জলকাব্য পর্ব ৪ || লেখিকা:সুরাইয়া আয়াত

জলকাব্য পর্ব ৪
লেখিকা:সুরাইয়া আয়াত

আয়নার সামনে দুহাতে শক্ত করে জলন্ত মোমবাতি ধরে আছে নীলু, ক্ষনে ক্ষনে গলন্ত মোমবাতি ওর হাতের ওপর এসে পড়ছে তবুও নীলুর পতিক্রিয়া স্বাভাবিক ৷ মনের দগদগে ক্ষতটা যে সবকিছুর উর্ধে ৷
গভীর রাত , এই শহরের সবাই হয়তো গভীর নিদ্রায় নিমজ্জিত আর তার মাঝে নীলু একা হয়তো এই গভীর রাত্রিকে দুঃখবিলাস করছে ৷ মোমবাতির লাল আভা নীলুর মুখে ছেয়ে যাচ্ছে,নীলুর ঠোঁটের এককোনে কালচে রক্তের দাগ, দুইগালে রক্তিম আভা ৷ আচ্ছা স্বামীর ভুল ক্রুটি গুলোকে ধরিয়ে দেওয়াটা কি অন্যায় ? সে পরকীয়া করলে তার বিরুদ্ধে কথা বললে কি প্রতে্্যকটা মেয়েকে এভাবেই বুঝি সবসময় লাঞ্ছনার স্বীকার হতে হয় ? তারা কেন এভাবে মুখ বুজে সহ্য করে? তারা কেন প্রতিবাদ করেনা?তারা দূর্বল বলে ? সমাজে তাদের কে নিরাপত্তা দেবে কে?

আজ আমার গর্ভের সন্তানটার কিছু হলে তার দায়ভার কে গ্রহন করবে ? আমি ? আমি মা বলে , আমার গর্ভে সে ছিলো আর আমার গর্ভ থেকেই সেই ছোট্ট ভ্রূনটা জীবনলাভ করার পূর্বেই মারা গেছে বলে কি সেই দায়ভার টাও কি আমিই গ্রহন করবো ?
মোমবাতির জলন্ত শিখাটা দপদপ করে জ্বলছে, নীলুর অন্তর কাঁপছে, ভাবনা হচ্ছে তার সন্তানের প্রতি ৷ আজ দুই দিন পরপর রুদ্র ওকে ধাক্কা মারায় পড়ে গেছে ৷ ওর সন্তানের যদি কিছু হয়ে যাই তাহলে ওর কি হবে ? রুদ্র তো বলেই দিয়েছে যে বচ্চাটার জন্যই রুদ্র এখনো নীলুকে ওর সাথে রেখেছে ৷ বাচ্চটা না থাকলে নীলুর স্বল্প সময় এই বাড়িতে ৷ নীলু মনে মনে ভাবলো

” এতো সহজে ওনাকে আমি ছাড়বোনা ৷ ভালোবাসা না হয় না পেলাম আমার প্রাপ্প সম্মানটুকু তো আমি পাবো ! বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয়তা সকলের মতো আমার ও আছে, আমিও বাঁচবো ৷ চিরকাল এই মানুষটার পদপৃষ্ট হয়ে আমি থাকবো না ৷”
কথাটা বলে নীলু মোমবাতিটা নিভিয়ে দিলো ৷পুরো ঘরজুড়ে পোঁড়া পোঁড়া গন্ধ, ধোঁয়া ভাসছে বাতাসে , নীলু আজ প্রতিবাদমুখর , থামাতে পারবেনা কেউ, থাকবেনা কারোর মুখাপ্রেক্ষি হয়ে ৷

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

” আম্মু একটা আনারস নেবে ? নীলু আনারস খেতে বড্ড ভালোবাসে ৷ ”
শ্রাবনের মা খানিকটা ধমকের সুরে বললেন
” পাগল হয়েছিস ! প্রেগনেন্সিতে কেউ আনারস খাই ? আনারস খেলে বেবি নষ্ট হয়ে যাই ৷”
শ্রাবন খানিকটা উদাস হয়ে বলল
” ওহহ ! আসলে জানতাম না তো ৷ তাছাড়া তোমার মনে আছে ,আগে বাসায় আনারস আনলে ও ঠিক কোন না কোন ভাবে আনারসের গন্ধ পেয়ে ঠিক ছুটে চলে আসতো ৷ কতো বচ্চামো স্বভাব নীলুর তাইনা !”
উনি হেসে বললেন

