জলকাব্য পর্ব ১২ || লেখিকা:সুরাইয়া আয়াত

জলকাব্য পর্ব ১২
লেখিকা:সুরাইয়া আয়াত

” ভাইয়া নাও আর ইউ নারভাস ?”
খানিকটা ভয়ার্ত কন্ঠে বলল নীলু ৷
শ্রাবন নীলুর দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলল
” নীলু আই থিংক আমার থেকে তুই বেশি নারভাস হয়ে পড়ছিস ৷ একটু শান্ত হ নীলু আই এম ফাইন ৷”
অনেকটা শান্ত ভাবেই বলল শ্রাবন ৷

নীলু নিজেই ফ্লাক্স থেকে খানিকটা গরম জল খেয়ে চোখ মুখ কুচকালো ৷শ্রাবন নীলুর মুখের অবস্থা দেখে মুচকি হেসে স্টেজের দিকে তকালো ৷ শ্রাবনের সিরিয়াল নম্বর 17 , আপাতত 15 নম্বর চলছে ৷ মনের মাঝে একটু একটু ভয় হচ্ছে তবে নিজের মাঝে নারভাসনেসটাকে বেশি গুরুত্ব দিতে চাচ্ছে না ৷ কিন্তু নীলুকে দেখে ভীষনরকম হাসি পাচ্ছে ৷ দেখতে দেখতে 15 নম্বরে যেই ছেলেটা ছিলো সে স্টেজ থেকে নেমে এলো ৷ নীলুর মুখে কালো মেঘের আভাস , শ্রাবন ঠিক বুঝতে পারছে না নীলুর ভয়টা ঠিক কিসের !
আর কিছুখন পরেই শ্রাবন যাবে , ওয়েটিং রুমে দাঁড়িয়ে আছে ও ৷
শ্রাবন নীলুকে বলল

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

” এই যে জলটা দে ৷”
নীলু কাঁপাকাঁপা হাতে জলটা দিলো ৷ শ্রাবন কয়েক ঢোক খেয়ে নীলুকে ওটা ফিরত দিয়ে বলল
” আ্যসিসট্য৷ন্ট হয়ে এতো ভয় পেলে চলবে ৷”
নীলু মাথা নীচু করে রেখেছে ৷ শ্রাবন ঠোঁট চেপে হেসে বলল
” একটা সত্যি কথা বলবি ?”
নীলু মাথা নীচু করে রেখে বলল “হমম ৷”
” কিসের জন্য এত ভয় পাচ্ছিস বলবি ? আমাকে হেরে যেতে দেখার ভয় ?”
নীলু মাথা নাড়ালো ৷ শ্রাবন স্বাভাবিক থেকেই বলল
” মাথা তোল, আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বল ৷”
নীলু মাথা উঁচূ করে তাকালো ৷
শ্রাবন ভাবুক সুরে জিজ্ঞাসা করলো
” আমার চোখে কিছু দেখলি ৷”
নীলু বোকার মতো মাথা নাড়িয়ে বলল
” কই না তো ৷”
শ্রাবন এবার জোরেই হেসে ফেলল ৷
” হাসছো কেন?”
শ্রাবন হাসি থামিয়ে বলল

” তোর মাথা নাড়ার ভঙ্গি দেখে ৷ আমার নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস আছে , নিজের চোখ জোড়াকে নিজে দেখতে না পেলেও অনুভব করতে পারছি সেখানে আত্মবিশ্বাস আছে ৷ আর এটা কোন ছোটখাটো পোগ্রাম না , যথেষ্ট বড়ো পোগ্রাম ৷ এখান থেকে প্রথম হলে আমাকে আর একটা জায়গাতে গিয়ে গাইতে হবে, সেমি ফাইনাল বলতে পারিস ৷ সেখান থেকে উইন করলে একটা মিউজিক আ্যলবাম বানানোর সুযোগ পাবো তাই এটা ছোট কিছু নয় ৷ আর এতো বড়ো যুদ্ধে যখন নেমেছি আত্মবিশ্বাস নিয়েই নামতে হয় ৷”
নীলু মুগ্ধ হয়ে শ্রাবনের দিকে তাকিয়ে আছে ৷ শ্রাবন অনেক কিছু বোঝে যা নীলু বোঝেনা , নীলু তো খুব অল্পতেই ভয় পেয়ে যাই ৷
শ্রাবন নীলুর চাহনি উপেক্ষা করে বলল
” নীলু আমাকে ডেকেছে , আসছি ৷”

