জলকাব্য পর্ব ৫ || লেখিকা:সুরাইয়া আয়াত

জলকাব্য পর্ব ৫
লেখিকা:সুরাইয়া আয়াত

শ্রাবনের মা কে দেখে নীলু থতমত মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলো ৷ অবাক হওয়ার ই কথা , বহুদিন হয়ে গেল ওর খোঁজে কেউ আসে না, কেউ হয়তো প্রয়োজন বোধ ও করে না সারিকা নীলাজ্ঞনা নামক মেয়েটার সাথে একবার দেখা করে আসি, সে আদেও ভালো আছে কি তার একবার খোঁজ নিয়ে আসি ৷
নীলুকে চুপচাপ থাকতে দেখে শ্রাবনের মা মায়াবী কন্ঠে বলে উঠলেন
” কি করে নীলু মা কেমন আছিস ৷”

বহুদিন পর সামনাসামনি চেনাপরিচিত কারোর কন্ঠে ওর নিজের নাম শুনে যেন নীলুর কলিজা কেঁপে উঠলো ৷ নীলু চমকে গেল, ওর হাত পা কাপছে , তবুও ওই আবেগকে কোনভাবেই আটকে রাখা সম্ভব নয় ৷ নীলু অনেকটা কাঁপতে কাঁপতে ওনাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে কাঁপতে লাগলো যেন এক্ষুনি ওনাকে ছেড়ে দিলে উনি হাওয়ায় মিলিয়ে যাবেন, প্রিয়মানুষদের যে হারাতে মানা !
নীলু যে ওনাকে আচমকায় জড়িয়ে ধরে থরথর করে কাঁপতে তা উনি বুঝতে পারছেন ৷ উনি নীলুর মাথার হাত বুলিয়ে বললেন

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

” শান্ত হ নীলু তুই বড্ড কাঁপছিস ৷ তোর হয়তো শরীর ঠিক নেই, প্রেশার লো মনে হচ্ছে বড্ড ৷”
নীলু এখনো ওনাকে জড়িয়ে ধরে আছে ৷ নীলু এবার চোখটা বন্ধ করে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সফলতা পেয়ে ওনাকে ছেড়ে খানিকটা দূরত্ব বজায় নিয়ে দাঁড়ালো ৷
নীলুর কাঁপাকাঁপি কিছুটা হলেও বন্ধ হয়েছে ৷
” তুমি এই সময়ে আসবে আমাকে জানাওনি তো ৷ হঠাৎ তোমাকে এসময়ে দেখে তো আমি চমকে গেছি ৷”
উনি একগাল হেসে হাতের ব্যাগগুলো মেঝেতে রেখে বললেন
” ভাবলাম তোকে আজ চমকে দেবো ৷ কেমন দিলাম সারপ্রাইজ ?”
নীলুও খানিকটা হাসার চেষ্টা করে বলল

” সত্যিই আমি অবাক হয়ে গেছি গো, কেমন কাঁপছিলাম দেখলেই তো ৷ যাই হোক এই রোদ গরমে এতদূর কষ্ট করে এলে তোমার অনেক ধকল গেছে ৷ ঐগুলো রাখো আর ভিতরে এসে বসো ৷”

উনি ব্যাগগুলোকে টেবিলের ওপর রেখে সোফাতে বসলেন, বাইরের গরমে শরীরে যে বিন্দুবিন্দু ঘাম ছিলো তা এসির হাওয়াতে শরীরের সাথে মিশে গেছে ৷ নীলুকে উনি এখন আর দেখছেন না , মেয়েটা ওনাকে সোফাতে বাসিয়ে কোথায় চলে গেল, হয়তো কিচেনে গেছে কিছু বানাতে ৷ শ্রাবনের মা চারিপাশে চোখ বুলিয়ে দেখছেন বেশ গোছালো ডাইনিং রুমটা ৷ কলকাতা শহরের এমন একটা জায়গায় একটা ফ্ল্যাট 55 কিংবা 60 লাখের নীচে তো পাওয়াই যাবে না, সেক্ষেত্রে নীলুর স্বামী যে একজন বিত্তবান মানুষ তার পরিচয় মেলে ৷ সেক্ষেত্রে শ্রাবনরা তেমন উচ্চবিত্ত নয় ৷ শ্রাবনের বাবা একটা ছোট্ট কম্পানিতে জব করতেন, রিটায়ার্ড হওয়ার আগেই তিনি মারা যান , তাছাড়া শ্রাবণের মা তিনি হাইস্কুলের বাংলার শিক্ষিকা ছিলেন, শ্রাবন ছোটবেলা থেকে বড্ড গান পাগল, গান গাইতে ভালোবাসে ৷ গানটাকে প্যাশান থেকে আজ প্রফেশন করবে ভেবেছে যদিও তাতে ওনার কোন আপত্তি নেই কারন কোন কাজই ছোট বড়ো হয় না ৷ওনার কথাগুলো ভাবতে ভাবতে নীলুও একটা প্লেটে মিষ্টি আর ঠান্ডা লস্সি নিয়ে হাজির ৷

