জ্বালাতে রং মশাল পর্ব ৫

জ্বালাতে রং মশাল পর্ব ৫
ইফা আমহৃদ

“সকালে তিনটা চড়, বিকেলে তিনটা, রাতে তিনটা চড় খেতে হবে। টানা একমাস। তারপরে আরুর বৃদ্ধি হবে।”
চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললেন অপূর্ব ভাই। সন্ধ্যার অন্ধকারে ঢেকে যাওয়ার পূর্বে বাড়িতে ফিরেছি। বিদ্যুতিক শক খাওয়ার পর মা সেখানে রাখতে ইচ্ছুক নয়।

তাই সাথে সাথেই বাড়িতে নিয়ে এসেছে। আমি খাওয়া থামিয়ে একবার অপূর্ব ভাইয়ের দিকে তাকালাম। সবাই নিরবে হাসছে। কুঁচকে গেল কপাল। আমি করুন দৃষ্টিতে মামুনির দিকে চেয়ে বললাম, “দেখেছ মামুনি, তোমার ছেলে আবার আমাকে ব্যঙ্গ করছে।”
মামুনি খাবারে লোকমা মুখে তুলে দিলেন স্বযত্নে। গ্লাসে পানি ঢেলে বললেন, “অপু বা’জে কথা বলিস না। চুপচুপ খেয়ে ঘুমা।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অপূর্ব ভাই-কে সংক্ষেপে অপু বলে ডাকে মামুনি। অপূর্ব ভাই খেলেন না। বামহাতের সিলভার রঙের ঘড়িটার দিকে
তাকালেন একপলক। দুধের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললেন, “আমি বলছি না মা, বলেছে সাধু পুরুষ। আরশি তো সাধু পুরুষের কথা শুনে চলে। আমার মনে হয় এবারেও শুনবে।”

আমি অশ্রু মিশ্রিত চোখে কোমল গালে হাত রাখলাম। সাধু বাবা বলেছে, তারমানে সত্যি হবে। ‘সকালে তিনটা, দুপুরে তিনটা, রাতে তিনটা’ – মোট নয়টা। আচ্ছা চড়গুলো খাবারের আগে না-কি পরে খেতে হবে? কতটা জোরালো হবে? আমি ফোড়ন দিয়ে বললাম, “ভাই সিনেমায় দেখেছিলাম, মাথায় আঘাত পেলে স্মৃতি হারিয়ে যায় আবার আঘাত পেলে স্মৃতি ফিরে আসে। তাহলে আমার বেলায় চড় কেন?”

“কারণ তোর স্মৃতি হারায়নি।”
পুনরায় নিরিবিলি হয়ে গেল। আমি খেতে মন দিলাম। ইতোমধ্যে খাওয়ার ইতি ঘটেছে। মামুনি মুখ মুছিয়ে দিলেন। মা নিচে এলেন। আমার ঘর গোছাতে গিয়েছিলেন। গোছানো শেষ করেছেন। বাবার প্লেটে ইলিশ মাছ দিয়ে বললেন, “এই মেয়েকে নিয়ে আমার দশা আছে। এমন বল’দি’কে কেউ বিয়ে করবে না।”

মামুনি হাত ধুয়ে বললেন, “এভাবে বলো না আপা, তোমার মেয়ে লক্ষী। ও সবার কথা শুনে, একটু বুদ্ধি কম। তাকে কী। সোনা মেয়ে আরশি। দেখবে, সবাই ওকে মাথায় তুলে রাখবে।”
মা বলেন, “এক দরজা দিয়ে ঘরে তুলবে অন্য দরজা দিয়ে দিয়ে যাবে।”

‘সোনা মেয়ে আরশি’ – কথাটা শোনার পর থেকেই শরীরের দিকে পর্যবেক্ষণ করলাম। কই আমার শরীর তো সোনার নয়। ফর্সা চামড়ার রক্তিম হয়ে আছে। আমি কৌতুহলী নিয়ে প্রশ্ন করলাম, “মামুনি তুমি কি সেকরা দিছে? তুমি জানলে কীভাবে আমি সোনার তৈরি?”

