জলকাব্য পর্ব ৯ || লেখিকা:সুরাইয়া আয়াত

জলকাব্য পর্ব ৯
লেখিকা:সুরাইয়া আয়াত

ছোট্ট ঘরটার মেঝেতে একটা ছোট্ট আসন পেতে জানালার দিকে তাকিয়ে আছে শ্রাবন,আকাশটা মেঘলা, সকাল থেকেই কেমন গুমোট অনুভুতি নিয়ে বসে আছে এই কালো মেঘের ঘনঘটায় আচ্ছন্ন আকাশটা , ঘখন তখন সীমা লঙ্ঘন করে আকাশ জুড়ে ছেয়ে যাবে একরাশ বৃষ্টি, পাখিরাও ব্যাস্তময় ভঙ্গিতে ফিরবে তাদের নীড়ে, পিঁপড়েরা তাদের অতিক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র ডিম গুলোকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেবে, বৃষ্টির ছত্রছায়া থেকে বাঁচতে কত মানুষ আশ্রয় নেবে ফুটপাতের কোন মিষ্টির দোকানে অথবা কোন বিরাট বড়ো বটগাছের ছত্রছায়ায় , কিছু মানুষের হয়তো থামতে মানা, তারা সব নিষেধ পার করে কত পথ অনায়াসেই পার হয়ে যাবে ৷ শ্রাবনের ও আজ মনটা খারাপ, নিজের নামের সাথে বৃষ্টির গভীর যোগসূত্র থাকলেও বৃষ্টিকে আপন করে নিতে পারে না তার কারনটা শ্রাবন নিজেও জানে না,হয়তো বৃষ্টির প্রখর ঝমঝম আওয়াজে ওর গিটারের মিষ্টি সুরটা চাপা পড়ে যাই তাই হয়তো ৷

দেখতে দেখতে বৃষ্টির সব চাইতে বেশি ব্যাসার্ধবিশিষ্ট ফোঁটাগুলো মাটিতে পড়তে লাগলো, কিছুখনের মধ্যেই হয়তো ভিজিয়ে দেবে এই ছোট্ট শহরটার প্রতিটা বাড়িঘরকে ৷ কেউবা ঘরে বসে বৃষ্টিকে উপভোগ করবে আবার কেউবা দুবাহু মেলে বৃষ্টিতে গা ভেজাবে ৷ প্রকৃতির কিছু অসামান্য নিয়ম যেমন বৃষ্টি যা শ্রাবনের একদমই পছন্দ নয় ৷ জানালা থেকে কয়েক হাত দূরে আছে একটা ছোট খাট, শ্রাবনের মা এখানে একা ঘুমান, সেই খাটে বেঘোরে শুয়ে আছে নীলু ৷ পুরো একদিন হয়ে গেল মেয়েটার জ্ঞান ফেরেনি,শরীরে ছিলো তীব্র জ্বর, সারারাত জলপট্টি দেওয়াতে খানিকটা হলেও তা কমেছে ৷ তবে এখনো জ্ঞান ফেরেনি তা নিয়ে আশঙ্কায় আছে শ্রাবন আর ওর মা ৷ বৃষ্টি বেশ ভালো ভাবেই শুরু হয়ে গেছে, কদিন পরই বর্ষা নামবে , এই বৃষ্টি হয়তো বর্ষার আগমনেরই পূর্বাভাস ৷

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

হঠাৎ কারঝর মাটিতে পড়ে যাওয়ার মতো আওয়াজ হতেই শ্রাবন পিছন ফিরে তাকাতেই দেখলো নীলু মেঝেতে পড়ে আছে, মাথায় হয়তো খানিকটা আঘাত পেয়েছে , নীলু মাথাটা শক্ত করে চেপে ধরে আছে ৷ শ্রাবন দ্রুত গিয়ে নীলুকে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে রুম থেকে জোরে ডাকতে লাগলো
” মা , ও মা , দেখোনা নীলু পড়ে গেছে ‌ ৷ তাড়াতাড়ি বরফ নিয়ে এসো ৷”
বাইরে বৃষ্টির ঝমঝম আওয়াজে শ্রাবনের গলার আওয়াজ ঠিক কতোদূর পৌছালো তা শ্রাবন জানে না, কিন্ত এতো ডাকাডাকির পরও যখন উনি আসলেন না তখন শ্রাবন নীলুর পাশে একটা কোলবালিশ দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল, তাতে নীলুর দ্বিতীয় বার খাট থেকে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কাটা কম ৷

