জ্বালাতে রং মশাল পর্ব ৩০

জ্বালাতে রং মশাল পর্ব ৩০
ইফা আমহৃদ

বিরতিহীন ধারায় ঝরছে ঘাম। নিজের ওড়না খামচে ধরে আরু। ক্রমশ পায়ের শব্দ বেড়ে চলেছে। খপ করে দরজা বন্ধ করে দিল। দরজায় ঠেস দিয়ে বসে পড়ল। দরজার করাঘাত ক্রমশ বেড়েই চলেছে। আরু অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করে, “কে? তুর।”

অচেনা পুরুষালি কণ্ঠস্বর পৌঁছে যায় তার কর্ণপথে। লোকটা যথারীতি ধমকাচ্ছে তাকে, “দরজা খোল। নাহয়ে ভেঙে ফেলব।”
থরথরিয়ে কাঁপছে লাগল আরু। দরজা ভেঙে ফেলার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো। আরু এদিক ওদিক তাকিয়ে দ্রুত আলমারির দরজা খুলে ঢুকে গেল। দরজা ভিরিয়ে নিচু হয়ে রইল। হঠাৎ বিকট শব্দে কেঁপে উঠে। দরজা নিচে খুলে পড়েছে। হুরমুরিয়ে সাত-আট জন লোক প্রবেশ করেছে ঘরের অভ্যন্তরে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

টর্চের আলো দেখা যাচ্ছে। বুকের ভেতর ধুক করে উঠল। ঘরের প্রতিটা জিনিস লন্ডভন্ড করে রেখেছে। চ্যাঁচিয়ে বলে একজন, “অপূর্ব তো বাইরে কোথাও ছিল না। আজ কোথাও দেখিনি। বাড়িতেই থাকার কথা। গেলো কোথায় শা/লা।”

দ্বিতীয় জন বলে, ” যাবে কোথায়? ঘরের ভেতরে মেয়ে লোকের কথা শুনেছি। নিশ্চয় অপূর্বও ছিল। তার বউকে দিয়ে কথা বলিয়েছে। দরজা জানালা ভেতর থেকে বন্ধ। মানে ওরাও ভেতরে।”
খুঁজতে ব্যস্ত হলো অতঃপর। হুট করে আলমারির ছিটকিনি খুলে ফেলল। তীর্যক আলোর রেখা আরুর মুখমণ্ডলে পতিত হলো। ছেলেটি চ্যাঁচিয়ে বলে, “এই তো মাইয়াডা।”

বলেই টেনে বের করল আরুকে। ছুঁড়ে ফেলে দিল মেঝেতে। চ্যাঁচিয়ে বলে, “অপূর্ব কোথায় বল, আজ ওকে চিবিয়ে খাবো।”
কথা গলায় আটকে গেছে। কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, “বা-বাড়িতে, নে-নেই।”
আরুর গলা চে/পে ধরে একজন। নখের আঁচড়ে পাকাপোক্ত জখম হয় আরু। দ্বিগুন তেজ নিয়ে বলে, “সত্যি করে বল, অপূর্ব কোথায়? নাহলে তোকে এখানে পুঁতে দিবো।”

আরু দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হল। আবছা আলোয় দেখতে পেল দরজা ভেরানো। অবিলম্বে উঠে ছুটে যায় বাইরে। কিন্তু মেয়েরা কি আদৌও ছেলেদের সাথে পারে? আরুর চুলগুলো খোলা। পেছন থেকে মুঠো করে ধরল। ছুড়ে ফেলল মেঝেতে। আ/ঘা/ত করল পেটে। পরপর দু’টো লা/থিতে আরু য/ন্ত্র/নায় কাতরাতে লাগল। দুহাতে পেট ধরে চিৎকার দিল। রক্তের ধারা ছড়িয়ে যাচ্ছে মেঝেতে। চোখ ভর্তি হয়েছে জলে। দাঁত দিয়ে ঠোট কামড়ে ধরে। অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করে, “সত্যি বলছি, বাড়ি নেই নেতা সাহেব।”

বাইরে থেকে তিনটা ছেলে প্রবেশ করে। সবার মুখ ঢাকা কালো মাক্স দ্বারা। বলে, “বস, বাড়িতে কয়েকজন গার্ড ছাড়া কেউ নেই। অপূর্বও নেই। কী করব এখন?”
আরুর মন পড়ল তুরের কথা‌। ওর কোনো ক্ষ/তি করবে নাতো? কয়েক জনের হাতে বন্দুক দেখতে পেল। আরুর অবস্থা তখন নাজেহাল। বস নামক ছেলেটা রাগান্বিত কণ্ঠে বলে, “তাইলে গেল কোথায় অপূর্ব? এতবড় প্লান ফেল করে গেল। ইচ্ছে করছে..

