জলকাব্য পর্ব ৭ || লেখিকা:সুরাইয়া আয়াত

জলকাব্য পর্ব ৭
লেখিকা:সুরাইয়া আয়াত

“করে নীলু তুই ঠিক আছিস তো ?” বেশ ভয়ার্ত কন্ঠে কথাগুলো বলল শ্রাবন ৷
নীলু চোখের জলটা মুছে বলল
” হমম ঠিক আছি শ্রাবন ভাইয়া ৷”
” আমার তোকে ঠিক মনে হচ্ছে না,তোর কন্ঠস্বরটা কাঁপছে নীলু আমি জানি তুই ঠিক নেই ৷”
নীলুর আরেক চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তেই নীলু আর এক হাত দিয়ে তা মুছে নিয়ে চুপ করে রইলো ৷
শ্রাবন নীলুর নিরবতা বুঝতে পেরে বলল
” আসলে কালকে রাতে তোকে আর ফোন করিনি আমিব ভাবলাম ফোন করলে তোর হাজবেন্ড যদি আবার কিছু মনে করেন তাই আর কি ৷আচ্ছা আমাকে একটা সত্যি কথা বলবি ?”
” হমম বলো ৷”

” উনি কি এই বিষয়টা নিয়ে তোর সাথে রাগারাগি করেছে ?”
নীলুর মনে মনে ভীষন ভাবে বলছে যে
” উনি তো জানলে আমাকে এ বাসায় রাখবেই না, তাছাড়া উনি তো নীলুর খোঁজ ই নেন না , বেঁচে আছে কি মরে গেছে তাও কখনো জানতে চাইনা ৷ পরকীয়াতে হাতেনাতে ধরার পর যেন আরো বেখেয়ালি হয়ে গেছেন ৷”
নীলু মনের ভিতর চলতে থাকা কথাগুলোকে দমিয়ে রেখে বলল
“কই না তো , উনি তো খুবই স্বাভাবিক ছিলেন, উল্টে উনি আরো অনেক করে বোঝালেন যে এটা একটা দুঃঘটনা তাই এই বিষয় নিয়ে যেন আর বেশি না ভাবি ৷”.
শ্রাবন নিজের অজান্তেই মুচকি হেসে বলল
” খুব লাকি তুই যে ওনার মতো হাজবেন্ড পেয়েছিস ৷ আশাকরি আজীবন এভাবেই তোকে আগলে রাখবে ৷”
কথাটা বলে শ্রাবন ও নিজের চোখ মুছলো ৷নীলু এখনো চুপচাপ ,শ্রাবনের কথাগুলো নিরবে মেনে নিচ্ছে ৷ শ্রাবন বলে উঠলো

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

” আচ্ছা নীলু রাখি রে, প্র্যাকটিস করতে হবে, পোগ্রামটা ক্যান্সেল হয়ে গেছে, 28 তারিখ নাগাদ হবে তাই একটু ৷ আর শোন নিজের খেয়াল রাখিস আর কখনো দরকার হলে আমাকে ফোন করিস ৷”
নীলু কিছু বলতে যবে তার আগেই শ্রাবন কলটা কেটে দিলো ৷
নীলু ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকে একটু নিস্তব্ধ হয়ে রইলো ৷ শ্রাবনকে আর কিছু বলতে না পারলেও একটা ধন্যবাদ জানাতো যা শ্রাবনের প্রাপ্য ৷ নীলু চোখজোড়া বন্ধ করলো ৷ সন্তানটা আর রইলো না ৷সন্তান থাকতেই নীলু নিজের কতো অযত্ন করতো আর সেখানে সন্তানটা আর নেই ,তাই এখন নিজের যত্ন নেওয়াটা নীলুর কাছে বিলাসিতা ছাড়া আর অন্য কিছুই না ৷