নীলু শ্রাবনের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো , শ্রাবনকে বড়ো ভাইয়ের চোখে নীলু দেখেছে এর বেশি কখনো ভেবে দেখেনি ৷ তাই একটা ভাইয়ের জন্য তার বোনের চিন্তাটা যেমন হওয়া উচিত নীলুর ও ঠিক তেমন অনুভতি হচ্ছে ৷
কিছু ক্ষনের মধ্যেই স্টেজ নানা রকমের আলোতে ভরে গেল ,ওয়েটিং রুম থেকে সব দেখা যাচ্ছে ৷ আর নিমেষেই গিটারের বাজনা বেজে উঠলো ৷ শ্রাবনের হাতে মাইক আর চোখে আত্মবিশ্বাস ৷হঠাৎ শ্রাবনের এক অপূর্ব কন্ঠস্বর ভেসে এল যা একদম অন্যরকম ৷ নীলুর কাছে তা অন্যরকম মনে হচ্ছে কারন এর আগে নীলু কখনো শ্রাবনের স্টেজ পারফরমেন্স দেখেনি ৷
স্টেজে উঠলে বুঝি সবার কন্ঠস্বরে অদ্ভুত পরিবর্তন আসে ৷

” ছেড়ে যেওনা, ছেঁড়ে যেয়োনা
কি করি বলো, তুমি হিনা?
আমি পারিনি তোমাকে
আপন করে রাখতে,
আমি পারিনি তোমাকে
আবার আমার করে রাখতে।
তুমি বুঝনি, আমি বলিনি
তুমি স্বপ্নতে কেন আসনি?
আমার অভিমান তোমাকে নিয়ে
সব গেয়েছি।
গানে গানে সুরে সুরে কত কথা
বলেছি তোমাকে,
তুমি বুঝনি, বুঝনি।

গান হচ্ছে আর নীলু চোখ বন্ধ করে কেবল অনুভব করছে ৷ আজকে রুদ্রর কথা খুব মনে পড়ছে ৷ কতো স্বপ্নই না নীলু সাজিয়েছিলো একে অপরের সাথে সারা জীবন পার করার, হাতে হাত রেখে আকাশের তারা গোনা থেকে শুরূ করে রাতে হাতে হাত রেখে দীর্ঘ পথ জুড়ে হাটা ৷
অজান্তেই চোখের কোনা বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো ৷ এই পোঁড়া ক্ষতের দগদগে অনুভূতি এত সহজে মিলিয়ে যাওয়ার নয় , তা ঠিক আঘাত দেবেই ৷

” তোমাকে না বলেছিলাম ওই অমানুষটার কাছে হাত পেতে টাকা চাইবে না ৷তোমাকে এতো বারন করা সত্বেও তুমি টাকা চাইতে গেছো লজ্জা করে না তোমার ?”
নীলুর বাবর ধৈর্যের বাঁধ আজ ভেঙে গেছে, উনি আজ এর একটা বিহিত করেই তার ক্ষান্ত হবেন ৷
নীলুর মা উনিও গজগজ করে বললেন
” বেশ করেছি টাকা চেয়েছি ৷ নিজের তো দু পয়সা উপার্জন করার ক্ষমতা নেই তাই তোমার মুখে এসব কথা মানায় না ৷ তাই যা পাচ্ছো যতোটা পাচ্ছো মুখ বুজে মেনে নাও ৷ আর তোমার ওই মেয়েকে আমি আবার বিয়ে দেবো ৷ আমি আজকে ছেলে খুঁজে এসেছি , সব কথাও ঠিক হয়ে গেছে ৷”
উনি এবার মেজাজের নিয়ন্রন হারালেন

” তোমাকে কিছু না বলে বলে আজ এতদূর , নেহাতই এক্সিডেন্টে তুমি নিজের সন্তান ধারনের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলে সেই কারনে কখনো তোমাকে কটু কথা শোনাই নি ৷ কারন আমি বুঝি একটা সন্তান জন্ম না দেওয়ার কষ্টটা ৷”
উনিও এবার যেন কোমর বেধে ঝগড়া করার একটা সুযোগ পেয়েছেন ৷ উনিও সমানভাবে বললেন
” তা নয় তো কি ৷ আমি যা বলবো তুমি তাই শুনবে ৷ নীলুকে আমি বিয়ে দেবো বলেছি যখন তখন আবার বিয়ে দেবোই ৷ পাশের পাড়াই শফিক আছে না , ওই যে যার বউ কয়েক মাস আগে ওকে তালাক দিয়ে চলে গেল তার সাথে নীলুর আবার বিয়ে দেবো, কিছুর অভাব নেই ওর ৷ গাড়ি , বাড়ি সব আছে ,একটা শোরুম ও আছে , জমি জায়গাও আছে আর মাস গেলে আমাদেরকে মোটা টাকা দেবে আর কি চাই ? বাকিটা জীবন এভাবেই চললে হলো ৷ কারন এর বেশি তোমার তো আর মুরদ নেই ৷নেহাতই নীলু আমার বড়ো বোনের মেয়ে তাই ওকে ফেলে দিইনা এটা ওর কপাল ৷ তিনবেলা আমাদের সাথে থেকেছে , আমাদের টাকাই খেয়েছে আর এখন আমাদেরকেই পথে বসিয়েছে ৷ ওরকম মেয়েকে সহ্য করা যাই ? তার ওপর ওই শ্রাবনের সাথে এত পিরিতের পর থেকেই তো আমি ওকে সহ্য করতে পারি না ৷ ওই ভিখারির ছেলে,,,,”

