জলকাব্য পর্ব ১৩ || লেখিকা:সুরাইয়া আয়াত

জলকাব্য পর্ব ১৩
লেখিকা:সুরাইয়া আয়াত

নীলুর বাবাকে কবর দিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ৷ উঠোনের এক কোণে বিধ্বস্ত অবস্থায় পড়ে আছে নিলু, চোখ মুখ শুকিয়ে গিয়েছে ,রোগা শরীর যেন আরো নেতিয়ে গিয়েছে , শরীরে রক্ত চলাচল কম আর এই সবকিছুর মাঝে এত বড় একটা আঘাত ৷
নীলুর মা নিলু থেকে কয়েক হাত দূরে বসে কান্নাকাটি করছেন , আর ওনার সাথে বসে আছে কয়েকজন উনার সমবয়সী মহিলা ৷ নীলুকে সান্তনা দেওয়ার মতো কেউ নেই , নিলু একাই বসে আছে ৷ সবাই যেন দোষারোপ করছে নীলুকে , কিন্তু নীলুর যে কোন দোষ নেই সেটা কেউ কখনো বুঝবেনা ৷ নীলুর মা অনেক সুন্দরভাবে সকলের সামনে নীলুকে অপরাধী বানিয়েছেন এবং বানিয়ে চলেছেন ৷

শ্রাবণের মা একটু নুন চিনির জল করে নীলুর সামনে ধরতেই নীলুর মা চেচিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলেন ” কি সর্বনাশ করলো এই মেয়ে ৷ যদি জানতাম যে নিজের আপনজনদেরকে এই মেয়ে মেরে ফেলবে তাহলে কখনো ওকে জন্মই দিতাম না আমি ৷ নিজের স্বামীর ঘর তো খেয়েছেআর এখন আমার স্বামীটাকেও খেয়ে ফেলেছে ৷ আল্লাহ কখনো ক্ষমা করবে না তোকে ৷ এই পাপের সাজা তুই পাবি ৷ কখনো সুখী হবিনা তুই ৷”

এই ধরনের আরো খারাপ মন্তব্য করতে লাগলেন উনি ৷ এই মুহূর্তে যেন নিজের স্বামীর মৃত্যুর শোকের তুলনায় নিলুকে দোষারোপ করাটা সবথেকে প্রয়োজনীয় ওনার কাছে আর সেই কাজটা অনেক ভালোভাবে করে চলেছেন উনি ৷
নিলু চুপচাপ শুনছে সবকথা , নীলুর কানে সব কথা পৌঁচ্ছাছে কিন্তু কিছু বলতে পারছেনা, হৃদয় থেকে শুধু একটাই ডাক ভেসে আসছে “ও বাবা , বাবা তোমার হৃদস্পন্দনে শুনতে পাচ্ছি না কেন ?বাবা তুমি কি তোমার উপর রাগ করেছ?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

শ্রাবণের মা নীলুর মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে পুনরায় নীলুর দিকে তাকালেন ৷ তারপর নিলু কে উদ্দেশ্য করে বললেন
” নীলু মা এই নে এটা খেয়ে নে, শরীরে শক্তি পাবি, এখনো অনেকটা কঠিন পথ বাকি আছে ৷ এইখান থেকেই তো তোর জীবনের যুদ্ধ শুরু আর এখনই এভাবে হেরে গেলে চলবে ? তোর বাবার শান্তির জন্য একটুকু করবি না ? দেখ উনি হার্ট অ্যাটাক করেছেন , এবার তোর চিন্তায় চিন্তায় কিন্তু আমিও কিন্তু হার্ট অ্যাটাক করবো বলে দিলাম ৷”

নিলু ওনার মুখ থেকে এই কথাটা শুনে উনার মুখের দিকে থমথম করে তাকিয়ে রইলো ৷ প্রিয় মানুষগুলো শুধু বারবার হারিয়ে যেতে চায় কেন ? তাদের কি ইচ্ছা যায় না প্রিয় মানুষদের সাথে থাকার ! নাকি আমরা তাদেরকে প্রিয় ভাবলেও তারা আমাদেরকে প্রিয় ভাবে না তাই খুব সহজেই দূরে ছেড়ে যাওয়ার কথা গুলো অনায়াসে বলে ফেলে ৷
উনার মুখের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে নিলু ওখান থেকে উঠে গেল ৷ জামাই ধুলোবালি , মাথার চুল গুলো উস্কখুস্ক, মুখে চোখের জল শুকিয়ে লেপ্টে আছে ৷ সবকিছু মিলে নিলু আজ ধ্বংস স্তূপের মতো ৷

