জ্বালাতে রং মশাল পর্ব ৩

জ্বালাতে রং মশাল পর্ব ৩
ইফা আমহৃদ

গালে চ’ড় পড়তেই হতভম্ব হলাম আমি। গালে হাত রেখে ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম অপূর্ব ভাইয়ের দিকে। তার কোনো হেলেদুলে নেই। দৃষ্টি তার প্রচণ্ড বিরক্তিকর। আরও একটা চ’ড় দিতে গিয়ে দিলেন না। রাগান্বিত কণ্ঠে বলেন,

“আমাকে তোর বাবা টাকা দিয়ে রাখছে? পঁচিশে ছুটি হয়েছে এখন দুইটা ছুঁইছুঁই। কোথায় ছিলিস এতক্ষণ? বয়ফ্রেন্ডের সাথে প্রেম করছিলি? তাহলে বয়ফ্রেন্ডকেই বলতি, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে, আশ্চর্য!”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আমার থেকে দূরে সরে গেলেন। উল্টো ঘুরে বার কয়েক শ্বাস-প্রশ্বাস নিলেন। তিনি প্রচণ্ড ক্ষেপে আছেন, এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। আমি নিজেও ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমি তো প্রেম করছিলাম না। ক্লাস করতে গিয়ে দেরি হয়েছিল, বাকিটা পিয়াসের জন্য। শুধু শুধু চড়। মুখ ভাড় করে বললাম, “স্যার একটু বেশি ক্লাস নিয়েছে, তার দেরি হয়েছে।”

তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেল, “একদম চুপ। আমাকে তোর মত গাধা মনে হয়? কিছু বুঝিনা। আমি আরও দশ মিনিট আগে এখানে এসেছি। তোকে এই ছেলেটা গোলাপ দেয়নি?”
মুখের বুলি বন্ধ হল এবার। দশ মিনিট পূর্বে তার আগমন ঘটেছে, আরও পাঁচ মিনিট পূর্বে আগমন ঘটলে কী হতো? তাহলে শুধু শুধু চড়টা গালে পড়তে না।

অপূর্ব ভাই পিয়াসের সামনে গেল। কলার টেনে দাঁড় করালো। চুলগুলো ঠিক করে দিতে দিতে বলল, “কোন ক্লাসে পড়িস তোরা?”
ভাব নিয়ে বলে পিয়াস, “সবার সিনিয়র, ক্লাস টেন। পরের বছর কলেজে যাবো।”

পরক্ষণেই ঠাস ঠাস করে বেশ কয়েকটা চড় পড়ল পিয়াপের গালে। গোনার চেয়েও দ্রুত পড়ছে। গালে হাত রেখে দ্রুত উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়ে রইলাম। প্রচণ্ড ভয় হচ্ছে। এই চড়ের একটাও যদি আমার গালে পড়ে, আমি শেষ। কালকে রাতের ঘটনা অনুসরণ করতে হবে। চোখে পানি এনে কাঁদার সূচনা করলাম।

ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললাম, “ভাইয়া, ও আমাকে প্রায়ই বিরক্ত করে। সেদিন আমাকে চড় দিয়েছে। আমার প্রচণ্ড ব্যথা লেগেছে। বলেছে, আমি তার কথা না শুনলে আরও মারবে।”
অপূর্ব ভাই থেমে গেলেন। একবার গভীর দৃষ্টিতে আমাকে পর্যবেক্ষণ করে বিষাদময় শ্বাস নিলেন। শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে বললেন, “হাঁটু মুড়ে ওর কাছে ক্ষমা চা দ্রুত, নয়ত আস্ত থাকবি না।”

