জলকাব্য পর্ব ১৫ || লেখিকা:সুরাইয়া আয়াত

জলকাব্য পর্ব ১৫
লেখিকা:সুরাইয়া আয়াত

নিলু গোছগাছ করে উপর থেকে নিচে নেমে এলো ,আজকে ওর কোর্টে কেসের প্রথম দিন ৷ সকাল থেকে শ্রাবণকে কোথাও দেখতে না পেয়ে নীলুর একটু চিন্তা হলো ৷তাহলে কি কোর্টে ওকে একাই যেতে হবে ? শ্রাবনের মায়ের শরীরটা ভালো নেই তাই চাইলেও উনি যেতে পারবেন না ৷ সেদিনের পর থেকে পুরো একটা দিন পার হয়ে গেল শ্রাবণ এখনো নীলুর সাথে কথা বলনি ৷ নীলুর ও অনুভুতিটা প্রখর ছিলো না , খারাপ লাগছিল ৷ তাই ও আর শ্রাবনকে কিছু বলেনি, যদি ওর কথা বলাতে শ্রাবণ বিরক্ত হয় সেই কারণে ৷হয়তো নীলুও নিজেকে সময় দিতে চাইছে তেমনটাই ৷ আসলে মানুষ সামান্য কিছু হতে না হতে অনেক কিছু ভেবে নেয় যার ফলে দূরত্ব বাড়ে ,আর ঠিক তেমনটাই হয়েছে নিলুর সাথে ৷ হয়তো নীলু শ্রাবনের সাথে একটু কথা বললে শ্রাবণের রাগ-অভিমান সবকিছু ভেঙে যেতো ৷

নিলু নিচে নেমে শ্রাবণের মায়ের সাথে দেখা করলো ৷ উনি রান্নাঘরে রান্না করছিলেন , নীলু পাশে দাঁড়াতেই উনি নীলুর উপস্থিতি বুঝে রান্না করতে করতে বললেন “সাবধানে যাস নীলুমা ৷ আর একদম ঘাবড়াবি না, আর টাকা পয়সা নিয়ে ভাববি না ৷ টাকা শ্রাবণের কাছে আছে আর শ্রাবণ একটু ওর 28 তারিখ যে অন্য একটা বিরাট কম্পিটিশনটা আছে সেটা নিয়ে কথা বলতে গেছে পার্কস্ট্রিট এ ৷ খুব সকালে গিয়েছিল,একেবারে ওখান থেকে কোর্টে যাবে বলেছিলো ৷ তোর সাথে হয়তো ওখানেই দেখা হবে নাহলে কল করে নিস একটা ৷

নিলু এবার একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল ৷ খানিকটা হলেও এখন রিলিফ ফিল হচ্ছে ৷ শ্রাবণ আছে ওর সাথে , নিলু তারমানে একা নয় ৷ এটা ভেবেই নীলুর ভালো লাগছে ৷ নীলু কিছু বলতে যাবে তখনি শ্রাবণের মা তরকারিতে জল ঢেলে বললেন
” হ্যাঁ রে নীলু মা তোর সাথে শ্রাবণের কি কোন কথা কাটাকাটি হয়েছে মানে কালকে থেকে দেখছি তোরা কথা বলছিস না একে অপরের সাথে ৷ অন্য দিন তো শ্রাবণ দিনে দশবার খোঁজ নেয় তোর, কিন্তু কালকে থেকে কেমন যেন একটা লাগছে ৷ তোদের মাঝে কি ঝামেলা হয়েছে কোন কিছু নিয়ে ? না কি তুই টাকা নিয়ে চিন্তায় ওকে কিছু বলেছিস. কোনটা? ”
হঠাৎ করে ওনার মুখ থেকে এমন কথা শোনায় নিলু চমকে উঠলো, খানিকটা কেপেও উঠলো ৷ থতমত করে বলল
“না তো ৷ কিছুই তো হয়নি ৷ভাইয়ার মনটা হয়তো খারাপ সেজন্য কথা বলছেনা ৷ ভাইয়ার সাথে দেখা হলে আমি জিজ্ঞাসা করবো ৷ আচ্ছা আমি এখন আসছি, না হলে লেট হয়ে যাবে ৷”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কথাটা বলে ওনাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিলু সেখান থেকে চলে এলো ৷মিথ্যা বলতে গেলে ওর গলার স্বর কাপে , মিথ্যা বলতে গেলে ও খুব সহজে ধরা খেয়ে যায় তাই বেশি সময় ধরে মিথ্যা কথা বলা নীলুর পক্ষে সম্ভব নয়, তাই যত দ্রুত সম্ভব পরিস্থিতি সামলে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলো ৷
নীলু রাস্তায় এসে ট্যাক্সি নিলো ৷ কোর্ট বেশ অনেকটাই দূর তাই রিকশাতে যাওয়া সম্ভব নয় ৷

