জ্বালাতে রং মশাল পর্ব ২৯

জ্বালাতে রং মশাল পর্ব ২৯
ইফা আমহৃদ

আরু কাঁচুমাচু করে বিদ্যালয়ে পা রাখে। আজ থেকে তার বড়ো দায়িত্ব। নিজের বাচ্চামো সামলে আরও একটা বাচ্চাকে মানুষ করবে। এবার থেকে নিজের যত্ন নিতে হবে। তুরকে রেখে একাই এসেছে আজ। মূল দরজা অতিক্রম করে ভেতরে প্রবেশ করে আরু। ঘণ্টা বাজে নি। আরু ক্লাসের দিকে পা বাড়াল। এখন সে দশম শ্রেণিতে পড়ে। গত এক মাসে পরীক্ষা দিয়ে দশম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে।

বেসিনের দিকে দৃষ্টি যেতেই তার গলায় শুকিয়ে কাঠ অনুভব করল। অনুভব করল ক্ষুধার জ্বালা। গতকাল রাত থেকে না খেয়ে আছে সে। ব্যাগ থেকে বোতল বের করে পানি ভরে নিল আরু। বোতলের ছিপি লাগানোর পূর্বেই ধাক্কা লাগল কারো সাথে। হাত ফসকে পড়ল ছিপি। আড়চোখে তাকাতেই দৃষ্টি নিবদ্ধ হল তন্বির দিকে। আরু মৃদু ঝুঁকে ছিপি তোলার প্রচেষ্টা করল। তন্বি ভয়ংকর এক কাজ করে বসল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

পা দিয়ে হাঁটুতে আঘাত করল। মুখ থুবড়ে পড়ল আরু। মাথা নত করে সালোয়ার পরিষ্কার করতে লাগল সে। ইচ্ছাকৃতভাবে ছিপি ফেলে দিছে, আরু অনুমান করতে সক্ষম হলো। তৎক্ষণাৎ ঘণ্টা বেজে উঠল। বোতলের পানি ঢেলে দিল আরুর শরীরে। চমকে গেল আরু। শীতকালে থরথরিয়ে কাঁপতে লাগল সে। সূর্য্যি মামা এখনো উঠে নি, তার শীতের মাত্রা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। আরু চুপ করে বসে থাকল।

তন্বি তার কাঙ্ক্ষিত কাজটি সমাপ্ত করে চলে গেল। আরু লজ্জায় উঠতে পারল না। আরেকটু আড়ালে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ক্লাস শুরু হয়েছে তখন। হাঁপাতে হাঁপাতে উপস্থিত হলো তুর। আরুর জন্য তার দেরি হয়েছে। আরুকে ইচ্ছেমতো ব/কে ক্লাস পা রাখল। সম্পূর্ণ ক্লাসে নজরবন্দি করল ফলাফল আরু নেই। স্যার পৌঁছে গেল। তুর চেয়েও বের হতে ব্যর্থ হলো আরুর সন্ধানে। পিরিয়ড শেষ, অন্য পিরিয়ড শুরু। সম্ভব হলোনা খোঁজা।

টিফিন টাইম দেওয়া হলো।পানির বোতল সমেত তুর বের হলো ক্যান্টিনের উদ্দেশ্য। দু’টো সিঙ্গারা কিনে ফিরে এলো বোতল ভর্তি করতে। পাশের ক্লাসে আলো জ্বলতেই সন্দেহপ্রবণ হলো। কৌতুহলবশত দ্রুতি পায়ে এগিয়ে গেল। দরজা খুলে তাকাতেই হাত ফসকে সিঙ্গারা পড়ল। দুটো বেঞ্চ নিয়ে আরু পড়ে আছে মেঝেতে। আরুকে ডাকল বেশ কয়েকবার। চেতনা নেই এককথায়। তুলে বের করার প্রয়াস করল। ফলাফল শূন্য। ছুটে গেল শিক্ষকদের কক্ষে। হাঁপাতে হাঁপাতে জানায়, “ম্যাম, স্যার। আরু ঐ কক্ষে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। প্লীজ দেখুন না কী হয়েছে।”