মামুনি আলতো হেসে বললেন, “এই সোনা সেই সোনা নয়। এই সোনা মানে আদরের মেয়ে।”
মা ব্যঙ্গ করে বললেন, “একে বোঝাতে বোঝাতেই আমার দিন শেষ।
“মামুনি দেখেছ, মা সবসময় আমাকে বকে। একদম সহ্য করতে পারেনা। তুমি বরং আমাকে তোমার ছেলের বউ করে নাও।”

মামুনি অপূর্ব ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “অপু ছাড়া অন্য ছেলে থাকলে বউ করার কথা ভাবতাম, অপু’কে দিয়ে আর যাই হোক সংসার হবেনা।”
কথাটা সবাই স্বাভাবিক ভাবে নিলেও আমি স্বাভাবিক ভাবে বলিনি। সত্যি তো, অপূর্ব ভাই-কে চাই।

রাতে ফিসফিসিয়ে কথা বলা শব্দ শুনতে পেলাম। ক্রমাগত আরু, আরু বলে ডেকে চলেছে। আমি কাত হয়ে শুয়ে পড়লাম। তৎক্ষণাৎ শীতল স্পর্শে কম্পনের সৃষ্টি হল দেহে। আপনাআপনি চোখের পাতা উন্মুক্ত হল। অন্ধকারে চরম ভীত হলাম। চিৎকার করার প্রয়াস করতে ব্যর্থ হলাম। বলিষ্ঠ পুরুষালি হাতের সহায়তায় ওষ্ঠদ্বয় আবদ্ধ রইল। একটু নিকটে এগোলেন। ফিসফিসিয়ে বললেন, “আমি অপু, চিৎকার করিস না। তাড়াতাড়ি ওঠ। কাজ আছে?”

হাত সরিয়ে নিলেন। আমি অবুঝ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। দৃষ্টিগোচর হচ্ছেনা কিছু। তবে বেশ কিছুক্ষণে কণ্ঠস্বর পরিচিত ঠেকল। মৃদু স্বরে বললান, “অপূর্ব ভাই, কিছু বলবেন?”
অপূর্ব ভাই মাথা ঝাঁকালেন। মুখশ্রী দেখা না গেলেও আবছা অন্ধকারে ঝাঁকানো ঠিকই দেখা গেল। উঠে বসলাম। টেবিলের উপরে রাখা চশমা পড়লাম। ভ্রু কুঁচকে ইশারায় জিজ্ঞেস করলাম, “কী?”

বিনিময়ে হাত ধরলেন অপূর্ব ভাই। নামিয়ে নিয়ে এলেন। সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করলেন। আমি সন্দেহ দমন করতে না পেরে বললাম, “অপূর্ব ভাই, এতরাতে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?”
অপূর্ব ভাই না থেমেই অন্ধকারে অগ্ৰসর হলেন। নির্ভাবনায় বললেন, “একটু সামনে। সন্ধ্যার সময় বলেছিলাম না, প্রতিদিন চড় খেলে তোর বুদ্ধি বাড়বে। তাই চড় দিতে নিয়ে যাচ্ছি।”

ডানহাত অপূর্ব ভাইয়ের আয়ত্বে। বামহাতে দিয়ে হাত সরাতে সরাতে বললাম, “তাহলে বাইরে কেন যাচ্ছি। ঘরে বসেই চড় দিতেন। রাতে বাইরে গেলে ভূতে ধরবে।”
থামলেন অপূর্ব ভাই। হাসলেন অন্ধকারে। মৃদু শব্দ শোনা গেল। ব্যঙ্গ করে বলে, “তোকে না-কি প্রেমের ভূতে ধরেছে, ডাক্তার নার্স কিছু করতে পারবে না। দেখি ভূতে কিছু করতে পারে কি-না।”

কাঁপছে হাটু। মুখশ্রীতে ভয়ের আভাস দেখা গেল আমার। সিঁড়ির রেলিং ধরে দাঁড়ালাম। অতঃপর বসে পড়লাম। অন্যহাত ছাড়াতে ছাড়াতে বললাম, “অপূর্ব ভাই ছাড়েন আমাকে, নাহলে আমি চ্যাঁচাবো।”
“আচ্ছা মুসকিল তো। ভূত আসবে কোথা থেকে। ভূত নেই, তুই চল।”
“আমি যাবো না, তাই আপনি মিথ্যা বলছেন। ভূত আছে। মা, বাবা..

