জ্বালাতে রং মশাল শেষ পর্ব 

জ্বালাতে রং মশাল শেষ পর্ব 
ইফা আমহৃদ

অপূর্ব চুপটি করে রইল। দু’পা পিছিয়ে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। অনিতা উত্তেজিত হয়ে বলেন, “এখন কেমন আছে।”
“ভালো, বাকিটা জ্ঞান ফেরার পর বলা যায়। চব্বিশ ঘন্টা অবজারভেশনে রাখা হলো।” বলেই ডাক্তার চলে গেলেন। আরুর মা অপূর্ব-কে ধাক্কা দিয়ে বলেন, “আরুর খবর কী? কেমন আছে মেয়েটা?”

অপূর্ব ছুটে গেল আরুর কাছে। পথ পেরিয়ে দাঁড়াল দরজার সামনে। লাল রঙের বাতিটা নিভে আছে। কাঁচের ভেতর দিয়ে চেতনাহীন মুখটা অপূর্ব দর্শন করে বিষাদময় শ্বাস নেয়। ডাক্তার দেখে উত্তেজিত হয়ে বলে, “আরু কেমন আছে ডাক্তার?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“গর্ভপাত হয়েছে। পেটে আঘাতের কারণে রক্তপাত ঘটেছে প্রচুর। দুই ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়েছে। তবে দুঃখের বিষয়, আরু হয়তো কখনো মা হতে পারবে না। কয়েক মাস আগে তার পাকস্থলীর ক্যান্সার ধরা হয়েছে। এমনিতেই তাঁর শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। বর্তমানে গর্ভপাত। আমার ধারণা আরু কখনো মা হতে পারবে না। গর্ভধারণ করলেও গর্ভপাতের সম্ভবনা রয়েছে। বাকিটা আল্লাহ ভরসা।” বলেই ডাক্তার চলে গেল।

আরুকে কেবিনে সিফ্ট করা হয়েছে। অপূর্ব তার পাশে বসল। চুলগুলো সরিয়ে আলতো চুমু খেল কপালে। ওষ্ঠদ্বয় স্থির রাখল কিছুক্ষণ। অতঃপর সরে গেল। চোখমুখে হাহাকার। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। আরুর দিকে ঝুঁকে রইল। চেতনা ফিরল আরুর। নিভু নিভু চোখে তাকিয়ে রইল। চোখজোড়ায় উচ্চে পড়ল অশ্রুধারা। মধুর স্বরে বলে, “কিছু হয়নি আরু, চুপ করে আছিস কেন? কথা বল।”

আরু চোখ বন্ধ করে নিল। কথা নেই তার। তার মা এসেছে ভেতরে। মায়ের হাতটা আলতো মুঠো করে বলে, “বাড়িতে যাবো মা, এখানে থাকলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। আমার ছোটো তীরের কান্না আমি শুনতে পাই।”
বলতে বলতে চিকচিক করে উঠে চোখ। আরুর মা আঁচল ঢেকে কেঁদে উঠে। অপূর্ব মাথা তুলে আরুকে দেখে। ভিশন নরম একটি মেয়ে হঠাৎ করেই পাথর হয়ে গেছে। অপূর্ব চুপচাপ বেরিয়ে যায়। বাড়িতেই সব ব্যবস্থা করে আরু ও তুরকে রাখার। দুই বাড়িতে দু’জন রাখে।

এভাবে পেরিয়ে যায় মাসের পর মাস। আরুর এস.এস.সি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। অন্য মনস্ক হয়ে সারাদিন পড়ে আর পরীক্ষা দেয়। কিছুটা দূরে পরীক্ষার হল পড়েছে। অপূর্ব তাকে নিজে দিয়ে আসে ও নিয়ে আসে। আরু তার কাছে থাকেনা। বাবা মায়ের সাথে থাকে।