সবাই একসাথে ক্ষমা চাইলো। সেই মুহূর্তে নিজেকে প্রিন্সেস মনে হল। বাহ্! এমন দেখতে একটা প্রিন্স যদি আমার হতো, কত ভালোই না হতো। কিন্তু প্রিন্স শুরু রুপকথার জগতেই সম্ভব।
শাস্তি দিয়ে অপূর্ব ভাই আমার আগেই বেরিয়ে গেলেন। আমি, তুর আর তন্বি একসাথে পা চালালাম। পেটে ক্ষুধায় চু-চু করছে। বাড়িতে থাকলে এতক্ষণে খাওয়া হয়ে যেত। তন্বি আমাকে চুপিসারে বলে, “কী কিউট এই ছেলেটা। কীভাবে ওদের শাহেস্তা করল দেখলি। আ’ম ক্রাশ অন হিম। লাভ হিম। নাম কী তার?”

বিষম খেলাম আমি। তুর আর আমি একে অপরের দিকে দুর্বল দৃষ্টিতে তাকাচ্ছি। অপূর্ব ভাই আবার ফিরে এলেন। রিকশা ঠিক করে এসেছেন। তন্বি তাকে দেখে একটু লজ্জা পেল। মুচকি হাসল। অপূর্ব ভাই অনুমান করতে পারল কিছু। মেয়েদের মন বুঝতে পিএইচডি অর্জন করেছেন তিনি। সরাসরি তন্বি’কে জিজ্ঞেস করল, “আমাকে তোমার ভালো লাগে?”

রোদ্দুরে রক্তিম হওয়ার চেয়ে ভাইয়ের কথায় একটু বেশি রক্তিম হল। আলত মাথা নেড়ে বিনা অক্ষরে জানায়। “হম।”
অতঃপর হাতের সহায়তায় মুখ আড়াল করে হেসে ফেলল। লজ্জা মিশ্রিত সেই অপূর্ব হাসি। অপূর্ব ভাইও হাসলেন। হকচকিয়ে গেলাম আমি।

ভেবেছিলাম, ওদের মত দুই একটা গালে পড়বে তন্বির, তা হলোনা। কন্ট্রাক নাম্বার চাইলো। তন্বি খুশি যেন এবার আকাশ স্পর্শ করল। আনন্দে আত্মহারা হয়ে এবার সে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলল। অপূর্ব ভাই আর কিছু বললে না। তন্বির পাশাপাশি হাঁটতে আরম্ভ করলেন। আমরা সামনে-সামনে। ভাই যে এবার ক্লাস নাইনের মেয়ের সাথে প্রেম করবে ভাবতেই পারিনি।

দুপুর হওয়ার দরুন চারপাশের লোকজন খাবারের দোকানে, রেস্তোরাঁয় কিংবা বাড়িতে যেতে ব্যস্ত। কর্মক্ষেত্র থেকেও ফিরছে বাড়ির তাগিদে। রাস্তাঘাট নিরিবিলি। মাঝে মাঝে রিকশা কিংবা সাইকেলের হন শোনা যাচ্ছে। সময় দুইটা ত্রিশ। ডাক্তাররা নিশ্চয় খাবারে ব্যস্ত। আমাদেরও ক্ষুধা লেগেছে, তাই ছোটো একটা রেস্তোরাঁয় গেলাম।

কিন্তু সেখানে যা ভিড়, এত ভিড়ে প্রাণ ভরে খাওয়া অসম্ভব। তাই খাবার নিয়ে পার্কের পাশে এসেছি। লম্বা একটা ব্রীজ। নদীর পাশ ঘেঁষে ব্রীজটা। লোকের আনাগোনা নেই বললেই চলে। সবুজ গাছপালা দিয়ে সাজানো।‌ বাঁধাহীন হাওয়া বহুদূর থেকে ছুটে আসছে এবং বয়ে চলেছে। পরিবেশটা সত্যি ভয়ংকর সুন্দর। এখান থেকে ডাক্তারের চেম্বারের দূরত্ব অতিশয় নয়। হেঁটে যাওয়া সম্ভব।

অপূর্ব ভাই ফোন টিপছেন। আমি আর তুর এক রিকশায় আর অপূর্ব ভাই একা এক রিকশায়। তন্বি’কে রিকশায় উঠিয়ে দিয়েছেন অপূর্ব ভাই। ভাড়া অবধি দিয়েছেন। অপূর্ব ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ডের সংখ্যা কত?

