া আয়াত

জলকাব্য পর্ব ১০
লেখিকা:সুরাইয়া আয়াত

” বলছি না নীলু তুই ঘরে যা, আমার কিছু হবে না, তাছাড়া আমার চিন্তা তোর না করলেও চলবে ৷”
ভারী গলায় বলল শ্রাবন ৷
নীলু কোন কথাই শুনলোনা, বড়ো বাটির মধ্যে থাকা জলে পট্টিটা ভিজিয়ে নিয়ে শ্রাবনের কপালে রাখলো , ওর নিজের শরীর কিছুটা হলেও সুস্থ ৷ বৃষ্টিতে ভিজে শ্রাবন ঘোর জ্বরের মুখোমুখি ৷ শ্রাবনের মা একটু জল গরম করে আনতে গেছেন, শ্রাবনের গলা ব্যাথা ৷

শ্রাবন বিরক্ত হয়ে চোখ বন্ধ করলো, শরীরের তাপমাত্রাটা আগের থেকে বেশ কম বলেই মনে হচ্ছে ৷ নীলুর প্রতি রাগটা নেমে গিয়েও যেন নামছেনা ৷ মেয়েটা ওকে মিথ্যা বলেছে ৷ বলেও কি কোন লাভ হলো ?
নীলু আর একটা পট্টি ভেজাতে ভেজাতে বলল
” ভাইয়া তোমাদের কাছে আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ যে আমার অসময়ে তোমার আমার পাশে আছো ৷ কিন্তু আমি হয়তো তোমাদের জন্য আহামরি কিছুই করতে পারবো না কারন সে সামর্থ আমার নেই ৷ নিজের ও খারাপ লাগছে এভাবে অন্যর সংসারে বসে থাকতে ৷
নীলুর কথার মাঝে শ্রাবন বলে উঠলো

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

” অন্যর সংসারটাকে নিজের ভেবে নিজের সংসার বানিয়ে নিলেই তো হয় ৷”
নীলু শ্রাবনের ঈশারা বুঝতে পারলো কিন্তু শ্রাবনের প্রতি ওর কখনো কোন অনুভুতি ছিলোনা তেমন , কিন্ত রুদ্রর প্রতি আজোও কোথাও না কোথাও একটা সফট কর্নার আছে নীলুর মধ্যেই ,যতই হোক মনুষটার সাথে স্পল্প দিনের হলেও তো সংসার ৷ নীলু শ্রাবনের কথা কাটাতে বলল
” ভাইয়া আমি ওনার শাস্তি চাই ৷ সবকিছুর জন্য না হলেও অন্তত আমাকে প্রতারনা আর আমার সন্তানের মৃত্যুর জন্য, আর আমার শরীরের আঘাতের কথা না হয় বাদই দিলাম ৷”

শ্রাবন রেগে গেল ৷ বিছানা থেকে উঠে পড়ে কপাল থেকে কাপড়টা সরিয়ে ফেলে দিয়ে বলল
” কেন অত্যাচার গুলো বাদ থাকবে কেন? সেগুলো তোর বিনোদনের জন্য করেছে নাকি যে তার ক্ষমা অনায়াসে হয়ে যাবে ৷ এমন মানুষরা সমাজে ছাড় পেতে পেতে কাপুরুষে পরিনত হয়েছে, মনুষত্ব বলেও যে একটা জিনিস থাকে তা ভুলে যাই ৷ অন্যায়টা অন্যায় ই হয়, তা ছোট হোক আর বড়ো হোক ৷ আর তোর যদি মনে হয় যে আমি কিছু ভুল বলেছি তাহলে তুই তোর মতো চলতে পারিস ৷”
নীলু খানিকখন চুপ থেকে বলল

” আমি জানি না আমি কতোটা পেরে উঠবো কিন্তু আমি প্রতিবাদ করবো, না জানি আমার মতো আরো কতো মেয়ের জীবনে এমন অহরহ ঘটছে, তাদের অবস্থা হয়তো আমার থেকেও শোচনীয় , তারা হয়তো মরতে মরতে বেঁচে আছে ৷ তবুও আমি হারবো না , ওনাকে উচিত শিক্ষা দেবো , শুধু আমার থেকে তোমরা মুখ ফিরিয়ে নিও না তাহলেই হবে ৷”
শ্রাবন বিছানা জেকে নেমে জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়ালো ৷ বাইরের দিকে উষ্ন শরীরের শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
” তোর আর রুদ্রর যে সুখের সংসার নামক মিথ্যা বলাটা কি বড্ড দরকারী ছিলো নীলু ! আমাকে কি অন্তত সত্যিটা বলা যেতো না ?”
নীলু দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল

