জ্বালাতে রং মশাল পর্ব ১৯

জ্বালাতে রং মশাল পর্ব ১৯
ইফা আমহৃদ

ছোটো বাচ্চার কথা স্মরণে রেখে মুখে খাবার তুললাম। নিঃশব্দে গাল গড়িয়ে অশ্রুটুকু ঝরে পড়ল। খাবার গলায় আঁটকে রইল। এত যন্ত্রণা কেন আমারই। খাওয়ার মাঝপথে অপূর্ব ভাই বেরিয়ে এলেন। তৈরি হয়ে নিলেন সে। কী কাজ করেন তিনি।

ঝংকার তুলে তার ফোন বেজে উঠল। রিসিভ করে বলেন, “একটু ব্যস্ত ছিলাম। সময় খেয়াল ছিলনা। আমি আসছি।”
ওপাশ থেকে কী বলছে, শোনা গেল না। অপূর্ব ভাই পুনরায় বললেন, “কালকে কি বার খোলা থাকবে? আমি যেতে পারব না। একটু হাসপাতালে যেতে হবে। জরুরি।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আমাকে নিয়ে হাসপাতালে যাবে? কিন্তু তার কাছে যে টাকা নেই। যাবো না হাসপাতালে। কথা বলতে বলতে বেরিয়ে গেলেন তিনি। ‘বার’ কেন বললেন? তিনি বারে কাজ করেন? না-কি গতরাতের মতো নে’শা করতে যাবেন। আমি বিছানায় বসে খাওয়া শেষ করলাম। সময় মিলিয়ে দুপুরের ওষুধ বিকেলে খেলাম। তৎক্ষণাৎ তুর এলো। অপূর্ব ভাই যাওয়ার জন্য নিশ্চয় তুর-কে পাঠিয়েছেন। আমি সৌজন্য হাসি দিলাম। তুর পাশে বসলেন। বললাম, “আজকে স্কুলে গিয়েছিলি তুর? পড়া কী দিয়েছে?”

“দেবো কানের নিচে লাগিয়ে। বিছানা থেকে উঠতে পারিস না, আবার স্কুলের পড়া। আমি থাকলে জীবনেরও স্কুলে যেতাম না। বিয়ে হয়ে গেছে এবার মন দিয়ে সংসার করতাম।”
ভ্রু কুঁচকালাম। আমার অবস্থা দেখেও ওর মনে হচ্ছে মন দিয়ে সংসার করা উচিত? অন্যদিকে তাকিয়ে বললাম, “মামুনি-কে বল বিয়ে দিতে। তারপরে পড়াশোনা ছেড়ে মন দিয়ে সংসার কর।”

চোখমুখ ছোটো ছোটো করে অভিমান মিশ্রিত গলায় বলে, “এভাবে বলিস্ না। আমার বুঝি সংসার করতে মন চায় না? একটা কথা বলব?”
সংক্ষিপ্ত জবাব দিলাম, “বল।”

গালে হাত দিয়ে বলে, “তুই প্রেগন্যান্ট হলি কীভাবে?”
থতমত খেয়ে গেলাম। পড়াশোনা তেমন ভালো নয় তুর, আমিও যে ভালো ছাত্রী এমনটা নয়। আমি পড়ি, যতটুকু পড়ি ততটুকু পারি। বুদ্ধি খাটিয়ে অতিরিক্ত লিখতে পারিনা। তুর দেশে ফিরেছে কয়েকমাস। ক্লাসেও তেমন যায়নি। জানবে কীভাবে? কী জবাব দিবো?

কোনো উত্তর না পেয়ে তুর ফের প্রশ্ন করে, “কি-রে বলবি?”
নতজানু হয়ে বললাম, “জানি না।”
“না জানলে প্রেগন্যান্ট হলি কীভাবে?”

বুঝতে পারলাম না বলার আগে তুর আমাকে ছাড়তে নারাজ। কিছু একটা বলতে হবে। কী বলব? ‘হামি’ ফ্লিমের কথা মনে পড়ল। সৌজন্য হেসে বললাম, “তোর অপূর্ব ভাই ভালোবেসে আমার গালে হামি দিয়েছে। তারপরে আমি প্রেগন্যান্ট হয়ে গেলাম।”

আমার কথাটা তুরের মনমতো হল বলে মনে হয়না। নিশ্চুপ হয়ে দু’য়ে দু’য়ে চার মেলায়। অতঃপর বলে, “কিন্তু অপূর্ব ভাই স্বীকার করেনি বাচ্চা তার‌। তাহলে হামি দিল কে? তাছাড়া আমিও তোকে অনেকবার হামি দিয়েছি, বাচ্চার বাবা আমি নয়তো?”