“সত্যিই তাই,আজ দেখতে দেখতে মেয়েটা কতো বড়ো হয়ে গেল সে আজ অন্য এক বাসার বউ আবার কারোর মা ৷”
শ্রাবন খানিকটা আনমনা হয়ে বলল
” সময়ের সাথে সাথে আমার নীলুও পরিবর্তন হয়ে যাবে না তো ? কখনো এমন হবে না তো মে নীলু আমাদেরকে দেখেও না দেখার ভান করছে , চিনেও না চেনার ভান করছে ৷ টাকার গন্ধ পেয়ে কতো মুরব্বীও আজ অমানুষে পরিনত হয়েছে সেখানে নীলু তো বাচ্চা মেয়ে ৷”
উনি শ্রাবনের পিঠে চাপড় মেরে বললেন
” এই কি সব যা তা বলছিস তুই ! নীলু আমাদেরকে ভুলে যাবে কোন দুঃখে, ও তো আমাদেরই মেয়ে ৷আর বেশি কথা না বলে ফলগুলো ব্যাগে রাখ, আর তাড়াতাড়ি চল, রোদের বড্ড তেজ ৷”
” হমম চলো ৷”

রিকশা চলছে, সূর্যটা যেন মাথার ওপরেই অবস্থান করছে, রোদে ঘেমে চটচটে অবস্থা ৷ রিকশা চলছে, রাস্তার যাও বা হাওয়া তাও যেন গায়ে লাগছে না ৷
শ্রাবন রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলল
” আম্মু তোমার কি সত্যিই মন হয় যে নীলু ভালো আছে ?”
উনি অবাক হয়ে বললেন
” কেন রে, তোর হঠাৎ এমন মনে হওয়ার কারন ৷”

রোদটা সরাসরি চোখের ওপর পড়তেই শ্রাবন চোখটা খানিকটা কুচকে নিয়ে বলল
” না তেমন কিছু না আসলে কালকে রাত্রে একটা গান গেয়েছিলাম, রেকর্ড ও করেছিলাম, তাই ভাবলাম নীলুকে দিই ৷ ও তো আমার গান শুনতে ভালোবাসে তাই আর কি ৷”
” হমম তো কি হয়েছে ? গান পাঠিয়েছিস ভালো কথা ৷”
” নাহ আসলে ব্যাপারটা হলো , ও গানটা শুনেছে অনেক রাতে তাও 2টো নাগাদ ,কিন্ত কেমন হয়েছে তা তো বলল না, ও তো সবসময় আমার গানের প্রসংশায় পঞ্চমুখ হয় তাই আরকি ৷”
উনিও একটু হেসে বললেন
“আরে তেমন কিছু না, হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিলো তাই আর কিছু বলেনি ৷”
শ্রাবন রাস্তার মানুষজন দেখতে দেখতে বলল
” হমম ৷”
শ্রাবন মনে মনে বলতে লাগলো

” এই শহরের প্রতিটা দেওয়াল আজও তোমার নামেই হাসে, তোমার নামেই কথা বলে ,তোমার নামে ভাবতেও তাদের ভালো লাগে ৷
সৃতিগন্ধা নামের যদি কখনো কোন পুষ্প বিকশিত হতো তবে তাও হয়তো তোমার নামে আখ্যায়িত হতে চাইতো ৷
সৃতিগন্ধা জলের গভীরে তোমার নামে কাব্য রচনা করতো যার নাম হতো ” জলকাব্য ৷” আর যার প্রতিটা অক্ষর জুড়ে থাকতো তোমার বিন্যাস ৷”
ব্যাস্ত মানুষ, ব্যাস্ত লোকজন, ব্যাস্ত নগরীর ভিড়ে কেউ বা আজ সুখের কাঙাল আবার কেউ বা প্রেমসোহাগী ৷

” আমার কিছু টাকা লাগবে ৷”
বেশ গম্ভীর কন্ঠে বলল নীলু ৷
রুদ্র টাই পরছিলো তখন নীলু এসে রুদ্রকে কথাগুলো বলল নীলু ৷
রুদ্র অবাক হয়ে বলল
” টাকা কিসের জন্য লাগবে ? এখন কি আবার দেহব্যাবসা শুরু করলে নাকি? নাকি অন্য কারোর ঘরে যাচ্ছো কোনটা ?”
নীলু এই মূহুর্তে আর কোন কথা বলল না, এখন যদি এইসব অবাঞ্চিত কথার প্রতিবাদ করতে যাই তাহলে ওর যে টাকা টার প্রয়োজন সেই টাকাটাও আর পাবে না উল্টে রুদ্রর কাছ থেকে আরো কয়েকটা নোংরা কথা শুনবে আবার হতেও পারে রুদ্র আবার ওকে ফ্লোরে ছুঁড়ে মারবে তাতে করে ওর বাচ্চটার বাঁচার সম্ভাবনা যাও বা ছিল তাও আর থাকবে না কথাটা ভেবে নীলু থেমে গেল ৷

