জ্বালাতে রং মশাল পর্ব ২৮

জ্বালাতে রং মশাল পর্ব ২৮
ইফা আমহৃদ

“আমি আর বাঁচবো না নেতা সাহেব।” পরক্ষণেই অপূর্ব নিজের হৃৎপিণ্ডে আবদ্ধ করল আরুকে। আরু নিস্তেজ হয়ে বসে আছে। পেরিয়ে যায় অপ্রিয় মূহূর্ত। অপূর্ব ক্ষান্ত হল ঈষৎ। ঢেকে রাখল পল্লব। তেমন ভঙ্গিতেই শুধাল, “তুই জানলি কীভাবে?”

আরু ব্যস্ত ভঙ্গিতে একটু সরে দাঁড়াল। অপূর্ব দৃষ্টি মেলল। ওড়নার সাথে গিট দেওয়া প্রেগন্যান্সি কিট এগিয়ে দিল সামনে। ধীরে ধীরে উচ্চারণ করে, “দেখুন পজেটিভ এসেছে। আগেরবারও পজেটিভ এসেছিল।”
অপূর্ব হাত বাড়িয়ে আয়ত্বে করে নিল বিলম্বে। গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে সন্দিহান গলায় বলে, “হঠাৎ টেস্ট করলি কী মনে করে?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“দুদিন ধরে প্রচুর মাথা ঘুরছে। বমি বমি ভাব হচ্ছে। গা গুলাচ্ছে। আগেরবার মা টেস্ট করিয়েছে তখন পজেটিভ হয়েছে। তাই আমিও টেস্ট করলাম।” আরু কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে। অপূর্ব বিষাদ পূর্ণ শ্বাস নেয়। তার আরুপাখি বিগত দিনগুলোতে অসুস্থতা বোধ করছে, অথচ সে লক্ষ্য করছে না। একবার তার মনের ভেতরে দানা বেঁধে গেল, আরু প্রেগন্যান্ট। পরক্ষণেই মন হয় সে বাবা হওয়ার ক্ষমতা হারিয়েছে।

আরুর হাত আলতো ধরে বলে, “চল, আল্ট্রাসাউন্ড করে আসি। এমনেও হতে পারে। কিন্তু চিন্তা করিস না আমি আছি তোর পাশে।”
আরু চিন্তিত ভঙ্গিতে ঘাপটি দিয়ে রইল। সে যাবে না কিছুতেই। আরু চায়নি, এত তাড়াতাড়ি অপূর্বকে জানাতে। সে চেয়েছিল ১০০% সিউর হয়ে বলবে। নত গলায় বলে, “নেতা সাহেব, আমি নিজেই আল্টা করেছি। আজ রিপোর্ট দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু ইলেকশনের ঝামেলার কারণে আনতে যাইনি।”

“দেখি, টেস্ট করিয়েছি সেই রশিদটা।” আরু আলমারির উপরে কাগজের নিচে রাখা এক টুকরো কাগজ এগিয়ে দিল। অপূর্ব ব্যস্ত ভঙ্গিতে নিয়ে হাসপাতালে নাম দেখল। উপরে দুইটা সিমকার্ডের নাম্বার দেওয়া। রিসেপশনিস্টের হওয়ার সম্ভাবনা। ফোন করল কন্ট্রাক্ট নাম্বারে। একটি মেয়ে রিসিভ করল। ধরেই সালাম বিনিময় করে অপূর্ব বলে, “আমি অপূর্ব আহসান বলছি। আপনাদের হাসপাতালে আরশি নামের কোনো মেয়ের আল্ট্রাসাউন্ড রিপোর্ট এসেছে?”