একের পর এক তুরের প্রশ্নে নাকানিচোবানি খেতে আরম্ভ করলাম। সোজাসাপ্টা বলার দরকার ছিল অপূর্ব ভাইকে জিজ্ঞেস কর। আমি জ্বরের অভিনয় করে শুয়ে পড়লাম। তুরের প্রশ্নের ঝুরি খুলে বসেছে। বিরক্ত নিয়ে চ্যাঁচিয়ে বলি, “মেয়ে মেয়ে-কে হামি দিলে প্রেগন্যান্ট হয়না। ছেলে মেয়েকে হামি দিলে প্রেগন্যান্ট হয়। অবশ্যই ভালোবেসে দিতে হবে। এবার তুই যা।”
চোখজোড়া বন্ধ করে শুয়ে রইলাম। তুর চলে গেল। আমার সাজানো একটা কথায় তুর ভয়ংকর কিছু বানিয়ে ফেলবে ভাবতে পারিনি। সবাইকে বলছে আমার বাচ্চার বাবা পিয়াস। কারণ সেদিন পিয়াস জোর করে আমার গালে কিস্ করেছিল। আমি ঘটনাটা ভুলে গেলেও তুর ঠিকই মনে রেখেছে। সবাই ঘরে চলে এলো।

তখন আমি ঘুমাচ্ছিলাম। ঘুম থেকে টেনে তুলে মা। নিভু নিভু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আমার ঘরে সবাইকে দেখে চরম বিস্মিত হয়েছিলাম। সবকিছু ধোঁয়াশা ও স্বপ্ন লাগছিল। মা বাবা মামা মামুনি সবাইকে এই ঘরে আশা করিনি। আমি সবটা বুঝে উঠার পূর্বেই মামুনি গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলেন, “তুই না-কি জানতি না, এই বাচ্চার বাবা কে? তাহলে তুর জানল কীভাবে এটা পিয়াসের বাচ্চা?”

পিয়াস‌ নামটা শুনে চমকে গেলাম। কারণ পিয়াস হিসেবে আমি একজনকেই চিনি। অন্য পিয়াস নয়তো? পর মুহূর্তেই প্রশ্ন করলাম, “কোন পিয়াস মা?”
মা চ্যাঁচিয়ে বললেন, “স্কুলে যার সাথে প্রেম করতি, সেই পিয়াস। কোন ক্লাসে পড়ে ঐ ছেলে? এতকিছু হয়ে গেল তুই কিছু বললি না। কী হয়েছে, চুপ করে আছিস কেন?”

এবার বুঝলাম কোন পিয়াসের কথা বলেছে। হ্যাঁ, পিয়াসের সাথে আমার তেমন দেখা হতো না। আমি দেরি করে যেতাম আর দেরি করে ফিরতাম।
“কিন্তু মা..

আমাকে কিছু বলতে দেওয়া হলনা। মা তার আগেই বললেন, “ভাবী-ভাইজান। আমাদের ভুল হয়েছে। আমি সত্যি দুঃখিত। আমার আগেই ভাবা উচিত ছিল অপূর্ব এমন ছেলে নয়। সব দোষ আমার মেয়ের। আমি আরু-কে নিয়ে যাচ্ছি। সত্যিটা না জেনে আপনাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য দুঃখিত। চল আরু।”

মা আমাকে নিয়ে চলে এলেন বাড়িতে। আমার নিজের ঘরে বন্দী করে রাখল। বাইরে থেকে দরজা আটকে রাখল। বাবা কিছু বললেন না। তিনি নিরব দর্শক। অনেকদিন পর নিজের ঘরে এসেও কষ্ট লাগছে। বিকেলে জ্বর নিয়ে অপূর্ব ভাইয়ের জামা কাপড় ধোয়ার ফলে শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। আমি ফ্যান চালু করে বসলাম। একটু পানি খেলাম।

বিছানা ছেড়ে উঠলেই মাথা ঘুরে যায়। কিন্তু কীভাবে জানল পিয়াসই আমার বাচ্চার বাবা? অপূর্ব ভাই যদি এই মিথ্যা জানতে পারেন, নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করে নিবেন। তখনকার বলা মায়ের কথাটা মনে পড়ল, ‘তুর জানে!’ আমি দরজার কাছে গেলাম। দরজা বন্ধ। বারান্দায় গেলাম। আমার বারান্দার পাশাপাশি অপূর্ব ভাইয়ের বারান্দা, তুরের নয়।

