ঝরা বকুলের গল্প পর্ব ১৫

ঝরা বকুলের গল্প পর্ব ১৫
মেহা মেহনাজ

পা দিয়ে পাতা ভরা ঝাপি উলটে ফেলে দিলো ও। রাগে ভেতরটা জ্বলেপুড়ে খাঁক হয়ে যাচ্ছে। লোকটা এমন কেন! কত ভালো আর ভদ্রলোক ভেবেছিল তাকে। কিন্তু শেষে কি বেরোচ্ছে? যেই না আহ্লাদিকে পেয়েছে,ওমনি বকুলের কদর শেষ? ফুরিয়ে গেছে? তাহলে ভালোমতোই ফুরানো উচিত। বকুল দাঁত কিড়মিড় করে ‘শুয়োর’ বলে তুষারের উদ্দেশ্যে গালি ছুঁড়ে দেয়।

তুষার নিজেই নিজের চালে ফেঁসে গেছে। আহ্লাদি ভেবে নিয়েছে, সেও বোধহয় তাকে পছন্দ করে। নাহয় এত গুরুত্ব কেন দিতো? তাই লাজ শরমের মাথা খেয়ে সারাক্ষণ তুষারের আশেপাশে ঘুরঘুর করা শুরু করেছে। প্রথম প্রথম মাথায় কাপড় দিতো না। এখন নতুন বউয়ের মতো ঘোমটা টেনে সামনে আসে। তুষারের গা পিত্তি জ্বলে যায়। না পারছে বলতে আর না পারছে এখন সহ্য করতে। বকুলকে জ্বালাতে গিয়ে নিজেই এ কোন যন্ত্রণায় পড়ল!
তুষার গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আমি একটু একা থাকতে চাই।”
আহ্লাদির কর্ম ব্যস্ত হাতজোড়া ঠাস করে থেমে গেল। সে বিছানার মধ্যিখান থেকে মুখ ঘুরিয়ে তুষারের দিকে দৃষ্টিপাত করে। অবুঝের মতো বলল,
“তো আপনে কি দোকলা আছেন? আপনে আপনার কাম করেন। আমি তো কতা কইতাছি না।”
তুষার বিরক্ত হলো। খানিকটা রাগও লাগল সম্ভবত। এই যুগে এমন বেহায়া আর নির্লজ্জ স্বভাবের মেয়ে সে খুব কমই দেখে আসছে।
তুষার বলল,

“আমি পুরোপুরি একা থাকতে চাচ্ছি। তোমার বিছানা গোছানোর কোনো প্রয়োজন নেই।”
আহ্লাদি তবুও শুনলো না। বালিশের কভার থেকে মিথ্যে ধুলো ঝাড়ার বাহানা করে জবাব দিলো,
“আপনে মেহমান মানুষ। আপনের ঘর থাকবো চকচকা ফকফকা। বকুল তো শরম পায়। তাই এই ঘরে আহে না। আপনে আপনার কাম করেন। আমি গুছাইয়া দিতাছি।”
তুষার দাঁত কিড়মিড় করে বিড়বিড়িয়ে স্বগতোক্তি করে,

“ওর থেকে একটুখানি লজ্জা নিজেও ধার নেও বেয়াদব মেয়ে! মাথায় তো গরুর গোবর থাকলেও সার হতো! সেটাও নেই। একটা মানুষ একাকী ভাবে কেন থাকতে চাচ্ছে, এইটুকু বুঝে আসে না! বলদী…”
“কি হইলো? আপনে ওমন চুপ হইয়া আমার দিকে চাইয়া আছেন কেন?”
তুষার হাল ছেড়ে দিয়ে একটা বেতের মোড়া টেনে বসল।
“কিছু না। দ্রুত নিজের কাজ সেড়ে ফেলো। আমি লিখতে বসব!”
“আপনে সবসময় খালি লেহেন?”
“তো?”