নীলু প্লেটটা ওনার সামনে রাখতেই উনি নীলুর হাত ধরে ওনার পাশে বসিয়ে বললেন
” আমাকে এখানে বসিয়ে তুই অমনি উধাও হয়ে গেলি !আমি তো তোর সাথেই দেখা করতে এসেছি নাকি ৷ ”
নীলু একটু হেসে মাথা নীচু করে নিলো ৷
” হ্যাঁ রে নীলু মা তুই ভালো আছিস তো ?আর তোর শরীরের এমন অবস্হা হলো কি করে ? কেমন যেন হয়ে গেছিস তুই ৷

ওনার কথা কাটাতে নীলু লস্সির গ্লাসটা ওনার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন
” এই নাও , এটা খেয়ে নাও ৷ তুমি অনেকটা জার্নি করে এসেছ ‌৷”
উনি খানিকটা ধমকের সুরে বললেন
” ধূর বোকা মেয়ে , কি আর জার্নি করলাম , এই তো বেহালা থেকে মহেশতলা এটা আর কতোটা দূর, রিকশাতে আসলাম 30 মিনিট লাগলো ৷ শুধু বাইরে একটু গরম যা তাছাড়া আর কিছু না ৷”
“হমম ৷”

কথাটা বলে নীলু আবার মাথা নীচু করে নিলো ৷
কথায় কথায় উনার চোখ গেল নীলুর বাম দিকের ঠোঁটের দিকে ৷ সেখানে কেমন যেন রক্তের জমাট বাধা ৷ উনি নীলুর মুখটা তুলে কাঁটা জায়গাটা ইশারা করে বললেন
” কি হয়েছে এখানে নীলু মা ? আর এভাবে কেটে গেলই বা কেন? ইশশ কি হয়ে গেছে, গোলগাল মুখটার পুরো নিমেষেই পাল্টে দিয়েছে ৷ কি করে হলো এটা ?”

নীলু এটারই ভয় করছিলো তাই বারবার মাথা নীচু করে রাখছিলো কিন্তু তাতেও যেন শেষ রক্ষা হলো না উনি ঠিক কোনভাবেই টের পেয়ে গেলেন ‌৷নীলু কাটা টার ওপর হাত রেখে বলল
” ওহহ এটা , আর বলোনা ছোট মা কালকে রাত্রে ওয়াশরুমে যেতে গিয়ে স্লিপ কেটে পড়ে গেছি ৷ তোমার জামাই তো কতো বকাবকি করলো , এই শেই কতো কিছু বললো
” নীলু তুমি খুব কেয়ারলেস হয়ে গেছ ! দেখে চলতে পারো না ! এই সেই আরো কতো কিছু ‌ ৷ আমার কিছু হলে ওনার যে কি হবে ৷”

কথাগুলো বলতে বলতে নীলুর গলার স্বরটা আটকে আটকে আসছিলো ৷ মিথ্যা জিনিসকে সত্যি প্রমান করতে গেলে এভাবেই হয়তো প্রকাশ পাই যে সে মিথ্যা বলছে , তেমনি নীলুও চেষ্টা করেছে যথাসাধ্য কিন্ত কতোটা সফল হয়েছে বলতে পারে না ৷”
শ্রাবনের মা উত্তেজিত হয়ে বললেন
” বলিস কি , এই অবস্হায় পড়ে গেছিস মানে তো সাংঘাতিক কান্ড আর তাছাড়া তোর ছোট বাচ্চাটার কিছু হয়ে গেলে ৷”
” হমম সেই ভয়টাই পাচ্ছি ৷ তাই তোমার জামাই সকালে এতগুলো টাকা দিয়ে গেল আর বলে গেল যে চেকআপ করিয়ে আসতে ৷ বাচ্চাটার যেন কিছু না হয় ৷”
উনি একটু ভাবুক সুরে বললেন