আজ রাতে নিশ্চয়ই রুদ্র ফিরবে , আর এটুকু নীলু ভালো জানে যে রুদ্র যদি জানে যে সন্তানটা আর নেই তাহলে নীলুর ও হয়তো এ সংসারে প্রয়োজন ফুরিয়ে এসেছে ৷ রাত অধবি ওর কাছে সময় আছে ভাবার জন্য, ও কি করবে পরবর্তীতে তা ওকেই ভাবতে হবে ৷ এক ক্ষুদ্র মস্তিষ্টের কোটি কোটি নিউরোন গুলোকে আজ স্বাভাবিকের তুলনায় আরো বেশি করে সক্রিয় হয়ে উঠতে হবে , আজ নীলুর বাঁচার একটা পথ খুজতে হবে ৷

সারাদিন নীলু ভেবেছে ৷ রুদ্রর সাথে আর যা করেই হোক বাকিটা জীবন তো কাটাতেই হবে যদিও বা ওর অনাগত সন্তানের জন্মের পিছনে রুদ্র নিজেই দায়ী তাও নীলু মুখ বুজে মেনে নিচ্ছে নাহলে তো নীলু নিজেও সবটা হারাবে আর ওর সাথে ওর পরিবার ও পথে বসবে ৷
নীলু ঠিক করেছে যে কোনভাবেই হোক রুদ্রর কাছে স্বীকার করবে না যে বাচ্চাটা নেই যদিও জানে যে এত বড়ো মিথ্যা বলাটা ওর উচিত নয় তবুও ৷ মেঝেতে বসে খাটে হেলান দিয়ে কথাগুলো ভাবছে নীলু ,তখনই দরজার বেল বাজলো ৷ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ঘড়ির ছোট কাটা 10 এর ঘরে ছুইছুই ৷ রাত দশটা বাজে , এতো রাতে বেল বেজে উঠেছে তার মানে এটা নিশ্চিত যে রুদ্র ফিরেছে ৷ তাড়াতাড়ি করে নীলু ছুটে গেল, নিজের ভাবভঙ্গি রুদ্রর সামনে ঠিক রাখতে হবে নয়তো ধরা খাওয়ার সম্ভবনা প্রবল ৷

নীলু দরজা খুলতেই দেখলো রুদ্র দাঁড়িয়ে আছে আর তার পাশে লাল টকটকে একটা জামদানি শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে মিঠি ৷ মিঠির হাতে একটা মস্ত ট্রলি ব্যাগ যা দেখে মনে হচ্ছে ওর বাসায় যতো পোশাক আশাক ছিলো সব সেই ট্রলিতে ভরে তুলে এনেছে ৷ নীলু মিঠিকে দেখে খানিকটা রূক্ষ গলায় বলল
” কি ব্যাপার মিঠি তুমি এতো রাতে এই বাসায় !”
মিঠি রুদ্রর দিকে তাকিয়ে মুচকি একটা হাসি দিয়ে বলল
” হমম , আমার বাসা আমি অসতেই পারি, যতই হোক এটা রুদ্রর বাসা আর আমি রুদ্রর লিগাল ওয়াইফ ৷”
নীলু অবাক হলো সাথে চমকেও উঠলো ৷ রুদ্রর দিকে তাকিয়ে বলল

” আপনি কিছু বলছেন না যে ৷ এসব আমি কি শুনছি ! আপনি ওনাকে বিয়ে করেছেন ?”
রুদ্র বিরক্ত হয়ে নীলুকে খানিকটা ধাক্কা দিয়ে গেটের মুখ থেকে সরিয়ে দিয়ে বলল
” সরো তো এখান থেকে, মিঠিকে আসতে দাও ৷ ও আজ থেকে আমার ওয়াইফ, এই বাসাতেই থাকবে ৷ ও এখানে থাকলে তাতে তোমার কোন সমস্যা থাকলে তুমি প্লিজ এখান থেকে আসতে পারো, আইমিন বিদায় হতে পারো ৷
নীলুর চোখজোড়া ভরে আসছে জলে ৷ রুদ্রর দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে বলল
” আপনি এটা আমাকে বলতে পারেন না, আর যাই হোক আমি আপনার স্ত্রী, আপনার ওপর আমারো অধিকার আছে, এর বাসার ওপরেও আমার অধিকার আছে ৷ ”