” আমি ডক্টরের কাছে চেকআপে যাবো, এই কদিনে কতোবার আপনি ধাক্কা মেরেছেন আপনার কোন ধারনা আছে ? সে যাই হোক আপনাকে এসব বলা বৃথা, ডক্টরের ভিজিট লগবে 1700 টাকা ৷ সন্তান নিয়ে কালকে অনেক কিছু শুনিয়েছেন তাই আমার জন্য না হলেও সন্তানের জন্য এটুকু নিশ্চয়ই করবেন ৷”
রুদ্র ঝাঝিয়ে বলল
” কোন টাকা পয়সা হবে না, এক পয়সাও পাবে না তুমি ৷ যাও এখান থেকে ৷”
নীলু রুদ্রর দিকে ঘৃনার চোখে তাকিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো ৷ রুমে গিয়ে বিছানায় হাত পা গুটিয়ে জড়োসড়ো হয়ে হাটুতে মুখ গুজে বসলো ৷সকাল থেকেই মনটায় কু ডাকছে, মনে হচ্ছে খারাপ কিছু ওর জীবনের সাথে ঘটবে বলে ওত পেতে বসে যাচ্ছে ৷ রুদ্রও টাকা দিলোনা এখন কি করবে ও ? রুদ্রর কাছে গিয়ে কি টাকার জন্য ঝগড়া করবে নাকি এভাবেই চুপ করে বসে থাকবে ?”

কিছু মাথায় আসছে না কি করবে , ওর জীবনে যে এতো খারাপ কিছুও হবে এটা আগে জানলে নীলু হয়তো ওর এই জীবনটাই আর রাখতো না, সন্তানকে নিয়ে বাঁচবে এবার থেকে দরকার হলে না হয় এই বাড়ির এ কোনেই পড়ে থাকবে ঝি চাকরের মতো তবুও ওর সন্তানের মাথা গোজার একটা স্থান তো থাকবে ৷
নীলুর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে ৷ নীলু হাতের ওপিঠ দিয়ে চোখের জলটা মুছে নিলো ৷ ওর চোখের জল খুবই সস্তা, মূল্যহীন ৷ কারোর কাছে ওর চোখের জলের গুরুত্ব নেই ৷এভাবে বসে থাকলে তো আর দিন চলবে না , ওর ভালো টা ওর নিজেকেই বুঝে নিতে হবে কথাটা ভেবে নীলু পা বাড়ালো ৷ নীলু ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই দেখলো রুদ্র কাধে ব্যাগ ঝুলিয়ে অন্য রুম থেকে বার হচ্ছে , এখন তো ওদের রুম ও আলাদা ৷

নীলুকে দেখে নীলুর মুখের ওপর কয়েকটা হাজার টাকার নোট ছুড়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল আর বলে গেল
” যদি শুনি বাচ্চাটার কিছু হয়েছে তাহলে তোর ও এই বড়িতে দিন শেষ ৷ ”
কথাটা বলে রুদ্র বেরিয়ে গেল ৷ রুদ্র চলে যেতেই নীলু টাকা গুলো মেঝে থেকে কুড়িয়ে নিলো ৷ এভাবেই যতো দিন যাই আরকি ৷

জলকাব্য পর্ব ৩

আয়নার সামনে দাড়িয়ে বারবার নিজেকে দেখছে নীলু, আজকে নিজেকে এটু অন্যরকম লাগছে ৷ চোখজোড়া বারবারই আটকে যাচ্ছে ঠোঁটের কোনের সেই কালো রক্ত জমাটপূর্ন ক্ষতর ওপরে ৷ একটা ক্ষতই চেহারাটার কতো পরিবর্তন ঘটিয়েছে কেবল একটা দিনেই, চোখগুলো ফোলাফোলা , গোলগাল মুখটা অত্যাধিক ফোলা ফোলা লাগছে ৷ বিতৃষ্ণা আসছে নিজের প্রতি ৷

মাথায় ওড়নাটা ভালোভাবে জড়িয়ে নিয়ে হাতে পার্সটা নিয়ে নিজেকে অনেকটা ঢেউ ঢুকেই রুম থেকে বার হলো নীলু ৷ দরজাটা খুলতেই একপ্রকার চমকে গেল ৷ শ্রাবনের মা দাড়িয়ে আছেন বাইরে, মুখে একগাল হাসি যা দেখলেই সব ক্লান্তি দূর হয়ে যাই,যা একপ্রকার তৃপ্তি আনে ৷ নীলু খানিকটা চমকে গেল ওনাকে দেখে , ওনাকে হয়তো এইসময় এখানে আশা করেনি নীলু ৷নীলুর মুখটা বেশ থমথমে ৷
উনি নীলুকে এমন থমথমে দেখে ময়াবী কন্ঠে বললেন
” কেমন আছিস নীলু মা ?”

জলকাব্য পর্ব ৫