” তোর এই অবস্হায় সে নিজেই তো তোকে নিয়ে গেলে পারতো , তোকে একা ছাড়াটা তার একেবারেই ঠিক হয়নি ৷”
নীলুও পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য বললো
” আরে তার তো অফিস আছে না, এই একমাস হলো তার প্রমোশন হয়েছে আর এখনই কাজে এতো ঢিলেমি দিলে চলে বলো ৷ তাই আমিই বললাম আমি একা চলে যাবো ৷ রেডি হয়ে বার হচ্ছিলাম আর তুমি তখন এলে ৷ যাক ভালোই হলো তোমার সাথে কথা বলে ভালো লাগছে ৷”
” আমার জন্য তোর অনেক দেরি হয়ে গেল ৷ চল আমিও তোর সাথে যাচ্ছি যতখন না কোন ভালো খবর পাই ততখন আমার শান্তি হচ্ছে না ৷”

নীলু শুকনো ঢোক গিলে বলল
” নাহ তার দরকার নেই, তোমার শরীর এমনিতেই খারাপ তার ওপর এই রোদ গরমে তুমি গেলে আরো অসুস্থ হয়ে যাবে ৷”
উনি নীলুকে ধমক দিয়ে বললেন
” একদম চুপ, আমি যাবো বলেছিতো যাবো কোন কথা না ৷ শ্রাবনকেও বলে দিই যে আমার ফিরতে দেরি হবে ৷”
ওনার কথার শেষ হতে না হতেই উনি শ্রাবনকে কল করলেন
” শ্রাবন বলছি বাবা শোন না আমার বাসায় ফিরতে একটু লেট হবে ৷ নীলুকে নিয়ে একটু ডক্টরের কাছে যাবো ৷”
শ্রাবন দেওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে ছিলো কিন্তু ওর মায়ের কথাটা শোনার পরই নড়েচড়ে উঠলো আর উত্তেজিত হয়ে বলল

” কি হয়েছে মা নীলুর , আর ডক্টরের কাছেই বা নিয়ে যেতে হবে কেন? সিরিয়াস কিছু ?”
উনি চিন্তিত গলায় বললেন
” হমম সিরিয়াস ই, নীলু কালকে রাত্রে ওয়াশরুমে পড়ে গেছে তাই ডক্টরের কাছে নিয়ে যাচ্ছি ওর বেবি কেমন আছে তা জানার জন্য ‌৷”
” তুমি বাসায় ফিরে যাও আমি যাচ্ছি ওর সাথে ৷”
” তুই যাবি মানে ,তুই তো একটা অডিশনে যাবি বললি তাহলে কি যাসনি ‌৷”
” নাহ আমি যাইনি, নীলুর বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছি ৷ তুমি জলদি ওকে নিয়ে নীচে নামো আমি ততখনে একটা ট্যাক্সি দেখছি ৷”

” আচ্ছা দেখ ‌ ৷ কিন্তু তুই অডিশনটা মিস করলি !”
শ্রাবন মুচকি হেসে বলল
” জীবনে অনেক সুযোগ আসবে মা কিন্তু তুমি আর আমার নীলু একটাই তাদের কোন অদ্বিতীয় নেই ‌৷ যাই হোক তোমরা নেমে এসো ৷”
উনিও ফোনটা কাটলেন তবে ওনার মনটা খারাপ হয়ে গেল ৷ শ্রাবন এই পোগ্রামটার জন্য কতো প্র্যাকটিস করেছে , কালকে সারারাত গান গেয়েছে কিন্ত আজকে ছেলেটা যে আজ কি ভেবে অডিশনটা মিস করলো তা উনি জানেন না ৷
উনি ফোন কাটতেই নীলু কৌতুহলের সাথে বলল
” শ্রাবন ভাইয়া কি নীচে দাঁড়িয়ে আছেন ?”

