ঝরা বকুলের গল্প পর্ব ১৪

ঝরা বকুলের গল্প পর্ব ১৪
মেহা মেহনাজ

“কই গেছিলি?”
ঘরে ঢুকতেই এহেন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হলো। বকুলের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। আহ্লাদি জেগে! বকুল হতবুদ্ধি হয়ে অন্ধকারের ভেতর চেয়ে রয়। আহ্লাদি পুনরায় প্রশ্ন ছোঁড়ে,
“বাইরে?”
বকুল চট জলদি বুদ্ধি করে জবাব দিলো,
“হ।”
“ও! আমি উইঠা তোরে না দেইখা ভয় পাইয়া গেছিলাম।”
বকুল বিছানার উপর এসে শুলো। বলল,

“ডরের কি আছে? বাইরে যাবি?”
আহ্লাদিও শুলো,
“না। হঠাৎ ঘুম টা ভাঙলো।”
“শুইয়া পড়।”
দু’জনের ভেতর নেমে আসে নীরবতা। অনেকক্ষণ পর আহ্লাদিই ডেকে ওঠে,
“বকুল রে..”
বকুল অস্পষ্ট সাড়া দিলো,
“হুঁ..”
“ঘুমাই গেছোস?”
বকুল পাশ ঘুরে ওর দিকে ফিরলো।
“না। কিছু বলবি?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“হুম। একটা কতা কইতাম। তুই কি জানোস আমি আইজকা তোগো বাড়ি আইছি ক্যান?”
“উঁহু, জানি না।”
“আমার আব্বা উনারে মেলা পছন্দ করছে। আব্বা চায় উনার লগে আমার বিয়া দিতে। তুই তো জানোস, আমি সহজে কাউরে পছন্দ করি না। উনারেও করি কি না, এই ডরে আব্বা আমারে আগে পাডাইছে। উনারে দেহনের লইগা। তাই আমি এই বাড়ি আইছি। খালা সব জানে।”
বকুল জবাব দিলো না। ও আগেই ধারণা করেছিল, কোথাও কিছু একটা ঘটনা আছে। এই তাহলে সেই ঘটনা! ও দায়সারাভাবে বলল,

“ভালো।”
আহ্লাদি বলল,
“উনারে দেখলাম। দেহার পর কি সিদ্ধান্ত নিলাম,হুনবি?”
বকুলের শুনতে ইচ্ছে করল না। উত্তরটা ওর জানা। তবুও জবাব দিলো,
“বল!”
এবারে আহ্লাদির কণ্ঠে পরিবর্তন ঘটে। স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর নিচু হয়ে আসে। খানিকটা লাজুক শোনায়। ও বলল,
“পছন্দ হইছে। মেলা পছন্দ হইছে।”

তুষার বকুলের কিচ্ছু না! হাতে গোণা কয়েকদিনের পরিচয়ে মানুষ টা হুট করে ওর কাছাকাছি এসেছিল। আস্থা, ভরসা মাখানো হাতটা ওর মাথায় রেখেছিল। সেই থেকে মানুষ টা কোথাও না কোথাও ওর বুকের ভেতর চেপেও বসেছে বোধহয়। নইলে কেন এত বুক ভেঙে যাওয়া মন খারাপ হলো ওর? বকুলের মনে হলো, কেউ ওর ছোট্ট বুকটায় একটা বড় পাথর চাপিয়ে দিয়েছে। দম টেনে নিতেও কষ্ট লাগল। ও জবাব দিলো না। যেন ভীষণ ঘুম পেয়েছে- এমন ভঙ্গিতে অন্য পাশ ফিরে চোখ মুঁদলো।

