ঝরা বকুলের গল্প পর্ব ১৬

ঝরা বকুলের গল্প পর্ব ১৬
মেহা মেহনাজ

“আমি চলে যাচ্ছি। তুমি উপরে উঠে এসো!”
তবুও নিশ্চুপ রইলো মেয়েটা। নড়লো না এক ইঞ্চিও। তুষার ওর দিকে সেকেন্ড কতক চেয়ে থেকে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। ক্ষনকাল পর আর কারো কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। বকুল পেছন ঘুরে তাকাল। তুষার নেই। সশব্দে বুক চিঁড়ে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। মুখটা চিটচিট করছে। ওখানে গোসলের পানি নাকি উত্তেজনার ঘাম- কে জানে! আর ভালো লাগে না কিছু। দূর আকাশে মাগরিবের আযান প্রতিধ্বনিত হয়। বকুল চট জলদি পুকুর থেকে উঠে পড়ল। শরীরটা অসাড় বোধ করছে ও। তুষারের বলা প্রত্যেকটি কথা কানে বেজে চলে।

ঘরে এসে নড়বড়ে চৌকির উপর ঝিম মে*রে বসে রইল বকুল। মনের ভেতর হাজারটা প্রশ্ন, মগজ কিলবিল করছে নানান চিন্তায়। এত বিক্ষিপ্ত মন আর মেজাজ পূর্বে হয়নি। মানুষটা কেমন করে ওর মনের খবর টের পেয়ে গেল?
হ্যাঁ, পছন্দ করে, ওই মানুষটাকে ভীষণ পছন্দ করে ও। ‘ভেঙেচুরে ভালোবাসা’ কি জিনিস, ওর জানা নেই। কোনোদিন কাউকে ভালোবাসার মতো সাহস ওর হয়ে ওঠেনি।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

গরীব ঘরের গরীব আর ভীষণ অভাগী মেয়েটা অল্পতেই সন্তুষ্ট থেকে এসেছে সবসময়। কেউ ওকে বিয়ে করে সংসার জীবন দান করবে- এমনটা ভাবতেই বুক কাঁপতো ওর। সেখানে কেউ ভালোবাসবে! এভাবে আকুতিপূর্ণ গলায় ভালোবাসার কথা বলবে! অবিশ্বাস্য ব্যাপার। মানুষের জীবনে হুট করে অবিশ্বাস্য কোনো ঘটনা ঘটলে সে যেমন স্থির হয়ে যায়, চমকে যায়, বাকহারা হয়ে পড়ে- বকুলের অবস্থা ঠিক সেরকম। ও স্তব্ধ হয়ে গেছে। থেমে থেমে বারবার তুষারের কথাগুলো কানে বাজছে। বকুল দু’দিকে মাথা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। নিজেই যেন নিজেকে বোঝানোর জন্য বলল,

“উনারে ভূতে পাইছে। কিয়ের লগে কি! না না, এইটা কক্ষনো হইতেই পারে না। বকুল- তুই ভুলেও পা বাড়াবি না। সে এই বাড়ির মেহমান। আইছে বেড়াইতে, যতদিন থাকার থাকুক, তারপর যাইবো গা। তুই শুধু নিজেরে সামলায়ে রাখবি। তার কথায় একদম গইলা যাবি না। মনে রাখবি, সূর্যের দিকে একনজর তাকানো গেলেও তার কাছে যাওয়া যায় না। পুইড়া যাওন লাগে। আর সে ওই সূর্যের মতো। তারে পাওনের কথা ভাবাও দুঃসাহস রে বকুল!”

দুই চোখে অবাধে জল জড়ো হয়। কাঁদবে না কাঁদবে না করেও মেয়েটা কেঁদে ফেলে হু হু করে। ওর চোখেমুখে স্নিগ্ধ বাতাস ছুঁয়ে যায়। মানুষটাকে হৃদয় থেকে অনুভব করে ও। কিন্তু… সব কিছুই এতো এলোমেলো যে গোছানোর ক্ষমতা নেই। তাই যে ভালোবাসা ভালোবাসা করে সে ম*রে এসেছে এতকাল যাবত, সেই ভালোবাসা আজ চোখের সামনে, হাতের এত কাছে, তবুও হাত গুটিয়ে নিজের হৃদয়ে সব কবর দিতে হবে ওর। নিয়তি- তুমি আরেক ভয়ংকর জিনিস! যাকে দাও, সবটা দাও। যাকে দাও না, তাকে কোনো কিছু আঁকড়ে ধরার সাহসটুকুও দাও না! এ কেমন অবিচার তোমার?

