ঝরা বকুলের গল্প পর্ব ১৭ (২)

ঝরা বকুলের গল্প পর্ব ১৭ (২)
মেহা মেহনাজ

খসখস আওয়াজ হচ্ছে পাতায়। তুষারের আঙুল চলছে। কলম ঘোরাতে ঘোরাতে বেলা কত হলো সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই ছেলেটার।
ও চাঁদ রাণী,

শেষমেশ তুমি ওই আকাশের চাঁদ হয়েই থাকবে? আমার আকাশে তোমার আলো পড়বে না? আমি যে মেঘ হয়ে উড়ছি তোমায় একটুখানি ছোঁয়ার জন্য। তোমার এক টুকরো স্পর্শও আমাকে জান্নাতের সুখ দেবে। মনে হবে, এ জীবনে আর চাওয়ার কিচ্ছুটি নেই। তুমি ছুঁয়ে দিলেই আমি অমর হবো। কিন্তু.. তুমি রাতের আকাশের তেজী চাঁদ! তোমার আশপাশ দিয়ে উড়ে চলে যাওয়া যায়, ঘাড় বাঁকিয়ে চেয়েও থাকা যায়, শুধু ছোঁয়া যায় না। তুমি না চাইলে কারো সাধ্যি নেই তোমাকে ছোঁয়! ও চাঁদ রাণী, আমার হয়েও হলে না। তোমায় এক সমুদ্র ভালোবাসা দিতাম। সেই সমুদ্রে তোমার আলো জ্বলজ্বল করে জানান দিতো, ভালোবাসা সুন্দর, ভালোবাসা পবিত্র, ভালোবাসায় ম*রলেও পাপ নেই। যদি আমি হারিয়ে যাই, কোনোদিন কি খোঁজ নেবে? কোনোদিন কি মনে পড়বে, এক টুকরো মেঘ ছিল তোমার আঙিনায়?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

দরজাটা খোলার শব্দ হলো। তুষারের মনোযোগ ছিন্ন হয়। সে ঘাড় ফিরিয়ে দেখল আহ্লাদি সজল চোখে এসে দাঁড়িয়েছে। তুষারের বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। সে সযত্নে ডায়েরিটা বন্ধ করতে করতে বলল,
“কিছু চাই?”
আহ্লাদি সে কথার জবাব দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করল না। সে এগিয়ে এসে চুপ করে তুষারের পাশে বসে। তুষার তার পরিপূর্ণ মনোযোগ নিয়ে আহ্লাদির দিকে তাকাল। মেয়েটাকে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। তার আগে জানা প্রয়োজন, ও এখানে কেন এসেছে!

তুষার প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,
“কিছু বলতে এসেছো?”
আহ্লাদি ঘাড় কাত করে।
“হুম।”
“বলো।”
একটুখানি সময় চুপ করে থেকে ও বলতে শুরু করে,
“আপনে সত্যিই আমারে পছন্দ করেন না?”
“পছন্দ বলতে কি বোঝো তুমি?”
“আমি আপনেরে যেমুন পছন্দ করি, সেমুন করেন না?”

“তুমি আমাকে কেমন পছন্দ করো, তা আমি জানি না! তবে হ্যাঁ, আমি তোমাকে মানুষ হিসেবে পছন্দ করি। এর বাহিরে আর কিচ্ছু নয়। তোমার সাথে আমার আলাদা কোনো সম্পর্ক তৈরি হওয়া অসম্ভব আহ্লাদি।”
আহ্লাদির চোখজোড়া জলে চিকচিক করছে। সে মাথানিচু করল। তুষার ফের গভীর একটি শ্বাস ছাড়ে। বলল,
“শোনো, আমার কথাগুলো মন দিয়ে শোনো। আমাকে একটা প্রশ্নের জবাব দাও। পৃথিবীর সব কাজ করতে তোমার ভালো লাগে?”

