জ্বালাতে রং মশাল পর্ব ১২

জ্বালাতে রং মশাল পর্ব ১২
ইফা আমহৃদ

আযানের ধ্বনি শ্রবণ হতেই ঘুম হালকা হয়ে এলো। নিভু নিভু চোখে অবলোকন করতে সর্বপ্রথম অপূর্ব ভাইয়ের বলিষ্ঠ শরীর নজরে এলো। পিঠ দেখিয়ে শুয়ে আছেন। বিষাদের ছোঁয়া লাগল। কখন এলেন তিনি? নিশ্চয় মাঝরাতে। সেন্টার টেবিলের উপর ঢেকে রাখা খাবার এখনও ঢাকা। খায়নি তিনি।

ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালাম আমি। শাড়ির কুঁচিগুলো খুলে নিচে পড়েছে। এলোমেলো হয়ে আছে। মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। অগোছালো কুঁচিগুলো গিট দিলাম শক্ত করে। কোনোরকম গুঁজে নিলাম কোমরে। আমার কাছে জামা নেই যে পাল্টে নিবো। বারান্দা থেকে উঁকি দিলে আমার বারান্দায় এক সুট পাওয়া যাবে। কিন্তু এতে অপূর্ব ভাই রেগে যাবেন।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এদিকে শাড়ির পড়তে পারি না, কুঁচি করা তো দূরের কাজ। শাড়ির নিচের অংশ ধরে ধরে ওয়াশরুমে ঢুকলাম। অজু করে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলাম। শাড়ির নিম্নাংশ ভিজে জবুথবু হয়ে গেছে। অনেকক্ষণের প্রচেষ্টায় কাবার্ড হাতরে একটা জায়নামাজ পাওয়া গেল। বিছিয়ে নামাজ আদায় করলাম।

ভাঁজ করে পূর্বের স্থানে রেখে দিলাম। শুয়ে পড়লাম বিছানায়। আলো ফুটেছে। সকাল হতে ঢের বাকি। এপাশ-ওপাশ করেও ঘুমের ছিটেফোঁটা এলো না। উপায়হীন হয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। সূর্য্যি মামা গাছ-গাছালির ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়েছে। আকাশে রক্তিম আভা ছড়িয়েছে। সকালের হাওয়া বইছে। কিছুক্ষণের মাঝে বারান্দায় বসে পড়ল। সকালের নরম রোদ। এক কথায় ‘ভিটামিন ডি’ সমৃদ্ধ রোদ।

একা-একা ভালো লাগছে না। হাতের কাছে ফোনটা থাকলে সময় পাড় করা যেত। অপূর্ব ভাইয়ের ফোন দিয়ে সময় পার করা যেতেই পারে।

বালিশের তলায় ফোন রাখা। অর্ধেক দেখা যাচ্ছে। আমি ধীরে ধীরে বালিশের তলায় হাত দিলাম। অবশেষে হাতের মুঠোয় পেলাম। খুশিতে ছুটে যাওয়ার প্রয়াস করতেই অঘটন ঘটল। ভেজা শাড়ি আরও ঝুঁকে গেছে, শাড়িতে পা বেঁধে ধপাস করে পড়লাম। হাত থেকে ফোনটা ছিটকে দূরে পড়ল। কোমরে হাত দিয়ে বসে রইলাম। অপূর্ব ভাই ধরফরিয়ে উঠে বসলেন। ঘুম ঘুম কণ্ঠে বললেন, “ক-কি হয়েছে?”

আমি যতটুকু মাথা বের করে রেখেছিলাম, এবার পুরো মাথা নিচু করে ফেললাম।সোজা হয়ে শুয়ে পড়লাম। মাটিতে শুয়ে ঠেলে ঠেলে বিছানার নিচে ঢুকতে চাই।পুরো শরীর ঢুকে গেলেও, শাড়ির অগোছালো আঁচল ঢুকল না। বাইরে ছড়িয়ে রইল। অপূর্ব ভাইয়ের চোখ এড়িয়ে গেল না। ধমকে বললেন, “আরু নিচ থেকে বের হ বলছি। আমি নামলে খবর আছে।”

যেভাবে কোমর দুলাতে দুলাতে ভেতরে গিয়েছি তেমনি দুলাতে দুলাতে বের হলাম।রোদ ছাড়া বত্রিশ পাটি দাঁত মেলে দিলাম। সন্দিহান গলায় বললেন, “ঘুমটা সহ্য হচ্ছিল না, দিলি তো ভেঙে। ওখানে কী করছিলি?”