শ্রাবন ওদের সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে নীচে গিয়ে দেখলো ওর মা নিজের মুখটা শাড়ির আঁচল দিয়ে চেপে ধরে বারান্দা থেকে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াচ্ছেন ৷ শ্রাবন ওনাকে দেখে তাড়াতাড়ি করে ওনার কাছে গিয়ে বলল
” মা , মা , তাড়াতাড়ি চলো নীলুর জ্ঞান ফিরেছে মনে হয় ৷”
উনি মুখ থেকে শাড়ির আচলটা সরিয়ে থমথমে গলায় বলে উঠলেন
” মেয়েটাকে ওরা বাঁচতে দেবে নারে শ্রাবন ৷”
শ্রাবন ঘরে যেতে গেলেও থেমে গেল, ওর মায়ের কথার অর্থ ও বুঝলো না ৷
শ্রাবনও অবাক হয়ে বলল
” এসব তুমি কি বলছো মা ৷”
ওনার চোখে রীতিমতো জল চিকচিক করছে , কথা বলতে গিয়েও যেন কথাগুলো আটকে আটকে আসছে ৷ খানিকটা চাপা স্বরে বললেন

” রূদ্র মানে নীলুর স্বামী সে পরকীয়া করে আর একজনকে বিয়ে করেছে ৷ নীলুর বাচ্চাটাও তার জন্য নষ্ট হয়ে গেছে ৷”
নীলুর বাচ্চা নষ্ট হওয়ার কথা শুনে ততটাও অবাক হলোনা যতটা না অবাক হলো এটা শুনে যে রুদ্র পরকীয়া করে আবার একজনকে বিয়ে করেছে ৷ কই নীলুর সাথে কথা বলে ওর তো কখনো মনে হয়নি যে রুদ্র আর নীলুর মাঝের সম্পর্কের অবনতি ঠিক এতোটা ৷ তাহলে কি নীলু কখনো বুঝতেই দেইনি?
কথাটা ভাবতেই শ্রাবন চমকে উঠলো, ওর সমগ্র শরীর শিউরে উঠেছে নিমেষেই ৷ আধো অধো গলায় বলল
” এসব তুমি কি বলছো মা , কই নীলু তো কখনো এমন কিছু বলেনি ৷”
উনি ওনার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া জলটা মুছে বললেন

” নীলুর মা এসেছিলেন একটু অগে, নীলুর খোঁজ নিতে যে নীলু এখানে আছে কি না ৷ আমি ভাবলাম নীলুর মা নীলুর খোঁজ নিতে এসেছে তারমানে নিশ্চয়ই নীলু কোন সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে তাই এখানে এসে উঠেছে তাছাড়া পরশু রাত থেকে ওর জ্ঞান ও ফেরেনি যে ওর থেকে সবটা জানবো তাই খানিকটা বাধ্য হয়ে মিথ্যা কথা বললাম যে নীলু এখানে নেই ৷ কথাটা শুনে উনি চলে যেতে নিলেই আমি জিজ্ঞাসা করলাম যে কোন সমস্যা হয়েছে কি ৷ কিন্ত উনি ও বলতে নারাজ, অনেক বড়ো মুখ মেয়েকে রুদ্রর হাতে তুলে দিয়েছিলেন আর এখন মেয়ের জীবনে এমন করুন পরিস্থিতি বলে হয়তো ওনার আত্মসম্মানে বাধছে তাই হয়তো বলতে চাইছিলেন না ৷ তাই অনেকটা বাধ্য হয়ে আমি বললাম যে ” নীলু মা এখানে আছে, ওর খুব জ্বর , আপাতত ঘুমাচ্ছে ৷”
খুব অবাক হলাম জানিস তো !”
শ্রাবন কৌতুহলের সাথে বলল

” কেন?”
” নীলুর মা একবারও জানতে চাইলেন না যে নীলু কেমন আছে ৷ মা হয়ে উনার এমন ব্যাবহার কখনো মানা যাই ? ”
শ্রাবন বিরক্ত হয়ে বলল
” তুমি ওনার কথা বাদ দাও, উনি মানুষটাই এমন, হৃদয়হীন ৷ নিজের মেয়ের প্রতি ওনার ভালোবাসা থাকলে মেয়ের ভালোটা উনি নিশ্চয়ই বুঝতেন ৷ তারপর বলো উনি কি বললেন ‌৷”
শ্রাবনের মা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সম্মতি জানিয়ে বলল