“মাঝে মাঝে আশেপাশেও তাকাইতে হয়। মন দিতে হয়। খালি লিখলেই হইবো?”
আহ্লাদি কোন দিকে তাকানোর কথা, মনোযোগ দেওয়ার কথা বলেছে- তা বুঝতে অসুবিধে হয় না তুষারের। ওর এবার বিক্ষিপ্ত লাগছে। মেয়েটা আচ্ছা রকমের জ্বালাতন শুরু করেছে!
তুষার প্রতিউত্তর করতে যাবে, এমন মুহূর্তে বকুল ঢুকল। তার হাতে অনেক গুলো কাপড়। হাস্যজ্বল মুখে বলল,
“দুলাভাইয়ের কাপড়ডি আইনা দিলাম। নে, গুছাইয়া রাখো।”
তুষার আহাম্মক বনে গেল। হতবিহ্বল কণ্ঠে জানতে চাইলো,

“কীসের দুলাভাই! কে দুলাভাই?”
বকুল ঠোঁটকাটা স্বভাব টাকে নিজের ভেতর খানিকের জন্য রপ্ত করে। নিজেও যেন এহেন প্রশ্নে অবাক হয়েছে- এমন ভাব করে স্পষ্ট উত্তর দেয়,
“ওমা ক্যান! আপনি! আপনি আমার দুলাভাই। আমার বইনের জামাই হইবেন না..”
“মানে কি!”
বকুল মিথ্যে করে ঘুরিয়ে কথাটা বলল,

“ক্যান, ওইদিন না আমারে কইলেন, ও আপনার বিশেষ কেউ! আবার আহ্লাদিও আপনারে পছন্দ করে। তাইলে তো হইলোই। আমার যে কি খুশি লাগতেছে জানেন! কত্তদিন পর একটা বিয়া খামু। আহারে…”
এসবের মাঝখানে আহ্লাদির মন বাক-বাকুম পায়রার মতো নাচতে আরম্ভ করেছে। সে খুশিতে আটখানা। তবে উপর থেকে প্রকাশ করছে না। হাত-পা কাচুমাচু করে বকুলকে মৃদু ধমকের সুরে বলল,
“এই যা…কি কস!”
বকুল থামে না। আজ ওর কথার গাড়ি ব্রেক ফেইল।করেছে।

“তুই লজ্জা পাইস না তো বইন। দুলাভাইয়ের তো জানতে হবে। আমার যে কি খুশি লাগতেছে।”
তারপর তুষারের দিকে তাকিয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে বলল,
“আপনে আমার দুলাভাই হবেন, এইডা ভাবতেই পারি নাই। আহারে! সব আল্লাহর মেহেরবানি। আল্লাহ চাইছেন বলে আপনের লগে সম্পর্কডা পাকাপোক্ত হইলো। দুলাভাই, আমি কিন্তু আপনের একটা মাত্র শালি। শালির লগে সবসময় সম্পর্ক ভালো রাখবেন। আইচ্ছা?”

তুষারের গলা শুকিয়ে কাঠ। গা ঘামছে। বকুলকে দেখে মনে হচ্ছে না ও মজা করছে। যা বলছে সত্যি বলছে। যদি তাই হয়, তাহলে কি জীবনসঙ্গী থেকে ডিমোশন হয়ে ডিরেক্ট দুলাভাই হতে হবে! তাও আবার আহ্লাদির মতো মেয়ের স্বামী? কক্ষনো না। তুষার তড়িৎ বলল,
“তুমি এসব কি বলছো বকুল! মজা করছ?”

“ক্যান দুলাভাই? মজা করমু ক্যান? আপনের লগে আমার দুষ্টামি ফাইজলামির সম্পর্ক ঠিক আছে তয় আমি এক্ষন মজা করতাছি না। সত্যি কইতাছি। আমি তো শাড়ি পইরা উরাধুরা নাচ দিমু ভাবছি। দুলাভাই, আপনে আপনার পরিবারে কবে কইবেন? তাত্তাড়ি বিয়াডা সাইড়া ফেলান। কত্তদিন একটা বিয়া খাই না।”
“তুমি বিয়ে খাও না, বিয়ে খাওয়ার শখ জেগেছে, এই কারণে আমাকে বিয়ে করতে হবে?”
“তা নয়তো কি? আমি আপনার দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র শালি। আমার শখের লিগা হইলেও আপনে দ্রুত বিয়া করবেন আশা রাখি। কি দুলাভাই, করবেন না?”