আহ্লাদি দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে বলল,
“না।”
“তুমি কি করতে সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করো?”
আহ্লাদি চটচট করে জবাব দিলো,
“বেশি কাম করতেই আমার ভালো লাগে না। আমি তো খাই, দাই, ঘুমাই আর ঘুরি। মায়ে আমারে বকে। এইডা ওইডা করতে কয়। আমি পাত্তা দেই না। ভাইয়ের বউয়েরা আছে। হেরাই সব করে। আমার কুনু কাম নাই।”

“আচ্ছা! তারপরও ধরো, তোমার অনেক বিরক্তিকর একটা কাজের কথা বলো।”
এবার ও খানিকটা ভাবার সময় নিয়ে উত্তর করল,
“কাপড় ধুইতে। এই কাম করতে গেলে আমার এমুন মেজাজটা খারাপ হয়। মন চায় সব কাপড় ছিঁড়া ফালাইয়া চইলা আসি।”
“কাপড় ধুতে তোমার কতক্ষণ সময় লাগে? সর্বোচ্চ?”
“এক ঘন্টা!”

“আচ্ছা। ভেবে দেখো, একটা কাজ তোমার পছন্দ না। তাও সেটা করতে এক ঘন্টা লাগে মাত্র। তবুও তুমি সেই কাজটা করতে ইচ্ছুক নও মোটেও। এই এক ঘন্টা সময় ত্যাগ স্বীকার করতে রাজী নও। সেখানে আমার তোমাকে অন্য ভাবে একেবারেই পছন্দ নয়। তারপরও তোমার ইচ্ছার গুরুত্ব দিতে গিয়ে সারাটা জীবন কীভাবে ত্যাগ করে দিবো? বলো?”
আহ্লাদি হা-মুখ করে চেয়ে রইলো। এই প্রশ্নের উত্তর ওর জানা নেই। এভাবে ও ভেবেও দেখেনি। তুষার আহ্লাদির মুখের অবস্থা দেখে অল্প একটু হাসে। পুনরায় বলে উঠল,

“শোনো আহ্লাদি, জীবনের ব্যাপারে কখনো জোর করতে নেই। যেটা ভালো লাগছে না, সেটা করো না, যেটা ভালো লাগছে, সেটা জানিয়ে দাও। যদি পাও তবে ভাগ্যবতী, না পেলে ভাগ্যে নেই ভেবে এগিয়ে যাও। একটা মাত্র জীবনে এত হিসেব কষে কি হবে বলো? মাঝে মাঝে নিজের প্রতি ন্যায় করা উচিত।”
আহ্লাদি ভোঁতা মুখ করে বলল,

“আপনের এত শক্ত শক্ত কতা আমি বুজি না। সব আমার মাতার উপর দিয়া যায়।”
“আমি তোমাকে বিশেষ নজরে দেখি না। তুমি আমার কাছে সাধারণ একটি মেয়ে, একজন মানুষ। তোমার সাথে আমার কোনো কিছু হওয়া সম্ভব নয়। এইটুকু তো বোঝো, বুঝতে পারছো, নাকি?”
আহ্লাদি মুখ গোমড়া করে বলে,

“হুঁ..”
“এইটুকু বুঝলেই হবে। আর কিছু বুঝতে হবে না। বোঝার প্রয়োজন ও নেই।”
“আরেকটা জিনিস বোঝার দরকার আছে। সেইটা বুঝতেই আপনের ধারে আইছি।”
“তাই? কি জিনিস?”
“বলব?”
“হ্যাঁ বলো! আমি শুনছি।”

আহ্লাদির হঠাৎ পরিবর্তন হয়। তার চেহারায় সে বিষাদ খেলা করছিল তা সরে গিয়ে অদ্ভুত একটি আবহ ঝিলিক দিয়ে ওঠে।
আহ্লাদি ধীর স্বরে আসল কথাটা পাড়লো এইবার,
“বকুল অত রাইতে আপনের ঘরে কি করতে আইছিল?”
তুষার বজ্রাহত হলো। ওর কপাল আপনা আপনি কুঁচকে আসে। আহ্লাদি যেন খুব মজা পায়। ওর ঠোঁটে এই এতক্ষণ পর এক চিলতে হাসি ফুঁটে ওঠে।

“আমি গতকাল সব টের পাইছি। আপনে বকুলরে টাইনা নিজের রুমে ঢুকাইছেন। তারপর কি কইছেন? ওয় ওমন দৌড় দিয়া বাইর হইলো ক্যান? ঘরে গিয়া আমারে পানি দেওনের সময় ওর পুরা শরীল থরথর কইরা কাঁপতেছিল। ক্যান? কি করছেন আপনে ওর লগে? আপনের লগে ওর কিয়ের সম্পর্ক? তাইলে কি ভাইবা নিমু আপনেগো ভেতর কিছু একটা চলতাছে?”
তুষার তড়িৎ বলে উঠল,