” কি হলো তোমাকে না বললাম দুজনে আজকে একসাথে লাঞ্চ করভো কোর্ট থেকে ফেরার সময়,তা তুমি ব্যাগে টিফিন গোচ্ছাছো যে ? আমার কথাগুলো কি তোমার কানে যায় নি?” ঘড়িটা পরতে পরতে খানিকটা রুক্ষ গলায় বলল রুদ্র ৷
রুদ্রের কথার প্রতি উত্তরে মিঠি কিছু বলল না ,ও নিজের ব্যাগ গোছাতে ব্যস্ত ৷ অফিস যাবে ,অফিসের টাইম হয়ে গেছে ৷ এই কদিনে ওদের সম্পর্কের মাঝখানে অনেক পরিবর্তন এসেছে ৷ প্রথম প্রথম রুদ্রর এমন ব্যবহার খারাপ লাগতো, প্রতিক্রিয়াও জানাতে কিন্তু এখন আর রুদ্রর ব্যবহারে খুব একটা পাত্তা দেয় না, নিজে নিজের মত চলে ৷ তাছাড়া অফিসে প্রমোশন পাওয়ার পর থেকে বসের কাছে ওর খাতিরটা এটু বেশি হয়েছে ৷

এখন তো প্রায় একসাথে দুজনে লাঞ্চ করা থেকে শুরু করে বেশি রাত হয়ে গেলে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া শুরু হয়েছে ,যদিও এই সমস্ত কথা রুদ্র কিছুই জানেনা ৷ আগের থেকেও রুদ্র বেশি ড্রিঙ্কস করে, ঠিকঠাক বাড়ি ফেরে না ৷ মিঠিও আর খোঁজ নেয় না ৷ বলতে গেলে দুজন দুজনের জন্য কারো সময় নেই ‌৷ যে যার নিজের জগতে ব্যস্ত ৷ রুদ্র খেয়াল করেছে মিঠির প্রমোশন হওয়ার পর থেকেই মিঠির মধ্যে বেশ দাম্ভিকতা এসেছে ৷ রুদ্রর যদিও এসব নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নেয় , এখন সারাদিন কেস আর নীলুর কথা মাথায় ঘোরে , মদ্যপান করে নেশা ধরে গেলে নীলুর প্রতিচ্ছবি যেন ওর চোখে ভসে , বরবার মনে হয়নীলু সামনে ঘোরাঘুরি করছে, রুদ্রর প্রতিটা পদক্ষেপ , ওর গতি প্রকৃতি লক্ষ করে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে ৷
রুদ্র আবার বলল

” কি হলো আমার কথা কি তুমি শুনতে পাচ্ছ না? নাকি ইচ্ছাকৃত উত্তর দিচ্ছ না কোনটা ?”
মিঠি এখনো কোন উত্তর দিল না দেখে রুদ্র এবার ওর হাত ধরে টেনে ওর মুখটা চেপে ধরল ,চেপে ধরে বলল ” এতো অহংকার কিসের তোর? এটা কি ভুলে যাসযে আমার জন্য তুই এই বাড়িতে জায়গা পেয়েছিস ৷ তুই নিজে চেয়েছিলি যে এই অবৈধ সম্পর্ক পূর্ণতা পাক তাই বিয়ে করেছিলাম না হলে তোর মত মেয়েকে রুদ্র দশবার কেনে আর দশবার বেচে ৷ এটা মনে রাখিস বিয়ে না করে অন্য একটা পর পুরুষের কাছে নিজের দেহ বিলিয়ে দিয়েছিস তুই , তুই তো একটা পতিতাপল্লীর মেয়ের সাথে সমান ৷”

