ঝরা বকুলের গল্প পর্ব ১৮

ঝরা বকুলের গল্প পর্ব ১৮
মেহা মেহনাজ

অবশেষে তুষার চলে গেল। বকুলের কোথাও একটা ক্ষীণ আশা ছিল মনের ভেতর, হয়তো যাবে না! হয়তো সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে থেকে যাবে মানুষটা। কিন্তু সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে আর কোথাও তুষারকে দেখতে না পেয়ে প্রায় অবশ হয়ে যাওয়া মনটা নিয়ে সে পুকুর পাড়ে এসে হাত-পা ছড়িয়ে বসে পড়ল। মনের জোর ছেড়ে দিয়েছে। মানুষটা গেল তো গেল, দুদিন আগেই চলে যেত। এখন এই পোড়া বুকে কোন পাতার প্রলেপ লাগিয়ে নিজেকে সুস্থ করবে ও? সব ঘা শোকানোর ওষুধ আছে। হৃদয় পুড়ে গেলে কী লাগাতে হয় ক্ষতস্থানে, বকুলের জানা নেই। ও একটু পর পর চোখ মোছে। বুক ভারী হওয়া মেঘদল বৃষ্টি ফোঁটা ঝরায় বারে বারে…

সত্যিকারের ভালোবাসায় প্রেমের চেয়ে বিরহের গল্প বেশি। সত্যিকারের ভালোবাসায় পেয়েও হারানোর গল্প বেশি। সত্যিকারের ভালোবাসায় মানুষটা চোখের সামনে থাকলেও তাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে বারবার কেঁদে ফেলার গল্প বেশি। ভালোবাসায় কষ্ট বেশি, যন্ত্রণাও হয়। বিরহ জাগে। মানুষ জানে, এ গল্পে আমায় কাঁদতে হবে, ডুবতে হবে, পুড়তেও হবে। তবুও মানুষ ভালোবাসাকে। ভালোবাসাকেই ভালোবাসে। নিজেকে উৎসর্গ করে দিয়ে ভালোবাসে। তাই বুঝি ভালোবাসা এক কঠিন ব্যাধির নাম!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বকুলের নিজের বুক খামচে ধরে। বিষ পোকারা একটু পর পর কলিজায় কামড় দিয়ে তাদের বিষ ছড়িয়ে দিচ্ছে। পুরো শরীর বিষাক্ত হয়ে উঠছে। শ্বাস টেনে নিতেও এত কষ্ট! বকুলের চোখের জল চিবুক ছুঁলো। সে ভীষণ আকুতির স্বরে উপরওয়ালার কাছে আক্ষেপ জানালো,
“যাইবোই যহন তাইলে দিলা ক্যান মাওলা? তুমি কি দেখতাছো না আমার কষ্ট? আমার কান্না? শান্তি আমার লিগা হারাম হইয়া গেছে। মানুষটা মনের এত কাছে কেমনে আইলো মাবুদ? এহন আমি কেমনে থাহুম? তারে রাইখা কেমনে থাহুম কও? সে তো হারাইয়া গেল। আজীবনের লিগা হারাইয়া গেল। আমারে দিয়া গেল এক বুক যন্ত্রণা…”

শুভ্র রঙা শরীর নিয়ে হেলেদুলে ছানাটি এসে বকুলের কোলে জায়গা করে নিলো আচানক। বকুল কান্না থামাল। ওর দিকে চাইতেই বুক ভরে গেল অন্যরকম ভালো লাগায়। গতকাল রাতে ওরা যখন বাড়ি ফিরছিল, তখন জঙ্গলের ভেতরেই এই ছোট্ট আদুরে বিড়াল ছানাটি দেখতে পেয়ে থেমে দাঁড়িয়ে ছিল তুষার। তুলোর মতো বলটার বয়স এক মাসও হয়নি। তুষার রেখে আসতে চেয়েছিল, বিড়াল ছানাটি বার বার পেছন পেছন দৌড়ে চলে আসে। এক পর্যায়ে তুষার বলল,
“বকুল, আমি একটা জিনিস দিলে রাখবে?”
বকুল মনে মনে বলল,

