ঝরা বকুলের গল্প পর্ব ১৭

ঝরা বকুলের গল্প পর্ব ১৭
মেহা মেহনাজ

প্রেম এবং ভালোবাসা- দুটি দু মেরুর জিনিস। প্রেম এবং ভালোবাসা কখনোই এক নয়। প্রেম কাব্যতেও হয়, কারো হাসিতেও হয়, কারো চোখ দেখেও প্রেমে পড়া যায়। কিন্তু ভালোবাসা হয় একান্ত মানুষটাকে ঘিরে! মানুষটার সবকিছুতে ভালোবাসার অনুভূতি থাকে। মানুষটার কথায়-কাজে মনের মাঝে এক অন্যরকমের প্রশান্তি এনে দেয়। মানুষটার বাজে অভ্যাস গুলোও তখন ভালো লাগতে শুরু করে। অপছন্দের জিনিস গুলো পছন্দের হতে শুরু করে। প্রেমকে ভুলে থাকা যায়, ভুলেও যাওয়া যায়। কিন্তু ভালোবাসা- ভোলা না এত সহজ, আর না এত ঠুনকো এই অনুভূতির তীব্রতা!

কাব্যিক মন হয়ে তুষারের হয়েছে যত জ্বালা। সবকিছুতেই আপনা আপনি কাব্য রচনা হয়। এই যে বকুল, কোনো উত্তর না দিয়েই পালিয়ে গেল, এতেও বেহায়া মন কাব্য লিখতে শুরু করল। তুষার মোটা কাঁথা গায়ে দিয়ে আধ শোয়া হয়ে কাঠের জানালার বাইরের ঘুটঘুটে অন্ধকার পানে তাকাল। বুকের ভিতর তীব্র হাহাকার, শূন্যতা। সে আপন মনেই স্বগতোক্তি করে উঠল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ওরে প্রকৃতি, যে শুষ্কতার হাহাকারে তুমি রুগ্ন, তারচেয়েও বেশি রুক্ষতা ধরেছে আমার হৃদয়ের দরজায়। গোপন কুঠুরিটা তালা মে*রে দিয়েছি। আজকের পর বসন্তের হাওয়ার মন বাড়িতে প্রবেশ নিষেধ নিষেধ নিষেধ! ওহে প্রকৃতি, আমার নিস্তব্ধতার আর্ত চিৎকার কি তুমি শুনতে পাচ্ছো?”

ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজে দরজাটা খুলে গেল। শাহজাদি দাঁত দিয়ে জিভ কামড়ে ধরে। ভয়ে ভয়ে পেছন এবং আশেপাশে সাবধানের সহিত দেখল। না, কেউ টের পায়নি কিছু। শাহজাদি পা টিপে টিপে ঘরের ভেতর ঢুকল। পুনরায় ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজে দরজাটা বন্ধ হলো। এরপর সব নিস্তব্ধ।

শাহজাদী দম আটকে দাঁড়িয়ে রইল বেশ কয়েক মিনিট। এই ঘরটা মোরশেদের বাড়ি একেবারেই কোণায় অবস্থিত। সব সময় খালি পড়ে থাকে। এই ঘরে দুটো জানালা। একটি জানালা খুললে আম, কাঁঠাল এবং তেতুলের ঝাড় চোখে পড়ে। আরেকটি জানালা খুলে চোখে পড়ে পাশাপাশি তিনটি কবর। কবর তিনটির একটি মোরশেদের বাবার, বাকি দুইটি দাদা-দাদীর। বলা যায় ছোটখাটো পারিবারিক কবরস্থান। শাহজাদি এই কয়েকদিন বাড়ির আনাচে কানাচে ঘুরে এই রুমটি বেছে নিয়েছে তার পিচাশ কর্মের জন্য।

কিন্তু এই মুহূর্তে সে ভয় পাচ্ছে। যে কাজ করতে চলেছে তা এর আগেও তিন বার করেছে। তবে তখন একা ছিল না। তার সঙ্গে অন্যরা ছিল। আজ সে একা। যা করতে হবে, একেবারেই একা হাতে করতে হবে। আরেক বার অন্ধকার ঘরটায় চোখ ঘুরালো। শাহজাদি ঘাবড়ে যাচ্ছে। সে চোখ বন্ধ করে বুক ভরে শ্বাস টেনে নিলো। তারপর এগিয়ে চললো জানালার দিকে। যেটি দিয়ে আম-কাঁঠালের গাছ চোখে পড়ে, সেই জানালাটি খুলে ওখানেই বসে পড়ল ও।