“জনমের বিয়ে খাওয়াবো তোমায়! পেয়ে নেই একবার বকুল!”
মনে মনে বলে ও। মুখে কোনো জবাব নেই। বকুল এক ভ্রু নাচিয়ে ফের প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,
“ও দুলাভাই, কতা কন না ক্যান? শরম পাইছেন? আহা লোওওও…আমাগো দুলাভাইয়ের কি শরম। ও বইন, তোর চাইয়া হের শরম দেহি বেশি…”

তুষার এবার সত্যিই লজ্জা পেল। বকুলের এত নাটকীয় রূপ ওর আগে দেখা হয়নি। আর না জানা ছিল। আহ্লাদি তখন লজ্জায় ডুবে ম*রে। সে এগিয়ে এসে বকুলের গায়ে মৃদু চাপড় দিয়ে বলে উঠল,
“একটু চুপ থাক বইন। কি কইতাছোস…”
“কি? কি কইতাছি? মিছা কইতাছি হ? তুমি কও, তোমার লগে হের বিয়া হইবো না?”
আহ্লাদি তুষারের দিকে আড়চোখে একবার তাকিয়ে লজ্জায় চোখ ফিরিয়ে নিলো। জবাব দিলো না। তবে তার মৌনতা সম্মতিরই লক্ষণ দেয়।
বকুল বলল,

“আইজ হোক আর কাইল, বিয়া তো হইবোই। আর বিয়া যহনই হোউক, আমার তো তারে দুলাভাই কইয়া ডাক দিতে হইবো। তাইলে এহন হইতে ডাক দিলে সমিস্যা কি? ও দুলাভাই, আপনে আর লজ্জা পাইয়েন না থাউক। আমি যাইতেছি গা।”
“হ চল চল..”
আহ্লাদিও যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে বকুল তাকে থামিয়ে দিলো।

“ওরে তুই কই যাইস? এই কাপড়ডি গুছাইবো কেডা? আম্মায় রান্ধে, বাড়িত কেউ নাই। আমিও কাম করতে যাই। তুই দুলাভাইয়ের লগে থাক। দুলাভাইয়ের কাম কাজ গুছাইয়া দে। তুই সামনে থাকলে হের ভালো লাগবো। মন ভালো থাকলে লেহাও ভালো বাইর হইবো। তুই থাক, আমি যাই।”
তারপর নাটকের মতো করে হাতটা কপালে উঠিয়ে তুষারকে লম্বা সালাম দিলো ও।
“দুলাভাই, আসি…”
বকুল বেরিয়ে গেল। পেছন ঘুরে একবারও তাকাল না। তাকালে ঠিক দেখতে পেতো, তুষার মাথা ঘুরে মোড়া থেকে কাত হয়ে মাটিতে পড়েছে।

বকুল বেরোনোর পর পরই আহ্লাদি বেরিয়ে এলো। তুষারের পাথর মুখখানা ওর মনে অনেক প্রশ্নের ভীড় জমা করেছে। সেসব কাউকে বলতে না পারলে শান্তি মিলবে না। বকুল যাচ্ছিল উঠোনের দিকে। আজ কিছুই ভালো লাগছে না। আরজু সকালে খানিকক্ষণ গজগজ করেছেন বকুল কাজ করছে না বলে। তবুও ও পাত্তা দেয়নি। বাড়িতে মেহমান আছে দেখে আরজুও চুপ করে গেছেন। আজকের রান্নাটাও নিজ দায়িত্বে করছেন। বকুল একবার গিয়ে সবকিছু কেটেকুটে গুছিয়ে দিয়ে এসেছে। আপাতত কাজ নেই। ঘরের দুয়ারে খানিকক্ষণ একলা বসবে- এই পরিকল্পনা।
খপ করে ওর পিঠ একটা হাত ছুঁয়ে গেল। বকুল তাকিয়েই দেখে আহ্লাদি। চোখেমুখে অস্থিরতা।
আহ্লাদি বলল,

“উনি অনেক শরম পাইছেন৷ এমনে কইলি ক্যান?”
বকুলের ভাবলেশহীন জবাব,
“শরম পাইলে আমার কি? আমার যা আইবো মুখ দিয়া, তাই কমু।”
“উনি মনে হয় রাগ হইছেন। কেমন শক্ত হইয়া চাইয়া ছিলেন।”
“হইলে হোক। আমি তো দোষ কিছু বলি নাই। তোর জামাই হইলে আমি তো দুলাভাই কইয়াই ডাক দিমু, নাকি?”
“আগে জামাই হোক, তারপর ডাকিস।”

“তোর তো বিয়া হয় নাই। তাও হের পিছে পিছে ঘুরতেছোস। তাইলে আমি দুলাভাই কইলে সমিস্যা কোতায়?”
“আমি হের পিছে পিছে কই ঘুরলাম?”
“আমার চক্ষু আছে। আমার লগে মিছা কতা কইয়া কদ্দুর যাবি?”
আহ্লাদি প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলে উঠল,
“তুই তারে আর দুলাভাই কইয়া চেতাইস না। উনি পছন্দ করতেছে না হয়তো।”
“ওরে বাবারে! বিয়া না হইতেই এত টান? এত মহব্বত?”
আহ্লাদি মেকী কপাল কুঁচকায়,