“আপনার দেওয়া যেকোনো জিনিস আমি মাথার তাজ কইরা রাখুম।”
মুখে ছোট্ট উত্তর দিলো,
“হুম।”
তুষার বিড়াল ছানাটি কোলে তুলে বলল,
“ওকে সাথে রেখে দাও। যখন আমার কথা খুব মনে পড়বে, তখন ওকে ছুঁয়ে দিও।”
পরমুহূর্তে একটু থেমে তুষার অনুনয়ের স্বরে জিজ্ঞেস করেছিল,

“আমাকে মনে পড়বে তো চাঁদ রাণীর?”
উত্তরে দুই চোখ ছাপিয়ে জল এসেছিল বকুলের।
বিড়াল ছানাটিকে পরম মমতায় বুকে আগলে নিলো ও। আবেশ পেয়ে মোমের মতো গলে বকুলের গালের সঙ্গে লেগে গেল ছানাটা। বকুলের কণ্ঠ ভিজে যায়। সে আকুতি পূর্ণ গলায় বিড়বিড় করে তুষারের নাম ধরে ডাকলো।

মাঘের শেষ প্রায়। আসরের আযান পড়ছে। গুটি গুটি পায়ে মাঝখানে কেটে গেছে বহুদিন। প্রকৃতি পরিবর্তন হয়েছে। যতই বসন্তের কাছাকাছি ধাবিত হচ্ছে, ততই যেন রঙ লাগছে জমিনের বুকে। এক সময় সর্ব রঙে রঙিন হবে চারপাশ। শুধুমাত্র বেরঙিন হয়ে রবে বকুল। সেই যে পৌষের ভোরে গেল মানুষটা…সব তো নিয়েই গেছে সঙ্গে করে। সব রঙ, সব আনন্দ, রেখে গেছে বুক কামড়ে খাওয়া শূন্যতা। বকুল যে কতবার আওড়ায়,

“সবই তো আছে তাও খালি লাগে ক্যান?”
কেউ এসে উত্তর দেয় না, এই শূন্যতা হৃদয় রাজ্যের! এই শূন্যতা চোখ দিয়ে দেখা যায় না। এই শূন্যতা শুধু অনুভবে মিশে থাকে। শূল বিঁধিয়ে নিস্তেজ করে ফেলে মানুষকে। বকুলও দিন দিন চুপচাপ হয়ে গেছে।
আরজু হাঁক ছেড়ে ডাকলেন,
“ওরে ও বকুল, কাপড়ডি তুইলা আন। নিশি পড়বো আরটু পরেই।”
“যাই…”

মাথায় ঘোমটা টেনে বকুল বেরিয়ে এলো উঠোনে। আগের সেই চপলতা মেয়েটার ভেতর নেই। নিস্তরঙ্গ নদীর মতো বয়ে চলছে ইদানীং। যেন চলতে হয় বলেই চলা, বাঁচতে হয় বলেই বাঁচা, মন থেকে যে জোর বা ইচ্ছে- তা ম*রে গেছে। ইদানীং মাথায় কাপড় টেনে হাঁটে। কারো ঘরের বউ না, খুব আদবের সাথে কখনো চলেওনি, তবুও খুব বউয়ের মতো সেজে থাকতে ইচ্ছে করে। দু’হাতে সরু দুটি চুড়ি পড়তে ইচ্ছে করে। নাকে ছোট্ট একটা নাকফুল। ইচ্ছে করে সকালে উঠে নাশতা বানিয়ে মানুষটার জন্য অপেক্ষা করতে। ইচ্ছে করে প্রতিদিন রাতে তার আদরের সাগরে ডুব দিতে। ইচ্ছে করে ফজরের আগে আগে নিজেকে গোসলের মাধ্যমে পবিত্র করতে। তারপর কাপড় মেলতে গিয়ে মানুষটার মুচকি হাসি দেখে লজ্জায় মাথানিচু করতে। কত কিছুই তো ইচ্ছে করে! মানুষের সব ইচ্ছা পূরণ হয় কই?

