জলকাব্য পর্ব ১৪ || লেখিকা:সুরাইয়া আয়াত

জলকাব্য পর্ব ১৪
লেখিকা:সুরাইয়া আয়াত

শ্রাবনের মা শ্রাবনকে জড়িয়ে ধরে একপ্রকার কেঁদেই ফেললেন, এত আনন্দ কোথায় ধরে রাখবেন তা উনি জানেননা ৷ উনি একহাতে শ্রাবনকে জড়িয়ে ধরেছেন এবং আরেক হাতে নিজের সোনার কানের দুল ধরে রেখেছেন ,শ্রাবন ওর পুরষ্কারের টাকা দিয়ে দুল জোড়া ফিরিয়ে এনেছে ৷ চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে অনবরত , এটা হলো উনার জীবনের অনেক বড়ো প্রাপ্তি ৷
ওদের একপাশে দাঁড়িয়ে আছে নিলু, ওর চোখের কোনে জল চিকচিক করছে ৷ ওর খুশিতে খুশি হওয়া প্রিয় মানুষগুলোর খুশি দেখে ওর মনটা আনন্দে ভরে উঠেছে , সত্যিই আজ শ্রাবণ পুরস্কার পাওয়াতে নিলু যে কতটা পরিমাণ খুশি হয়েছে সেটা বলে বোঝাতে পারবে না ৷ শ্রাবণের মা শ্রাবনকে ছেড়ে দিয়ে চোখটা মুছে নীলুর দিকে তাকালেন ৷
” কিরে নিলু তুই ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন ! এখানে আয় ৷”

নিলু মুখে হাসি ফুটিয়ে চোখের জলটা খানিকটা গোপনে মোছার চেষ্টা করে ওনাদের কাছে গেল ৷ শ্রাবণ দেখলো নীলুর চোখে জল ৷ শ্রাবনের এই জয়ে নীলুর চোখে জল চলে এসেছে দেখে শ্রাবণের মনে নীলুর জন্য একরাশ প্রশান্তি কাজ করলো ৷ তাহলে নীলুও কি ওর জন্য ভাবে? ওর জন্য আনন্দ পায়? ওর জন্য কষ্ট পায়? শ্রাবণে কথাগুলো নিজের মনে মনে ভাবতে লাগল আর নীলুর প্রতি ভালোবাসাটা আরো বেড়ে গেল ৷ মেয়েটা যেন বুঝেও বুঝতে চাই না এমন ৷
নীলু ওনার কাছে গেল , নীলু যেতেই শ্রাবণের মা মিষ্টির প্যাকেট থেকে মিষ্টি নিয়ে নীলুকে খাইয়ে দিলো ৷ কষ্টে আনন্দে নীলুর মুখ যেন আর চলছেনা, কোনরকমে মিষ্টিটা গিলে নিলো ৷
শ্রাবনের মা নীলুর গালে হাত রেখে বললেন
“তুই অনেক স্ট্রং একটা মেয়ে , এখনো তোর জীবনে অনেক লড়াই বাকি , জানি তুই থেমে থাকবিনা, অনেক বড়ো হ আর জীবনে সফলতা অর্জন কর , শুধু আমাঊরকে পর ভেবে কখনো দূরে সরিয়ে দিস না , তাহলে মধে বড়ো আঘাত পাবো ৷”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আনন্দে নীলু শ্রাবনের মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিলো , এ অনুভুতি প্রকাশ করার মতো বাষা নীলুর নেই ৷ ওর জীবনে হারানোর জন্য আর কিছুই নেই যা হারানোর সব হারিয়ে ফেলেছে নীলু ৷ নিজের সব থেকে প্রিয় মানুষ ওর বাবা আর নিজের পরিচয়টা হারিয়ে ফেলেছে , আজ নীলুর নিজের কি পরিচয় সেটাও ও জানেনা , কে ওর আপন আর কে কেউ পর সেটাও জানেনা ৷ আর এত কিছু সত্ত্বেও শ্রাবণের মা এবং শ্রাবণ নিলুর সাথে যেমন ব্যবহার করে তাতে নিলু কখনো বুঝতেই পারে না যে ওর জীবনে আপন মানুষ বলতে কেউ নেই ৷ পরের ঘরে একটা মেয়েকে একটা মানুষ কিভাবে এত ভালোবাসতে পারে সেটা নিলু শ্রাবনের মাকে না দেখলে বুঝতেই পারতো না ৷ নিলু তার জন্য খুব আনন্দ বোধ করে যে ভবিষ্যতে শ্রাবণের বউ হবে , শ্রাবণের মা তাকে কতইনা ভালবাসবে কিন্তু নিল আজ পর্যন্ত নিজেকে কখনো শ্রাবণের স্ত্রীর জায়গায় কল্পনা করে দেখেনি ৷

