জ্বালাতে রং মশাল পর্ব ২৫

জ্বালাতে রং মশাল পর্ব ২৫
ইফা আমহৃদ

আকাশে সূর্যি মামা উঁকি দিয়েছে। ফুলের টবে পানি দিতে দিতে গুনগুনিয়ে গান ধরেছে আরু। অপূর্ব সকালে গেছে। কানে ইয়ারফোন গুঁজে রাখা। ঝংকার তুলে মুঠোফোন বেজে উঠল। মুঠোফোনের দিকে দৃষ্টি দিতেই দেখল ‘তুর’ নামটা জ্বলজ্বল করছে। রিসিভ করে ব্লুটুথে কানেক্ট করল। উৎফুল্লিত হয়ে বলে, “তুর, সাতসকালে ফোন করলি, কিছু হয়েছে?”

ওপাশ থেকে তুর বলে, “জানিস আরু, ভাইয়া একটা সুন্দরী মেয়ের সাথে প্রেম করছে।”
হাত থেকে পাইপ পড়ল। আজ সকালে অপূর্ব বলেছিলেন, তিনি আমাকে ভালোবাসেন শুধু। বিচলিত হয়ে একের পর এক প্রশ্ন করল তুর, “তুই জানলি কীভাবে? তোকে কে বলেছে? দেখ মিথ্যা বলবি না।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আজ সকালে আলমারি গোছাতে গিয়ে কিছু ছবি পেয়েছি। আমি এম. এম. এস করে পাঠাচ্ছি।” তুর ফোন রেখে দিল। ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তুর ছবি পাঠিয়েছে। অসম্ভব সুন্দরী মেয়েটা। অপূর্ব তাকে একহাতে জড়িয়ে রেখেছে, মেয়েটি দুহাতে কাঁধে রেখে হেসে আছে। হাত ফসকে ফোনটা নিচে পড়ল। সবকিছু অগোছালো রেখে বড়ো পেট নিয়ে দৌড়ে ছুটে। ফুপুদের বাড়ি থেকে আরুর বাড়ির দূরত্ব ‘দশ টাকার’ অটো ভাড়া। সম্পূর্ণ রাস্তা ছুটে গেল।

বাড়িতে পৌঁছে দরজা ধাক্কা দিল। পাশাপাশি হওয়ার দৌলতে মা নেমে এলেন বাড়ি থেকে। উত্তেজিত হয়ে বললেন, “আরু, মা। এমন করছিস কেন?”
ঘাম ঝরছে ক্রমাগত। হাঁপাতে হাঁপাতে আরু বলে, “তোমার অপু আমাকে ঠকাচ্ছে মা। অন্যমেয়ের সাথে প্রেম করছে।”

মা দিল এক ধমক, “একটা চড় দিবো। কে বলেছে তোকে এইসব?”
এতটা পথ ছুটে আসার দরুন পেটে অসম্ভব ব্যথা করছে তাঁর। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে রাগান্বিত স্বরে বলে, “আমি ছবি দেখেছি।” ততক্ষণে তুর দরজা খুলে দিয়েছে। পুনরায় ছুটে গেল। মা পেছন থেকে চ্যাঁচিয়ে বারণ করছে ছুটতে। কিন্তু আরুর উত্তর চাই।

দরজা খোলা। কতদিন পর প্রবেশ করেছে। অগোছালো ঘর। কতদিন গোছায়নি, অথচ তিনি পরিপাটি গোছালো মানুষ। অপূর্ব ঘুমিয়ে আছেন। পিঠে হাত রেখে ঠেলে বলে “অপূর্ব ভাই, শুনছেন? উঠুন তাড়াতাড়ি।”
একলাফে উঠে বসলেন তিনি। আরুকে দেখে চরম হতবুদ্ধি সে। চোখ পরিষ্কার করলেন বেশ কয়েকবার। ঘনঘন পলক ফেলে বললেন, “তুই এখানে? কখন এলি? বস।”

“আগে আপনি বলুন, ঐ মেয়েটা কে?” কেঁদে উঠল আরু। স্বামীর ভাব কাউকে দিতে নারাজ সে।। জড়িয়ে নিলেন আরুকে। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “শান্ত হ আগে, তারপরে বল কোন মেয়ে?”
বলেই পানির গ্লাস এগিয়ে দিলেন। করতলে নিয়ে মাথায় দিলেন। মুখে দিতেই ফেলে দিল আরু। ভেঙে গেল গ্লাস। চ্যাঁচিয়ে বললেন, “আরু।”

“তারমানে সত্যি, আপনি সত্যিই প্রেমে পড়েছেন।” উল্টো ছুট লাগাল। দরজার সাথে মাথায় আঘাত লাগল তাঁর। চলাফেরা ভালো নয়। ঘুরে উঠল মাথা। মুচড়ে উঠল পেট। পেটে হাত রেখে দেয়াল ঘেঁষে বসে পড়ল। অস্ফুট স্বরে বললাম, “অ-পূ-র্ব..