“কেউ কারো ঘরে আসা মানেই নেতিবাচক কিছু? এত ছোট মন নিয়ে থাকো কীভাবে আহ্লাদি?”
আহ্লাদির নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জড়ো হয়। অপমানিত বোধ করল সে। ভেবেছিল, এই কথার দ্বারা তুষারকে কাবু করা সম্ভব। কিন্তু এখন দেখছে তুষারই বরং তাকে কাবু করে ফেলছে।
আহ্লাদি শক্ত কণ্ঠে বলল,

“একটা পোলা আর একটা মাইয়া রাইতের আন্ধারে কি করে এক লগে? তাও দুইডাই আবিয়াইত্তা। আমি কি কিছু বুজি না?”
“বোঝো, কিন্তু বেশি বোঝো। অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নয় আহ্লাদি। হ্যাঁ, ওকে আমি টেনে নিয়েছিলাম কিন্তু তোমার ভাষা যা বুঝাতে চাইছে সেরকম কোনো কিছুর জন্যে নয়। এই বিষয়টা এখানেই সমাপ্ত থাকবে। যদি এটা নিয়ে তুমি বকুলের সাথে কোনো প্রকার বাজে ব্যবহার করো তাহলে অনেক দূর পর্যন্ত জল গড়াবে আহ্লাদি।”
আহ্লাদির দাপট কমলো না বরং তুষারের প্রতিটা কথা ওর গায়ে শূলের মতো বিঁধতে শুরু করল।
“আপনের লগে ওর কিছু না থাকলে ওর লিগা আপনের এত দরদ লাগে ক্যান? আপনে কি মনে করছেন, আমারে একটা বুজাইয়া দিলেই হইবো?”
“শোনো মেয়ে…”

ভয়ংকর রেগে গেল ও। এতক্ষণ যাবত চুপচাপ সহ্য করলেও এই মুহূর্তে আর পারল না। তুষারের একটি বাজে স্বভাব হলো, ও সহজে রেগে যায় না কিন্তু একবার রেগে গেলে সহজে ঠান্ডা হয় না। অনেকক্ষণ যাবত ভূতের মতো রাগটা মাথায় চেপে থাকে। একটু পর পর সাপের মতো নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে। আশেপাশের সবকিছুর প্রতি মেজাজ খারাপ লাগে। ভয়ানক নিষ্ঠুরতা করতেও দ্বিধাবোধ করে না।
আহ্লাদির পাশ থেকে উঠে দাঁড়াল তুষার। একটা আঙুল তুলে শাসানোর ভঙ্গিমায় বলতে শুরু করল,

“ঠিক এই কারণেই আমি তোমাকে পছন্দ করতে পারিনি। তোমার আর বকুলের ভেতর পার্থক্যটা ঠিক এই জায়গায়। বকুল যখন জেনেছিল তুমি আমাকে পছন্দ করো, ও বিষয়টা নেতিবাচক ভাবে নেয়নি। তোমাকে আমাকে এক সাথে এক ঘরে দেখেছে যতই সেটা দিনের বেলা হোক না কেন, তারপরও ও তোমাকে আমাকে ছোট নজরে দেখেনি। আর তুমি তখন থেকে উলটাপালটা কথা বলা শুরু করেছো! নিজের মন মানসিকতা পরিবর্তন করো। স্বভাব পাল্টাও। আশেপাশে চোখ মেলে দেখো। তোমার ব্যাপারে সত্যিই কি সবাই মন থেকে ভালোটা বলে? বলে না আহ্লাদি! মেয়েরা হয় মায়ের জাত তাই মেয়েরা লক্ষী। অলক্ষী হয়ো না। কোনো একদিন নিজের এহেন নিচু ভাবনার কারণে নিজেই আফসোস করবে।”