বুক দুরুদুরু করছে। কিন্তু সাহস হারালে চলবে না। রাতের মধ্যভাগ চলছে। প্রহর শেষ হওয়ার আগেই ওর কার্য সম্পাদন করা খুব জরুরি। একটা কাপড়ের থলেতে প্রয়োজনীয় সব নিয়েই এসেছে। এই কয়দিন যাবত এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে সবকিছু জোগাড় করেছে সে। দু’দিন আগে কবর খুঁড়ে মানুষের মাথার কঙ্কাল বের করে আনতে গিয়ে প্রায় জানটাই বের হয়ে যাচ্ছিল ওর। কত কষ্ট করে এই জিনিস জোগাড় করেছে, তা শুধুমাত্র ও-ই জানে।

থলে থেকে আলগোছে জিনিসটা বের করে নিলো। দু’হাতের আঁজলায় কঙ্কালটা ধরে মাথার উপর নমস্কারের ভঙ্গি করে উঁচু করে। তারপর মুখ দিয়ে বিড়বিড় করে শয়তানের প্রশংসা এবং শুকরিয়া আদায় করতে করতে কঙ্কালটি মাটির উপর রাখল। যেখানে রাখল তার চারপাশে গোল দাগ টেনে মধ্যে তারা আঁকলো। পাঁচটি তারায় পাঁচ ধরনের জিনিস রাখল। সব গুলোয় প্রাণীর শরীরের বিভিন্ন অংশবিশেষ। প্রায় রাতে মোরশেদকে কাঠবাদামের দুধ খাইয়ে গভীর ঘুমে নিমজ্জিত রাখত ও।

কেননা কাঠবাদামে থাকে ম্যাগনেশিয়াম এবং ট্রিপটোফ্যান- যা মানুষের স্নায়ুপেশী শিথিল করে ঘুম গভীর এবং দীর্ঘ করে। মোরশেদ ঘুমিয়ে গেলে চুপিচুপি ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ত ও। ফিরতো ফজরের আগে আগে। রুনু বেগম দেখে ফেলেছিলেন একদিন। কোনো ভাবে কথা ঘুরিয়ে বেঁচে ছিল সে-বারে। মধ্য রাতে এর কবর ওর কবর ঘুরে ঘুরে এই জিনিসগুলো উদ্ধার করতে হয়েছে ওর। থলে থেকে কালচে শুকিয়ে যাওয়া মানুষের কলিজাটা বের করতে গিয়ে ওর একবার হাত কাঁপল। তীব্র শীতের রাতেও ও হু হু করে ঘেমে উঠল। কলিজাটা তারার শেষ ভাগে রেখে আরও একবার সব ঠিকঠাক ভাবে গোছানো হলো কি-না, তা দেখে নিলো ও।

এরপর শুরু হলো যজ্ঞ। দু’হাত জোড় করে নমস্কারের ভঙ্গিতে আসন পেতে বসে বিড়বিড় করে মন্ত্রপাঠ করতে লাগল। দশ মিনিট, বিশ মিনিট, তিরিশ মিনিট। হঠাৎ হাওয়ার গতি বাড়ে। শাহজাদি কেঁপে ওঠে তবে মন্ত্রপাঠ থামাল না। দু’হাত আরও শক্ত করে জোর দিয়ে ধরল। ঠোঁটের বিড়বিড়ানি বেড়ে চলে। বাহিরে ততক্ষণে হাওয়ার তেজ দ্বিগুণ হয়ে উঠেছে। শান্ত প্রকৃতি হঠাৎ করে ঝড়ের রূপ ধারণ করে।

শাহজাদি বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে ওর মন্ত্রপাঠ বাড়িয়ে যায়। কে*টে যায় চল্লিশ মিনিট। একটা বড় বাতাসের ঝাপটা চোখেমুখে আঁছড়ে পড়তেই শাহজাদি চোখ মেলে তাকাল। ডান পাশ থেকে বের করে রাখা চা*কুটা এবার তুলে নিলো। চোখের পলকে বাম হাতের মাঝখান দিয়ে কে*টে ফেলল ও। গলগল করে বেরিয়ে আসে র*ক্ত, টপটপ করে গড়িয়ে পড়ে মানুষের মাথার খুলিটার উপর।