তখনই মিঠি ওর ব্যাগ থেকে একটা কাগজ বার করে রুদ্রর হাতে ধরিয়ে দিলো ৷ একটা কালির বাক্স নিয়ে নীলুর হাতের ছাপটা ওই পেপারে বসিয়ে দিলো ৷ নিমেষেই সবটা এমন ভাবে ঘটে গেল যে নীলু কিছুই বুঝতে পারলো না ৷
মিঠি বলে উঠলো
” নাও ডিভোর্স করিয়ে দিলাম , ও আর তোমার হাজবেন্ড না, লিভ হিম ৷”
নীলু আর সহ্য করতে পারলো না, ঠাস করে মিঠিকে একটা চড় বসিয়ে দিলো নীলু, আজ অবধি নীলু কখনো কারোর গায়ে হাত ওঠাই নি, বৈবাহিক জীবনটা কি একটা ছেলেখেলা নাকি যে বিয়ে বললেই বিয়ে আর ডিভোর্স বললেই ডিভোর্স ৷
রুদ্র রেগে গিয়ে নীলুর চুলের মুঠি ধরে বলল

” তোর সাহস তো কম না তুই ওকে চড় মারিস ৷ বেহায়া লজ্জা শরম কিছু নেই,রাত দুপুরে পর পুরুষ নিয়ে ঘুরে বেড়াস ৷ চরিত্রের ঠিক নেই ৷ আমার তো এখন সন্দেহ হচ্ছে যে তোর ওই পেটের সন্তানটা আদেও আমার কি না !”
নীলুর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন ওঠালো রুদ্র এমনকি ওর এই কুটুকথা থেকে ওর বাচ্চাটাটেও রেহায় দেইনি ৷
নীলু রুদ্রকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলল

” লজ্জা করে না আপনার , নিজের সন্তানকে এভাবে অপবিত্র বলতে ! আপনি কি মানুষ নাকি জানোয়ার ৷ আরে আজ আপনারই কারনে সে আজ এই পৃথিবীতে নেই, জন্ম নেওয়ার আগেই তো শেষ করে দিলেন তাকে আবার তার পিতৃপরিচয় নিয়ে কথা বলছেন ৷ আপনার ওপর এখন ঘৃনা হচ্ছে, বারবার মনে হচ্ছে আপনি যখন ধাক্কা মেরে আমাকে মাড়িয়ে চলে যেতেন তখন কেন আপনাকেও আমি একটা সপাটে চড় মারিনি ৷ ”

কথাটা শোনা মাত্রই রুদ্র নীলুর গালদুটো শক্ত করে চেপে ধরলো ৷ আর দাঁতে দাঁত চেপে বলল
” এক্ষুনি গলাটা টিপে ধরলেই তো দম আটকে মরবি আবার বড়ো বড়ো কথা ৷ ফকিন্নির বাচ্চা ৷ নিজের দিকে দেখেছিস কখনো ৷ তুই কেন তোর চোদ্দ গোষ্টির বাচ্চা কেও আমি পালবো না ৷ ”
কথাটা বলে নীলুকে জোরে ধাক্কা মেরে ফেলে দিতেই নীলু দরজার কাছে গিয়ে আছড়ে পড়লো ৷ নীলুর চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় জল গড়িয়ে পড়ছে ৷ মিঠি নীলুর হাত ধরে বাইরে বার করে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো ৷
নীলু মেঝেতে বসে ফুপিয়ে কাঁদছে ৷ হঠাৎ রুদ্রর প্রতি তীব্র ঘৃনা জন্মাতে লাগলো ৷ চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো নীলু ৷ জোরে জোরে দরজা ধাক্কা তে লাগলো আর বলতে লাগলো ” দরজা খোলো ৷”
রুদ্র আর মিঠি চরম বিরক্ত হচ্ছে ৷ মিঠি বলে উঠলো