মিঠিকে রুদ্র পতিতা পল্লীর মেয়ের সাথে তুলনা করলো দেখে মিঠি রগে ওর গায়ের সর্বোস্ব শক্তি দিয়ে ধাক্কা মারলো ৷ রেগে চেঁচিয়ে বলল
” তুমি আমাকে পতিতা বল কোন সাহসে? তোমা নিজের চরিত্রের ঠিক আছে যে অন্যকে বিচার করছো ৷ যে স্বামী নিজের ঘরে বউ থাকা সত্ত্বেও অন্য নারীতে আকৃষ্ট হয় তাকে তুমি কি বলবে ? তুমি তো কাপুরুষের সমান ৷নীলু ঠিকিই বলেছিলো ৷ ”
দুজন দুজনের আত্মসম্মানে আঘাত করায় একে অপরের প্রতি মনের ক্ষোভ প্রকাশ হতে লাগলো ৷ রুদ্র রেগে গিয়ে মিঠিকে ধাক্কা মারলো ৷
মিঠি ফ্লোরে পড়ে গেল ৷ রুদ্র মিঠির দিকে একবার দেখে বিশ্রী ভঙ্গিতে গালি দিয়ে বেরিয়ে গেল ৷ মিঠিও ফ্লোর থেকে উঠলো ৷ চোখ দিয়ে জল পড়ছে ৷ খানিকটা হলে কষ্টও লাগছে এখন ৷ তারমানে রুদ্রর ওর প্রতি কোন ভালোবাসা , কোন অনুভূতি নেই , যা ছিলো সব মোহমায়া তাও মিঠির শরীরের প্রতি ৷
মিঠিও এতো সহজে রুদ্রকে ছেড়ে দেবে না , ওকে পতীতা বলার জন্য শাস্তি দেবে ৷ ব্যাগ থেকে ফোন বার করে খানিকটা ন্যাকামি আর কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল
” আমি আজকে অফিসে আসতে পারবো না sir ৷ আমার কিছু পার্সোনাল প্রবলেম আছে সেই কারণে ৷”

” শেয়ার করা যায় , তবুও !”

” আমি তো আজ অফিসে যাব না , কিন্তু আপনি যখন বলছেন তখন আপনাকে আমার সমস্যার কথা বলতেই পারি ৷”

“ওকে ৷ তাহলে দুটোর সময় অফিসের সামনে রেস্টুরেন্ট আছে ওখানে মিট করি ৷”

” আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমার এই অসময়ে আমার পাশে থাকার জন্য ৷”