নীলুকে কাঁদতে দেখে শ্রাবণের নিজের মনের মাঝে কষ্ট হতে লাগলো, প্রিয় মানুষদের চোখের জল কখনোই সহ্য করতে পারে না কেউ তেমনই তা সহ্য করা শ্রাবণের পক্ষেও সম্ভব নয় ৷ শ্রাবণ নীলুকে হাসানোর জন্য বলল
” তা এখন কি আমার অ্যাসিস্ট্যান্টটা কাজের ভয়ে কি হাত পা গুটিয়ে চুপচাপ বসে থাকবে ভাবছে ? এখন থেকে তো যাত্রা শুরু, এখনো তো একসাথে অনেকটা পথ চলা বাকি ৷ যদি ভাবেন যে এখন আপনি আর আমার সাথে কাজ করবেন না তাহলে কিন্তু আজই আপনার নামে কোর্টে মামলা করবো বলে দিলাম ৷ অভিযোগ জানাবো যে দায়িত্ব বেড়ে যাওয়াই চুক্তি ভঙ্গ করলেন সারিকা নীলাঞ্জনা ৷”
শ্রাবনের কথাটা শুনে নিলু ফিক করে হেসে ফেললো , নীলুর মুখে এই হাসিটাই হয়তো দেখতে চাইছিল শ্রাবণ ৷ ওরা তিনজনই হেসে ফেলল ৷ পুরো ঘর জুড়ে হাসির প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে , ভালোবাসা ছেয়ে যাচ্ছে সমগ্র জায়গা জুড়ে ৷

” তোমার আজকে এতো ফিরতে লেট হলো যে ? কোথায় ছিলে এতোখন আর আমার ফোনটা তুলছিলেনা কেন?” খানিকটা মাতাল কন্ঠে কথাগুলো বলল রুদ্র ৷
” আমার তো অফিসে আজকে বস একটা গেট টুগেদার এর আয়োজন করেছিলেন আমার প্রমোশনের খুশিতে তাই লেট হলো ,সরি জান ৷”
রুদ্র এবার টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালো , মিঠির কাছে গিয়ে ধমকের সুরে বলল
“তাই বলে আমার ফোন তুলবেনা তুমি ? আমি আগে নাকি এই পার্টি আগে কোনটা ?তোমার জন্য আমি নীলুকে ছেড়েছি সেটা কি ভুলে গেছো ?”
রুদ্রের এমন ব্যাবহার আর নীলুর নাম শুনে মিঠি রেগে গেল ৷ রেগে বলল
” নীলু নীলু আর নীলু, এই মেয়েটা আমার সংসার থেকে সরে গিয়েও শান্তিতে থাকতে দেবে না , আর তুমি ড্রিংক করেছো রুদ্র? ”

বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখল সারা বিছানার ওপর মদের বোতলের ছড়াছড়ি ৷ আগে যা ও বা বারে গিয়ে খেতো এখন তা প্রকাশ্যে বড়িতে এনে খাচ্ছে ৷ মিঠি বোতলটা বিছানা থেকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলল
” তুমি জানোনা যে আমি এই ছাইপাশ খাওয়া একদম পছন্দ করি না, আর তোমাকে না বলেছিলাম ওগুলো কখনো খাবে না, আর তুমি তো আগে কখনো এগুলো খেতে না ৷”
রুদ্র বোতল ভাঙার ঝনঝন আওয়াজ শুনে বলল
” বেশ করিছি খেয়েছি , আর কে বলল আমি খাইনা ? এতো দিন বারে লুকিয়ে লুকিয়ে খেতাম আর এখন বড়িতে এনে খাচ্ছি ৷ তোমার কোন সমস্যা ? আর তুমি বোতলটা ভাঙলে কেন? জানো এটার দাম কতো ?”
মিঠি রেগে গেল

” তুমি এখন আমার ওপর টাকার গরম দেখাচ্ছো, টাকা আমারো আছে ? একেই তো এগুলো খেয়েছো তার ওপর আমাকেই দোষারোপ করছো ? এবার বুঝেছি তুমি নীলুকে কেন ছাড়তে চাইছিলে না, কারন ও তো তোমাকে কিছু বলে না তাইনা? মারধোর করলেও তো মুখ বুজে সহ্য করে , কিন্তু আমি তো এসব সহ্য করবো না , আমাকে নীলু ভেবোনা ৷ আর আমি সারাদিন অফিস ছিলাম, অনেক টায়ার্ড , তোমার এইসব নোংরামো গুলো বন্ধ করো আমি ঘুমাবো ৷ আর এগুলো এখান থেকে সরাও ৷”
মিঠি যেতে নিলেই রুদ্র ওর হাত ধরে নিলো ,
মিঠিকে সামনে এনে বলল