শুকনো কাপড় গুলো তুলতে গিয়ে সোহাগীর মায়ের সঙ্গে দেখা হলো। সোহাগীর মা হাঁটতে বেরিয়েছেন। বকুল তাকে ‘চাচী’ বলে ডাকে। সোহাগীর মা কে দেখেই বকুল সুন্দর করে সালাম দিলো। তিনি সামান্য অবাক হলেন।
“ও বকুল, ওমন ওড়না টাইনা মাথায় পেচাইছোস ক্যান? দেইখা কেমুন বউ বউ লাগে!”
বকুল কথার পিঠে অল্প একটু হাসল। উলটো প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,

“সোহাগী কেমন আছে চাচী?”
“ভালাই আছে। জামাইর ঘরে সুখ হইছে।”
“তোমরা তো দিবার চাও নাই। এহন দেহো, মাইয়া ভালো আছে।”
“দিবার চাই নাই কি শখ কইরা? পোলার সেরম ধন-সম্পত্তি নাই। ভালা কাম করে না। নাও বায়। নাও বাইয়া কয় টেহা কামায় ক? তাও মাইয়ার জোরাজুরিতে দিলাম। এহন তো কম খাইলেও ভালা আছে।”
“চাচী, খাওন খাইলে পেটের সুখ হয়, এই সুখ অল্প ইট্টুখানি। মনের সুখ থাকলে পেটের সুখ না হইলেও চলে। যে যার লগে ভালো থাকে, আল্লাহ তারে তার লগেই মিলাইয়া দিক।”

“তুই বড় গো মতোন কতা কইতাছোস।”
“আমি কি এহনো ছোডো নাকি!”
সোহাগীর মা একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন,
“তুই মাইয়াও বড় ভালা। তাও তোর কপালডায় এমুন…”
বকুল মাঝপথে তাঁর কথা কেড়ে নিলো।
“শুকরিয়া করো মাওলার ধারে। যা হয় মাওলার ইশারায় হয়। আমার লগে যাই হউক, আমি ভালা আছি চাচী। সামনেও যেন ভালা থাকতে পারি, হেই দোয়া করো।”
বকুল চলে যায়। সোহাগীর মা একলা উঠোনে দাঁড়িয়ে মেয়েটার কল্যাণ কামনা করলেন।

কাঁচ ঘেরা একটি সুসজ্জিত অফিস রুমে তুষার বসে রয়েছে। অফিস রুমটি ওর বাবার। বাবা নামক মানুষটির সাথে খুব বেশি সম্পর্কের গভীরতা নেই। মানুষটি বরাবরই ব্যবসা, কাজ নিয়েই থেকেছে। সন্তানের প্রয়োজনে দু’হাত ভর্তি করে টাকা উড়িয়েছে, কিন্তু কখনো পাশে বসে জিজ্ঞেস করেনি প্রয়োজনটা কিসের ছিল। তুষার অবশ্য কখনোই টাকাপয়সার গরমে বিগড়ে যায়নি। খুব বেশি বাবার টাকার উপর নির্ভর হয়েও থাকেনি। অনেক কম সময়ের ভেতর নিজেই নিজের পায়ে শক্ত অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।

তুষারের কর্পোরেট জীবন ভালো লাগে না। সাহিত্যের মানুষ সে, যেখানে প্রেম নেই, আবেগ নেই, নেই কোনো অনুভূতির খেলা- খালি কম্পিউটারের মতো বড় পর্দার সামনে ঘচঘচ করতে থাকা, এমন জীবন দেখলে ওর মৃত মৃত মনে হয়। তাই তুষারের বাবা শত চেয়েও ছেলেকে নিজের অফিসের কোনো পদে বসাতে পারেননি। শেষতক ছেলেকে পাখির মতো ছেড়ে দিয়েছেন। সেই ছেলে আজ বিনা আহ্বানে তার কেবিনের বাইরে অপেক্ষা করছে শুনে মাঝ পথেই মিটিং স্থগিত করলেন আফজাল হোসেন। রফিককে বললেন, দুই কাপ গরম চা ভেতরে দিয়ে যেতে এবং তুষারকে আসতে বলতে। রফিক এখানকার পিয়ন। সে মাথা নেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলো।

“ছার আপনেরে ভিত্রে যাইতে বলছে।”
তুষার আপন ভাবনায় ডুবে ছিল। রফিকের কথা ওর চিন্তার রেশ ভেঙে দেয়। সে মাথা নেড়ে ধীর পায়ে কেবিনের দরজা ঠেলে।
“বাবা…”
আফজাল হোসেন মাথা তুলে হাস্যজ্বল মুখে বললেন,
“আয়, আয়, ভেতরে আয়।”
তুষার হাসিমুখে ভেতরে ঢুকল। টেবিলের সামনে থেকে একটা চেয়ার টেনে তাতে বসে পড়ল।
“আমার অফিসে তুই! আমি কি ঠিক দেখছি?”
তুষার মৃদু হেসে বলল,