” তারপর উনি একপ্রকার চেঁচিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন, আর সবটা বললেন যে রুদ্র পরকীয়া করে নতুন কাউকে বিয়ে করেছে তাই নীলু ওর সংসার ছেড়ে চলে এসেছে কিন্তু নীলুর সাথে রুদ্রর সম্পর্ক আর না থাকলে রুদ্র আর মাসে মাসে তাদের সংসার চালানোর জন্য টাকা পাঠাবেনা তখন ওনারা না খেতে পেয়ে মারা যাবেন তাই নীলু যেন সত্তর রুদ্রর কাছে আবার ফিরে যাই, আর যে করেই হোক সংসারটা যেন আবার টিকিয়ে নেই নয়তো উনি আত্মহত্যা করবেন আর তার দায়ভার নীলুকে দেবেন ৷”
কথাটা বলে উনি একটা দীর্ঘশ্বাস নিলেন ৷
শ্রাবন হঠাৎ করে জোরে চেঁচিয়ে বলে উঠলো

” নীলু কোথাও যাবে না, দরকার নেই নীলুর অমন স্বামী আর ওমন সংসারের , ওনার মারার ইচ্ছা হলে মরুক তাতে আমার নীলুর কিছু যাই আসে না ৷ ওনার মতো পিশাচীনির কথা তুমি বাদ দাও আর তাড়াতাড়ি আসো, নীলুর জ্ঞান ফিরেছে ৷
তাড়াতাড়ি ওনারা দুজন ঘরে গেলেন গিয়ে দেখলেন নীলু উঠে বসে রিতিমতো টেবিলটা ধরে হাটার চেষ্টা করছে ৷ নীলুকে উঠতে দেখে শ্রাবন গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে বলল
” তোর সাহস হয় কি করে বিছানা ছেড়ে ওঠার, আমি কি তোকে উঠে হাটতে বলেছি যে উঠেছিস , নাকি নিজেকে সুস্থ প্রমান করতে চাইছিস ৷”
নীলু শ্রাবনে ধমক শুনে কেঁপে উঠলো ৷ ও ভয়ে পড়ে যেতে নিলেই শ্রাবন গিয়ে ওকে ধরে বিছানায় বসালো ৷ নীলুর দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বলল

” মা ওকে বলে দিও এতোই যদি তার কাপুরুষ স্বামীর সাথে সংসার করার ইচ্ছা থাকে তাহলে সে চলে যেতে পারে , আমরা কেউ তাকে আটকাবো না ৷”
কথাটা বলে শ্রাবন চলে গেল ৷ শ্রাবনের মা শ্রাবনকে ডাকতে লাগলেন
” বাবা শ্রাবন শোন, কোথায় যাচ্ছিস এই মেঘলা বাদল দিনে, শোন ৷”
কিন্তু ততখনে শ্রাবন বেরিয়ে গেছে ৷ নীলুর আচরনে ভীষনভাবে ক্ষিপ্ত ও ,ও এতোবার নীলুকে জিজ্ঞাসা করেছে যে নীলু ভালো আছে কি ,কিন্তু নীলু বারবার এমনভাবে ছলনা করেছে যে নীলু ভালো আছে , সেই কারনে শ্রাবনের বড্ড রাগ হচ্ছে

বেরিয়ে গেছে বাইরে, আজ ওর এই অপছন্দের বৃষ্টিতে ভিজবে , যদি নীলুর প্রতি রাগটা কমে ৷
নীলু শ্রাবনের মাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কাদছে, দূবল শরীরটা যেন আরো দূর্বল হয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত ৷আসলেই কষ্টগুলো কি চোখের জলের সাথে মিলিয়ে যাই ? নাহ ! যদি মিলিয়ে যেত তাহলে ডিপ্রেশন আর দুঃখ বলে কোন জিনিসই থাকতো না, মানুষ সাময়িক কান্না করে কষ্ট নিবারন করে ফেলতো ৷

” আমার কেমন জানি লাগছে, ওই নীলু জানোতো আমাকে যাওয়ার আগে কতো কথা শোনাচ্ছিল যে তোমার উপযুক্ত শাস্তি দেবে ৷”
রুদ্র মিঠির গালে আলতো করে স্লাইড করে বলল
” ওর কথা ছাড়ো তো , দুটাকার মেয়ে , আরে ওর কি সামর্থ আছে আমাকে শাস্তি দেওয়ার , কেস করতেও মিনিমাম টাকা পয়সা লাগে ওর তাও নেই, ওর বাপের সংসার চলেই আমার টাকায় আবার বড়ো বড়ো কথা ৷ ক্ষিদেই পেটে জ্বালা ধরলে এমনিই ছুটে আসবে দাসী হওয়ার জন্য ৷”

