জলকাব্য পর্ব ৮ || লেখিকা:সুরাইয়া আয়াত

জলকাব্য পর্ব ৮
লেখিকা:সুরাইয়া আয়াত

ঠকঠক করে দরজায় আওয়াজ হতেই নীলুর মা তার সদ্য কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে উঠে এলেন ৷ বিরক্তি ভরা মুখ করে আর রাগে গজগজ করতে করতে দরজাটা খুললেন ৷ এতরাতে নীলুর কম্পমান শরীর আর থমথমে মুখ দেখে ওনার আর বুঝতে কিছু অসুবিধা হলো না যে নীলু কিছু তো একটা ঘটিয়েছে ৷ নীলু শাড়ির আঁচল দিয়ে শরীর ঢেকে রেখে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ৷ নীলুকে এমনভাবে দেখে উনি দু কদম পিছিয়ে গিয়ে গর্জন সুরে বললেন
” কই শুনছো ! দেখো এতরাতে তোমার মেয়ে দরকার কড়া নাড়ছে তাও আবার একা একা এসেছে, কোন অঘটন ঘটিয়ে এসেছে তাকে সাধো ৷”

উনি অবাক হয়ে চোখ তুলে ওর মায়ের দিকে তাকালেন ৷ ভেবে ছিলো এতরাতে নিজের মেয়েকে এমন অবস্থায় দেখে উনি বুকে আগলে নেবে কিন্তু নাহ, উনি তো এই ঘটনার জটিলতাকে আরো এক ধাপ বেড়াচ্ছেন ৷
নীলু চুপচাপ চেয়ে আছে ৷ ওর মায়ের দিকে থেকে ও যেন চোখ ফেরাতে পারছে না ৷ সন্তানের বিপদে মায়েরা বুঝি তাকে আগলে না রেখে তার বিচার করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে !
নীলুর ভাবনার ব্যাঘাত ঘটলো ওর বাবার কন্ঠস্বর শুনে, অনেক উত্তেজনা আর কিঞ্চিত ভয় মিশ্রিত কন্ঠ ৷
” কি রে নীলু মা তুই এসেছিস ? আমি তো ভাবছিলাম কাল পরশুই তোর সাথে একটু দেখা করে আসবো কিন্ত দেখ আমাকে আর যেতে হলো না তুই নিজেই চলে এলি ৷”
নীলু মাথা নীচু করে আছে , শরীরের কম্পন আগের তুলনায় ও বেশি ৷ কোনরকম জ্বর না , এ কম্পন সবকিছু হারানোর ভয়ের ৷

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

উনি খানিকখন নীলুর আশেপাশে তাকিয়ে বললেন
” এতো রাতে তুই একা এলি যে রুদ্র আসেনি ?” ”
ওনার কথাটা নীলুর মায়ের কানে পৌছাতেই উনি কর্কশ কন্ঠে বলে উঠলেন

“এত আদিখ্যেতা দেখানোর কোনো দরকার নেই ৷ আগে কি ঘটনা ঘটিয়ে এসেছে সেটা আগে জিজ্ঞাসা করো ৷ যদি এখন এটা বলে যে ওর স্বামী ওকে ছেড়ে দিয়েছে আর ভাবে যদি এই বাসায় সারা জীবনের জন্য থাকবে তাহলে ওকে বলে দাও যে আমাদের নিজেদের ই নুন আনতে পান্তা ফুরায়, রুদ্রর টাকায় সংসার চালাতে হয় , ও রুদ্রকে ছেড়ে দিয়ে চলে আসলে ভাতটুকুও জুটবে না ৷ আর এই মুহূর্তে তার মত উটকো ঝামেলা নিয়ে নিজেদের সংসারটাকে ডোবানোর কোন সখ নেই আমার ৷ লাজলজ্জার মাথা কেটে নিজের স্বামীর ঘরে আবার ফিরে যেতে বল না হলে এই বাসায় যেন আর পা না রাখে ৷”
কথাটা বলে গজগজ করতে করতে উনি ঘরের ভিতরে চলে গেলেন ৷ নিলু নীলুর মায়ের এই কথাটা শোনার পর নীলুর চোখ দিয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পড়তে লাগল ৷ ওর মা এমন কেন ? সবার থেকে আলাদা ৷ আর পাঁচটা মায়ের মতো নিজের সন্তানের প্রতি উনার মায়া মমতা নেই, আছে কেবল টাকার প্রতি লোভ ৷