” ওকে ৷”হাসিমুখে বলল ৷

আজকে নীলুর কেসের প্রথমদিন সমাপ্ত হল, তেমন কিছুই হলো না, নিলু কেবল নিজের অভিযোগগুলো জানালো সবার সামনে ৷ রুদ্র যে দিনের-পর-দিন ওর ওপর শারীরিক এবং মানসিকভাবে অত্যাচার করেছে কেবলমাত্র পরকীয়া সম্পর্কের কারনে, এমনকি ওর বাচ্চাটা নষ্ট হয়েছে কেবলমাত্র রুদ্রর জন্য ৷ তাছাড়া জোরজবরদস্তি করে ডিভোর্স পেপারে সই করিয়ে নেওয়া থেকে শুরু করে ওকে বাড়ি থেকে বার করে দেওয়া সব কথায় নীলু বলেছে ৷ রুদ্র যদিও সবটা অস্বীকার করেছে ৷ প্রথম দিন এটুকুই হলো ৷ যেহেতু রুদ্রর সাথে মিঠির পরকীয়ার সম্পর্ক ছিলো তাই মিঠির উপস্থিতি আবশ্যিক ৷ যেহেতু মিঠি আসে নি তাই কেস ও বেশি এগোয় নি ৷ কোর্ট থেকে বেরোতে না বেরোতেই উকিল সাহেব দেড় হাজার টাকা চেয়ে বসলেন ৷ উনি চাইতেই শ্রাবন ওর ওয়ালেট থেকে সুড়সুড় করে টাকা বার দিলো , এমন মনে হচ্ছে যে টাকা গুলো ব্যায় করতে ওর মায়া দয়া লাগছে না ৷ এদিকে নীলুর ভীষনরকম কষ্ট হচ্ছে এটা দেখে যে ওর কারনে শ্রাবনের পরিশ্রমের এতো এতো টাকা ব্যায় হচ্ছে ৷ টাকা পেতেই উকিল হাসিমুখ করে চলে গেলেন ৷ আবর 4 দিন পর কোর্টে আসতে হবে, হয়তো ডেটের পর ডেট এগিয়ে যাবে আর টাকা ব্যায় হতেই থাকবে তবুও এর সমাধান হবে না ৷ নীলুর চোখের কোনে নোনা জল ভিড় জমিয়েছে ৷ শ্রাবন নীলুর দিকে একবার চেয়ে দেখলো নীলুর চোখে জল ৷ শ্রাবন ওর অভিমানের মেঘ সরিয়ে বলল

” খিদে পেয়েছে ? কিছু খাবি ?”
নীলু শ্রাবনের গলার আওয়াজ পেয়ে চমকে গেল, ও ভাবেনি যে শ্রাবন আর ওর সাথে কখনো কথা বলবে ৷ কোর্টে বিচার চলাকালীন সময়েও শ্রাবন কথা বলেনি ৷ নীলু অজান্তেই হেসে ফেলল ৷ হেসে বলল
” হঠাৎ একথা বলছো যে ৷”
শ্রাবন ওর মাঝে সিরিয়াসনেস বজায় রেখে বলল
” বাচ্চা মেয়েরা খিদে পেলে কাঁদে, তোকে কাঁদতে দেখলাম তাই মনে হলো তোর ও বুঝি খিদে পেয়েছে ৷”
নীলু শ্রাবনের কথা বলার ধরন শুনে বুঝলো যে শ্রাবন তার কথার ভঙ্গিতে নীলু ধমকাচ্ছে যাতে নীলু আর না কাদে ৷ ভাবতেই নীলু ফিক করে হেসে ফেলল ৷
শ্রাবন বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে বলল

জলকাব্য পর্ব ১৪

” হাসছিস কেন ?”
নীলু হাসি থামানোর চেষ্টা করে বলল
” কিছুনা ৷”
শ্রাবন চোখের ইশারায় বললো
” চল ৷”
নীলু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো
” হমম৷”

” আজ তো ও আমার গায়ে হাত তুলেছে , এভাবে দিনের পর দিন চলতে থাকলে তো আমার বেঁচে থাকায় কষ্টকর হয় পড়বে ৷”
মিঠির বস নিখিল আচমকাই মিঠির হাতের ওপর হাত রেখে বলল
” চিন্তা করোনা ডিয়ার আমি আছি তো ৷”
মিঠিও খানিকটা সুযোগ বুঝে ওনার হাতের ওপর হাত রেখে বললো
” thank u so much sir .”
” উহু sir না নিখিল বলো ৷ ওনলি নিখিল ৷”
মিঠি মুচকি হাসলো ৷ উনি বললেন
” বাই দা ওয়ে তোমার সমস্যা না থাকলে তোমার মুড ভালোর জন্য আমরা এটু ঘুরতে যেতে পারি ৷ যাবে ?”
মিঠি হেসে বলল
“হোয়াই নট ৷ ”

জলকাব্য পর্ব ১৬