মিঠি মুচকি হেসে রুদ্রর চোখে চোখ রেখে বলল
“আমার কিন্তু ওকে দাসী হিসাবে দেখতে বেশ ভালোই লাগবে , আমার কথাটা কি তুমি রাখবে জান ?”
রুদ্র মিঠির আরো খানিকটা কাছে গিয়ে বলল
” কেন নয় ৷” কথাটা বলে মিঠির দিকে চোখ মারলো ৷

” আমি আর খাবো না আন্টি , আমি সত্যি বলছি আমার আর খিদে নেই, তুমি এতো খাওয়াচ্ছো কেন আমাকে ?”
মুখে খাবার নিয়ে কথাগুলো বলল নীলু, শরীরটা বেশ দূর্বল আর সেই সুযোগ নিয়েই হয়তো শ্রাবনের মা বেশি বেশি খাবার দাওয়ার খাওয়াচ্ছেন নীলুকে ৷
উনি একটু ধমকের সুরে বললেন
” একদম চুপ , কোন কথা না , তাড়াতাড়ি খেয়ে নে ৷ শ্রাবনকে খেতে দিতে হবে ৷”
শ্রাবনের কথা শুনে নীলু থেমে গেল, মাথা নীচু করে বলল
” শ্রাবন ভাইয়া বাসায় কখন ফিরেছেন ?”

” এই তো কিছুখন আগে , ভিজে একাকার ৷ জ্বর না আসলেই হয় ৷”
” আমি তোমাদের বোঝা হয়ে আছি, খারাপ লাগছে আমার ৷”
উনি ধমক দিয়ে বললেন
” আর একটাও কথা না ৷ এসব শ্রাবন শুনলে আর রক্ষে নেই ৷ ”
তুই এগুলো ধীরে সুস্থে সবটা খা আমি ওর খাবারটা বেড়ে দিয়ে আসছি ৷
কথাটা বলে উনি চলে গেলেন ‌৷
নীলু ওর খাবার রেখে শ্রাবনের ঘরের দিকে গেল, শ্রাবনের কাছে গিয়ে সরি বলবে ৷ ও ভাবলো শ্রাবনের মায়ের পিছুপিছু গেলে শ্রাবন ওনার সামনে নীলুকে বেশি বকাঝকা করবেন না ,করলেও উনি নীলুকে শ্রাবনের কথার হাত থেকে বাঁচিয়ে নেবেন ৷

জলকাব্য পর্ব ৮

শ্রাবনের রুমের সামনে যেতেই নীলুর কানে শ্রাবনের কিছু কথা ভেসে এলো, সেগুলো শুনে নীলু আবার ওর ঘরে চলে এলো ৷ বৃষ্টি আর নেই, অনেকখন আগেই থেমে গেছে , ভেজা জানালার লোহা গুলো দুহাত দিয়ে ধরে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে নীলু ৷ মানুষের দ্বারা অনেক ভুলভ্রান্তি হয় তা কখনো বেশি কখনো কম ৷ বেশি ভুল গুলোই সাধারনত আমাদের চোখে পড়ে যা মেনে নিতে বড্ড কষ্ট হয় ৷

মানুষের জীবন যখন তীব্র বিষাদে ছেয়ে যাই তখন ঠিক ভুলটা ঠিক চোখে পড়ে না, সবকিছুকেই ভুল মনে হয় ৷ আমরা না চাইতেও তাদেরকেই সবচেয়ে বেশি দূরে ঠেলে দিই যারা আমাদেরকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেই আর তাদেরকেই কাছে টেনে নিই যাদের কাছে আমারা অর্থহীন ৷ মানুষ যদি অনুভুতির প্রকৃত অর্থ বুঝতো তাহলে হয়তো দূরে সরে যেতে হতো না হাজারো ভালোবাসার মানুষকে , ঠিক টাকে ঠিক হিসবেই গ্রহন করতো ৷ বিচ্ছিন্নতার হতাশায় জর্জরিত হতো না হাজার হাজার যুবক যুবতী ,সৃষ্টি হতো না যুবসমাজের এই করুন বিশৃঙ্খল ‌৷

জলকাব্য পর্ব ১০