কথাটা আর পুরো বলতে পারলেন না উনি তার আগেই নীলুর বাবা কষিয়ে একটা থাপ্পড় মারলো নীলুর মা কে ৷ ওনার সমগ্র শরীর থরথর করে কাপছে ,নীলু ওনার নিজের মেয়ে না কথাটা সত্যি কিন্তু তাই বলে কখনো নীলুকে হেয় করেনি, নিজের সন্তানের মতোই ভালোবাসা দিয়েছে আর আজ নীলুর মা সামান্য কয়েকটা টাকার জন্য নীলুর পরিচয় নিয়ে, নীলুর চরিত্র নিয়ে আবার অন্যর ছেলেকে নিয়ে টানাটানি করছে ৷
নীলুর মা চড় খেয়ে বলল

” তুমি আজ ওই মেয়ের জন্য আমাকে মারলে তো? থাকবো না আর আমি এই বাড়িতে ৷ যে বাড়িতে আমার কোন দাম নেই সেই বড়িতে আমার থাকার কোন দরকার নেই, তুমি আর তোমার মেয়ে থাকো ৷ ”
.কথাটা বলে কাঁদতে কাঁদতে উনি ঘরের মধ্যে চলে গেলেন ৷ নীলুর বাবা থরথর করে কাপছেন ৷ বুকের মধ্যে অসহ্য জালাপোড়া শুরু করে দিয়েছে ৷ এক্ষুনি হয়তো দম আটকে নিশ্বাস ত্যাগ করবেন ৷ উনি সেখানে ঠাই দাঁড়িয়ে রইলেন , বেশ কিছুক্ষন পর উনি দেখলেন নীলুর মা নিজে ব্যাগ গুছিয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেলেন ৷ দূরপথেও তাকে এখনো দেখা যাচ্ছে ৷ নীলুর বাবা কাঁপতে কাঁপতে ওনার নিজের ঘরে গেলেন ৷ বিছানায় বসে খাতা কলম হাতে নিলেন ৷ ওনার মেয়ে নীলুকে অনেক কিছু বলার আছে যদিও তা কখনো সম্পূর্ণ লিখে প্রকাশ করার সম্ভব নয় তবুও যতটুকু পারে ৷ কাঁপাকাঁপা হাতে লিখতে বসেছেন আর চোখের জল টুপিয়ে টুপিয়ে পৃষ্ঠার ওপর পড়ছে আর লেখাগুলোকে অষ্পষ্ট করে তুলছে ৷

” শ্রাবন ভাইয়া তুমি গাড়িতে উঠছোনা যে তুমি কি এখন বাড়িতে যাবে না ?”
একটা হলুদ ট্যাক্সিতে উঠে শ্রাবনের দিকে প্রশ্নটা ছুড়লো নীলু ৷
শ্রাবন ব্যাস্ত রাস্তার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল
” নাহ, আমি পরে ফিরবো ৷ সবাধানে যাস ৷”
” কিন্তু তুমি এখন ফিরবেনা যে !”
” হমম আমার একটু কাজ আজে , কাজ শেষে ফিরবো ৷ সবধানে যাস ৷”
ট্যাক্সি স্টার্ট হতে শুরু করলো ৷ নীলু জানালা থেকে মুখ বর করে শ্রাবনের দিকে তাকিয়ে বলল

” ভাইয়া !”
শ্রাবন চোখের ইশারায় জিজ্ঞাসা করলো
” কি?”
” সাবধানে এসো ৷”
শ্রাবন আর কোন উত্তর দিলো না ৷ নীলুর কথার ইশারা উপেক্ষা করে পিছু ঘুরলো ৷ নীলুও ট্যাক্সির মাঝে বসে হাজারো কল্পনা জল্পনা করতে লাগলো ৷