উল্টো দিকে ফিরে ছিলেন তিনি। অকস্মাৎ ডাকে তাকালেন। ছুটে এলেন কাছাকাছি। মাথা তুলে নিলেন কোলে। গালে চপল দিয়ে বললেন, “এই আরু, কী হয়েছে তোর?”
“পেটের ভেতরে ব্যথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে অপূর্ব ভাই। মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রনা করছে। বমি বমি ভাব আসছে।” বলেই গলা ধরল আরু। পাঁজাকোলা করে ওয়াশরুম অবধি নিল অপূর্ব। দরজার বাইরে হেলান দিয়ে বসিয়ে বললেন,

“এসেছিস কীভাবে?”
“দৌড়াতে দৌড়াতে।”
“পা/গল তুই। এবার কী করব আমি।” ততক্ষণে মুখ ভার করে বমি করে দিলাম। রক্ত ভেসে গেল মেঝে। ক্লান্ত হয়ে পড়ল আরু। চোখ গড়িয়ে অশ্রুধারা ঝরল। অপূর্ব আলতো হাতে মুছে দিলেন চোখ জোড়া। মুখ মুছিয়ে দিল স্বযত্নে। তৎক্ষণাৎ পরিবারের সবাই হাজির হল। মা কেঁদে দিলেন। তুর একপাশে দাঁড়িয়ে ক্রমাগত কাঁদছে। অপূর্ব ভাই পাঁজাকোলা করে ধীরে ধীরে সিঁড়ি পেরিয়ে নিচে নামলেন। তার গলা জড়িয়ে ধরার শক্তিটুকুও পেল না আরু। নিভু নিভু চোখে তাকিয়ে বলল, “মেয়েটি কে বলুন না?”

অপূর্ব ভাই শুনতে পেলেন না। মা মামুনি পেছনে বসলেন। আরুকে তাদের কোলে রেখে বললেন, “চোখ বন্ধ যাতে না করে, খেয়াল রেখো।”
আধঘণ্টায় হাসপাতালে এসে পৌঁছে তাঁরা। অক্সিজেন মাস্ক পড়িয়ে দিল নার্স। ইনজেকশন পুশ করল বাহুতে। পেট আঁকড়ে ধরে শুয়ে আছে আরু। যন্ত্রনা ছিঁ/ড়ে যাচ্ছে। জেনারেল ডাক্তার এসে রিপোর্ট চাইলেন। কিছুক্ষণ দেখে ফোন করলেন টিউমার অনকোলজিস্ট বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে। দশটা নাগাদ পৌঁছে গেলেন ডাক্তার। দু’জনে চেম্বারে গিয়ে গবেষণা করে ডাকলেন পরিবারের তিনজনকে। অপূর্ব ভাই, বাবা, মামাকে‌।

দরজায় টোকা দিতেই অনুমতি দিলেন প্রবেশের। চেয়ার টেনে বসতেই অনকোলজিস্ট বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলতে শুরু করলেন, “কতদিন ধরে উপসর্গ দেখা দিচ্ছে।”
অপূর্ব ফুফুর দিয়ে তাকিয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললেন, “মাস খানেক।” ডাক্তার রিপোর্ট থেকে রোগীর নাম চেক করে বললেন, “আমার ধারণা আরু ম্যালিগন্যান্ট টিউমারে আক্রান্ত ছিলেন। এটা পুরোপুরি বিনাইন টিউমারের বিপরীত।

এ জাতীয় টিউমার শক্ত হয়। এটা খুব দ্রুত বেড়ে যায় এবং আবরণ থাকে, এটার উপরে চর্ম আলাদা মনে হয় না। এই টিউমারের কাছাকাছি গ্রন্থির সমূহ আক্রান্ত হয় এমনকি চাপ দিলে সামান্য ব্যথা অনুভূত হয়। এই টিউমারের উপর অস্ত্র প্রচার করলে সাধারণত ক্ষতি হয়ে থাকে। ক্যান্সারে পরিণত হচ্ছে সবে। পাকস্থলীর টিউমারে/ক্যান্সারে বাঁচার সম্ভাবনা খুবই কম।