গলা ফা’টিয়ে বেশ কয়েকবার ‘তুর’ বলে ডাকলাম। তুরের খবর নেই। এক পর্যায়ে তুর এলো। কঠিন গলায় বললাম, “তুই সবাইকে কী বলেছিস? সবাই কেন শুধু শুধু পিয়াসের নাম জড়াচ্ছে।”
“শুধু শুধু কোথায়? তুই বলিস্ নি, ভালোবেসে কোনো ছেলে হামি দিলে প্রেগন্যান্ট হয়ে যায়?”
আমিও সায় দিলাম, “হম।”

“সেদিন তোকে স্কুলের বারান্দায় পিয়াস তোর গালে হামি দিয়েছিল। তুই কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে এসেছিলি। এতকিছুর চাপে তুই সেই কথাটা হয়তো ভুলে গেছিলি। আমার মনে পড়েছে। এবার বুঝলি তোর বাচ্চার বাবা-কে? দেখলি কীভাবে সত্যি সামনে নিয়ে এলাম, এবার ট্রিট দে।”

বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফুস ফুস করে ক্ষোভে ফুঁসছি। ইচ্ছে করছে এক লাফে ওপাশের বারান্দায় গিয়ে আছাড় দিতে। ফুলের টবে থাকা মাটির টুকরোগুলো তুরের দিকে ছুড়ে দিলাম। ফুঁসতে ফুঁসতে বললাম, “তোর অপূর্ব ভাই বলে আমি না-কি গাধা। আজ আসুক তিনি। তার বোনটা যে আমার চেয়েও বড় গাধা, সেটা জানে না।”

ঘরে গেলাম। কাবার্ড থেকে নিজের মুঠোফোন বের করে হাতে নিলাম। কতদিন পর ফোনটা স্পর্শ করেছি। কাঁপা কাঁপা হাতে অপূর্ব ভাই-কে কল দিলাম। রিং হওয়ার আগেই রেখে দিলাম। দুইবারের প্রচেষ্টায় সফল হলাম। রিসিভ হলনা। অপূর্ব ভাই কি আসবেন?

রাত দশটা পেরিয়েছে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আকাশ। শুয়ে শুয়ে ফোনে গেমস খেলছি। দক্ষিণা হাওয়া বইছে। দরজা খোলার শব্দ পেলাম। আড়চোখে তাকাতেই অপূর্ব ভাইয়ের অগ্নিরুদ্ধ দৃষ্টি নজরবন্দি হল। ফোন রেখে নখ কামড়াতে ব্যস্ত হলাম। অপূর্ব ভাই ভেতরে প্রবেশ করলেন। তার পিছু পিছু বাকিরা।

ভীত হলাম তৎক্ষণাৎ। নির্ঘাত সবটা বলেছে এবং আমাকে শাস্তি দিতেই এখানে এসেছেন। আরু এবার তোকে কে বাঁচাবে? কিন্তু তেমন কিছু বললেন না। উল্টো সুর তুলে ক্ষিপ্ত গলায় বললেন, “তুই এই ঘরে কী করছিস? কোন সাহসে অন্যের ফোন ধরেছিস? আবার সেই ফোন দিয়ে আমাকে কল করেছিস, হাউ ফানি।”

মামুনি এগিয়ে এসে বললেন, “এর পেছনে অনেক কারণ আছে, আগে শুনে নে।”
অপূর্ব ভাই সোজাসাপ্টা জবাব দিলেন, “এই ঘরে আসার আগ পর্যন্ত সব তো শুনলাম।”
“তুই এখনও এই মেয়েটাকে ঘরে তুলবি?”

“বিয়েটা যখন করেছি, অবশ্যই তুলব। তাছাড়া আমার ঘর আমি তুলব, ভাড়া দিয়ে থাকি। বিয়ের আগে আমি অনেকবার বলেছিলাম, কিন্তু কেউ আমার কথা শুনো নি। ওকে জোর করে আমার কাঁধে তুলে দিয়েছ। এবার ভেলিভারির আগ পর্যন্ত আমাকেই ভাবতে দাও।”

জ্বালাতে রং মশাল পর্ব ১৮

সবাই দমে গেল। বোঝার বাকি নেই, সবাই সবটা বলে দিয়েছে এবং সবার উপরে রাগ করেই আমাকে নিয়ে যাবেন।
এগিয়ে এসে কোলে তুলে নিলেন। ‘পুষ্পা’ ভঙ্গিতে গলার নিচে জমে থাকা ঘামটুকু মুছে অপূর্ব ভাইয়ের গলা জড়িয়ে ধরলাম।

জ্বালাতে রং মশাল পর্ব ২০