দাঁত দিয়ে আওয়াজ তুলে শান্ত করার প্রচেষ্টা করল নিজেকে। অতঃপর বলে, “তাহলে এখানে থেকে কী হবে? চলে যাই বহুদূর। নাহলে রক্ষা নেই। সময় সুযোগ বুঝে চলে আসব।”
টর্চের আলো সামনে ধরতেই রক্ত নজরে এলো। রক্তের উৎস খুঁজতে খুঁজতে আরুর পানে আলো নিবদ্ধ হলো। একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে বলে, “ভাই মাইয়াডা পোয়াতি ছিল। মনে হয় বাচ্চাটা..

আমরা তো অপূর্বকে মা/র/তে এসেছি। এই নিষ্পাপ শিশুটাকে না। কী করব এখান?
বস নামক লোকটা মাথা চুলকে বলে, “বুঝতে পারি নাই, লা/থিটা পেটে লাগবে। এখন আমরা বাঁচাতে গেলে আরও ফেঁসে যাবো। চল যাইগা..

তরুণ এক ছেলে এসে আরুকে ধরে। টানতে টানতে আলমারির ভেতরে রেখে দরজা বন্ধ করে দেয়। অতঃপর ধপাধপ পায়ে হেঁটে প্রস্থান করল সকলে। আরুর চোখ ভিজে যাচ্ছে। অবুঝ আরুও বুঝে গেছে তাঁর ছোটো বাচ্চাটা আর নেই। দুহাতে চুলের মুঠি ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। কাতরাতে কাতরাতে একপর্যায়ে চেতনা হারিয়ে ফেলে আরু।

আলো জ্বলছে। অপূর্ব বাড়ি ফিরেছে সবে। সকালের আলো ফুটল বলে। আজ মনটা তার ফুরফুরে কারণ আভাকে সবটা জানাতে পেরেছে। মন ভরে দোয়া দিয়েছে আভা। আভাও অন্তঃসত্ত্বা। বাড়ির শান্ত পরিবেশ দেখেই মন খচখচ করছে তাঁর। দরজা খোলা। ঘরের আসবাবপত্র ভাঙচুর। আরুর জন্য ‘আনা’ উপহারগুলো হাত থেকে ফেলে ছুটে যায় নিজ কক্ষে। অগোছালো বিছানায়, প্রতিটি জিনিস এলোমেলো। অপূর্ব এদিক ওদিক তাকিয়ে আরুকে খোঁজে। পায় না, চ্যাঁচিয়ে বলে, “বাবা, মা, তুর। কোথায় সবাই।”

ভাইয়ের ডাক শুনে মন শান্ত হয় তুরের। রান্নাঘরের কার্নিসের উপর লুকিয়ে ছিল এতক্ষণ। নেমে এসে ঝাপ্টে ধরে অপূর্ব-কে। কাঁদতে কাঁদতে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, “জানিস ভাইয়া কতগুলো লোক এসেছিল। সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে রেখেছে।”
অপূর্ব ওদিক ওদিক তাকিয়ে বলে, “বাকিরা কোথায়?”

“সবাই গ্ৰামে গেছে। দাদিমা অসুস্থ হয়ে‌ছে। আরু ঘরে। মা বাবাকে এগিয়ে দিতে গেলাম। ফিরে এসে দেখি কতগুলো লোক। ভয়ে আমি কার্নিসের উপর লুকিয়ে ছিলাম।”

অপূর্ব তুরকে সরিয়ে ঘরে ছুটে যায়। মেঝেতে থাকা রক্ত এবার তার দৃষ্টিনন্দন হয়। জীবনটা এক মিনিটের জন্য থেমে যায়। তুর চট করে বলে, “ওরা যাওয়ার সময় কয়েকবার আলমারি বলেছে। আলমারিতে দেখব?”
অপূর্ব শব্দ উচ্চারণ না করেই ছুটে গেল সেদিকে। দরজাটা খুলতেই মেঝেতে ঢলে পড়ল আরু। অপূর্ব পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তুর দূর থেকে দেখামাত্র ছুটে এলো নিকটে। আরুকে পরপর ধাক্কা দিয়ে বলে, “এই আরু, আরু। শুনতে পাচ্ছিস?”