“তুমি একদম ঠিক দেখছো বাবা। আমি আসলে একটা জরুরি প্রয়োজনে এসেছি।”
“সে আমিও বুঝতে পারছি। জরুরি প্রয়োজন না হলে এই কবরস্থানে তুই আবার আসতি!”
তুষার এবারেও হাসে। সে এখানকার সবাইকে জ্যান্ত মরা বলে আখ্যায়িত করে তাই তার কাছে বাবার অফিস একটি শুনশান কবরস্থানের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
“তা কী তোর জরুরি প্রয়োজন? শুনি!”

“বাবা, আমার লেখা একটা স্ক্রিপ্ট ভারতের একজন প্রযোজকের ভীষণ পছন্দ হয়েছে। উনি আমাকে বার্তা পাঠিয়েছেন। আমাকে নিয়ে আলাদা ভাবে বসতে চান। ওই স্ক্রিপ্টে কিছু সংযোজন বিয়োজন করে একটা ছবি তৈরি করতে চান।”
“এ তো দারুণ খবর! আমার তোমাকে নিয়ে গর্ব হচ্ছে। এই এতদিনে বোধহয় মন থেকে তোমার লেখালেখিকে আমি বাহ্বা দিলাম।”
“হুম। ধন্যবাদ বাবা। আমি হয়তো এক সপ্তাহের মধ্যে ভারতে চলে যাবো।”
“বেশ তো। আমি সব ব্যবস্থা করে দেবো।”
“তার প্রয়োজন হবে না বাবা।”

আফজাল হোসেন মুচকি হাসেন। তিনি জানেন, তার ছেলে এখন যথেষ্ট বড় হয়ে গেছে। যতটা বড় হলে নিজের সব কিছু নিজেই নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে, ঠিক ততটা বড়। এটা যদি ভারত না হয়ে আমেরিকা হতো, সেখানে যাওয়ার জন্যেও সব ব্যবস্থা তুষার একাই করতে পারত। তাহলে সে এখানে কেন এসেছে? এই কথাটা বলার জন্য বাসায়ই তো যথেষ্ট। আলাদা ভাবে বাবার অফিসে আসার পেছনে তার মূল উদ্দেশ্য কি?

রফিক এসে দুই কাপ চা এবং বেলা বিস্কুট দিয়ে গেল। তুষার সময় নিলো। যে কথা গুলো ও বলতে এসেছে তা শোনার পর বাবার কিরকম আচরণ হতে পারে, তা একবার মনে মনে ভাবার চেষ্টা করল। তাকে চিন্তিত দেখালো। সময়টাকে দীর্ঘ করতে সে চায়ের কাপ তুলে নেয়। কি ভেবে বিস্কুটও নিলো। চায়ে একবার বিস্কুট ডুবিইয়ে মুখে দিতেই তার মুখ বিস্বাদে ভরে উঠে। মনে হচ্ছে, কাদা চাবাচ্ছে। কি বাজে স্বাদ!
আফজাল হোসেন বললেন,

“তুমি যা বলতে যাও নির্দ্বিধায় বলতে পারো আমাকে। আমি তোমাকে কখনো বেলা বিস্কুট খেতে দেখিনি। আমার জানা মতে, এই বিস্কুট তোমার কাছে কাদার মতো লাগে।”
তুষার ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেলে বাকি বিস্কুট বাটিতে রেখে দিলো।
“বাবা আমি আসলে বুঝতে পারছি না কথা গুলো শোনার পর তোমার প্রতিক্রিয়া কেমন হবে।”
“আমার প্রতিক্রিয়া তেমনটাই হবে যেমন হওয়া উচিত। কি বলতে চাও সেটা না জেনে আমি তোমাকে কিছু বলতে পারছি না।”

“বাবা…বাবা আমি ভারত যাওয়ার আগে বিয়ে করতে চাই।”
আফজাল হোসেন বেশ স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন,
“এটা তো ভালো খবর। তোমার মা অনেকদিন ধরেই তোমার বিয়ে দিতে চান, এটা তুমিও জানো। আমি তাহলে তোমার মা’কে বলছি…”
“বাবা, আমি নির্দিষ্ট একজন কে বিয়ে করতে চাই।”
এইবার আফজাল হোসেন ছেলের আসল রোগ ধরতে পারলেন। তিনি যথেষ্ট শান্ত মেজাজে বললেন,
“কেউ আছে?”