” হ্যাঁ নীলুকে ওই জন্যই ছাড়তে চাইছিলাম না কারন ও তোমার মতো অতো স্মার্ট না, আনস্মার্ট, যা বলি তাই বিশ্বাস করে , মেরে শরীরের চামড়া তুলে নিলেও ও মুখ ফুটে কিছু বলেনা , কারন ও জানে যে কিভাবে সবকিছুকে আকড়ে ধরে রাখতে হয় ৷ তুমি তো পুরো একটা আইটেম বম, হট প্যাকেজের বস্তা ৷ উম্মাহ ৷ ” কথাটা বলে মিঠির দিকে এগোতে গেলেই কিছু একটা ভেবে রুদ্র সরে এলো ৷ ভ্রু কুঁচকে বললো
” তুমি এতখন ধরে আমাকে এতো ঞ্জান দিলে তুমি নিজেই তো মদ খেয়েছো ৷ কি খাওনি বলো?”
মিঠি খানিকটা ঘাবড়ে বলল
” নাহ আমি খাইনি ৷ মাতাল হয়ে এসব কি বলছো ৷ যাও গিয়ে ঘুমাও , সকালে তোমারো অফিস আছে আর আমারো ৷ ”
রুদ্র মিঠির মুখটাচেপে ধরে বলল

” আমার চোখকে ফাকি দেওয়া এতোই সোজা ? নিজে গিলে এসে এখন আমাকে ভাষন দাও ৷”
কথাটা বলে মিঠিকে ধাক্কা মারলো ৷ আসলে পার্টিতে বসের জোরাজুরিতে মিঠি খেয়েছে একটু ৷
” যাও এখান থেকে , আমাকে একা থাকতে দাও ৷”
মিঠিও ও রেগে বেরিয়ে গেল রুম থেকে ৷ দিনদিন কেমন জানি সম্পর্কের অবনিতি হচ্ছে ৷ সম্পর্কটা কেবল যৌন চাহিদা আর মোহ মায়ার ছিলো বলেই কি আজ এই অবস্থা ৷ ভস্মীভূত হয়ে যাক সেই সব সংসার যার ভীতটা পরকীয়া দিয়ে গঠিত ৷

” মন খারাপ ?” নীলুর দিকে তাকিয়ে বলল শ্রাবন ৷
নীলুও শ্রাবনের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ালো ৷
শ্রাবন কৌতুহলী হয়ে জানতে চাইলো
“কি হয়েছে?”
নীলু শ্রাবনের দিকে তাকিয়ে বলল
” আচ্ছা শ্রাবন ভাইয়া উনি কি আমাকে সত্তিই ভালোবাসেন না ? আমাকে এতোটাই অপছন্দ করেন যে আমার সাথে সংসার করা যাই না ! আমি কি এতোটাই অযোগ্য !”
শ্রাবনের আর বুঝতে বাকি রইলো না , নীলু ঠিক কার কথা বলতে চাইছে ৷ ও এবার রেগে গিয়ে ওর সামনে থাকা চেয়ারটা লাথি মেরে ফেলে দিলো ,নীলু হঠাৎ এমন হওয়াতে চমকে গেল ৷

জলকাব্য পর্ব ১৩

” খুব বেশি পিরিত ওই রুদ্রর প্রতি তাইনা ? ভালোবাসা উতলে পড়ছে ?যে তোর ভালোবাসা বোঝে না তার প্রতি তোর ভালোবাসা উতলে উতলে পড়ছে বল? পড়বেই না বা কেন ! তার তো অনেক পয়সা , পয়সার অভাব নেই , তোর মায়ের কথায় যেখানে পয়সা আছে সেখানেই সুখ আছে, আমার কি আর ওতো টাকা পয়সা আছে ? না নেই ৷আমি গরিব , আমার কিছ্ছু নেই , আমার মা আছে , আমাকে ভালোবাসার মানুষ আছে ৷ আমি আর পাঁচ জনের মতো মদ খেতে পারিনা, বউ পেটাতে পারিনা, কারোর বাচ্চা নষ্ট করতে পারিনা, কারোর সাথে পরকীয়া করতে পারিনা , আর সেটাই হয়তো তোর চোখে আমার বড়ো দোষ যার জন্য তো আমার ভালোবাসা তোর চোখে পড়লেও না দেখার ভান করিস , বুঝিস না যে আমি তোকে কতোটা ভালোবাসি কতোটা চাই ৷যদি বুঝতিস তাহলে এভাবে আমাকে সবসময় দূরে ঠেলে দিতিস না ৷ যেদিন আসল ভালোবাসাটা বুঝবি সেদিন হয়তো বড্ড দেরি করে ফেলবি নীলু,হাজারো ডাকেও আমাকে খুজে পাবিনা ৷ থাক ভালো তুই তোর রুদ্রকে নিয়ে আমি আর কখনো তোদের মাঝে তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে আসবো না ৷ বড্ড ভুল হয়ে গেছে রে তোকে ভালোবেসে বড্ড ভুল ৷”

কথাটা বলে শ্রবন চোখ মুছতে মুছতে চলে গেল, আজ ওর ধৌর্যর বাঁধ ভেঙে গেছে , নীলুকে কথাগুলো বলার হয়তো বড্ড দরকার ছিলো ৷
শ্রাবন চলে যেতেই নীলু ধপ করে মাটিতে বসে পড়লো ৷ মুখের ভাষা শূন্য , কি বলবে যানে না ৷ তাহলে আজ শ্রাবনও কি ওর প্রতি অভিমান করে মুখ ফিরিয়ে নিলো ?

জলকাব্য পর্ব ১৫