শ্রাবন এখন গহনার দোকানে যাবে , ওর মা যেই দোকানে তার দুল জোড়া বিক্রি করেছে সেই দোকানে গিয়ে দোকানদারকে গিয়ে বলবে যাতে সেই দুলজোড়া ভাঙা না হয় বা অন্য কোন কাজে না লাগানো হয় ৷ শ্রাবন টাকা দিয়ে দুলজোড়া ফিরত নেবে , যতই হোক ওর মায়ের স্মৃতি ওটা ,কি করে এতো মহামূল্যবান স্মৃতি কে হারাতে দেওয়া যাই !
তেমাথার মোড়ে ট্যাক্সি থামলো, এরপর যা আছে সব সরু গলি , গলিতে ট্যাক্সি যেতে পারে না , তাই এখান থেকেই সবাইকে হেটে যেতে হয় ৷ নীলুকে আর টাকা দিতে হলোনা কারন আগে থেকেই শ্রাবন টাকা দিয়ে রেখেছিলো ৷ নীলু গলি দিয়ে হাটছে ৷ বাড়ির জন্য আজ খুব মন খারাপ করছে ,শেষবার ওর বাবকে অনেকটা হাতছানি দিয়েই পালিয়ে এসেছিলো নীলু, বাবার গলা জড়িয়ে কতো কথা বলার ছিলো সেদিন বলতে পারেনি তাই ভাবলো আজ একটু দেখা করে আসবে তাতে ওর মা ওকে যা কথা শোনানোর শোনাবে , আর ওর বাবাকে বলবে যে রুদ্রর বিরুদ্ধে ও স্টেপ নেবে , সেটা শুনে নিশ্চয়ই উনি অনেক খুশি হবেন ৷

জলকাব্য পর্ব ১১

নীলু গলির বাকে ওর নিজের বাড়ির দিকে পা বাড়ালো ৷ দুই মিনিট হাটতেই বাড়ির সামনে পৌছে গেল ৷ বাড়ির সামনে যেতেই দেখলো লোহায় মরচে ধরা গেটটা খোলা আছে , বাড়িতে কুকুর ঢুকে যাই তাই নীলুর মা সবসময় গেট বন্ধ করে রাখেন কিন্তু আজকে হঠাৎ খোলা দেখে নীলু একটু অবাক হলো ৷ নীলুর এক কাধে ব্যাগ ঝুলছে আর লম্বা চুলে বেনুনি গাঁথা, গায়ে একটা চুড়িদার ৷ নীলু বাড়িতে ঢুকতে ওর মাকে দেখতে পেলো না , ওর বাবার রুমের দরজাটা আলতো করে আটকানো দেখে বুঝলো ওর বাবা ওই রুমেই আছেন ৷ নীলু গুটিগুটি পায়ে দেখলো ওর বাবা বিছানার ওপর শুয়ে আছেন , অন্যদিন চেহারার মাঝে যে উজ্জলতা থাকে তা আজ যেন কেমন ফিকে ফিকে লাগছে ৷ওনাকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে নীলু ওনার পাশে বসে ওনার বুকের ওপর মাথা রেখে বলতে শুরু করলো

” কেমন আছো বাবা ?তোমার নীলু মা আজ তোমার সাথে দেখা করতে এসেছে ৷ ঘুমাচ্ছো ? কথা বলবেনা ?”
অন্যদিন এতখনে নীলুর উপস্থিতি পেয়ে উনি হয়তো জেগে যেতেন কিন্তু আজ উঠছে না ৷ নীলুর ও অবাক লাগছে বেশ ৷ হঠাৎ নীলু অনুভব করলো ওনার হৃদপিন্ডের ধুকপুকুনিটা আর নেই, স্তব্ধ সব ৷ নীলুর সমগ্র শরীর কেঁপে উঠলো ৷ওর বাবার বুকেই মাথা রেখে কেঁদে দিলো
” ও বাবা ,তোমার নীলু ময়ের ওপর রাগ করেছো?কথা বলছোনা কেন গো? তোমার নীলু মা কি খুব খারাপ ? ও বা তোমার হৃদস্পন্দন আর আমি শুনতে পাচ্ছি না কেন? ও বাবা !”
নীলু ওনার বুকে মাথা রেখে গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে কাদতে লাগলো ৷ আজ ওর জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে ওর থেকে ৷ কেউ আর মাথায় হাত রেখে বলবেনা
” নীলু মা রে বড়ো ভালোবাসি রে তোকে ৷”

জলকাব্য পর্ব ১৩