অপূর্ব গোসল সেরে টাওয়াল মেলে দেয় বারান্দায়। কাবার্ড থেকে পোশাক বের করতে গেল। নিয়ে পড়ল কয়েকটা কাগজ। অপূর্ব আড়চোখে তাকিয়ে তুলে নেয় হাতে। পৃষ্ঠায় নজরবন্দি করে ফোঁস ফোঁস করে উঠে। আরু তাকে ডিভোর্স পেপার পাঠিয়েছে। হাতের টিশার্ট পরে নিল। পেপার টা নিয়ে ধপাধপ পায়ে হেঁটে আরুর ঘরে গেল। আরু জানালায় মাথা রেখে অদূরে পুকুর পাড়ে তাকিয়ে আছে।

পুকুরের চারপাশে গাঁদা ফুল ফুটেছে। অপূর্ব আরুর হাত ধরে টান দিল। অকস্মাৎ ঘটা ঘটনায় হতভম্ব হলো আরু। বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। পেপার টা অনেক খণ্ড করে ছুঁড়ে দেয়। আরু বিষাদময় শ্বাস নেয়। সে জানে এমন কিছুই হবে। অপূর্ব ফোঁস ফোঁস করে বলে, “এতবড় সাহস তোকে কে দিয়েছে আরু? তোর হাত একবারও কাঁপছে না।”

আরু বুকে হাত দিয়ে নিজেকে যথাসম্ভব সামলে বলে, “আপনি বিয়ে করে নেয় নেতা সাহেব। নতুন একটা সংসার পেতে নিন।”
অপূর্ব উল্টো স্বরে বলে, “তুই আগে করে নে।”
“বিয়ে আর আমি? বিপরীত শব্দ শুনেছেন নিশ্চয়। তেমন। কে করবে বিয়ে?”

“আমি তোকে ভালোবাসি আরু, প্রচণ্ড ভালোবাসি। আমি জানি একটা বাচ্চার জন্য তুই এমন করছিস। তুই যখন জেনেছিলি, ‘আমি বাবা হতে পারব না।’ তখন কিন্তু ছেড়ে যাস নি। আমিও যেতে পারব না। একটা বাচ্চার উপর ভালোবাসা নির্ভর করে না।”

আরু তাকিয়ে রইল পলকহীন দৃষ্টিতে। অপূর্ব উল্টো টি শার্ট পরে আছে। আজ সে স্বার্থক! পূর্ণ! এতগুলো দিন পর আজ প্রথম তার চোখের বাঁধ ভাঙল। হাউমাউ করে কেঁদে বলে, “নেতা সাহেব, আমি কখনো মা হতে পারব না। কখনোই না। প্রচণ্ড ভালোবাসি আপনাকে। নিজেকে বারবার অপূর্ণ লাগে। মনে হয় আপনার যোগ্য নেই।”
অপূর্ব রিমোট হাতে নিল। চ্যানেল চেঞ্জ করে সংবাদ দিল।

সংবাদ পাঠিকা বলছেন, “জনকল্যাণে নিয়োজিত অপূর্ব আহসানের বাড়িতে আক্র/মণ করা স/ন্ত্রা/সবিরোধীরা ধরা পড়েছে। বর্তমানে পুলিশি হেফাজতে আছে।”
অপূর্ব আরুর হাত ধরে বলে, “আমাকে ছাড়া তুই সুখে থাকবি না, তোকে ছাড়া নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে পারি না। তুই কি চাস না, আমি ভালো থাকি? তাছাড়া ডাক্তার বলেনি, তুই কখনোই মা হতে পারবি না।”

আরু অপূর্বর বুকে মুখ লুকিয়ে নেয়। এতগুলো দিন পর তার মুখে হাসি ফুটেছে। মৃদু স্বরে বলে, “আমি কিন্তু চেষ্টা করে যাবো, আপনি বারণ করতে পারবেন না। এটাই আমার শর্ত।”
অপূর্ব জবাব দেয়না‌। তার হাতটা আরুর পিঠে রেখে আশ্বাস দেয়।
পরিশিষ্ট
আট বছর পর

আহসান বাড়িতে শোনা গেল সদ্য জন্মানো নবজাতক শিশুর কান্নার শব্দ। আরু ঘনঘন নিঃশ্বাস নিতে নিতে বিছানা খামচে ধরে আছে। ভেতরটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। অপূর্ব দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে হাঁসফাঁস করছে। দরজার করাঘাত করে চ্যাঁচিয়ে বলে, “কতক্ষণ লাগবে? ভেতরে আসব না?”