“যা তো বকুল! আমার মেজাজখান খারাপ করিয়া না।”
“তোমাগোই যত মেজাজ! লাগে যেন আমার মেজাজ বলতে কিছু নাই!”
আহ্লাদি বকুলের মুখপানে তাকিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করল,
“তোর কি হইছে ক তো! তুই তো এমন চ্যাটাং চ্যাটাং করার মতো মাইয়া না। হঠাৎ এত তেজ দেহাইতাছোস!”
বকুল অল্প একটু হাসে।

“আমারে ভূতে ধরছে। সবকিছু ফালাফালা কইরা দেওনের ভূত। আমি যা দেহি, তাতেই মেজাজ খারাপ হয়। মন চায় সব উল্ডায়ে ফেলি। ধ্বংস কইরা ফেলি। শেষ কইরা ফেলি।”
“বকুল!”
“কি?”
“কি হইছে তোর?”
“চুলকানি উঠছে। সর তো…আমার কতা কইতে ভাল্লাগতেছে না। আর তুই এইনে কি করোস? যাইয়া তোর নাগরের পাশে বইসা থাক।”
আহ্লাদি মুখ ভার করে বলল,

“অনেকক্ষণ ধইরা তোর বাড়াবাড়ি দেখতাছি। তুই আমারে আর তারে নিয়া আর একটা কথাও কবি না।”
বকুল উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল,
“আমি একশোবার করমু। তুই এইহান থেইকা যা।”
“বকুল!”
“যা….”

বকুল রীতিমতো চিৎকার করে ওঠে। আহ্লাদি কেন যেন চুপ হয়ে যায়। তবে অবাক হয়। এই বকুলকে সে পূর্বে দেখেনি। অদ্ভুত আচরণ গতকাল থেকেই করছে। আর এখন যেটা করছে,সেটা কেন করছে,কোনো উত্তর নেই। তবে সবকিছুর পেছনে একটা শক্ত এবং কঠিন কারণ রয়েছে, এইটুকু আহ্লাদির মন বোঝে। শুধুমাত্র মশকরার খাতিরে এতোটা উত্তেজনা বকুলের মধ্যে আসেনি!
ওদের দু’জনের কথোপকথনের স্বাক্ষী হলো আরও একজন মানুষ। পেছনের ঘরে দাঁড়িয়ে আড়াল থেকে সবটা লক্ষ্য করে কাঙ্ক্ষিত উত্তরটি পেয়ে গেল সে। অলক্ষ্যে তার ঠোঁট চিঁড়ে হাসি ফুঁটে ওঠে।

সন্ধ্যা গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসছে। পশ্চিম আকাশে লালীমা ঘষা। শীত গায়ে লাগতে শুরু করেছে। এখন পৌষের শেষ প্রায়। মাঘটা কাটবে অলসতায়। তারপর থেকে রঙিন বিকেলের শুরু।
বকুল কলপাড়ে বালতি ভরে ভরে পানি তুলে রেখেছে সবার ব্যবহারের জন্য। বারবার পুকুরে নামা যায় না। বিশেষ করে রাতে তো একদমই না। কলটাতেও কি যে সমস্যা হয়েছে। পানি উঠছে না। তাই সবার কথা চিন্তা করে, বিশেষ করে তুষারের কথা চিন্তা করেই সে বেশ কয়েক বালতি পানি ভরে রাখল। তুষারকে আর ডাকাডাকি করতে হবে না। নিজেই পানি নিয়ে ব্যবহার করতে পারবে।

তারপর নিজে নামলো পুকুরে। গা ভেজাতে।
কয়েক কদম নামতেই পানি কোমর ছোঁয়। বকুল শিরশির করে কেঁপে ওঠে। আজ এতোটাই মরা দিন ছিল যে সময়ের গোসলটাও অবেলায় এসে করতে হচ্ছে। কেমন একটা মন খারাপের দিন ছিল। সেই যে মেজাজটা ঘেটেছে, এখন অবধি ঠিক হয়নি।