সবাই ছুটে গেল। পরনের জামাটা শুকিয়েছে সেখানেই। পাশের ছোটো ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো আরুকে ধরে ধরে। পানির ছিটা দেওয়া হলো। মিনিট পাঁচেক পর চেতনা ফিরল আরুর। অপূর্ব-কে জানানো হয়েছে। ডাক্তার খবর দেওয়া হয়েছে। নেতার বউ বলে কথা।

দশ মিনিটের মাথায় উপস্থিত হলো অপূর্ব। রক্তিম চোখজোড়া। গতকালের ভাঁজ বিশিষ্ট পোশাক পরনে। অপূর্ব ছুটে এসে আরুকে ঝাপ্টে ধরল। আরু কাঁচুমাচু মুখ করে বসে আছে। চিন্তিত ভঙ্গিতে কিছুটা ধমকে বলে, “বাসা থেকে না খেয়ে বের হয়েছিস কেন? কিছু হয়ে গেলে কী হতো?”

আরু ঠাঁয় চুপ করে থাকে। পরপর কাশি দিল দু’বার। অপূর্বর সন্দেহ জাগল। সাদা জামার মাঝে পানির ছাপ। সন্দিহান গলায় বলে, “তুই ভিজলি কীভাবে আরু?”
আরু জামা ঝাড়তে ঝাড়তে বলে, “মটরে পানি তুলছিল, খেয়াল করিনি। পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম তখন ছিটকে এসেছে।”

“তাহলে এখানে কী করছিলি?”‌ আরু থতমত খেল। অপূর্ব কথা বাড়াল না। আরুকে পাঁজাকোলা করে প্রস্থান করল স্কুল থেকে।

আরুর শরীর জ্বরে পু/ড়ে যাচ্ছে। চোখ মেলে তাকানোর ফুরসৎ নেই।‌ আরুর মায়ের চিন্তার অন্ত নেই। ক্ষণে ক্ষণে পট্টি দিচ্ছে। অপূর্ব দিশেহারা হয়ে ডাক্তারকে কল করেছে। বাড়ি এলেন ডাক্তার। আরুকে পরীক্ষা করে চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন, “মেয়েটি বিবাহিত?”
অনিতা বলেন, “হ্যাঁ।”

“এতো ছোটো একটা মেয়েকে এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে দিলেন কেন? কিছুদিন আগে এতবড় একটা অপারেশন হল। বুঝতে পারছেন এখন গর্ভধারণের মানে?”

সবাই চমকে গেল। আধো আধো চোখে তাকাল আরু। অপূর্ব ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলে, “এজন্যই আরুকে বলছি অ্যা/বশন করতে। সামনে ওর এস.এস.সি পরীক্ষা। কতবড় প্রেসার বুঝতে পারছ? মা ফুফু, তোমরা ওকে বোঝাও।”
অনিতা বেগম বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। চোখের পাতা পূর্ণ জলে। উত্তেজিত হয়ে বলে, “আমি বলেছিলাম না তোকে, তোর কিছু হয়নি। দেখলি তো বাবা!”

আরু অস্ফুট স্বরে বলে, “জানো মামুনি, নেতা সাহেব আমাকে বলছেন বাচ্চাকে ফেলে দিতে, তুমি তাকে বোঝাও।”
ছেলের গালে চ/ড় বসিয়ে দিলেন অনিতা। অপূর্ব ত্যাড়া হয়ে বলে, “মা তুমি প্লীজ বোঝার চেষ্টা করো।”
“চুপ, একদম চুপ। আগেরদিনে অসংখ্য মেয়েরা এই বয়সে চৌদ্দটা বাচ্চার মা হয়েছে, আরু একা নয়। এই নিয়ে কোনো কথা শুনলে আমি তোরে বাড়ি থেকে বের করে দিবো।”‌ অপূর্ব চুপসে গেল। আরুর প্রতি অদ্ভুত টান অনুভব করে সে। ভালোবাসার টান। মাথা চুলকে বলে, “তার মানে তুমি বলছ, আরুর কিছু হবেনা?”