আরুর রেসপন্স নেই। হাত তখনও পেটে চেপে আছে। তুর উঠে দাঁড়াল। অপূর্বকে কয়েকটা ধাক্কা দিয়ে বলে, “ভাইয়া দেখ, নিশ্চয়ই তীরের কিছু হয়েছে। আমাদের তীর হয়তো আসার আগেই বিদায় নিয়েছে।”
অপূর্ব ধীরে ধীরে আওড়াল, “না, কিচ্ছু হবেনা।”
“তাড়াতাড়ি তোলো ওকে, হাসপাতালে যেতে হবে।”
অপূর্ব নিজের ভেতরে ফিরল। ঘনঘন পলক ফেলে বলে, “হ-হ্যাঁ।”

অতঃপর পাঁজাকোলা করে তুলে নিল আরুকে। তখনও রক্তের ধারা বইছে‌। তুর পেছনে পেছনে ছুটে আসছে। তার বুকে প্রচণ্ড ব্যথা করছে। নিঃশ্বাস আঁটকে আসছে। অপূর্ব গাড়িতে রাখল আরুকে। তুর বসল পেছনে। অপূর্ব গাড়ি চালাতে ব্যস্ত হয়েছে। ফাঁকা রাস্তা দিয়ে শোঁ শোঁ করে ছুটছে গাড়ি। তুর বুকে হাত দিয়ে বলে, “ভাই গাড়িতে পানি আছে।”

তুরের অস্পষ্ট স্বর অপূর্বর কানে পৌঁছায়। গাড়ি থামিয়ে পানি এগিয়ে দেয়। তুর পানি পান করা বলে, “ভাইয়া আমার বুকে প্রচণ্ড ব্যথা করছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।”
তুরের চোখের কোনে পানি। স্পিড বাড়িয়ে দেয়। অপূর্ব ভেঙে পড়েছে। ভয়ে হার্টবিট দ্রুত গতিতে ছুটছে। নিজেকে অসহায় লাগছে।

হাসপাতালের সামনে গাড়ি থামল। অপূর্ব আরুকে পাঁজাকোলা করে ছুটল। ফোন করেছে ডাক্তারকে। স্টেচারে করে আরুকে ইমারজেন্সিতে নেওয়া হয়েছে। অপূর্ব আশেপাশে তুরকে দেখল না। অপূর্ব ছুটল তুরের খোঁজে। গাড়িতে হেলান দিয়ে আছে। হাতটা বুকে‌।

অপূর্ব ডাকল, নো রেসপন্স। ধরতেই পড়ল নিচে‌‌। দিশেহারা হয়ে পড়ল অপূর্ব। অতি দ্রুত তুরকে কোলে নিয়ে অপূর্ব ছুটল। ইমারজেন্সি নেওয়া হয় তুরকে। দুই জায়গায় দুইজন অসুস্থ। অপূর্ব করিডোরে রাখা বেঞ্চিতে বসে পড়ল। বাবা মায়ের মুখ ভেসে উঠল। ফোন করল বাড়িতে। পরিবারের সবাই তখনও গ্ৰামে পৌঁছায় নি। অপূর্ব ধীর গলায় বলে, “আরু, তুর একসাথে হাসপাতালে ভর্তি আছে। পারলে চলে এসো।”

অপূর্ব জানে বাবা মা ঠিক আসবে, তবুও ওভাবেই বলল। দশটা নাগাদ পৌঁছে গেল তাঁরা। আরু তুর তখনও ‘ওটি’ তে। অনিতা ছুটে এসে বলে, “কী হয়েছে ওদের?”
অপূর্ব কথা বলতে পারল না। এতক্ষণ সঞ্চয় করে রাখা অশ্রু ধারা ঝরল। মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে, “আমি তো বলেছিলাম ফিরছি, তবুও একটা রাতের অপেক্ষা কেন করলে না মা।”

তাদের কথা বলার মাঝপথে ডাক্তার বের হলো। নত গলায় বলে, “পেসেন্ট কোনো কারণে শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ রেখেছিল। অতিমাত্রায় ভয়, উত্তেজনা, চিন্তা ভাবনার কারণে ঘটেছে। হার্টের রক্তনালিতে ব্লক তৈরি হয়ে রক্ত চলাচল মারাত্মক অথবা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। এ সময় হার্টের মাংসপেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং বিভিন্ন রকম জটিলতা সৃষ্টি হয়।”

জ্বালাতে রং মশাল পর্ব ২৯

এজন্যই কি তুর বলেছিল, তার বুকে ব্যথা করছে?

জ্বালাতে রং মশাল শেষ পর্ব