কি ভয়ংকর সেই দৃশ্য! প্রকৃতি শান্ত হলো। শাহজাদির ঠোঁটের কোণে হাসি ফুঁটে ওঠে। তৎক্ষনাৎ থলে থেকে কাপড় দিয়ে বানানো বিভৎস পুতুলটি বের করে নিলো ও। নিজের হাতের রক্ত দিয়ে মাখামাখি করে দিলো পুতুলটি। তারপর একটি বড় মোটা সূচ পুতুলের বুক বরাবর এফোড়-ওফোড় করে ঢুকিয়ে দিতেই বাইরের ঝড় পুরোপুরি শান্ত হয়ে আসে। দেখে মনেই হবে না, মিনিট কয়েক পূর্বেও সব ভেঙেচুরে নেওয়া বাতাস বইছিল! শাহজাদি ঘেমে জবজবে হয়। তবুও তার বুকে প্রশান্তি, ঠোঁটে পৈশাচিক তৃপ্তিময় হাসি। কাজ হয়ে গেছে। এবার শুধু সময়ের অপেক্ষা।

সবকিছু দ্রুততার সঙ্গে গুছিয়ে নিয়ে পুনরায় থলেতে ভরল ও। শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে বাম হাতটা শক্ত করে বেঁধে নিলো। ভেতরে দিয়ে দিলো কিছু দূর্বাঘাস। যন্ত্রণা হচ্ছে ভীষণ। কিন্তু এই যন্ত্রণা আগাম হতে যাওয়া কাজটির কাছে কিছুই নয়! শাহজাদি দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। সোজা চলে এলো কবর তিনটির পাশে। খুঁজে বের করল,মোরশেদের বাবার কবর। তারপর সেই কবরের পাশেই মাটি খুঁড়ে পুতুলটিকে দাফন করে দিলো ও। সম্পূর্ণ কাজ শেষ!

শাহজাদি কবরের গায়ে হেলান দিয়ে বসে পড়ল। ভোরের আলো ফুঁটি ফুঁটি করছে। এখন গোসল সাড়তে হবে। ক্লান্ত লাগছে তবে স্বস্তি লাগছে। শাহজাদি দুনিয়ার সবচেয়ে কুৎসিত হাসিটা ওর ঠোঁটে ধরে বলল,
“খা** মা**, কাইল থেইকা এই সংসার আমার একলার। তোর যাওনের সময় হইয়া গেছে।”
পরদিন সকালে মোরশেদের ঘুম ভাঙলো শাহজাদির আর্ত চিৎকারে। শাহজাদি ‘আল্লাহ গো’ বলে চিৎকার করে কাঁদছে। কেননা রুনু বেগম গতকাল রাতে ঘুমের ভেতরই মা*রা গিয়েছেন।

মোরশেদের মনে হলো তিনি ভয়ংকর কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছেন। এই বুঝি ঘুম ভেঙে জেগে উঠবেন আর দেখবেন, সব কিছুই ঠিক আছে। তাঁর মা বেঁচে রয়েছেন। উনুনের সামনে পিড়ি পেতে বসে জ্বাল ঠেলছেন চুলোর ভেতর। মোরশেদ কে দেখেই ডাক দিয়ে বলবেন,
“বাবা, উঠছোস? হাত-মুখ ধুইয়া আয়। আমি ভাত বাইড়া দেই।”
কিন্তু…

না! কঠিন হলেও সত্য, তাঁর মা তাঁকে ছেড়ে চিরজীবনের জন্য চলে গিয়েছেন। আর কোনোদিন তাঁর জন্য তিন বেলার খাবার বেড়ে অপেক্ষা করবেন না। তিনি আর অস্থির হয়ে উঠবেন না সন্তান বাড়ি ফেরার আগেই রান্না হলো কীনা সেই দুশ্চিন্তা করে। কোনোদিনই সন্তানের মঙ্গল কামনায় রবের নিকট দু’হাত তুলে অঝোরে কাঁদবেন না। আর না কোনোদিন মোরশেদ অসুস্থ হলে বারবার ‘কিছু লাগবে কীনা, কিছু চাই কীনা, এখন কেমন লাগছে’ করে করে অশান্ত হয়ে উঠবেন!