নিলু ওখান থেকে চলে গিয়ে ওর বাবার ঘরে চলে গেল ,যে জায়গাটা ওর বাবা টা শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছিলো সেখানে গিয়ে নিলু শুয়ে পড়লো ৷ ওর বাবাকে অনুভব করতে পারছে ও, মনে হচ্ছে যেন ওর বাবা ওর খুব খুব কাছেই আছে ,আর ওর কানে বারবার বলছে
” বড্ড ভালোবাসি রে আমার নিলু মা টাকে ৷ ভেঙে পড়িস না, লক্ষ ভ্রষ্ঠ হোস না ৷ আমি তোকে হারতে শেখায় নি , তুই হেরে গেলে যে আমিও হেরে যাব মা , আমাকে এভাবে হারতে দিস না ৷”

কথাগুলো ভাবতেই নিলু ওখান থেকে উঠে পড়লো ৷ তাড়াতাড়ি নীলু ওর বাবার বালিশের তলায় হাত দিয়ে দেখল ৷ নিশ্চয়ই ওর বাবা এমন কিছু না কিছু রেখে যাবেন যা সারা জীবন নিলু কে আত্মশক্তি দেবে৷ নিলু দেখল যে ওর বাবার বালিশের তলায় একটা চিঠি পড়ে রয়েছে চিঠি , তার বাবার হাতের লেখা গুলো স্পষ্ট কাগজের মাঝে ৷ মাঝে মাঝে কিছু জায়গায় কাগজটা সামান্য অসমতল, ভেজা কাগজ শুকিয়ে গেলে যেমনটা হয় ঠিক তেমনটাই ৷ কিছু কিছু জায়গায় অস্পষ্ট চোখের জলের কারনে ৷
নীলু চোখ বন্ধ করে চিঠিটা বুকেজড়িয়ে নিলো ৷ এই চিঠি ওকে সারাজীবনে বেঁচে থাকতে আশা দেবে ,ভরসা দেবে, চিঠির মাধ্যমে নীলু ওর বাবাকে খুঁজবে ৷

আজ এক সপ্তাহ হল নীলুর বাবা মারা গেছে ,এই এক সপ্তাহের মধ্যে নীলুর মা একবারও নীলুর খোঁজ নেননি ৷ হয়তো নিজের সন্তান হলে একবারও খোঁজ নিতেন ,এভাবে দূরে ঠেলে দিতে পারতেন না ৷ রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও কি মানুষ এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে? শ্রাবনের মায়ের সঙ্গে নীলুর কোন রক্তের সম্পর্ক নেই তবুও তো উনি নীলুকে নিজের মেয়ের মত দেখেন ,নীলু কষ্ট পেলে উনিও কষ্ট পান ৷ একেই বলে ভালোবাসা ৷

নীলুর বাবা মারা যাওয়ার তিন দিনের মধ্যে নিলুর কানে খবর এসেছে যে নীলুর বাবার সমস্ত সম্পত্তি নিলুর মা বিক্রি করে দিয়েছেন ,আর নিলু যাতে কোনো রকম কোনো দাবি করতে না পারে সেই কারণে উনি সকলের সামনে প্রকাশ করেছেন যে নিলু কখনোই ওনার নিজের মেয়ে ছিলেন না ,উনার বড় আপুর মেয়ে ছিল ৷ উনার বড় আপু নীলুর জন্ম দেওয়ার সময় মারা যায় , আফসোস একটাই নীলুর ওর নিজের মা কে দেখার সৌভাগ্যটা হয়ে ওঠেনি ৷

আজ শ্রাবণের কনটেস্ট এর রেজাল্ট ঘোষণার দিন ৷ শ্রাবণ ওখানে গেছে , পুরস্কার হিসেবে থাকছে 25000 টাকা এবং সাথে সেমিফাইনালে যাওয়ার সুযোগ ৷ সেমিফাইনাল থেকে বিজয়ী হলে একটা অ্যালবাম সং গাওয়ার সুযোগ পাবে বিজয়ী ৷সকলের মাঝে একটা আশা আছে শ্রাবণ কে নিয়ে ৷ সকাল থেকে নীলুর মন খারাপ , সব কিছুতেই মনের বিষন্নতায় ছেয়ে গেছে ৷ এদিকে রুদ্রকে নিয়ে থানায় কেস করেছিল সেই কেস কোর্টে উঠেছে ৷ পরশুদিন সেই কেসের জন্য কোর্টে যাওয়া লাগবে ৷ নিলু জানেনা যে এত যুদ্ধের পর ও সঠিক বিচার পাবে কিনা ৷ কিন্তু এটুকু জানে যে ওর হেরে যাওয়া মানে ওর বাবাকে হারিয়ে দেওয়া ৷ নীলুর বাবা মারা গেলেন যেদিন সেদিন এসে রুদ্র সকলের মাঝখানে নীলুকে একপ্রকার শাসিয়ে গেছে যাতে নীলু কেসটা তুলে নেয় ৷ নয়তো ভালো হবে না ৷ কিন্তু নিলু কেস তুলে নেবে না , এই যুদ্ধে যতটা না ও নিজে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে তার থেকেও বেশি ভাবে শ্রাবন আর শ্রাবণের মা এটা নিয়ে বেশি চিন্তিত ৷ নীলুর সঠিক বিচারের জন্য ওনারা সবটুকু দিয়ে লড়ছেন ,ওদেরকে দেখলে নীলুর মাঝে মনোবল আসে ৷ এ যুদ্ধে নিলু নিজেকে নিজেই দমিয়ে নেবে না ,প্রাণপনে লড়ে যাবে, অবশেষে সত্যের জয় হবে ৷