নীলুর বাবা নীলুর মায়ের এমন ব্যবহারে চমকে গেলেন ,মেয়েটা কি বলতে চাইছে সেটা একবারও কর্ণপাত করলেন না তার আগেই নিজের মন মত যা খুশি বলে উনি চলে গেলেন, আসলেই উনি কি মা হওয়ার যোগ্য সেটা উনি মাঝে মাঝেই ভাবেন ৷ নীলুকে সান্ত্বনা স্বরূপ নীলুর বাবা যখনই কিছু বলতে যাবে তখনই নীলু ওর বাবার পায়ে সালাম করে ছলছল চোখে তাকিয়ে বলল

“আমাকে মাফ করো ৷ এরপরে তোমাদের খারাপ সময়ের জন্য হয়তো আমিই দায়ী ৷ আমি রুদ্রকে ছেড়ে চলে এসেছি , উনি মিঠির সাথে পরকীয়াতে লিপ্ত, প্রতিবাদ করায় আমার সন্তানটাও আজ নেই ৷ উনি আমার গায়ে হাত তুলেছেন ৷ উনি একজন কাপুরুষের সমতুল্য, আর আমি তোমার শিক্ষায় বড় হয়েছি, তুমিই বলতে অন্যায় কে কখনো প্রশ্রয় দিতে নেই তাহলে যে অন্যায় কে প্রশ্রয় দেয় সেও সমান অপরাধী হিসাবে গন্য হয় ৷ আমিও সহ্য করি নি বাবা আমি চলে এসেছি তবে আমি এখন দুর্বল আমাকে শক্তিশালী হয়ে ঘুরে দাঁড়াতে হবে হয়তো কাউকে পাশে পাবো না তবুও যতটা পারি নিজের জন্য লড়ে যাবো ৷ উনার কঠোর থেকে কঠোরতম শাস্তির ব্যবস্থা করব আমি ৷ তোমাদের আগামী জীবনের খারাপ সময়ের জন্য হয়তো আমিই দায়ী হবো , তাই পারলে আমাকে ক্ষমা করো ৷ ”

কথাটা বলেন নীলু প্রাণপণে দৌড়াতে লাগলো ৷ এত অল্প সময়ের মধ্যে নীলুর বাবা সমস্ত টা শুনে যেন হতভম্ব হয়ে গেলেন, কি বলবেন ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয় ৷ নীলুর কথা শোনার পর নীলু কে কি বলে সান্তনা দিবে সেই ভাষাটা ওনার কাছে নেই কিন্তু উনি কিছু বলার আগেই নীলু সেখান থেকে দৌড়ে চলে গেল ৷ নীলুর পিছন পিছন দৌড়ে নীলুকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার কিন্তু তার বয়সের তাড়নায় আগেকার দিনের মতো অনায়াসে কয়েক মিটার দৌড়ানোর ক্ষমতা ওনার আজ নেই ৷ নীলু ছুটছে ৷ উনি খানিকটা যেতেই হাপিয়ে পড়লেন আর খানিকটা গোঙানির সুরে বললেন
” নীলু মা যাস না ফিরে আই, আমি তোকে আগলে রাখবো , তোকে লড়তে সাহায্য করবো ৷” কথাটা বলে উনি সরু রাস্তার মাঝে বসে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলেন ৷

তুমি চিরদিন.. ভিষণ কঠিন
তোমার ঘর ভেসে যায়
ওরা মুখ দেখে বুঝতে পারে না (x2)
ওরা এ মন কেমন বোঝে না
ওরা আসল কারণ খোঁজে না
তুমি চিরকাল.. স্বপ্নে মাতাল
হেটে সারাজীবন ধরে
ঝড় বৃষ্টি মাথায় করে (x2)
ওরা মনের গোপন চেনে না
ওরা হৃদয়ের রং জানে না
প্রজাপতি ডানা ছুঁলো বিবাহ বাসরে
কেন সারারাত জেগে বাড়ি ফিরি ভোরে
ওরা মনের গোপন চেনে না
ওরা হৃদয়ের রং জানে না