আহ্লাদিও একসময় ওর থেকে সাড়াশব্দ না পেয়ে ঘুমিয়ে গেল। তুষার নিজ রুমে নানান জল্পনা কল্পনা মাথায় নিয়ে এক সময় ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমালো। ঘুমালো ওদের বাড়ির হাঁস-মুরগি গুলো, গরু-ছাগল গুলো, ঘুমালো ছোট্ট বিড়াল ছানা গুলো, পুকুরের মাছ গুলো, গাছ গুলো, ঝিঝি পোকারাও! শুধু বোধহয় ঘুম হলো না বকুলের। সারা রাত অদ্ভুত নীল ব্যথায় থেমে থেমে কুঁকড়ে উঠল ও। কাউকে বলতে পারল না কিছু! কি বলবে? কেন এরকম ব্যথা লাগছে বুকে, সেই উত্তরই তো জানা নেই। তুষার তার কিচ্ছু না।

তবুও কখন কোন ফাঁকে হৃদয়ের এতখানি জায়গা জুড়ে বসল? কোথায় তুষার,কোথায় সে! কখনো কল্পনা করা যায়? যায় না! সেখানে বাস্তব ভাবা বিলাসিতা ছাড়া অন্য কিছুই না। তবুও কোনো ভাবেই মন কে বোঝানো গেল না। একসময় বকুল হার মেনে দু’চোখে বর্ষণ নামতে দিলো। নিঃশব্দে, নীরবে, নিজেই নিজের কান্নার সাক্ষী হয়ে কা*টিয়ে দিলো মুহূর্তের পর মুহূর্ত। যখন দু’চোখ ক্লান্ত হয়ে বুঁজে এলো, তখন পূবের আকাশে আলো ফুঁটি ফুঁটি করে।

একটি নতুন সকাল একেক জনের জীবনে একেক রকম নতুনত্ব নিয়ে আবির্ভাব ঘটায়। কারো জন্য নিয়ে আসে হাসি, কারো জন্য কান্না। কেউবা জীবনের এমন সব পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যায়, যেখানে হাসি-কান্না কোনোটাই দেখা দেয় না। এক রাশ নিস্তব্ধতা ঘিরে ধরে মানুষকে। ভালোমন্দ বিচার করার জ্ঞানটুকু লোপ পায়। তথা, মানুষ এক ধরনের ঘোরে চলে যায়।
বলা বাহুল্য, মোরশেদের জীবন থেকে শান্তি নামক শব্দটি দিনকে দিন উঠে যাচ্ছে। শাহজাদি এবং রুনু বেগমের প্রতিদিনকার একই ক্যাচাল, মোরশেদকে স্তব্ধ বানিয়ে দিয়েছে।

তিনি কোন পক্ষে যাবে, কার বিরুদ্ধে কথা বলবে, কাকে বোঝাবে, ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। শাহজাদির হয়ে মা’কে বোঝালেও মনের ভেতর খারাপ লাগা কাজ করে একধরনের। শত হোক, মা তো! আর মা তার ভালো বৈ খারাপ চান না। শাহজাদি সত্যিই গর্ভবতী হওয়ার পর একদম হাত-পা ছেড়ে দিয়ে বসে গেছে। ঘরের কাজ করতে তার দ্বিধা যত, এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতে সমস্যা হয় না। আজ অসময়ে বাড়ি চলে আসায় সে নিজেই এর সাক্ষী হয়েছে। শাহজাদি কোথায় যেন চলে যায়। অনেকক্ষণ পর আসে। কোথায় যায়, জিজ্ঞেস করলে ঠিকঠাক উত্তর দেয় না। এড়িয়ে যায়। তেজ দেখায়।
হঠাৎ শাহজাদি ছনছন মেজাজ নিয়ে মোরশেদের সামনে এসে দাঁড়াল।

“আমারে আমার বাড়িত দিয়া আহেন।”
এমনিতেই মেজাজ ঘেটে আছে। এর উপর শাহজাদির জেদী কথা মাথা বিগড়ে দিলো। মোরশেদ হুট করে এসে খপ করে শাহজাদির চুলের মুঠি চেপে ধরলেন। শাহজাদি আকাশ কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠল।
“ও মা গো…”
মোরশেদ ওর দুই গাল শক্ত হাতে চেপে ধরে শাসানোর ভঙ্গিতে বললেন,
“একদম চুপ। আমার সংসারে আমারেই তেজ দেহাস। খা** মা**! তোরে আর তোর পেটের ডারে আমি মা*ইরা ফালামু।”