‘মা’ – এক অক্ষরের ছোট্ট এই শব্দটার ভেতর পৃথিবীর সব মায়া মমতা জড়ানো। দশটা মাস পেটে রাখার পর দুনিয়ার সঙ্গে লড়াই করে জন্ম দিয়েও আজীবন ছায়ার মতো মিশে থাকেন সন্তানের সঙ্গে। আগলে রাখেন বটবৃক্ষের মতো। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত সন্তানের ভালোটা চেয়ে যান, চাইতেই থাকেন, চাইতে চাইতে নিজেকে উজাড় করে বিলিয়ে দেন। তবুও তার দুঃখবোধ থাকে না, আফসোস লাগে না। কি এক অদ্ভুত সম্পর্ক, রহস্যময় টান মা এবং সন্তানের মধ্যে। স্বয়ং আল্লাহ এই মহব্বত তৈরি করে ছড়িয়ে দেন! তাই বুঝি মানুষ বলে, নাড়ির টান, সবচেয়ে বড় টান!

মোরশেদ দু’হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেললেন। তাঁর আব্বা মা*রা গেছেন আরও প্রায় বাইশ বছর পূর্বে। তখন তিনি কম বয়সী তরুণ। খুব একটা চোট লাগেনি হৃদয়ে। আব্বা চলে যাওয়ার পর থেকে মা-ই একমাত্র ছেলেটাকে ভালোবেসে, বুকে আগলে দিন পার করেছেন। মোরশেদ যত বড়ই হোক না কেন, তাকে মমতা করেছেন যেন সে ছোট্ট একটি শিশু! সেই মা আজ চোখের সামনে নিথর হয়ে শুয়ে… এ দৃশ্য কি মানা যায়?

আর কোনোদিন তবে ‘মা’ বলে ডাক দেওয়া হবে না! আর কোনোদিন অন্যের রাগ মায়ের উপর মিটিয়ে ফেলার সুযোগ পাওয়া যাবে না। আর কোনোদিন মা’কে জ্বালিয়ে পৈশাচিক আনন্দ উপভোগ করা হবে না। আর না কোনোদিন মায়ের থেকে শুনতে পারা যাবে, ‘পেটে একটা অজাত ধরছি!’
মা- মা’রে..মায়ের চেয়ে বড় আপন কেহই যে হয় না! সবকিছুর ঋণ শোধ হয়, মায়ের ঋণ যে শোধ করা যাবে না গায়ের চামড়া দিয়ে জুতো বানিয়ে পড়ালেও! উপস্থিত জনস্রোত স্তব্ধ হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখলেন, জীবনের অর্ধেকেরও বেশি পার করা পুরুষটি ছোট্ট শিশুর মতো হাউমাউ করে মায়ের লা*শ জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন। এহেন দৃশ্য পানি এনে দিলো সকলের চোখেই…

কবর জীবনটা কেমন হয়? মাটির ঘরে শুয়ে থাকে কেমন করে রুহ? একলা অন্ধকারে সেও বুঝি কাঁদে! হয়তো ডাকেও পরিবারের পরিচিত মানুষদের। হয়তো আর্তনাদও করে। তাই তো মানুষের কানে সেই আর্তনাদ পৌঁছানোর কোনো পথ মাওলা তৈরি করে দেননি। যদি দিতেন, তবে বুঝি পৃথিবীর বুকে পেন্সিলের এক ফোঁটা সমপরিমাণ পাপ কাজ করার সাহস কারো চিত্তে থাকত না।

সদ্য তাজা মাটির খোঁড়া কবরটির সামনে দাঁড়িয়ে মোরশেদ অনেক কিছুর হিসেব মেলাতে শুরু করে। তার অবচেতন মন কেমন যেন হু হু করছে। মনে হচ্ছে, কোথাও কিছু খারাপ হয়েছে। ভীষণ খারাপ কিছু। যা কল্পনাও করা যাচ্ছে না। একটু অদূরেই খাটিয়ার উপর রাখা মায়ের লা*শটা কি যেন বলতে চাইছে, বোঝাতে চাইছে। কিন্তু সেই নিস্তব্ধ চিৎকারের ভাষা বোঝার সাধ্য মোরশেদের নেই। সে মাথা ঝেড়ে চিন্তা সরানোর চেষ্টা করে।