“হ্যাঁ।”
“নাম?”
“বকুল।”
“কোথায় পড়াশোনা করে?”
তুষার ছোট্ট একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
“ও পড়াশোনা করেনি কখনোই। গন্ডগ্রামের এক মেয়ে। সবচেয়ে বড় কথা, ওর পারিবারিক কোনো স্ট্যাটাস নেই। আমাদের সাথে মিলবে না। এবং ও বিবাহিত ছিল! তবে সেখান থেকে অনেক দিন আগেই চলে এসেছে। বয়স কম। আমার চেয়ে অনেক ছোট।”
“আমি যা যা শুনলাম, সব কি সত্যি?”

“হ্যাঁ সত্যি। আমি জানি, ও তোমাদের পছন্দের কোনো কাতারেই পড়বে না। কিন্তু বিশ্বাস করো বাবা, আমি ওকে ভীষণ ভালোবাসি। ওর মাঝে শান্তি খুঁজে পাই। আলাদা শান্তি! আমি চাইবো, তুমি এবং মা আমাকে হাসিমুখে সম্মতি দিবে। আমি ওকে বিয়ে করে রেখে তারপর ভারত যেতে চাই।”
“যদি বলি আমি এবং তোমার মা, আমরা কেউই হাসিমুখে সম্মতি দিবো না। তাহলে?”
তুষার কয়েক সেকেন্ড ভেবে জবাব দিলো,
“আমি ওকে কথা দিয়ে এসেছি বাবা!”

আফজাল হোসেন ছেলের এহেন কথায় যা বোঝার বুঝে নিলেন। তিনি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন।
“আমি সম্মতি দিচ্ছি না। এরকম একটা মেয়েকে আমার বাড়ির বউ হিসেবে আমি মেনে নেবো না। বাকিটা তোমার মায়ের সাথে কথা বলে দেখো।”
“বাবা, মা মানবেই না। সে দোলাকে অসম্ভব পছন্দ করে। দোলার সাথে আমার বিয়ে দেওয়ার জন্য কিভাবে পাগল হয়ে আছে তা তো জানো।”

“তুমিও নিশ্চয়ই জানো দোলা শিক্ষিত, স্মার্ট, ওর বংশ ভালো, দেখতে সুন্দর। চমৎকার করে কথাবার্তা বলে। ওর পরিবারের সাথে আমাদের অনেক দিক দিয়ে মিল রয়েছে। এবং মেয়েটি তোমাকে অসম্ভব পছন্দ করে। তুমি এখন বিয়ে করতে চাচ্ছো না তাই সে নিজে বলেছে কেউ যেন তোমার সাথে জোরাজুরি না করে এই বিষয়ে! সে তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছে। তুমি যখন চাইবে ঠিক তখনই সে বিয়ের জন্য প্রস্তুত।”
“আমি ওকে বলিনি আমার জন্য অপেক্ষা করো! আর না আমি ওকে পছন্দ করি! বাবা, ও কে, দেখতে কেমন, ওর পরিবার কেমন, এত হিসাব কষে ভালোবাসা হয় না অন্তত! আর আমি ভালোবাসা বিহীন সংসার চাই না।”

“ভালোবাসায় পেট ভরে না!”
“পেট ভরানোর জন্য যা প্রয়োজন তা জোগাড় করার মতো যথেষ্ট ক্ষমতা আমার আছে। আমি ভালোবেসে ভালো ভাবে থাকতে চাই এবং আমার সেই শান্তি শুধুমাত্র বকুলের কাছে।”
“আবেগ দিয়ে দেখছ তুষার।”
“দেখলে দেখছি। আমি নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পর থেকে তোমার কাছে কখনো কিছুর জন্য আসিনি। এই প্রথম এলাম। খালি হাতে ফিরিয়ে দিও না।”
“যেখানে থেকে এলে এই মেয়ে কি সেখানকার? কি যেন জায়গাটার নাম?”