” পরিস্থিতি মানুষকে অনেক কিছু করতে বাধ্য করে ৷ যার সাথে ঘটে সেই ভালো বুঝতে পারে যে তার অবস্থা কতটা শোচনীয় তখন কেবলমাত্র একটা জিনিস ই ভাবে যে কিভাবে ঠান্ডা মায়ায় সবটার সমাধান করা যাই, আমিও তাই করেছি ৷ আমিও চেষ্টা করেছিলাম যে কোন কিছু জানাজানি না হয়ে যদি আমি নিজের এটা সামলাতে পারি তাহলে ক্ষতি কি ?”
শ্রাবন আর কিছু বললো না , সত্যিই নীলুর কথাটা অনেকাংশেই ঠিক, পরিস্থিতি মানুষকে অনেক কিছুই করতে বাধ্য করে চাইতে না চাইতেও ৷
পুরো ঘরজুডড়ে নিস্তব্ধতা বিরাজ করতে, পড়ছে কেবল গরম নিশ্বাস, আর শোনা আছে হৃদস্পন্দন যা মনের ভিতর উষ্ন অনুভুতি জোগাতেই যথেষ্ট ৷

কালকের দীর্ঘ বৃষ্টির পর আজ ঝা ঝা করা রোদ বেরিয়েছে ৷ তবুও বাতাসের শীতল অনুভুতিতে গায়ে লাগছে না ৷ ট্যাক্সি তে বসে আছে ওরা তিনজন, শ্রাবন, নীলু আর শ্রাবনের মা ৷ উদ্দেশ্য রাজারহাট ৷ মহেশতলা থেকে রাজারহাট যেতে প্রায় 1 ঘন্টা মতো লাগে, শ্রাবনের শরীরটাও খুব একটা ভালো না, নীলুও অসুস্থ ৷ রাজারহাটে শ্রাবনের মায়ের খানিকটা দূর সম্পর্কের মামা থাকেন ৷ উনি একজন উকিল তাই নীলুর ব্যাপারে ওনার সাথে কথা বলতে যাচ্ছেন ৷
গাড়ি আপন গতিতে চলছে , শ্রাবন সামনে বসে আছে আর পিছনে নীলু আর শ্রাবনের মা ৷ নীলু হঠাৎ করে বলে উঠলো
” আজ তো 23 তারিখ, ভাইয়া তোমার 28 তারিখ পোগ্রাম আছে না ?”
শ্রাবন মুখে হাত রেখে বলল

” হমম ৷”
” তা তুমি তো অসুস্থ, গলাও খানিকটা .খারাপ , সমস্যায় পড়ে গেলে যে ৷ এরপর আবার কবে পারফ্রম করর জন্য এতো বড়ো স্টেজ পাবে তার ঠিক নেই, কিন্তু তুমি দেখছি একেবারেই উদাসীন হয়ে পড়েছো এই ব্যাপারে ৷”
শ্রাবন খানিকটা গম্ভীর সুরে বলল
” তোর কেসটা আগে সলভ হোক তার পর দেখবো ৷”
নীলু আরো কিছু বলতে যাবে তখনই শ্রাবনের মা নীলুর হাতে হাত রেখে চোখের ইশারায় নীলুকে থামিয়ে দিলো , এ ব্যাপারে এখন কথা না বাড়ানোয় শ্রেয় ৷ নীলুও আর কিছু বলল না ৷

” তা তুমি যে এই কেসটা লড়তে চাইছো , তাই থানায় গিয়ে কি আগে কোন ডায়েরি লিখিয়েছো ? কোন অভিযোগ জানিয়েছো ওনার প্রতি ৷”
নীলু মাথা নীচু করে না সম্মতি জানালো ৷ কোনরকম সেখান থেকে প্রানপনে বেরিয়ে আসতে পেরেছে, তারপর ওর এই অসুস্থতা , আর সবচেয়ে বড়ো কথা আগে যে থানায় একটা লিখিত ডয়েরি করতে হয় তা নীলুর মনেই ছিলো না ৷
উনি একটু ভাবুক সুরে বললেন
” সে না হয় ডায়েরি করলে, কিন্তু তোমার কেসটা শুনে যা বুঝলাম তাতে ওনার শাস্তি পাওয়ার চান্স প্রায় 75% যদি উপযুক্ত প্রমান থাকে তবে ৷ তবে তোমার দাবী টা কি ? তুমি কি শুধুই ওনার শাস্তি চাও নাকি টাকা পয়সার ও একটা দাবী করবে ৷ কোনটা ?”