পরবর্তী বাক্য মুখেই সীমাবদ্ধ রইল। অপূর্ব ভাই পুনরায় অধর চেপে ধরলেন। পকেট থেকে ভিজিটিং কার্ডের মত অ’স্ত্র বের করে গলায় চেপে ধরলেন। হুমকি দিয়ে বললেন যদি না যাই, শেষ করে দিবে।
অবস্থা আমার শোচনীয়। উঠতে পারলাম না। নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলাম। অপূর্ব ভাই বিরক্তিকর দৃষ্টিতে দেখলেন। অতঃপর কোলে তুলে নিলেন। ভারসাম্য বজায় রাখতে গলা জড়িয়ে ধরলাম তার। হাঁটা দিলেন সামনের দিকে।

ল্যাম্পপোস্টের আলোতে সবকিছু জ্বলজ্বল করছে। অপূর্ব ভাইয়ের পাশাপাশি হাঁটছি। ডান হাতটা তার আয়ত্তে। ছোটো ছোটো পা ফেলছি। এখন অবধি তিন’শ একান্ন কদম ফেলেছি। আমি ঘুমু ঘুমু কণ্ঠে বললাম, “অপূর্ব ভাই, আর কতদূর। চড়টা দিয়ে বাড়িতে চলে আসুন। ঘুম পাচ্ছে।”

অপূর্ব ভাই রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে উচ্চ শব্দে হেসে উঠলেন। হাতের ইশারায় সামনে দেখিয়ে বললেন, “ঐ-দেখ। আমরা কেন এসেছি।”
সামনের দিকে দৃষ্টিপাত করতেই বিস্মিত হল। মাঝরাতে তন্বি দাঁড়িয়ে আছেন। হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানির বেড়ে গেল। চোখের ঘুম বিদায় নিল‌। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আমি পারছি না। হাত ছেড়ে দিলেন অপূর্ব ভাই। তন্বির কাছে গেলেন। দূর থেকে দাঁড়িয়ে রইলাম। অপূর্ব ভাই হাতের ইশারায় ডাকলেন। মুচকি হেসে বললেন, “দাঁড়িয়ে আছিস কেন? এদিকে আয়। তন্বির মা জেগে থাকলে, আমাদের দেখলে ঝামেলা হবে।”

গেলাম এগিয়ে। হাত ধরলেন তিনি। মাঝরাতে হাঁটতে লাগলেন। মিনিট দশ অতিবাহিত হল। পেরিয়ে গেল রাস্তা। মাঝরাস্তায় ছেলেরা আড্ডা দিচ্ছে। এদের দেখার পর মনে একটাই কথা জাগল, ‘বাড়িতে কেউ এদের কিছু বলে না।’ আরেকটু পথ পেরিয়ে গেলাম। ছেলেগুলোর সামনাসামনি আসতেই আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “ভালো আছো মামুনি?”

“জি, আলহামদুলিল্লাহ। আপনারা ভালো আছেন?”
“হ্যাঁ, এখন ভালো আছি।”
অপূর্ব ভাই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। জিভের ডগায় শব্দ থেমে থাকল। কী বিরক্তিকর একটা পরিস্থিতি। পুনরায় নিশ্চুপ হয়ে গেলাম। ছেলেগুলো এবার অপূর্ব ভাই-কে বললেন, “কী খবর। দুই ফুল-কে এক মালিক নিয়ে যাচ্ছিস? ডানপাশেরটা আমাদের দিয়ে যা।”

অপূর্ব ভাইয়ের ডানপাশে আমি। খামচে ধরলাম হাত। এরা নিশ্চয় ভূত। অপূর্ব ভাই এই ভূতের কাছে আমাকে রেখে যাবে। শেষমেষ আমি নিজেই ভূতের সাথে কথা বললাম।
তন্বি অপূর্ব ভাইকে বলল, “দেখেছ হিরো, ওরা কীসব বলছে। তুমি হিরোর মতো ওদের ডিসুম ডিসুম মে’রে দাও।”
“হিরো শুরু হিরোইনদের বাঁচায়। কোনো বুদ্ধু-কে নয়। ওরা তোমাকে বলেনি, আরু-কে বলেছে। তুমি চুপ থাকো।”