চারটা বিরিয়ানির প্যাকেটের একটা তন্বি’কে দিয়েছে। বাকি তিনটা আমাদের। নদীর দিকে মুখ করে নেত্রযুগল গ্ৰথণ করে নিলাম। দমকা হাওয়া ক্লান্তি অবসাদ করল। পানির বোতল খুললাম। হাত ধুয়ে নিলাম। বিরিয়ানি প্যাকেট খুললাম। কাচ্চি বিরিয়ানি। উপরে থেকে ছোটো লোকমা মুখে পুড়ে নিলাম। চিবুতে গিয়ে অনুভব করলাম, ঝাল।

দ্রুত পানি খেলাম। ঝাল কমার বিপরীতে বেড়ে গেল। ঝালে ওষ্ঠদ্বয়ে কম্পন ছড়িয়ে গেল। মাত্রাতিরিক্ত ঝাল। কাচ্চি বিরিয়ানিতে এত ঝাল সচরাচর দেখা যায়না। ওষ্ঠদ্বয় চেপে স্থির হয়ে রইলাম কিয়ৎক্ষণ। মাংসের টুকরো মুখে নিলাম। না ঝাল নেই। ডিম থেকে কিছু অংশ মুখে দিলাম, ‘না নেই।’ এখানেও ঝাল নেই। প্যাকেটের অন্যদিক থেকে মুখে নিলাম। ঝাল লাগছে।

বোধগম্য হলনা, ঝালের ব্যাপারটা। বিরিয়ানির ভেতরে এক খণ্ড বোম্বাই মরিচের টুকরো পেলাম। একটু খুঁজতেই আরও কয়েকটা। মনে হচ্ছে, প্যাকেট করার সময় দিয়েছে। অপূর্ব ভাই আর তুরের দিকে দৃষ্টিপাত করলাম। ওরা শান্তিতে খাচ্ছে। ঝালের ছিটেফোঁটা নেই। আমি বিরিয়ানি রেখে দিলাম, খেলাম না।

সামান্যতম ঝাল খেতে পারি না। ঝালে আমার এলার্জি প্রবলেম। যেই-সেই এলার্জি নয়, ভয়ংকর এলার্জি। আমাকে শেষ করে জন্য যথেষ্ট। তাই সর্বক্ষণ রান্নার সময় তরকারিতে ঝাল কম দেয় কিংবা আমার জন্য আলাদা রান্না করে। বেছে বেছে মাংস, ডিম, শশা খেয়ে বিরিয়ানি রেখে দিলাম। বাকিটুকু পেট পানি দিয়ে ভর্তি করে ফেললাম। টিসু পেপারে হাত মুছে বললাম, “আমার খাওয়া শেষ।”

“ডিম মাংস খাওয়া শেষ, অমনি পেটে বলে গেছে। সব খাওয়া শেষ কর। তাড়াতাড়ি খা!”
আমি ধীর গলায় বললাম, “ভাই, খাবারে অনেক ঝাল। আমি ঝাল খেতে পারিনা। ”
দ্বিগুণ তেজ দেখিয়ে বললেন, “আমরা খাচ্ছি আমাদের খাবারে ঝাল নেই, তোরটায় ঝাল, মজা করছিস? সার্ভেন্টের কোনো কাজ নেই, তোর খাবারে ঝাল দিবে। কীসের শত্রুতা তোর সাথে? স্টুপিড।

আমি প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বললাম, “সত্যি বলছি, বিশ্বাস না হলে খেয়ে দেখো!
“এখন আমি তোর এঁটো খাবার খাবো। চুপচাপ খা। ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।”
অস্ফুট স্বরে বললাম, “ভাই!”
বাক্য শেষ হওয়ার পূর্বে চিৎকার করে বললেন, “চুপ। তাড়াতাড়ি। খা।”