তুষারের মুখ চললো বিরামহীন। এক নাগাড়ে অনেক গুলো কথা বলা শেষে যখন ও কথার লাগাম টেনে ধরে তখন আহ্লাদির দু-চোখে নোনা স্রোতের বন্যা। মানুষটা ওকে চরম অপমান করল বটে। আহ্লাদির জেদ বেড়ে এবার আকাশ ছুঁলো। বারবার দাঁতে দাঁত চেপে একটি নাম মনে মনে উচ্চারণ করে, ‘বকুল’
ওকে করা অপমানের শাস্তি মেয়েটাকে পেতে হবে। নাহলে যে কিছুতেই শান্ত হবে না অশান্ত মনখানা। আহ্লাদি কোনো প্রকার জবাব না দিয়ে সাথে সাথে বেরিয়ে গেল তুষারের ঘর থেকে। তুষার এক হাতে ঘাম মুছতে মুছতে ভাবল, এবার যদি একটু আক্কেলবোধ হয় ওর!

কেউ নিজ থেকে না চাইলে তাকে গিলিয়ে আক্কেলবোধ অথবা ভালো চিন্তা ভাবনার গুণ খাওয়ানো যায় না। এগুলো মা্নুষের ব্যক্তিগত ইচ্ছা, স্বভাব এবং বৈশিষ্ট। আহ্লাদির বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই নিজের স্বভাব পরিবর্তন করার। তার কাছে সে সঠিক এবং তার ভাবনাই ঠিক। একটা মেয়ে অত রাতে আরেকটি ছেলের ঘরে কেন যাবে? আবার সেটি বলায় ছেলেটির এহেন আচরণ তো করার কোনোই প্রশ্ন ছিল না যদি না তাদের ভেতর বিশেষ কোনো সম্পর্ক লুকিয়ে থাকে।

তবে কি আহ্লাদি যে চিন্তাভাবনা করত তুষারকে নিয়ে সেই একই চিন্তা বকুলেরও! এবং তুষার তার প্রতি সাড়া না দিলেও বকুলকে সাড়া দিয়েছে? একজন তালাকপ্রাপ্তা নারী হয়েছে তুষারের মতো ছেলের দিকে হাত বাড়ানো! এত বড় দুঃসাহস ওর? আহ্লাদির ভেতরটা রাগে,ক্ষোভে ফেটে পড়ে। বকুলের চেয়ে হাজার গুণ দেখতে ভালো হওয়া আহ্লাদি সোজা গিয়ে ঢুকলো আরজুর ঘরে। দুর্ভাগ্যবশত মকবুল ঘরেই ছিলেন। গেঞ্জি গায়ে চাপাচ্ছিলেন। কোথাও বেরোবেন মনে হয়। আহ্লাদি ও ঘরে ঢুকেই কেঁদে ফেলল।
আরজু ব্যতিব্যস্ত হয়ে এগিয়ে এলেন।

“ও আহ্লাদি, ও মা, তুই কান্দোস ক্যান? কি হইছে?”
এগিয়ে এলেন মকবুলও। আরজুকে প্রশ্ন করলেন,
“ওয়ে কান্দে ক্যান?”
“কইতে পারি না।”
পরমুহূর্তেই আহ্লাদির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করলেন। প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে লাগলেন।
“ওমা, কি হইছে? ক আমারে। আমি না তোর মায়ের মতো। কেউ কিছু কইছে? কি হইছে মা? ও আহ্লাদি, এমনে চুপ কইরা থাকলে কি বুজুম? বকুলের লগে লাগছে? ও কিছু কইছে?”

আহ্লাদি চোখের জল, নাকের জল একত্র করে দু দিকে মাথা নাড়লো। নাক টেনে ভেজা কণ্ঠে বলল,
“না, ও কিছু কয় নাই। ওরে কিছু কমু দেইখাই তো এত্তডি কতা হুনলাম। ওয় আর কি কইবো?”
“আমি তোর কতার আগামাতা বুজতাছি না মা। আমারে একটু খুইল্যা ক দেহি। এই তোর খালুও আছে সামনে। তুই ক আমারে…”
“তোমার মাইয়ার লগে ওই ভাইজান ভাব জমাইছে। আমি হেইডা জিগাইছি দেইখা আমারে দুনিয়ার কতা হুনাইলো!”
আরজু এবং মকবুল একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলেন।