নীলু মুচকি হেসে বলল
” টাকা পয়সা দিয়ে তো কত মানুষই বড়োলোক হয়েছে কিন্তু ঠিক কতজন সুখী হতে পেরেছে বলতে পারেন ? ছোটবেলা থেকে বাবার খুব একটা টাকা পয়সা ছিলো না তাই আমার ময়ের বারাবরই সে নিয়ে ক্ষোভ ৷ আমার মা বিশ্বাস করেন যেখানে টাকা আছে সেখানে সমস্ত সুখ আছে আর যেখানে টাকা নেই সেখানে সুখ নেই ৷ তাই রুদ্রর মতো একজন বিত্তবান মানুষের সাথে আমার বিয়ে দিয়েছিলেন যাতে ভবিষ্যতে তাদের ও কোন অসুবিধা না হয় আর আমিও যেন ভালো থাকি ৷ কিন্তু তা কি হলো ? পরিনামে কি পেলাম অত্যাচার ৷ টাকা থাকলেই সুখ থাকে না কথাটা আমি আগেও বিশ্বাস করতাম আর এখন তো সেই বিশ্বাসটা আরোও জোরালো হয়েছে ৷ সত্যি বলতে টাকা পয়সার আশা আমার কখনোই ছিলো না ৷ থাকলে হয়তো ছলে বলে কৌশলে যে করেই হোক রুদ্রর সাথে টাকা পয়সার জন্য হলেও সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখতাম ৷ আমার সেসব কিছু লাগবে না, আমি একটু মানসিক ভাবে শান্তি পেতে চাই ৷ আমার প্রতি হওয়া অন্যায়ের সঠিক বিচার চাই এটুকুই ৷”

নীলু কথা থামাতেই শ্রাবন বলল
” টাকা পয়সা না , কেবল ওনার শাস্তি হলেই চলবে ৷”
উনি ওনার চোখের চশমাটা ঠিক করে বললেন
” তাহলে টাকা পয়সার বিষয়টা নিয়ে একটু কথা বলা যাক ৷ ”
শ্রাবন বেশ ভালোই বুঝলো যে উনিও টাকার লোভের বাইরে নন, নাহলে একবারো কিভাবে কি সমাধান করবে তা না ভেবে একেবারে টাকার কথা বলে বসলো ৷ আসলে সমাজটাই যে এমন ৷ যার যতো বেশি থাকে সে আরো তত বেশি পেতে চাই ৷

জলকাব্য পর্ব ৯

নীলুর মুখটা থমথমে হয়ে গেল ৷ ওর কাছে টাকা পয়সা তেমন কিছুই নেই, যা ছিলো সব রুদ্রর ৷
” ঠিক কতো লাগবে আপনার?”
দেখো বুঝতেই পারছো বেশ জটিল কেস , প্রমান ও তেমন দেখছিনা তাই একটু বেশি টাকাই লাগবে ৷
” ঠিক কতো লাগবে সেটা বলুন ৷”
“ওই যে পুরো কেস সলভে অন্ততপক্ষে 25 হাজার তো লাগবেই ৷”

নীলুর গলা শুকিয়ে এলো ৷ লজ্জায় সেখান থেকে পালাতে ইচ্ছা করছে ৷ না জানি শ্রাবন ওকে কি ভাববে ৷
” আচ্ছা ৷ তাহলে আমরা এর পরবর্তী ধাপে ঠিক কি করবো ?”
” তোমরাএখন থানায় গিয়ে একটা কেস করো ওনার নামে তারপর মামলা কোর্ট অবধি যাক বাকিটুকু আমি দেখে নেবো ৷”
“আচ্ছা ৷”
কথাটা বলে ওরা বেরিয়ে এলো ৷ সারাটা রাস্তা নীলু চুপচাপ , কথা বলার ভাষা নেই ৷ কি বলবে ও ? আসলেই কি টাকা ছাড়া মানুষের কোন দাম নেই ?

জলকাব্য পর্ব ১১