পরক্ষণে নিজেই খাবার কেড়ে নিলেন। বড় লোকমা করে মুখে মুড়ে দিলেন। আমি মুখ সরিয়ে নিলাম। গাল চেপে জোরপূর্বক মুখে খাবার পুড়ে দিলেন। আমি অশ্রু মিশ্রিত চোখে চেয়ে খাবার চিবুতে লাগলাম। কেন এমন করছেন তিনি। অর্ধেক খাবার শেষ করে ছাড়লেন। আমি ছাড়া পেতেই পানি খেলাম।

ওষ্ঠদ্বয় কিঞ্চিৎ বিচ্ছিন্ন করে উষ্ণ নিঃশ্বাস ত্যাগ করছি এবং হিম শ্বাস গ্ৰহণ করছি। পুরো বোতল ফাঁকা করলাম। নেত্রযুগল পূর্ণ হয়ে এলো জলে। নেত্রপল্লব ফেলতেই গড়িয়ে পড়ল গাল গড়িয়ে। গাল রক্তিম হয়ে এলো। কর্ণপথে শব্দ প্রবেশ করার পরিবর্তে উষ্ণ হাওয়া নির্গত হচ্ছে। কাঁপা কাঁপা গলায় টেনে টেনে বললাম, “ঝাল।”

অপূর্ব ভাইয়া তখন নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে আছেন। দৃষ্টি ঘুরিয়ে আমার দিকে নিবদ্ধ করল। মৃদু অসহায় কণ্ঠে বলে, “আমার হাতও জ্বলছে। প্রচণ্ড জ্বলছে।”
টিসু পেপারে দিয়ে নিজেই আমার অশ্রু মুছে দিলেন। নাক থেকে পানি ঝরতে লাগল। তিনি অসহায় কণ্ঠে বললেন, “তোর কি সত্যি ঝালে এলার্জি?”

“হম।” বলে উচ্চ শব্দে কেশে উঠলাম। কাশি থামছে‌ না। মাথা গরম হয়ে আছে। রোদের তীক্ষ্ণ রশ্মির ফলে বেড়ে গেল কয়েক’শ গুন। শরীর লাল হয়ে এসেছে। বিভিন্ন অংশ কিছুটা ফুলে উঠেছে। জ্বালা সৃষ্টি করেছে। আমি ব্যাগ কাঁধে নিলাম। বাড়িতে যেতে হবে আমায়। আমি সবাইকে ফেলে রেখেই সর্বশক্তি দিয়ে ছুটলাম। জ্বর নেই অথচ শরীরের তাপমাত্রা জ্বরের ঊর্ধ্বে অনুভব করছি। ইচ্ছে করছে‌ নদীতে ঝাঁপ দিয়ে কিছুক্ষণ ডুবে থাকি। এতে দেহের তাপমাত্রা কিছুটা হ্রাস পাবে, কিন্তু সাঁতার জানি না আমি।

দৌড়ে মেন রোড পর্যন্ত আসতেই একটা রিকশা পেলাম। অপেক্ষা করতে হলনা। দ্রুত রিকশায় চেপে বসলাম। বাড়ির ঠিকানা বলে মাথা চেপে বসে রইলাম রিকশায়। হুড টেনে রোদ থেকে আড়াল করার প্রচেষ্টা করলাম।

জ্বালাতে রং মশাল পর্ব ২

পেছন থেকে অপূর্ব ভাই, তুর ক্রমাগত ডাকছে। তাঁদের কণ্ঠস্বর আমার শ্রবণ হলেও প্রতুক্তির করার মত শক্তিটুকু নেই। আলোর মাঝেও আঁধারে ভুগছি। চারপাশ আঁধারে ঢেকে যাচ্ছে। দৃষ্টিতে আঁধার ছাড়া নেই কিছু। আমি বাড়িতে যেতে চাই।

জ্বালাতে রং মশাল পর্ব ৪