” তুমি থাকো, আমি ওর তেজ কমাচ্ছি ৷”
মিঠি দরজা খুলতেই দেখলো নীলু দাড়িয়ে আছে, নীলু ভিতরে ঢুকতে নিলেই মিঠি আটকালো
” একদম ভিতরে আসার চেষ্টা করবে না ৷ ভিতরে ঢুকলে আর বেঁচে ফিরতে পারবেনা বলে দিলাম ৷”
নীলু মিঠির দিকে তাচ্ছিল্য করে বলল

” একটা মেয়ে তাইনা তুমি ? মেয়ে হয়ে একটা মেয়ের সংসার ভাঙতে খুব মজা পেলে ? নিজের রুপ আর যৌবন দিয়ে পুরুষকে আকৃষ্ট করা যাই কিন্তু বেশি দিন তাকে ধরে রাখা যাইনা ৷ যে পুরুষ নিজের ঘরে বউ থাকতে অন্য কাউ তে আকৃষ্ট হয় সে পুরুষ না কাপুরুষ ৷একজন মানুষের রুপ চিরকাল একই থাকে না, পরিবর্তন সবার মাঝেই আসবে ৷ তুমিও একদিন অভিশপ্ত হবে ৷ সব হারাবে ৷ কাউকে ঠকিয়ে কেউ সুখী হয়না ৷ উপরওয়ালা এতো সহজে তোমাদেরকে যেন পার পেতে না দেন ৷ ”

জলকাব্য পর্ব ৬

কথাটা বলে নীলু চলে এলো ৷ নীলুর শরীরের রক্ত যেন টগবগ করে ফুটছে ৷ কিছ মাথায় আসছে না কি করবে ৷আর যাই হোক এতো অত্যাচার সহ্য করা সম্ভব না ৷ নীলুর গাল বেয়ে রক্ত ঝরছে ৷ ফুটপাত দিয়ে হাটছে ৷ শহরের গাড়ির ভিতর থাকা মানুষগুলোও যেন দেখেও দেখছেনা এমন ৷ সকালে শাড়ির আঁচলে একটা 100টাকার নোট বেধে রেখেছিলো নীলু , টাকাটার কথা মনে পড়তেই তাড়াতাড়ি দৌড়ে রিকশ স্ট্যান্ড এ গেল ৷ এখান থেকে রিকশা নিলে 25 মিনিটের মধ্যেই ওর নিজের বড়ি পৌছে যাবে ৷ আশেপাশে রিকশা পেল না কোথাও ৷ পায়ে হাটতে শুরূ করলো নীলু ,মাঝেমাঝে দৌড়াচ্ছে, নিরাপদে ফিরতে হবে, ও শহরে নারীকে খুবলে খাওয়ার মতো মানুষের অভাব নেই ৷ গাড়ির আলো ফুটপাতটাকে আলোকিতো করছে ৷ নীলুও জোর পায়ে হাটছে ৷ মাঝপথে এসে নীলু হাপিয়ে গেল, জীবনের প্রতি তীব্র বিতৃষ্ণা আসছে , চিৎকার করে কান্না করতে ইচ্ছা করছে, না পেরে নীলু কেঁদে উঠলো ৷ নিজেকে নিজেই বলতে লাগলো
” তোকে আরো শক্ত হতে হবে নীলু, আরো ৷”

নীলু হাটতে শুরু করলো ৷ জীবনে যে একবার থেমে যাই সে শতমাইল পিছিয়ে পড়ে জীবন যুদ্ধে ৷
তাই থেমে না থেকে এগিয়ে যাওয়াই শ্রেয় ৷

জলকাব্য পর্ব ৯