মেয়েটি কিছুক্ষণ নিরবতা বিরাজ করল। পৃষ্ঠা উল্টানোর শব্দ শোনা গেল। অতঃপর বলল, “জি, আজকে নেওয়ার কথা ছিল স্যার।”
“রিপোর্টে কী আছে?”
“সেটা বলার অনুমতি নেই স্যার। রশিদ দেখিয়ে আল্ট্রাসাউন্ড রিপোর্ট নিতে হবে।”

অপূর্ব ফোন রেখে দ্রুতি পায়ে প্রস্থান করল। আরু ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল দরজার কাছে। রাত গভীর হওয়ার পাশাপাশি ভেতরটা তার দুমড়েমুচড়ে উঠছে। আযান দিয়েছে অনেক আগে। নামাজ আদায় করা হয়নি। আরু ওয়াশরুমে গিয়ে ওযু করে নামাজ আদায় করল। আরুর নামাজ দীর্ঘ হয়েছে। ৯ রাকাত নামাজ আদায় করতে সে যা সময় নিল অপূর্ব সেই সময়ে পৌঁছে গেল বাড়িতে। তবুও শেষ হলনা। মোনাজাত শেষ করে দেখল অপূর্ব বিছানায় বসে জানালার গ্ৰিলে মাথা ঠেকিয়ে আছে‌। আরু জায়নামাজ ভাঁজ করে কার্বারে রেখে অপূর্বর পাশে বসে বলে, “কী হয়েছে নেতা সাহেব, রিপোর্ট কী বলছে?”

বিষণ্নতায় মাখা গলায় বলে, “পজেটিভ। তবে প্রেগন্যান্সি পজেটিভ।” বলেই অপূর্ব বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। আরু ঘরের জানালা দিয়ে দেখল অপূর্বকে। মা হওয়ার আনন্দে তার মন উচ্ছসিত। মাতৃত্বের স্বাদ পেতে চলেছে সে। কিন্তু অপূর্ব? সে-কি মেনে নিবে বাচ্চাটাকে? অপূর্ব বাবা হতে পারবে না অথচ আরু অপূর্ব ছাড়া কোনো পুরুষের সংস্পর্শে যায়নি। চোখের বাঁধ ভাঙল। অতিদ্রুত বিচ্ছেদ হতে শুরু করেছে যে।

আরু বারান্দায় পা রাখল। আলো নেই। চাঁদ নেই। তাঁরারা আলোয় পরিপূর্ণ করেছে আকাশ। নিভু নিভু তাঁরা জোনাকির মতো জ্বলছে। আরু পিঠ চুলকে উঠল। কোনো পিঁপড়া কামড়ে দিল পিঠে। লাল পিঁপড়া। অপূর্ব রেলিং-এ হাত রেখে বাইরে মুখ করে রেখেছে। আরু পেছন হতে অপূর্বকে জড়িয়ে ধরল। বুকে মাথা রেখে দাঁড়ায়। মুখোমুখি হওয়ার দুঃসাহস নেই।

ধরা গলায় বলে, “অপূর্ব ভাই, বিশ্বাস করুন না এই রিপোর্ট ভুল। আমি শুধু আপনার সাথে.. একটা টেস্ট করাবেন প্লীজ। আমি দেখতে চাই, আপনি সত্যিই কি বাবা হতে পারবেন না?”
অপূর্ব পিছু ফিরল। আঁধারের তার অশ্রুধারা বালুর মতো চিকচিক করে উঠল। আঁতকে উঠল আরু। তার অপূর্ব ভাই এভারে কাঁদছে? ইচ্ছে করছে দু’হাতে মুছে দিতে। অপূর্ব কি রাজি হবে?

আরু অগোছালো ভাবে বলে, “আপনি আমাকে একটু বিশ্বাস করবেন?”
আরুকে আরও অগোছালো করে অপূর্ব আরেকদফা জড়িয়ে ধরল। ঝুঁকে গেল ঈষৎ। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, “এটুকু বিশ্বাস আমার আছে আরুপাখি। টেস্ট করে কী হবে? ‘আমি বাবা হবো’ – এই অনুভূতিটা পাবো। প্রত্যাশার বাইরে ছিল।