শাহজাদি মাথা এদিক ওদিক মুচড়ে নিজেকে মোরশেদের হাত থেকে ছাড়াতে নিতে মোরশেদ ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেন।
“একদম মাথা নিচু কইরা থাকবি। ঠিকমতো কাজ কাম করবি। মায়ের লগে পেদাপেদি করবি না। যদি এভাবে থাকতে পারোস, তাইলে থাক, আর নাইলে যেদিকে দু’চোখ যায়, বাইর হইয়া যা।”

তুষার মিটিমিটি হাসছে। সকাল থেকেই বকুলের পরিবর্তন ওর চোখে পড়েছে। বেচারি গতকাল এতই কষ্ট পেয়েছে যে আজকে ওর মুখ থেকে মেঘের কালো ছায়া সরছেই না। তুষার একবার ডেকে বলেছিল, আমাকে একটু পানি তুলে দাও। উত্তরে বকুল আহ্লাদিকে পাঠিয়ে দিয়েছে। গাঢ় অভিমানে দূরত্ব বজায় রেখে চলছে। তুষার সব বুঝেও না বোঝার ভান করে রইলো। ওকে দেখিয়ে দেখিয়ে আহ্লাদির সঙ্গে বেশ খাতির পূর্ণ আচরণ ও করল। বকুল সরাসরি তাকাল না। তবে আড়চোখে সবটা খেয়াল করল।

আহ্লাদি পানি তুলে দিলো। বকুল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দড়িতে আধভেজা গতকালের কাপড় গুলো মেলছে। তুষার ওকে শুনিয়ে শুনিয়ে আহ্লাদিকে নরম স্বরে বলল,
“কষ্ট দিলাম!”
আহ্লাদি মোমের ন্যায় গলে গেল।
“আরে না, আপনের লিগা এইটুক করতে পাইরা নিজেরে সৌভাগ্যবতী মনে হইতাছে। আপনের আর কুনু কাম আছে? থাকলে কন, আমি কইরা দেই।”
“না, না, আর কিছু করতে হবে না। তুমি ভালো মেয়ে। কত সুন্দর আগ বাড়িয়ে সাহায্য করতে চাইছো। আর কিছু মেয়েরা আছে, তাদেরকে নিজ থেকে বললেও সাহায্য করতে চায় না। অন্যকে পাঠিয়ে দেয়।”
বকুল আড়চোখে তুষারের দিকে তাকাতেই তুষারের চোখে চোখ পড়ল। বকুল থতমত খেয়ে দ্রুত নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিলো।

আহ্লাদি বুঝল, তুষার কাকে বুঝিয়ে কথাটা বলেছে। সে একটু মজাই পেল। তুষারের চোখে সে ভালো মেয়ে- এর চাইতে বড় পাওয়া আপাতত আর কিছু হতেই পারে না। তবুও তুষারের কাছে আরও ভালো সাজতে আহ্লাদি ন্যাকা কণ্ঠে বলে উঠল,
“আমগো বকুলও ভালো মাইয়া। অনেক কাম করতে পারে।”
“কাজ পারলেই সে ভালো মেয়ে হয়ে যায় না আহ্লাদি। ভালো মেয়ে হওয়ার জন্য সুন্দর একটা মন প্রয়োজন।”
“আপনে কি কইতে চান? আমার মন ভালা না? ক্যান, আমি আপনের লগে কোন খারাপি টা করছি?”
আর মুখ বুজে থাকা যাইয় না, ক্ষ্যাপাটে গলায় তাই প্রশ্নের উত্তরটা জানতে চাইলো বকুল। তুষার ভ্রু কুঁচকে বলল,

“মেহমানের সাথে মানুষ এমন ব্যবহার করে?”
বকুল কয়েক কদম এগিয়ে এলো। ওকে দেখে ক্ষেপা বাঘিনীর ন্যায় লাগছে।
“আপনে আমারে নিয়া উলটাপালটা কইতাছেন দেইখা আমি জবাব করলাম। আপনে আমারে নিয়া কইয়েন না। তাইলে আমিও কমু না।”
তুষার বকুলকে আরও ক্ষেপিয়ে তুলতে আহ্লাদিকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল,
“তোমার বোন দেখি চরম ঝগড়াটে! ইশ, তোমার মতো একটু ভালো গুণ যদি তারও থাকত!”
“কি কইলেন? কি কইলেন আপনে..”