বোকামি হয়ে গেল। এবার হয়তো স্বাভাবিক সম্পর্কটাও নষ্ট হয়ে যাবে। কেন যে আগ বাড়িয়ে কথাগুলো বলতে গেল ও! নাহ…বকুলের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেবে। নিজের ভালোলাগা, ভালোবাসার দহনটুকু নিজের ভেতরই চেপে রাখা ভালো। যে ক’টাদিন আছে, অন্তত সেই ক’টাদিন মেয়েটা কথা তো বলতো। এখন বোধহয় সেইটুকুও ভাগ্যে জুটবে না। তুষারের নিজের প্রতি রাগ লাগে। কেন যে সে ভালোবাসা কথাগুলো বলতে গেল এভাবে। উচিৎ ছিল আরো অনেকক্ষণ সময় নেওয়া। বড্ড তাড়াহুড়ো স্বভাবের ও! তুষারের মা ঠিক বলতেন। উনার ছেলেটা অস্থির প্রকৃতির। যা প্রয়োজন তা খুব দ্রুতই চাই। একটুখানি দেরি সহ্য হয় না। এটা তাড়াহুড়ো স্বভাবের কারণে অনেক কিছু হারিয়েছে জীবনে। এবারও না হারাতে হয় বকুলকে!

তুষার দীর্ঘশ্বাস ফেলে। রাতের ঝিকিরা ডাকছে। তুষার বিছানার উপর শুয়ে, দুহাত মাথার নিচে দেওয়া। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলল, যেটা হয়ে গেছে সেটা শুধরানোর আর পথ নেই। তবে ক্ষমা চাওয়া যেতে পারে। ক্ষমা মহৎ গুণ। ঠিকঠাক ভাবে ক্ষমা টা চাইলে, বকুল ঠিকঠিক ক্ষমা করে দেবে। ভালোবাসা না পাক, বকুলের বন্ধুত্বটা ওর চাই। আর কোন তাড়াহুড়ো নয়। বন্ধুত্বের সম্পর্ক হোক ধীর-স্থিরভাবে, টিকে থাকুক আজীবন।

রাতে মুড়ি মাখা হলো। পেয়াজ, রসুন, আর কাচা মরিচ দিয়ে, সাথে খাঁটি সরিষার তেল। মুড়ি মাখানো খাওয়ার সময় গল্প হলো অনেক। আজ সবাই আছে। মকবুল, আরজু, আকাশ, সবুজ, বকুল, আহ্লাদি এবং তুষার। সবাই রাজ্যের সব জিনিসপত্র নিয়ে কথা ছুঁড়ে দিলেও বকুল এবং তুষার চুপচাপ। ওদের দুজনের যেন কোনো কথা নেই, ভাষা নেই। শব্দভাণ্ডার খালি।

একবার তুষার বকুলের দিকে তাকায়, একবার বকুল তুষারের দিকে তাকায়। তারপর দুজনের চোখাচোখি হলে চোখ সরিয়ে অন্যদিকে দৃষ্টিপাত করে। যেন লুকোচুরি চলছে। একজনের কাছ থেকে আরেকজনের পালিয়ে বেড়ানোর খেলা। তুষারের অস্থিরতা বাড়ে। আরো একবার মনে মনে নিজেকে অভিশাপ দিলো ও। কেন যে নিজ হাতে গলা টিপে মেরে ফেলল ওর আর বকুলের সম্পর্কটা! চাইলেও মেয়েটার স্বাভাবিক হবে না হয়তো। হয়তো স্বাভাবিক হলেও একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় থাকবে দুজনার ভেতর। এমন দূরত্ব কি আদৌ কোনদিন চেয়েছিল তুষার? ও তো চেয়েছিল আরো কাছে আসতে!
মকবুল বললেন,

“আমগো গেরামডা তোমার কেমুন লাগতাছে বাবাজি?”
তুষার খেতে খেতে জবাবে ছোট করে বলল,
“ভালো।”
“তোমার কাজ কাম কেমুন চলে?”
তুষার উত্তর দিতে যাবে, মাঝ দিয়ে ফট করে আগ বাড়িয়ে আহ্লাদি মুখ ঢোকালো,
“হারাদিন তো কলম খাতা লইয়াই পইড়া থাহে। কি যে এত লেহে!”