” আমার আলমারির ভিতরে 50000 টাকা ছিল তুমি দেখেছো?”
“কই না তো ,আমি তো তোমার টাকা দেখি নি ৷ তাছাড়া আমার আবার টাকা কিসের জন্য প্রয়োজন হবে ? আমার কোন টাকার দরকার নেই ,তাছাড়া আমার টাকা লাগলে আমি তো তোমার কাছ থেকে চেয়ে নিই নাকি ৷ তাহলে এমন উদ্ভট প্রশ্ন কেন করছো
রুদ্র ?”
টাকাগুলো না পেয়ে খানিকটা রেগে গিয়ে মিঠিকে বলল

” অযথা ফালতু কথা বলোনা মিঠি, আমি জানি তুমি কালকে একটা ডায়মন্ডের এয়ার রিং কিনে এনেছ , সেটা আমার থেকে লুকিয়ে রাখলেও আমি দেখতে পেয়েছি ৷ তারাতারি টাকা টা ভালই ভালই দাও আমাকে এখন উকিলের কাছে যেতে হবে, আর্জেন্ট ৷ মাঝখান থেকে এই নীলু এসে সবকিছুর একেবারে দফারফা করে দিলো ৷ না জানি এখন কতো টাকাই না দিতে হবে ৷”

মিঠি আয়নার সামনে বসে কানের জোড়া পড়তে পড়তে বলল
“ও তার মানে তুমি দেখে ফেলেছে ! আমি তো ভেবেছিলাম এগুলো পরে তোমাকে সারপ্রাইজ দেবো কিন্তু তার আগে তুমি জেনে ফেললে, দেখতো আমাকে কেমন লাগছে ৷”
কথটা বলে রুদ্রর সামনে দাঁড়াতেই রুদ্র রেগে গিয়ে বলল
“তুমি যদি টাকা না নিয়ে থাকো তাহলে কানের জোড়া কেনার টাকা তুমি কোথায় পেয়েছ মিঠি?”

জলকাব্য পর্ব ১২

রুদ্র মিঠির দু’বাহু শক্ত করে চেপে ধরেছিল ,মিঠি রুদ্রকে ছাড়িয়ে দূরে সরে গিয়ে বলল
” এভাবে দোষারোপ করছো কেন ?আমি তো বললাম আমি টাকাটা নিইনি, তাছাড়া অফিসে আমার প্রমোশন হয়েছে, বস স্যালারি বাড়িয়েছে 15000 টাকা ,আর তুমি তো জানো আমি আমার সেভিংস আছি সেখান থেকে জমিয়ে জমিয়ে আমি এটা আনেছি আর তুমি এত সহজে আমার উপর সন্দেহ করলে?”

হঠাৎ করে রুদ্রর মনে পরল কালকে রাত্রে নিলু কেস করেছে সেই রাগে ও বারে গিয়ে মদ খেয়ে এসেছে ,প্রচুর টাকা সেভাবেই খরচ হয়েছে ৷ রুদ্র এবার শান্ত হয়ে মেঠিকে জড়িয়ে ধরে বলল
” আমাকে ভুল বুঝনা আমার মাথা গরম ছিল তাই বলে ফেলেছি প্লিজ রাগ করোনা লক্ষীটি ৷”
মিঠি ঢং করে কাঁদতে কাঁদতে বলল
“তুমি আমার কাছে হয়তো কিছু লুকাচ্ছো ! কি লুকাচ্ছো বল!”

“আরে কিছু না, তুমি খামোখা চিন্তা করছো, আচ্ছা আমি আসি উকিলের কাছে যেতে হবে ৷”
কথাটা বলে রুদ্র বেরিয়ে গেল ,মিঠি চোখের জলটা মুছে আয়নার সামনে হাসিমুখে দাঁড়ালো আর নিজেকে কেমন লাগছে দেখতে লাগলো ৷

জলকাব্য পর্ব ১৪