“মনপুরা…”
“ক’দিন যাক, এদিকে মন দাও, সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“বাবা…”
“আমি হিসেব কষেই জীবন চালাই তুষার। যদি না চালাতাম খালি হাতে এত বড় শহরে এসে আজ এত কিছু করতে পারতাম না। তোমার ব্যাপারেও আমি হিসেবেই সীমাবদ্ধ থাকব। আমার কাছে আবেগ নামক বস্তুটার কোনো মূল্য নেই। ওসব তোমার গল্পের কাহিনিতেই মানায়। বাস্তবে শোভা পায় না। তুমি বরং ভারত যাও, ঘুরে এসো।”
“তার মানে তুমি আমাকে মত দিচ্ছো না বাবা।”

“এর চেয়ে স্পষ্ট ভাষায় মানা করার মতো বাক্য আমার কাছে নেই।”
“ঠিক আছে।”
তুষার উঠে দাঁড়াল।
“নিজের মায়ের শরীর টা ভালো না। সেদিকে একটু নজর রেখো…”
তুষার শুনেও শুনলো না। চুপচাপ কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল।

চাঁদ রাণী,
আমি এখন বসে আছি আমার ঘরের বেলকুনিতে। এটা একটা ঝুল বারান্দা। মাথার উপর ছাদ নেই। আকাশটা স্পষ্ট চোখে পড়ছে। এই আকাশের নিচেই তুমি আর আমি আছি। তাই না? তুমি এখন কি করছো চাঁদ রাণী? তোমার আকাশে তারা আছে? চাঁদ হয়ে একাই জেগে আছো নাকি কালো মেঘের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে নিয়েছো? আমার আকাশে আজ চাঁদ নেই। চারিদিকে নিকষ কালো অন্ধকার।

এমন অন্ধকার আমার গোটা জীবনটাকে তলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। চাঁদ রাণী, তোমার কথা বড্ড মনে পড়ছে। ইচ্ছে করছে, পিঠে দুটো ডানা লাগিয়ে আমি উড়ে যাই তোমার কাছে। সেই পৌষের রাতের মতো…জাপটে জড়িয়ে তোমার গায়ের গন্ধ নেই। তোমাতে ডুব দেই। এমন ডুব যেন আর কোনোদিন ভেসে না উঠি। চাঁদ রাণী, বাবা মানছে না। মা কে বলার সাহস হচ্ছে না। দিন যাচ্ছে, আমার ভারত যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসছে। যদি এই যাত্রায় আর না ফিরি! যদি ফিরে এসে জানতে পারি তুমি নেই…এমন অদ্ভুত অস্থিরতা কেন কাজ করছে বুকে চাঁদ রাণী?

রাতের আকাশ চাঁদ ছাড়া শূন্য, যেমন আমি…চাঁদের আলোয় না মেঘ পথ চিনে উড়ে বেড়ায়। আমি উড়তে পারছি না। এত অন্ধকারে কোনো পথ পাচ্ছি না। তুমি একবার এসো না…আমায় পথ দেখিয়ে দাও। আমি সানন্দে মৃত্যুকে গ্রহণ করব কিন্তু তোমার আমার বিচ্ছেদকে নয়। যে প্রেম দুনিয়ার সামনে ঠুনকো আবেগ, সেই প্রেমই আমার বাঁচার প্রেরণা। তোমায় বড্ড মনে পড়ছে চাঁদ রাণী, বড্ড মন পুড়ছে আজ।

ঝরা বকুলের গল্প পর্ব ১৭ (2)

মেঘবালক কাঁদে। স্মৃতির পাতায় ডুবে চাঁদ রাণীর মুখটা নিজের আঁজলায় ভরে কাঁদে। ওর অশ্রু ফোঁটা কাগজের পাতা ভিজিয়ে দেয়। বাতাস বয়। এক চিলতে বাতাস ওর মুখের আদল ছুঁয়ে চলে যায়।
তুষার বিড়বিড় করে উচ্চারণ করে,
‘বাতাসের গায়ে আগুন ধরানো, আকাশে নেই কো চাঁদ;
দুনিয়া জানুক তুমি কলঙ্কিত, আমি জানি তুমি নিখাঁদ।’

ঝরা বকুলের গল্প পর্ব ১৯