অনিতা উচ্চ স্বরে বলে, “বকবক করিস না। বসে থাক। হলে আমরাই ডাকব।”
অপূর্ব পাশে দেখল তার ছোটো বোন তুর এসেছে। কোলে তার চার বছরের ছেলে তীব্র। এগিয়ে এসে অপূর্ব কোলে দিয়ে ভেতরে গেল‌। ভাগ্নে-কে কোলে নিয়ে অপূর্ব অভিযোগ করে, “আমার বউ, আমার বাচ্চা। অথচ আমি ভেতরে যেতে পারছি না।”

পেরিয়ে গেল অপ্রিয় মুহূর্ত। দরজা খুলে দাত্রী বের হলো। অপূর্ব কোলে সদ্য জন্মানো নবজাতক শিশু তুলে দেওয়ার প্রচেষ্টা করে বলে, “আপনার তীর। মেয়ে হয়েছে। একদম নেতার মতো হয়েছে। মিষ্টি খাওয়ান।”
অপূর্ব অনুভূতিহীন হয়ে তাকিয়ে থাকে তীরের দিকে। আঠারো বারের সময় এলো তীর। সতেরো বার এসে চলে গেছে। কখনো দুই কখনো বা তিনমাস। তর্জনী এগিয়ে দিতেই আঁকড়ে ধরল শিশুটা। অপূর্ব হেসে ফেলে। উঁকি দিয়ে বলে, “আরুর কাছে যাবো।”

“হ্যাঁ, যান। ঘণ্টা পেরিয়েছে। এখনো খাওয়ানো হয়নি। সাহায্য করুন।” বলেই দাত্রী অপূর্ব হাতে তুলে দিল ছোটো তুরকে। নিয়ে নিল তীব্রকে। চলে গেল। অনিতা ছেলের চুল টেনে সেও চলে গেল। অপূর্ব ভেতরে ঢুকল। আরু তাকিয়ে আছে দুজনের দিকে। অপূর্ব পাশে রাখল ছোটো তীরকে। আরুর কপালের মধ্যিখানে ওষ্ঠদ্বয় স্পর্শ করে বলে, “সে চলে এসেছে। এরপর আর করবি না, মনে থাকবে?”

আরু আলতো করে হাসে। এতগুলো বছরে সে হাল ছেড়ে দেয়নি। অপূর্ব তাড়া দিয়ে বলে, “দ্রুত ওকে খাওয়া।”
আরু ইতস্তত করে বলে, “কী?”
“আমি সাহায্য করব?”
আরু চিৎকার করে বলে, “না। মাকে ডাকুন।”
“বাবার চেয়ে দাদি বেশি বড় হয়ে গেল? এত বছর ধরে একটা পুঁচকু জন্ম দিয়ে তোর মাটিতে পা পড়ছে না দেখছি।”

আরু মুখ ঘুরিয়ে বলে, “আপনার আশায় থাকলে, সেটাও হতো না।”
ছোটো তীর কেঁদে উঠে দুজনার ঝগড়া শুনে। দু’জনে দু’জনার দিকে তাকিয়ে হেসে উঠে।
ইচ্ছে করে, তোর শহরে
থাকতে সন্ধ্যে সকাল
ইচ্ছে করে, জ্বালতে আলো
জ্বালাতে রং মশাল

(সমাপ্ত)

ছোটো করে হলেও মন্তব্য করার অনুরোধ। অপূর্ব আরুকে নিয়ে আরও একটি গল্প লেখব অতিদ্রুত।

জ্বালাতে রং মশাল পর্ব ৩০