বারবার চোখে ঝাপসা হয়ে আসে। পাঞ্জাবির হাতায় চোখ মুছতে মুছতে গলার কাছে এক ধরনের জ্বালাপোড়া অনুভব করেন তিনি। বুকের ছাতিটা ফেটে যাচ্ছে। একটুখানি পানি ভীষণ প্রয়োজন। মোরশেদ চারপাশে চোখ বোলালেন। শাহজাদি নেই। মেয়েটা গর্ভবতী। সকালে সেই অবস্থায় চিৎকার করে কেঁদেছে। সম্পর্ক যেমনই ছিল কিন্তু শ্বাশুড়ি ছিল ওর। কষ্ট পেয়েছে! মোরশেদের উচিত নিজের পাশাপাশি বউকেও সামলানো, সাহস এবং শক্তি দেওয়া। মানুষ মরণশীল। আজ নয়তো কাল তাকে তার রবের পথে চিরতরের পাড়ি জমাতে হবেই। দুই দিনের এই দুনিয়ার প্রতি এত মায়া না রাখাই উচিত তাই।

মোরশেদ রুনু বেগমকে কবরে শোয়ানোর আগে পানি খাওয়ার উদ্দেশ্যে ঘরের ভিতরে পা বাড়ালেন। পানি খেয়ে শাহজাদি কে খুঁজতে খুঁজতে নিজেদের ঘরে এলেন। দেখলেন, শাহজাদি চুপ করে বসে রয়েছে। ওর চোখমুখ অদ্ভুত। গভীর চিন্তায় যেন নিমজ্জিত। মোরশেদের হৃদয়টা পুনরায় মোচড় দিয়ে উঠে। তিনি এগিয়ে গিয়ে শাহজাদির পাশে বসতেই শাহজাদির ধ্যান ভাঙে। চোখের সামনে আচানক মোরশেদ কে দেখতে পেয়ে কয়েক সেকেন্ডের জন্য থতমত খায়। পরমুহূর্তেই নিজেকে ধাতস্থ করে অভিনয়ের অংশটা শুরু করে।
মোরশেদকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বলল,

“আপনে ভাইঙ্গা পড়বেন না। হায়াত মউত সব আল্লাহর হাতে। মায়ের এই কয়দিন রিযিক আছিলো। আপনে আল্লাহর দোহাই লাগে ভাইঙ্গা পড়বেন না।”
মোরশেদ ব্যথিত স্বরে বললেন,

“কষ্ট হইতাছে। সুস্থ মানুষ, হঠাৎ কইরা…ভাবতে পারি নাই।”
“আল্লাহর কাছে শুকরিয়া করেন, আম্মারে বেশি কষ্ট দিয়া নেয় নাই। ঘুমের মধ্যে নিয়া গেছে গা। আম্মা জানি বেহেশত পায়, আপনে নামাজ পইড়া খালি হেই দোয়াই করবেন। কবর দিছেন?”
মোরশেদ শাহজাদিকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন,

“না। গলাডা শুকাইয়া গেছিল। পানি খাইতে আইয়া এদিক আইলাম। তুমি আর কান্দাকাটি কইরো না। ইট্টু শুইয়া থাকো। এই শরীরে এইসব…”
“আপনে আমার লিগা চিন্তা কইরেন না খামাকা। আমি ঠিক আছি। আপনে যান। কবর দিয়া আহেন।”
“আইচ্ছা।”

মোরশেদ চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়িয়ে পুনরায় শাহজাদির দিকে তাকালেন। একটা জিনিস হুট করেই তার চোখে লেগেছে। শাহজাদি খানিকটা হতভম্ব হয়ে গেল। মোরশেদ এগিয়ে এসে খপ করে শাহজাদির বাম হাতটা নিজের হাতে তুলে নেন। শাহজাদি ভয় পেয়ে যায়। হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে মোরশেদ কঠিন চোখ করে তাকায়।
“হাতে কি হইছে?”
শাহজাদি আমতা আমতা করে বলল,
“কি অইবো! কিছু না।”
“তাইলে কাপড় বাইন্ধা রাখছোস ক্যান? দেহি…”