“পড়ে গেছিলাম।”
কঠিন গলায় বলেন, “মহিষের মত দৌড়ালে পড়েই যাবি, এখন তুই একা না মনে রাখিস, বিরক্ত লাগে‌।”
আমতা-আমতা করে বললাম, “শাড়িতে পা লেগে পড়েছি।”
“তাহলে ঐ বস্তাটা পড়ে আছিস কেন? পাল্টে নে।”

বস্তা শুনে নিজের দিকে তাকালাম। “এটা বস্তা না শাড়ি। বিয়ের শাড়ি একটু ভারী হয়। আপনি জানেন না, অপূর্ব ভাই?” এমন কিছু বলতে ইচ্ছে করল কিন্তু বলার সাহস নেই। সরল ভাষায় বললাম,
“আমার জামা কাপড় নেই। আনা হয়নি। ঐবাড়ির কিছু পড়লে আপনি তো বকবেন।”
“কাবার্ড থেকে আমার জামা কাপড় নিয়ে পড়।”

“আপনার জামা কাপড়, কিন্তু কীভাবে? আপনার জামা কাপড় কীভাবে পড়ব?”
“যেভাবে আমার বিছানায় ঘুমাচ্ছিস, যেভাবে আমার ঘরে থাকছিস এবং আমারটাই খাবি। তেমনি আমার জামা কাপড় পড়বি।

আর শোন, শাড়িটা লুকিয়ে রাখবি। আমার চোখের সামনে পড়লে, একদম ছিঁড়ে ফেলব।”
আমি মাথা নেড়ে সম্মতি দিলাম। অপূর্ব ভাই আবার শুয়ে পড়লেন। কাবার্ড থেকে একটা টি শার্ট আর ট্রাউজার বের করলাম। পুনরায় ওয়াশরুমে গিয়ে চেঞ্জ করে নিলাম। বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লাম। একদম হালকা লাগছে। অপূর্ব ভাই ঠিকই বলেছেন, বস্তা। আমার মতে, বস্তার চেয়েও ভারী। এতক্ষণ এগুলো পড়ে কীভাবে ছিলাম?

অপূর্ব ভাই শুয়ে থেকেই রাগি গলায় বললেন, “ইচ্ছে করছে, রাস্তায় নিয়ে ফেলে দিতে। আমার ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দিল। অসহ্যকর।”
ভয়ে ভয়ে থাকলাম। শাড়িকে অজস্র গা’লা-গা’ল দিলাম। পেটের ভেতরে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে। তিনি পুনরায় বললেন, “এত সকালে উঠেছিল কেন?”

মৃদু শব্দে বললাম, “ক্ষুধা লেগেছে।”
“কালকে রাতেই তো খেলি। সকাল হওয়ার আগেই ক্ষুধা লাগল। বিয়ে করে এনেছি বলে, এখন সারাদিন খাওয়াতে হবে?”
“আগে আমি একা ছিলাম, এখন দু’জন। একটু বেশি ক্ষুধা লাগবেই তো।”

অপূর্ব ভাই কম্বল থেকে বের হলেন। রাতে বাড়িতে এসে জামা কাপড় পাল্টেছেন। জিন্সের পকেটে থেকে ওয়ালেট নিজের পকেটে নিয়ে বললেন, “বেবীর হওয়ার আগ পর্যন্ত তোকে সহ্য করব। তারপরে বহুদূরে চলে যাবো। শান্তিতে থাকব।”
আমি চুপচাপ শুনে গেলাম। তার কাছেও বোঝা হয়ে আছি। তিনি আবার বললেন, “বেবীর সময় কতমাস?”

“জানি না।” সংক্ষিপ্ত জবাব।
“আল্ট্রাস্নোগ্ৰাফি করিস নি?”
“না‌। কেউ ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়নি।”

নিজ থেকেই বললেন, “এখনই যখন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে‌। কম হলেও দুই এক মাস হবে। বাকি রইল আট মাস। বেবী হয় দশমাস দশ দিনে। হতে সবসময় দশমাস দশদিন লাগে না। আট-নয় মাসেও চলে আসে। মোটামুটি সাত মাস ধরলাম। তারপরে মুক্ত।”

বলেই চলে গেলেন। জানালার গ্ৰিল ধরে উঁকি দিলাম। অপূর্ব ভাই স্লিপার পড়ে চলে যাচ্ছেন। আমি এখনও বুঝতে পারছি, ‘এই বাচ্চার বাবা কে?’
আমি না-হয় এইসব খেয়ে হুঁশে ছিলাম না। কিন্তু অপূর্ব ভাই ছিলেন। নিজের প্রতি এমন বিশ্বাস না থাকলে কেউ এমনভাবে বলেনা।

কাগজের ঠোঙা নিয়ে এলেন। আগের ভঙ্গিতে গ্ৰিলে মাথা রেখে বসে আছি। তিনি প্যাকেট রেখে আমাকে খেতে বললেন। চাইলে কি খাওয়া হয়? দরজা খোলা ছিল। মামুনি ঘরে এলেন। ভয়ে শিটিয়ে গেলাম। অপূর্ব ভাই ফোন ঘাটতে ঘাটতে বললেন, “কালকে রাতে দেওয়া শর্তের কথা ভুলে গেছ? কেন এসেছ এখানে?”