আমরা প্রথমে কেমোথেরাপি করব। ২-৬ দফায় কেমোথেরাপি করে আক্রান্ত কোষকে সংকোচিত করব। অতঃপর অপারেশনের মাধ্যমে আক্রান্ত কোষ বের করে আনব।”
অপূর্ব বিষাদের নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বলে, “যেটা ভালো হয় করুন।” ডাক্তার পুনরায় বললেন, “আপনারা রক্তের ব্যবস্থা করবেন। যথেষ্ট রক্তের প্রয়োজন। টিউমার/ক্যান্সার শরীরের অর্ধেকের বেশি রক্ত শুষে নেয়। কখনো কখনো রোগী রক্ত স্বল্পতায় মা/রা যায়।”

আরুর বাবা বিচলিত হয়ে বললেন, “কখন কেমো দিবেন?”
“সন্ধ্যার দিকে। তার আগে আমরা গ্যাস্ট্রোজেজেনোস্টমি করব। রোগীর আক্রান্ত কোষ থেকে এক টুকরো মাংস এনে পরীক্ষা করব, তার জন্য কোন কেমোথেরাপি বেস্ট হবে।” ডাক্তার গলা ঝেড়ে নার্সকে ডাকলেন। অবিলম্বে নার্স হাজির হলেন। আদেশ করলেন, “আগামী তিন ঘণ্টা রোগীকে কোনোপ্রকার মেডিসিন, খাবার দিবেন না, তাকে প্রস্তুত করেন।”

সূর্য ডুবে গেছে। আরুকে বাড়িতে পাঠানো হয়েছে। সেই ঘরটা একদম হাসপাতালের মতো সাজানো হয়েছে। তার গ্যাস্ট্রোজেজেনোস্টমি সম্পূর্ণ হয়েছে। ডাক্তার তার শিরায় কেমো দিবেন। আরুর মাথায় হাত রাখতেই কেঁদে উঠল সে। কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠে, “আমাকে কেউ ভালোবাসে না ডাক্তার সাহেব। আমি বাঁচব না।”
ডাক্তার থেমে গেলেন।

জেনারেল ডাক্তার মুহিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “রোগীর নিজেরই বাঁচার ইচ্ছে নেই।”
ডা. তুহিন অপূর্ব-কে টেনে বললেন, “কেমো দেওয়ার সময় রোগীকে মানসিক ভাবে ফিট থাকতে হবে। কেমোর ডোজে তার চোখ ঘুমে তলিয়ে যাবে। মানসিক সুস্থতাই তার ঘুম ভাঙাতে পারবে। আশা ছেড়ে দিলে চলবে না।”
‘আমি দেখছি বলে’ অপূর্ব আরুর পাশে বসে।

চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে আলতো চুমু খায় তার ললাটে। তার চোখজোড়া পূর্ণ হয়ে এলো অশ্রুতে। আরুর চোখের পাতা স্পর্শ করল। চোখ খুলে তাকাল আরু। হাত নাড়িয়ে অপূর্বর চোখ মুছে দিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলে, “কাঁদছেন কেন অপূর্ব ভাই? কান্না আপনাকে মানায় না।”
হাতের উপর ঠোঁট স্পর্শ করে অপূর্ব। অসহায় কণ্ঠে বলে, “তুই শুনতে চেয়েছিলি না, মেয়েকে কে? কেমো দেওয়ার পর ঘুম ভাঙলেই বলব তোকে।”

উত্তেজিত হয়ে বলে আরু, “সত্যি বলছেন।”
“তিন সত্যি।”
ডাক্তার আরুর শিরায় পুশ করলেন কেমো। আরুর চোখ ভেঙে এলো। বোধশক্তি হারিয়ে ফেলছে ধীরে ধীরে। অপূর্ব আরুর মাথায় হাত রেখে তিন গ্লাস পানি পান করতে সাহায্য করল। একপর্যায়ে আরু গভীর ঘুমে নিমজ্জিত হল।

জ্বালাতে রং মশাল পর্ব ২৪

কিছু কথা, ১. গল্প নিয়মিত কেন দেই না?
২. ১খণ্ডের মতো মনে ধরে না কেন?
৩. অগোছালো লাগে কেন?
উত্তর,
১ম খণ্ডের পর ৫ বছর বিরতি নিয়ে লিখতে পারছি না। একেই তো ২ মাস লেখিনি, ধীরে ধীরে ভুলে যাচ্ছি। তারপরে ৫ বছর বিরতি দেওয়ার পর আরও সম্ভব হচ্ছেনা। তাই আগামীকাল থেকে ১ খণ্ডের শেষ থেকে ২য় খণ্ড শুরু করতে চাইছি। ইন শা আল্লাহ্, নিরাশ হবেন না। গত ছয় পর্ব আপাতত অতিরিক্তের খাতায় যোগ করছি।

জ্বালাতে রং মশাল পর্ব ২৬