“কইলাম তো কিছু অয় নাই। ইট্টূখানি কাইটা গেছিল। আপনে এদিক না দেইখা ওদিক যান। রুহের কষ্ট হইতাছে। তাড়াতাড়ি দাফন দেওয়া ভালো।”
“আমারে হিগাইস না। হাত খুলতে দে।”

এক প্রকার জোর করেই শাহজাদির হাতের বাঁধন খুলে ফেললেন। শাহজাদি ব্যথা পেল ভীষণ। ব্যথায় গুঙিয়ে উঠল। মোরশেদ হাত দেখে তাজ্জব বনে গেলেন। এত বড় কা*টার আঘাত! তাও আবার এবড়োথেবড়ো ভাবে নয়। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এই কা*টা টা ইচ্ছাকৃত ভাবে করা হয়েছে। ধারালো কিছু দিয়ে এক টানে কা*টা হয়েছে। কিন্তু এমন কাজ শাহজাদি কেন করতে যাবে! মোরশেদ একটি প্রশ্নও করলেন না। ভয়ার্ত শাহজাদির চোখমুখ দেখে শুধু বললেন,

“কাপড় পেচাইয়া ল।”
তারপর বের হয়ে গেলেন। শাহজাদির বুকের অস্থিরতা বেড়ে আকাশ ছুঁলো। মানুষটা কিচ্ছু বলল না কেন! তবে কি সে সব বুঝে গিয়েছে?
ভাগ্য সদয় হলো নাকি মায়ের রুহই একের পর এক ঘটনা গুলো মোরশেদের মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাওয়ালো কে জানে। শাহজাদির কা*টা হাতটা মনের মধ্যে অদ্ভুত সব চিন্তাধারার আবির্ভাব করছে। মোরশেদ ঘোরগ্রস্তের মতো খোঁড়া কবরে নামে।

মায়ের লাশটা শুইয়ে দিয়ে উপরে উঠতে গেলে রোদের আলোতে কী যেন চমকে উঠল। মোরশেদ সরু চোখ করে তাকাল। কবরের ডান পাশে, মাটির ভেতর কিছু একটা চকচক করছে। সূর্যের তেজী রশ্মির কারণে সেটিই আলো প্রতিফলন করছে। মোরশেদ হাত ঢুকিয়ে দিলো। মাটির ভেতর থেকে জিনিসটা টেনে বের করে আনতেই তার চক্ষু চড়কগাছ। সেই সঙ্গে আশেপাশে যারা উপস্থিত, সবাই-ই একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করল।

এ যে ভালো লক্ষণ নয়! অশুভ প্রতীক! বুকে শূল বিঁধানো পুতুল! পুতুলের গায়ের যে কাপড়টা, সেটি রুনু বেগমের শাড়ির এক টুকরো অংশ। এই শাড়িটা খুব ভালো ভাবে চেনে মোরশেদ। সে নিজ হাতে হাট থেকে মায়ের জন্য কিনে নিয়ে এসেছিল গত রোজায়। মা সবসময় পড়তেন। সেই শাড়ির একটুকরো অংশ এই বীভৎস পুতুলের গায়ে কি করছে? আর কেনই বা এর বুকে শূল বিঁধে আছে? শাহজাদির হাত কা*টা কেন?

একটার পর একটা প্রশ্ন মোরশেদের বুকের উপর ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ে। মোরশেদ থ মে*রে বেশ কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়েই রইলেন। সদ্য শোয়ানো লা*শের দিকে তাকালে তাঁর চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। মা কি তবে এই কথাই বলতে চেয়েছিলেন? এই প্রশ্নের উত্তর গুলো বুকে আসার জন্যে বুঝি এত উচাটন হচ্ছিল সকাল থেকে!

ঝরা বকুলের গল্প পর্ব ১৬

পর্ব-১৭ এখানেই শেষ নয়। আমি সম্পূর্ণ টা লিখে শেষ করতে পারিনি। যতদূর লিখলাম, পোস্ট করলাম। আগামীকাল এই পর্বেরই পরবর্তী অংশ অর্থাৎ পর্ব-১৭ (খ) আসবে।

ঝরা বকুলের গল্প পর্ব ১৮