বকুল ভ্রু কুঁচকে কাঁদোকাঁদো মুখ করে তাকাল। সত্যিই ওর কান্না পেয়ে যাচ্ছে। একে তো ওর সামনে আরেকজনকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া, তার উপর ওকে খারাপ বলা! খারাপের কি এমন করেছে সে? নাকি গতকাল রাতে ওভাবে হুট করে তার কাছে যাওয়ায় তুষার তাকে খারাপ মেয়ে হিসেবে বিবেচনা করে নিয়েছে? বকুলের চোখ ভরে উঠে।
তুষার হেসে বলে উঠল,
“মেয়েরা এমনই। ঝগড়ায় না পারলে কেঁদে জেতার চেষ্টা করে। আহ্লাদি, তুমিও কি বেহুদাই কান্না করো নাকি?”
আহ্লাদি সঙ্গে সঙ্গে ভাব নিয়ে জবাব দিলো,

“না না, অত আলগা চোখের পানি আমার নাই। আর আমি তো ঝগড়াঝাটির মধ্যেই নাই। আমারে কেউ দুঃখ দিয়া কতা কইলেও আমি চুপচাপ সইরা আসি। কি লাভ আছে কুত্তারে কামড়াইতে যাওয়ার?”
“বাহ, বাহ! চমৎকার চিন্তাভাবনা। আহারে, তোমার বোনের মাথায় যদি এর এক ভাগও থাকতো..”

বকুল আর অপেক্ষা করে না। এক ওই আহ্লাদি, চূড়ান্ত বেয়াদব আর ঝগড়াটে মেয়ে নামে পরিচিত নিজ এলাকায়, সে কিনা এখানে এসে ভোল পাল্টেছে। আর দুই ওই তুষার। বকুল যত ধরনের গালি শিখে এসেছিল মায়ের পেট থেকে, সব গালি বিড়বিড় করে চর্চা করতে লাগল তুষারকে উদ্দেশ্য করে। ভাগ্যিস তুষার শুনছে না। শুনলে নির্ঘাত অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেতো। বকুল ফুলে বোমা হয়ে উঠে। গমগমে কণ্ঠে বলল,
“এই, তোর হেতের কাপড় আছে বালতিতে। আমি পারতাম না। আমি তো খারাপ। আপনে ভালো, আপনেই মেইলা দেন। আমি গেলাম।”

তারপর গটগট পায়ে চলে এলো। হাঁটার গতি এবং মাটিতে পা ফেলার তীব্রতা দেখে তুষার ভেতরে ভেতরে পেট ফেটে ম*রে। এত ক্ষেপেছে পাগলিটা তার! অপরদিকে আহ্লাদি লজ্জায় লাল-নীল-বেগুনি হয়ে উঠে। তুষারের সামনে কীরকম নির্লজ্জের মতো কথাটা বলল ও! জড়সড় হয়ে বালতিতে হাত দিতেই তুষার গম্ভীর কণ্ঠে আদেশ ছোঁড়ে,
“প্রয়োজন নেই। আমার কাপড় আমিই মেলে দিতে পারবো। তুমি যাও।”

ঝরা বকুলের গল্প পর্ব ১৩

“আ…আমি…”
“বললাম তো, যাও!”
আহ্লাদি বেক্কল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এই ভালো এই খারাপ! লোকটার মাথায় কোনো সমস্যা আছে নাকি?

ঝরা বকুলের গল্প পর্ব ১৫