” হমম রে , আজ ওর অডিশন ছিলো ৷ প্রতিবছর কলকাতায় যে সবচেয়ে বড়ো মিউসিক টুর্নামেন্ট টা হয় সেটারই অডিশন ছিলো আজ, তবে ও যাইনি ৷ ”
নীলুর মনটাও খারাপ হয়ে গেল খানিকটা ৷ কালকে রাতে শ্রাবন একটা গান পাঠিয়েছিলো যেটা নীলুর সেই মন খারপের সময়ে এক চিলতে হাসি ফুটিয়েছে আর আজ শ্রাবন অডিশনটাই মিস করেছে ৷”
” অডিশন মিস করা নিয়ে শ্রাবনের সামনে মন খারাপ করবি না তাহলে ও কিন্ত তোকে বকবে ৷”
নীলু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো ৷

কাজের অবসরে ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে রুদ্র, ওর আর মিঠির একের পর এক ঘনিষ্ট ছবিগুলো খুব ভালোভাবে দেখছে ৷ তখনই ফোনে কল এলো ৷ স্ক্সিনের দিকে তাকিয়ে দেখলো নীলুর নাম্বার , নীলুর নাম দেখতেই কেটে দিলো, এভাবে পরপর 5 বার নীলু কল করেছে, তারপর হঠাৎই নীলু কল কাটতেই তৎক্ষনাত কল ঢুকলো মিঠির নাম্বার থেকে ৷ চটজলতি ফোনটা ধরে বললো
” তোমার কলেরই অপেক্ষা করছিলাম ‌ ৷ কি করছো ?”
” তোমার জন্য রান্না করছি, রাত্রে একসাথে ডিনারের কথা ভাবলাম, তারসাথে আমাদের দুজনের একসাথে আরেক রাত কাটানোর কথাও ভাবলাম ৷”
রুদ্র হেসে বলল
” মনের কথাগুলো এভাবে বুঝে যাও কেন বলতো ?আমি যাবো, তুমি যখন ডেকেছো তখন কীভাবে ফেরাই বলো ৷ আই কান্ট ৷”
” উম্মাহ, ওকে তাড়াতাড়ি এসো কিন্তু , আমি অপেক্ষায় থাকবো ৷”
রুদ্র কলটা কেটে ফোনটা সাইলেন্ট করে দিলো যাতে দ্বিতীয়বার নীলু কল করলেও ও বুঝতে না পারে ৷

জলকাব্য পর্ব ৪

” আচ্ছা আমি ডক্টরের কাছে যাচ্ছি, ট্র্যক্সিতে আছি , আপনার কথা কিছু শোনা যাচ্ছে না, কেটে কেটে আসছে কথাগুলো
….
” ওহহ,এই কথা, কোন চিন্তা করবেন না , সাবধানেই যাবো, আপনিও সাবধানেই থাকবেন ৷”
কথাটা বলে নীলু মিথ্যা কলের অভিনয়টা শেষ করলো ৷
শ্রাবন বাইরের দিকে তাকিয়ে বলল
” কি বললো উনি ?”
” উনি বললেন যেন সাবধানে যাই আর প্রতি মিনিটে ওনাকে কল করে আপডেট দিই ৷”
শ্রাবন কিছুক্ষন চুপচাপ থেকে বড্ড ভাবলেশহীন হয়ে বলল
” মানুষ কল্পনাতেই বেশি সুখী তাইনা নীলু ?”
নীলুও খানিকটা আবেগী কন্ঠে বলল

” হমম যেখানে কল্পনা হয় আবেগ আর ভালোবাসা মিশ্রিত সেখানে কোন কষ্টই আর কষ্ট মনে হয় না ৷ তাই বলায় বাহুল্য যে মানুষ কল্পনাতেই বেশি সুখী ৷”
শ্রাবন বাইরের দিকে তাকালো , ট্র্যাফিক জ্যামের মতো জীবনের দুঃখ গুলোও যদি একের পর এক মুক্তি পেত না কতোই না ভালো হতো, তাহলে মৃত্যু ঘটতো না শতঝত মানুষের অনুভূতির ‌, অমর হয়ে থাকতো ভালোবাসা ৷

জলকাব্য পর্ব ৬