মাথা নিচু হয়ে গেল‌। সৌজন্য হাসি দিলাম। কষ্ট হচ্ছে ভিশন। ওরা যে বা’জেলোক, তন্বির কথার নিশ্চিন্ত হলাম। অপূর্ব ভাই হিরো আর তন্বি হিরোইন। কিন্তু অপূর্ব ভাইতো আমার রাজকুমার, আমি তার রাজকুমারী। রাজকুমার কাউকে মা’রেনা। তারা তার রানী আর রাজ্যের সুখের চিন্তা করে। এত বুঝের পরেও মনের ভেতরের শান্ত অনুভব করতে ব্যর্থ হলাম। শান্ত হাওয়াতে বিষাদের স্বাদ অনুভব করছি। ফট করে বললাম, “অপূর্ব ভাই, ঘুম পেয়েছে। বাড়িতে যাবো।”

“এখনই ঘুম পেতে হল। সবে বেরিয়েছি। পনেরো মিনিট হলনা। এরপর থেকে তোকে ছাড়াই আসবো।”
অপূর্ব ভাই পিছু হাঁটলেন। বাড়িতে যাওয়ার জন্য অগ্ৰসর হলেন। আমি সামনে-সামনে হাঁটার চেষ্টা করলাম। পুরো রাস্তায় দু’জনের কথপোকথন শোনা গেল। বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম। তাড়াতাড়ি হাঁটার বলে অনেক পিছিয়ে আছেন তিনি। কয়েক কদম ফেলে গেলাম। হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, “তাড়াতাড়ি আসুন।”

“তোর ঘুম পাচ্ছে, তুই যা। আমি পরে যাবো।”
আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। তিনি পেছন থেকে সিগারেট এনে টান দিলেন। ধোঁয়া ছাড়লেন। হতভম্ব হলাম। সিগারেটের জন্য ধীরে হাঁটছিলেন। আমি এগোলাম। পেছন থেকে হাত ধরলেন তিনি। বললেন, “মন খা’রাপ কেন তোর?”
টেনে টেনে বললাম, “অপূর্ব ভাই ওরা যদি আমাকে কিছু না বলে তন্বি’কে বলত, আপনি কি ওদের মা’রতেন।”

“হ্যাঁ।” একরোখা জবাব দিলেন।
অস্ফুট স্বরে বললাম, “তাহলে আমার বেলায় কেন মা’রলেন না?”
“কারণ ওরা আমাকে ভালোবাসে আর আমি ওদের দিকে আমার সময় পার করি।”
আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। চোখ বন্ধ করে একদমে বললাম,
“অপূর্ব ভাই, আমার সাথে প্রেম করবেন? সবাইকে ভালোবাসেন, আমার সাথে না-হয় প্রেম করলেন।”

“তোর মতো মাথামোটার সাথে কে প্রেম করবে? কেউ না। আমি তো কখনও না। তুই আমার বোন, ব্যাস। আমি গেলাম, তুই ভেতরে যা। আমার তিন নাম্বার গার্লফ্রেন্ড অপেক্ষা করছে, দেখা করি আসি।”
চলে গেলেন তিনি। আমি বাড়ির ভেতরে ঢুকলাম। গাছের ঝড়ে পড়ে শুকনো পাতা পায়ের উপর পড়ল। আমার জীবনটাও এমন। গাছের ডালে ঝুলে আছি, ঝড়ার অপেক্ষায়।

জ্বালাতে রং মশাল পর্ব ৪

আমি ঠিক রাজি করাবো, প্রেম করতে। আচ্ছা অপূর্ব ভাই সবাইকে ভালোবাসুক, আমার সাথে প্রেম করুক। কোনো সমস্যা নেই। সবার হিরো হোক আমার না-হয় রাজকুমার।

জ্বালাতে রং মশাল পর্ব ৬