ওর বলার ধরনটা মোটেও পছন্দ হয় না তুষারের নিকট। লিখালিখি একটা শ্রদ্ধার জিনিস। এটি একটি শিল্প। শিল্পকে ছোট করা নিকৃষ্ট ব্যাপার গুলোর ভেতর একটি। যে মানুষ শিল্প এবং শিল্পীর কদর করতে জানে না, সে মানুষ হিসেবে একটি বড় গুণ হারালো!
তুষার গলায় খানিকটা কাঠিন্য যুক্ত করে বলল,

“দেখো আহ্লাদি, আমার লেখালেখিকে তুমি বুঝবে না। যেটা বোঝো না সেটা নিয়ে কথাও বলতে এসো না। লেখালেখি একটা শিল্প। চাইলেই যে কেউ লিখতে পারে না। মনের ভাব কালো অক্ষরে রূপান্তর করা বড় কঠিন কাজ!”
আহ্লাদির গায়ে লাগল। তার মনে হলো, তুষার তাকে ছোট করে কথা বলেছে। উপরন্তু আরও ভাবল, তুষার আর তার সম্পর্কটা যেহেতু এখন অন্যরকম, তাই চাইলেই তার উপর অধিকার খাটিয়ে অভিমান দেখানো যায়! তাই অভিমানী সুরে ও বলল,

“কি এমন কইলাম? কত্তডি কতা শুনায়ে দিলেন!”
“আমি বরাবরই দেখে আসছি তুমি আমার লেখালেখি নিয়ে কথা বলো। আমি যেন আর না দেখি।”
আহ্লাদি ভোঁতা মুখে বলল,
“হুম।”

আরজু চোখ ইশারায় মকবুলকে কিছু একটা ইশারা করলেন। মকবুল বুঝলেন না। আরজু পুনরায় তাকে ইশারায় বোঝালেন উঠে আসার জন্য। মকবুল থালায় হাত ধুয়ে বউয়ের পেছন পেছন উঠে চলে গেল। তুষারও হাত ধুলো। খাওয়ার ইচ্ছেটা ম*রে গেছে। আহ্লাদি হৈ হৈ করে উঠে,
“আরে আরে আপনে কই যান! এতগুলা খাওন খাইবো কে?”
তুষার বিরক্তির সুরে বলল,

“তুমি খাও।”
“আমি একলা এত খাইতে পারুম না। আপনে বসেন। গল্প করতে করতে খাই।”
“ইচ্ছে নেই।”
“আরে বসেন না…”
আহ্লাদি জোর করল। তুষারের এমনিতেই মন ভালো নেই, মেয়েটার অহেতুক জ্বালাতন ওকে আরও অতিষ্ঠ করে তোলে। ও রেগে বলল,

“আহ্লাদি, তুমি সবসময় এত অধিকার খাটাও কেন আমার উপর? তুমি কি বোঝো না আমি বিরক্ত হই?”
আহ্লাদি হতবাক হয়ে গেল। হতবিহ্বল হলো বকুলও। ও তুষারের দিকে অবাক নয়নে তাকাল। আহ্লাদি বলল,
“আপনে বিরক্ত হন?”
“হ্যাঁ! হই! প্রচুর প্রচুর প্রচুর বিরক্ত হই। তোমাকে কে কি বলেছে আমি জানি না। শোনো, আজ সরাসরি বলছি। আমার তোমাকে বিশেষ ভাবে পছন্দ নয়। আমি তোমাকে সাধারণ হিসেবে দেখি। তোমার সাথে আমার কোনো কিছু হওয়া সম্ভব নয়। এটা মাথায় ঢুকিয়ে নাও। যতদিন আমি আছি বা তুমি আছো, বকুল যেভাবে থাকে, ওভাবেই থাকো। এর বেশি আহ্লাদ দেখাতে আসবে না। আমি অপছন্দ করি।”

কথাগুলো ছুঁড়ে দিয়ে বাকি দু’জন কে হতভম্ব রূপে ফেলে রেখে তুষার গটগটিয়ে চলে গেল। বকুল আহ্লাদির দিকে তাকিয়ে দেখে, আহ্লাদির দু’চোখে পানি ছলছল করছে।