মামুনি দারুন গলায় বললেন, “তোমরা কাল নতুন এলে, দেখতে এলাম কিছু লাগবে কি-না? বাড়িওয়ালা হিসেবে তোমার খোঁজ-খবর নেওয়া আমাদের দায়িত্বের ভেতরে পড়ে।”
‘তুমি’ সম্বোধন। আগে তুই বলে সম্বোধন করতেন। অপূর্ব ভাই তেমন সুরে বললেন, “ধন্যবাদ, আমাদের কিছু লাগবে না। আমরা ভালো আছি।”

মামুনি ঘরে ঢুকলেন। কাগজে মোড়ানো প্যাকেট খুলে দেখে বললেন, “তোমরা নতুন বিয়ে করেছ, তার উপরে চাকরি বাকরি করোনা। আমার কাছ থেকে টাকা ধার নিতে পারো। টাকা হলে দিয়ে দিবে।”
অপূর্ব ভাই কঠিন গলায় বললেন, “টাকার প্রয়োজন, কিন্তু আপনার টাকা লাগবে না। অন্য কারো থেকে ধার নিবো।”
মামুনি বললেন, “এখানে নতুন তুমি। কে ধার দিবে। আমার কাছ থেকে নাও।”

অপূর্ব ভাই ভেবে ছিলেন কিছু সময়। মামুনির কথা ভুল নয়। উপায়হীন হয়ে রাজি হলেন মামুনির থেকে টাকা নেই। খুব তাড়াতাড়ি ধার মিটিয়ে দিবেন। হাজার পাঁচ ধার নিলেন। এই টাকা দিয়ে চলতে হবে চাকরি পাওয়া এবং স্যালারি পাওয়ার আগ পর্যন্ত।

শাওয়ার নিতে ওয়াশরুমে এসেছি। নিচে বসে ভাবছি ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো। পানির প্রবাহিত ধারা ভিজিয়ে দিচ্ছে। তার ধর্ম গড়িয়ে চলা। সে গড়িয়ে চলছে। চাকরি খুঁজবেন? এখন ঘুমাচ্ছেন। জেগে থাকলে ফোনটা নিয়ে পড়ে থাকে, কোনো কথা বলেনা। তিনি বাড়িতে থাকাও যা, না থাকাও তাই। চ্যাঁচিয়ে বললেন, “কে, ভেতরে কে?”

আমি দরজার দিকে তাকালাম। ঘুমের কারণে আমার কথা বিস্মৃতি হয়েছেন। আমি দ্রুতি কণ্ঠে বললাম, “ভেতরে আমি।”
“আমিটা কে?”
“আরশি।”

“আমি ভুলেই গিয়েছিলাম তোর কথা। আমার একটা কাজ আছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। তুই এখুনি বের হবি।”
আমি দ্রুত ভেজা জামা কাপড় পাল্টাতে পাল্টাতে বললাম, “মাত্র পাঁচ মিনিট‌ দিন। বের হচ্ছি।”
“তোর জন্য আমি এখন দাঁড়িয়ে থাকব?”
“প্লীজ..

অনুরোধের স্বরে বললাম। তিনি বিরক্তি প্রকাশ করলেন। দরজা জোরে আঘাত করে সরে গেলেন।
জামা কাপড় পাল্টে দ্রুত বেরিয়ে গেলাম। অপূর্ব ভাই কোথায় যাচ্ছেন। আমি ভীত গলায় বললেন, “যাবেন না?”
মুজো পায়ে পড়তে পড়তে বললেন, “না, সারাদিন গিয়ে বসে থাক। বাড়িতে আসার পর তোকে যাতে ওয়াশরুমে যেতে না দেখি।”

পরক্ষণেই বললাম, “কোথায় যাবেন?”
“একটা চাকরি পেয়েছি। ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হবে। আসার সময় খাবার নিয়ে আসব। কেউ খাবার দিলে ভুলেও খাবি না। তাহলে আমার চেয়ে খা’রাপ কেউ হবে না, মনে থাকবে?”

জ্বালাতে রং মশাল পর্ব ১১

মাথা নিচু করে বললাম, “থাকবে।”
‘গুড।’ বলে চলে গেলেন। বিকেলের আযান দিচ্ছে। এখন কীসের চাকরি করবেন?

জ্বালাতে রং মশাল পর্ব ১৩