আরু অপূর্বর পিঠে হাত রেখে বলে, “তাহলে কাঁদছিলেন কেন?”
“আমার ভালোবাসা সমাপ্তি পায়নি, কারণ আমি বাবা হতে পারব না বলে।
আমি চিন্তিত, তখন কেন নেগেটিভ এসেছিল?”
“মানে…

“একজনের সাথে হিসাব মেলানো বাকি আছে, সময় করে যাবো। তারসাথে হিসাবটা মিলিয়ে আসব।”
অপূর্ব আরুকে কোলে তুলে নিল। বিছানায় বসিয়ে পাশে বসে আলতো হাসে। মাথাটা কোলে রেখে বলে, “তোর বয়স কত হবে? ১৪-১৫?”
“হম।” সংক্ষিপ্ত জবাব।

“আমাদের দেখে নারীর প্রজনন ক্ষমতা থাকে ১৫-৪৫ বা ১৯-৫৫ বছর পর্যন্ত। তোর অপরিণত বয়সে গর্ভধারণ হয়েছে। এতে নারীদের অনেক ঝুঁকি থাকে। আমি তোকে একটা কথা বলব, ‘অ্যাবশন করবি’ ভেবে বলিস।”
আরুর হাত তখন নির্বিকার ভঙ্গিতে অপূর্ব চুল টেনে দিতে ব্যস্ত ছিল। হাতটা সেখানে স্থির হয়ে গেল। পাল্টা প্রশ্ন করে বলে, “ও আপনার সন্তান, আপনার এতে কোনো সন্দেহ আছে নেতা সাহেব?”

“আমার কথাটা রাখ।” অপূর্বর আবদার আরু প্রত্যাখান করে। অপূর্বকে সরিয়ে দেয়। বিছানায় বালিশ ঠিক করে শুয়ে পড়ে। অপূর্ব তাকিয়ে থেকে বলে, “খাবি না?”
“কথাতেই পেট ভরেছে।” বলে কম্বল দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলে। অপূর্ব দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে আলো নিভিয়ে দেয়। আরুর পাশে শুয়ে পড়ল। কম্বল টেনে আরুর কাছাকাছি গেল। তাকাল না আরু।

আরু স্কুলের জন্য তৈরি হচ্ছে। আড়চোখে তাকিয়ে দেখল টেবিলের উপর অনেকগুলো ফুলের মালা। তাজা রাখতে পানি ছিটিয়ে দিল উপরে। বেসামাল দৃষ্টি অপূর্বর দিকে নিবদ্ধ হতেই ঈর্ষান্বিত হল। ফুলে পানি দেওয়ার পাশাপাশি অপূর্বর শরীরের ছিটিয়ে দিল পানি। পানির ছোঁয়া পেতেই ধরফরিয়ে উঠে বসল। হাউসি দিয়ে আরুর দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা মুচকি মুচকি হাসতে। পানির বোতল দেখে আন্দাজ করতে পারছে। ঘুমু ঘুমু গলায় বলে, “সমস্যা কী? ফুলের মালাগুলো ওদিকে নিয়ে পানি ছিটা। আমার ঘুমে ডিস্টার্ব করছে।”

জ্বালাতে রং মশাল পর্ব ২৭

“ফুলের পাশাপাশি মানুষের শুকিয়ে যাওয়া মনটাকেও তাজা করছি।” দৃঢ় গলায় জবাব দিয়ে আরু আর পানি ছিটাল না। অপূর্ব কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল। ইচ্ছাকৃতভাবে অনেকটা পানি অপূর্বর মুখে ফেলল। অপূর্ব সুন্দর ঘুম বিদায় নিল। হাই তুলতে তুলতে ওয়াশরুমে গেল। আরু মুখ ভেংচি দিয়ে বেনুনি করে নিল। অতঃপর বেরিয়ে গেল স্কুলের উদ্দেশ্যে। নেতার বউ বলে কথা। আরুর শান্তিকে অশান্তিতে রুপান্তরিত করতে অপূর্ব গার্ড রেখেছে।

জ্বালাতে রং মশাল পর্ব ২৯