“না, হবে না। আমরা ওর প্রোপার যত্ন নিলে কিছু হবেনা।” অপূর্ব হাসে। তার মুখে টোল পড়ে। দৃষ্টি নিবদ্ধ করা সেই মনোরম হাসি। কিছুক্ষণ পর সবাই প্রস্থান করল ঘর থেকে। অপূর্ব পাশে বসে মাথায় হাত রাখে। আশ্বাস দিয়ে বলে, “আমাকে ছেড়ে যাবি না কিন্তু, এই শর্তেই অনুমতি দিলাম।”
দ্বিগুন তেজ নিয়ে আরু বলে, “কে চেয়েছে শর্ত। বের করে দিন, বাড়ি চলে যাই।”‌
“বললেই হলো, আমার বাচ্চা, আমার বাচ্চার মা।”

অপূর্ব তার হাত আরুর উদরে রাখে। সন্তানের হৃৎস্পন্দন শুনার প্রচেষ্টা করে। অসাধারণ এক টান অনুভব করে সে। আরু তখন মুখ গুছিয়ে বসে আছে। ফিসফিসিয়ে বলে, “আমার আরু বা তার সন্তানের ক্ষতির কথা যে চিন্তা করবে, তাকে আমি উপযুক্ত শান্তি দিবো। তন্বিকে স্কুল থেকে বের করে দিয়েছি।”

আরু ডাগর ডাগর চোখে তাকায়। অপূর্ব একগাল হেসে বেরিয়ে যায়। তখনও আরু নির্বিকার ভঙ্গিতে তাকানো। সে জানতে পারল না অপূর্ব ভাই সি সি ক্যামেরা চেক করে ধরে ফেলেছে সবটা। বড্ড বুদ্ধিমান, বোকা নয় মোটেও।

পেরিয়ে গেছে কয়েকমাস। শীত পেরিয়ে বসন্ত, বসন্ত পেরিয়ে গ্রীষ্মেকালে পৌঁছেছে। ৩ দিন পর পৌঁছে যাবে বর্ষায়। আরুর ছয়মাস চলছে। নিজে সামলাচ্ছে সবকিছু। পড়াশোনায় খামতি নেই, নেই যত্নে। অপূর্ব দেশের সেবা সেরে আরুর যত্নে উঠে পড়ে থাকে। আজ সে ইউকে গেছে। ৫ ঘণ্টা পেরিয়েছে।

মন খারাপেরা জড়োসড়ো হয়েছে তার মনের জানালায়। অপূর্ব আর নিজের ছবিটার দিকে পলকহীন দৃষ্টিতে থাকতে থাকতে চোখ ঝিমিয়ে যাচ্ছে তার। ভালোবাসা এমনই হয়। আরু বিছানা করে শুয়েছে সবে। তুর তার পাশে শুয়ে গল্প করছে। তৎক্ষণাৎ দরজার করাঘাত পড়ল। উপস্থিত হলো পরিবারের সবাই। তুর দরজা খুলে দিল। অনিতা উত্তেজিত হয়ে বলে,

“আমরা গ্ৰামে যাচ্ছি আরু-তুর। সাবধানে থাকিস, কেমন?”
আরু বিচলিত হয়ে বলে, “কী হয়েছে মামুনি, তোমরা কোথায় যাচ্ছ?”
“তোর নানিমা হুট করে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আমরা যাচ্ছি গ্ৰামে। কাল পরশুর ভেতরে ফিরব।” আরু বিছানা ছেড়ে উঠে। দরজার কাছে যায় পেট হাত দিয়ে। বলে, “আমিও যাবো।”

জ্বালাতে রং মশাল পর্ব ২৮

আরুর মা দিল এক ধমক, “এই পেট নিয়ে যাবি? চুপচাপ ঘুমা। অপূর্ব শুনলে আমাদের আস্তো রাখবেনা।”
আরু চুপটি করে বিছানায় বসল। তুর চলল মাকে এগিয়ে দিয়ে আসতে। বারান্দায় দেখল মাকে। পরপর দু’টো গাড়ি বেরিয়ে গেল। হুট করেই আলো নিভে গেল ঘরের। কয়েকজনের পায়ের শব্দ তার শ্রবণ হলো। তবে কী ঘোর বিপদ অপেক্ষা করছে তারজন্য? গতবারও এমন হয়েছিল। নানি মায়ের অসুস্থতার কারণে সম্পর্কে জড়িয়েছে সে।

জ্বালাতে রং মশাল পর্ব ৩০