ওই সময়ের পর তুষারের সাথে বিশেষ কথা হয়নি। তুষার ঘরের দরজা আঁটকে ঘন্টার পর ঘন্টা পার করেছে। খাওয়ার সময় বেরিয়েছিল। বকুল সবার সামনেই বার দুয়েক দুলাভাই দুলাভাই করে ডেকে উঠলেও তার তরফ থেকে কোনো প্রকার সাড়াশব্দ না পেয়ে শেষমেশ সে নিজেই চুপটি মেরে গেছে। অপরদিকে নাকে মুখে গিলেই ঘরে গিয়ে ফের দুয়ার দিয়েছে তুষার। বকুলের অস্থির লাগলেও প্রকাশ করল না। নিজের মতো স্বাভাবিক রইলো।
দু’হাত দু’দিকে ছড়িয়ে জলকেলি করতে লাগল বকুল। বাড়িতে কেউ নেই। আরজু আর আহ্লাদি, আকাশকে সাথে করে কোথাও একটা বেরিয়েছে। সবুজ খেলা থেকে এখনো ফেরেনি। মকবুলও ফেরেননি। বাড়িতে বকুল এবং ঘরে পড়ে থাকা তুষার।

হঠাৎ কারো উপস্থিতি টের পেয়ে বকুল একটুর জন্য থমকালো। পেছন ঘুরে যাকে সন্দেহ করেছিল, তাকেই দেখতে পেয়ে মুখ দিয়ে বিরক্তির চ কারান্ত শব্দ বেরিয়ে আসে। পুনরায় নিজ মনে জলকেলি করতে লাগল। যেন কেউ আসেনি। পেছনে তুষার দাঁড়িয়ে নেই।
তুষার সময় নষ্ট করল না। আরও একবার মনে মনে কথাগুলো গুছিয়ে নিলো। পৌষের শেষ বেলার শরীর জাঁকানো শীতেও সে ঘামছে।
ভণিতা ছাড়া সরাসরি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,
“আমি তোমার দুলাভাই?”
বকুল তাকালোই না। যেন শুনতেই পায়নি। তার মতো করে কুলকুচিতে ব্যস্ত।
তুষার ফের বলল,

“কী হলো? শুনতে পাওনি? কি বললাম?”
বকুল তাকাল। যেন এই এতক্ষণ পর তুষারকে ও দেখেছে। অবাক হওয়ার ছোট্ট অভিনয়টা বেশ দারুণ করল ও।
“আরে দুলাভাই! আপনে এইনে? পা ধুইতে আইছেন? ওই যে পানি উডাইয়া রাখছি। ধুইয়া ঘরে যান। সন্ধ্যা হইছে।”
তুষার রাগ নিয়েই বলল এবার,
“বকুল, তোমার মুখ থেকে বার বার দুলাভাই শব্দটা শুনতে আমার ভালো লাগছে না। দয়া করে, আর ওই শব্দটা উচ্চারণ করবে না আমার জন্যে!”
“ক্যান? বইনের জামাইরে দুলাভাই কমু না তো কি কমু?”
“আমি তোমার বোনের জামাই নই!”

“হইবেন তো। আগেও যা, পরেও তা। পরে তো কইতেই হইবো। তাই আগে থাকতেই কইয়া কইয়া অভ্যাস করতাছি।”
“আমি কখনোই তোমার বোনের জামাই হবো না বকুল। ওর সাথে আমার কিচ্ছু নেই। আর হওয়ার সম্ভাবনাও নেই।”
“হেইডা আমারে শুনাইতে আইছেন ক্যান? আমার বইন তো আপনেরে ধ্যান দুনিয়া সব দিয়া দিছে। তার লগে বোঝাপড়া করেন। আমার সাথে এসব বিষয়ে কতা কইলে কুনু কাম অইবো না।”

“তুমি উপরে উঠে এসো। অনেকক্ষণ যাবত পানিতে..”
“আপনে যান। আমার সময় লাগব।”
“বকুল, ঠান্ডা লেগে যাবে।”
“লাগুক।”
“বকুল!”
বকুল তুষারের দিকে তাকাল। ওর দু’চোখ লাল হয়ে গেছে। গতকালের হওয়া নীল কুঁকড়ে দেওয়া ব্যথাটা আবার বুকের ভেতর অনুভূত হচ্ছে।
বকুল নিস্তরঙ্গ কণ্ঠে বলল,