সে রাতে তিনজনের ঘুম হয় না। আহ্লাদি জেগে, বকুল জেগে, তুষার ও নিজ ঘরে জেগে। এ যেন ত্রিভুজ প্রেম। একজন আরেকজনের বিরহে জ্বলেপুড়ে খাঁক হয়ে যাচ্ছে। অথচ কেউ কাউকে নিজ মনে চলা কথাগুলো স্পষ্ট ভাষায় প্রকাশ করতে পারছে না।
আহ্লাদি নড়েচড়ে উঠে বসল। বিষন্ন কণ্ঠে বলল,
“একটু পানি খাওয়াবি?”
বকুল অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠল।
“আইতাছি।”

ঘরে পানি রাখা হয় না। খেতে হলে খাওয়ার ঘরে গিয়ে খেয়ে আসতে হবে। আহ্লাদির যেহেতু মনটা খারাপ, তাই তাকে আর ঘাটালো না। নিজেই অন্ধকারে বেরিয়ে গেল। দুটো ঘরের পর তুষারের ঘর আর খাওয়ার ঘর। ও ঘর দুটো পাশাপাশি। তুষারের ঘরটা আগে, তারপর খাওয়ার ঘর। বকুল একবার ভাবল, ভেতরে উঁকি দেবে। কিন্তু ঘরের ভেতর আজ কোনো আলো দেখা গেল না। তুষার এত তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছে দেখে খানিকটা অবাক হলো ও। বুকের পাজরে কেমন অশান্তি অনুভব করে। তবুও অনুভূতিটাকে পাত্তা না দিয়ে তুষারের ঘরটা অতিক্রম করার জন্য যেই না পা বাড়িয়েছে, ওমনি হাট করে খুলে গেল দরজাটা। অন্ধকারে এক মানব ছায়া বেরিয়ে এসে প্রায় চিলের মতো ছো মে*রে ভেতরে ঢুকিয়ে দরজাটা আঁটকে দিলো মাত্র তিন সেকেন্ডের ব্যবধানে।

বকুল হা করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। বড্ড হাপাচ্ছে। ভয় পেয়ে গেছে ভেতরে ভেতরে। ডাগর ডাগর চোখ দুটি মেলে ওর চেয়ে একটু দূরত্বে দাঁড়ানো মানুষটিকে অবাক নয়নে দেখে। তুষার বোঝে, হাতে সময় কম। তাই দ্রুত হাত দুটি জোড় করে ধরে বলল,
“আমি দুঃখীত সে সময়ের জন্য। রেগে থেকো না। অন্তত বন্ধুত্বটা থাকুক বকুল।”
বকুলের বুক উঠানামা করে দ্রুত। শ্বাস ঘন চলছে। ও হাপানো কণ্ঠে উত্তর দিলো,
“আপনে পাগল!”

“হ্যাঁ পাগল। উন্মাদ হয়ে গেছি। কি থেকে কি করছি, নিজেও বুঝতে পারছি না। পাগলের কথা তো ধরতে নেই। আমার কথাও ধরো না। শুধু এইটুকু বলো, আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করবে না তুমি!”
বকুল আশ্বস্ত করে,
“কতা কওয়া বন্ধ করমু ক্যান? কতা কমু।”
“ক্ষমা করে দিও।”
“ভুল তো করেন নাই!”

“তার মানে তোমাকে ভালোবেসে ভুল করিনি?”
বকুল এ কথার জবাব দিলো না। উলটো ঘুরে দাঁড়াল।
“আমার যাইতে হবে। আহ্লাদি জাগনা।”
“ও ঠাডা পড়ে পিছলে যাক, আমার দেখার বিষয় না! তুমি আমার কথা শুনে যাও বকুল।”
“কি?”

ঝরা বকুলের গল্প পর্ব ১৫

“আমাকে… আমাকে কখনো ভুলে যেয়ো না!”
বকুল মৃদু হাসে, একটা নাই নাই হাসি। অন্ধকারে সে হাসি তুষারের দৃষ্টিতে পড়ল না। যে মানুষটা হৃদয়ের এত কাছাকাছি, সেই মানুষটাকে নাকি ভুলে যাওয়া যায়! আহারে…বোকা মানুষটা!

ঝরা বকুলের গল্প পর্ব ১৭