গিটারের তালে গান ধরেছে শ্রাবন ৷ বাড়ির সামনে ছোট্ট উঠোনটাতে একটা বড়ো মাদুড় পেতে শ্রাবন আর ওর মা বসে আছে ৷ রাত পৌনে বারোটা ছোবো ছোবো ৷
একমাত্র মধ্যবিত্তরাই জানে রাত জেগে হাজারো স্বপ্নকে কীভাবে বাস্তবায়িত করা যাই, কীভাবে একরাশ জোনাকির মিটমিট আলোতে কীভাবে সুখ খুঁজে পাওয়া যাই ৷ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান মানেই একরাশ দায়িত্ব, যেখানে সবাইকে সুখী করতে গিয়ে আর নিজেকেই সুখী করা হয়ে ওঠেনা, হাজারো মধ্যবিত্তদের স্বপ্ন ভাঙে রাতের অন্ধকারে , পাশে থাকে না কেউ ৷

শ্রাবনের মা শ্রাবনের কাছে বসে আছেন , মাদুড়ের ওপর একটা ছোট্ট মমবাতি জ্বলছে , মাঝে মাঝে মৃদু হাওয়ার মমবাতিটা নিভেও নিভছেনা ৷

শ্রাবনের গানের তালের সাথে সাথে গম্ভীর এক ক্লান্তিমাখা পদধ্বনি ভেসে আসছে ৷ হঠাৎ অন্ধকারের মাঝে কেউ একজন যেন শ্রাবন আর ওর মায়ের পায়ের কাছে এসে আছড়ে পড়লো ৷ শ্রাবনের মা কেঁপে উঠে খানিকটা চেঁচিয়ে উঠলেন ৷ শ্রাবনের হাত থেকে গিটারটা পড়ে গেল আচমকাই , বিচ্ছিন্ন হলো সুর ৷ মমবাতিটা হাতে নিয়ে পড়ে থাকা মানুষটার মুখের কাছে নিয়ে যেতেই তারা দুজনেই কেঁপে উঠলো ৷ নীলু মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে ৷ খশখশে ঢালাইয়ের ওপর আছড়ে পড়ে হাত কেটে রক্ত বার হচ্ছে ৷ নীলুর কোন জ্ঞান নেই , না আছে কোন সাড়াশব্দ ৷ শ্রাবনের মা নীলুকে তাড়াতাড়ি তুলে নিজের বুকে জড়িয়ে নিলেন ৷ ওনার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে নীলুকে এই অবস্থায় দেখে,মেয়েটার ব্লাউজের হাতাটা ছেড়া, ঠোঁটের কোনে কাটা, গালদুটো লাল , আর মেঝেতে পড়ে গিয়ে হাতটা কেটে গেছে ৷

জলকাব্য পর্ব ৭

শ্রাবনের গলা বসে এলো , মুখ দিয়ে কিছু উচ্চারন করতে গিয়েও ওর গলা কাপছে ৷ অথচ এই গলার সুর দিয়ে কতো গান অনায়াসেই গেয়ে ফেলে ৷
শ্রাবন কাঁপাকাঁপা কন্ঠে বলল
” মা নীলুর এই অবস্থা হলো কি করে ?”
উনি নীলুকে আরো শক্ত করে জাড়িয়ে ধরে কাঁপতে কাঁপতে বললেন
” এক্ষুনি ডক্টর ডাক বাবা, মেয়েটার যেন কিছু না হয় ৷”
শ্রাবন মোমবাতিটা মেঝেতে ফেলে খালি পায়ে দৌড়াতে লাগলো ৷ আর যাই হোক ওর নীলুর কিছু হলে চলবে না ৷ রাতের ঘন অন্ধকারে শ্রাবনের মা নীলুকে আগলে রেখেছেন নিজের মেয়ের মতো করে যেখানে নীলু তার নিজের মায়ের কোলে স্থান পাইনি ৷

টাকার গন্ধে পাগল এই পৃথিবী
সবাই করে অবহেলা
থাকবেনা টাকা চিরকাল
থাকবে শুধু পাপের ঘড়া ৷
” টাকা এক প্রকার নেশা যা সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষকেও আসক্ত করতে সক্ষম ৷”

জলকাব্য পর্ব ৯