“আমারে এমনে ডাকবেন না।”
“ডাকলে?”
“মানা করছি। ডাকবেন না।”
“আমিও তো মানা করেছি। শুনছো কই?”
বকুল সে কথার জবাব না দিয়ে প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে ফেলল।
“আপনে যান। কেউ দেখলে…”
ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে তুষার বলল,

“যার যা ভাবার, ভাবুক বকুল। তুমি শুধু এইটুকু ভাবো যে একটা মানুষ কেন তোমাকে দেখলেই অস্থিরতা বোধ করে। একটা মানুষ কেন তোমার আশেপাশে থাকলে নিজেকে সবচেয়ে বেশি সুখী অনুভব করে? একটা মানুষ যে কিনা ভূতের সিনেমার ডায়লগ লিখতে এসেছিল, সে খাতা খুললেই ভালোবাসার কথা গড়গড় করে লিখে ফেলছে। এমন কেন হচ্ছে, তুমি কি ভেবে বের করতে পারো?”

বকুল চট জলদি অন্যদিকে ঘুরে গেল। ও দাঁড়িয়ে আছে, পুকুরের ভেতর, পুরো শরীর ভেজা, সন্ধ্যে হয়ে গেছে। বড়জোর মিনিট সাতেক দিনের আলো থাকবে। চারিদিকে অন্ধকার বাড়ছে। পৌষের হাড় কাঁপানো ঠান্ডা। বরফের মতো পুকুরের পানি। তবুও বকুলের কান দিয়ে গরম ধোয়া বের হতে শুরু করেছে। ও ঠিক বুঝে উঠতে পারল না, ঠিক শুনলো নাকি ভুল! তুষার এইসব কথার মাধ্যমে কি বুঝাতে চাইছে?
তুষার থেমে নেই। বলে চলে আপন মনে।

“বকুল, তোমার মনে অনেক প্রশ্ন এসে জড়ো হচ্ছে আমি জানি। এটা স্বাভাবিক। হয়তো এমনটাও ভাবছো, তুমি কোথায় আর আমি কোথায়! তার উপর তুমি বিবাহিত ছিলে আর আমি…
এক কথায়, আমরা দু’জন একে অপরের সম্পূর্ণ বিপরীত। তারপরও আমি তোমার প্রতি…
বকুল, দয়া করে আমার কথাগুলো অবজ্ঞা করো না। আমি সত্যি বলছি। শুধু হৃদয়ে জমে থাকা কথাগুলো বলে দিচ্ছি। আমি ভণিতা পছন্দ করি না। আর যদি বলি, তুমিও আমাকে কোথাও না কোথাও পছন্দ করো, তাহলে ভুল বলা হবে না। যদি কিছুই না থাকত আমার প্রতি, তবে আহ্লাদির সঙ্গে ব্যাপার জড়িয়ে এতোটা উত্তেজিত হয়ে পড়তে না। আমি সব বুঝি বকুল। হাওয়া খেয়ে বড় হইনি! বকুল শোনো…একটু এদিকে তাকাও!”

বকুল মাথা নাড়ালো। জবাবে কিচ্ছুটি নেই ওর মুখে। তুষার আকুতির সুরে বলল,
“তুমি ভাবো। ভাবার জন্য যত সময় লাগে নাও। আমি তোমাকে স্বাধীন পাখি করে ছেড়ে দিয়েছি। যদি আকাশটা আমার হয়, তাহলে ফিরবেই আমার খাঁচায়! আমি অপেক্ষা করতে জানি।”

ঝরা বকুলের গল্প পর্ব ১৪

থামলো ও। আর কিছু বলার নেই আবার অনেক কিছু বলার আছে। সব কথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। কীভাবে নিজের ভালোবাসাটা প্রকাশ করতে হবে সে বুঝে উঠতে পারছে না। অথচ ওর লেখা ডায়লগ কত প্রেমের সিনেমায় ব্যবহার হয়েছে। আজ কবি নিরব, কবির শব্দ ভান্ডারে শব্দ জমা নেই। তবে কি ভেঙেচুরে ভালোবাসা গুলো এমনই হয়? মানুষকে উন্মাদ আবার একই সাথে শান্ত করে তোলে। মানুষকে অস্থির আবার একই সাথে স্থির করে ফেলে? মানুষের হৃদয়ে কথার মেলারা হৈহল্লা করে ছুটে চললেও ঠোঁট চিঁড়ে বেরোয় না একটি শব্দও! ভালোবাসা- তুমি এক সাংঘাতিক জিনিস!

ঝরা বকুলের গল্প পর্ব ১৬