“গতকাল রাইতের বেলা তোমার ছেড়িরে কইছি আমার লিগা পানি আননের কতা। ওয় আনতে গিয়া হাওয়া হইয়া গেছে। আমি দেখবার লিগা বাইর হইয়া দেহি, ওয় ভাইজানের ঘরের সামনে। দুইজনে কি ফুসুরফাসুর করল। আবার ওর গায়েও হাত দিছে। আমি এইসব দেইখা সারা রাইত ঘুমাইতে পারি নাই। বকুলরে কি জিগামু? তুষার ভাইজানরে জিগাইতে গেছিলাম, হেয় আমারে কি রাগডা দেহাইলো।

আমারে কইলো, আমি যেন বকুলরে এইসব লইয়া কিচ্ছু না জিগাই আর না কাউরে কই। যদি কই তাইলে বলে অনেক খারাপ হইবো। হেয় এই বাড়ির মেহমান, তাই বইলা যা মুন চায় তাই করবো। আর তোমার মাইয়াও বা কেমন! লজ্জা শরম সব খাইয়া ফালাইছে? কয়দিন হইলো এক সংসার থেইকা তালাক খাইয়া আইলো। আইতে না আইতে পোলা মানুষ পাইয়া আউলায় গেছে? এডি জিগাইছি দেইখা আমার দোষ? আমার মন ভালা না। আমারে এতডি কতা হুনানোর হেয় কেডা?”
আহ্লাদি পুনরায় শব্দ করে কাঁদতে লাগল। আরজু দাঁতে দাঁত ঘষলেন। পা বাড়ালেই মকবুল ডেকে উঠে বললেন,
“ওর গায়ে একটাও হাত দিবা না। যা করার আমি করতাছি। মেহমানরে আমি ঘরে আনছি, তাই আমারেই বুজতে দাও।”

“তোমার সাথে আমার মাইয়ার কিয়ের সম্পর্ক?”
তুষার চুপ করে বসে রয়েছে। তাকে ঘিরে আছে মকবুল, আরজু, আহ্লাদি, আহ্লাদির বাবা হারেস এবং ঘরের এক কোণে বকুল। আকাশ এবং সবুজও এতক্ষণ ছিল, তুষার ওদের চলে যেতে বলেছে। মকবুল আর তুষার মুখোমুখি চৌকিতে বসে রয়েছে। মকবুল উত্তরটা করে একবার হারেসের দিকে তাকালে হারেস সুযোগ পেয়ে দ্বিতীয় প্রশ্নটি ছুঁড়ে দিলো,
“তোমারে এইহানে অনেক বিশ্বাস কইরা আমরা জায়গা দিছি। তুমি দেহি এহন ঘরের মাইয়াগো ইজ্জত নিয়া টান লাগাইছো।”

তুষার দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
“আমি এখানে থাকার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ ভাড়া দিয়েছি। আপনারা কেউ বিনা খরচে আমাকে রাখেননি।”
“তাই বইলা যা মুন চায় তাই কইরা বেড়াবা হ?”
“আমি এমন কিছুই করিনি যার কারণে ঘরের মেয়েদের সম্মানহানী হবে। বরং আপনারা একটা ছোট্ট বিষয়কে জটিল করে তুলছেন এবং চিৎকার করে আশেপাশের সবাইকে জানাচ্ছেন। আপনারাই বরং বকুলের সম্মান নষ্ট করছেন।”
“কি বললা তুমি!”

হারেস এমন ভাবে এগিয়ে এলেন যেন এক্ষুনি তুষারের গায়ে হাত তুলবেন। তুষার নিজেও বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। ওর মাথার রগ দপদপ করে কাঁপছে। হুট করে ওর চোখ পড়ল বকুলের দিকে। বকুলের চেহারার অস্বাভাবিক কাঁপন ওকে নিস্তেজ করে দিলো। চোখ ইশারায় মেয়েটাকে স্বাভাবিক হতে বলে হারেসের দিকে ফিরে যথাসম্ভব ঠান্ডা গলায় বলল,
“আপনি উত্তেজিত হয়ে জল ঘোলা করবেন না। বকুল গত রাতে যাচ্ছিল, আমি জেগে ছিলাম। ওকে দেখার পর থামিয়ে দাঁড়া করাই এবং কিছু কথা বলি। আমি মনে করি না এতে এমন কোনো পাপ করে ফেলেছি।”
“আপনে ওরে ছুইছেন…”

তুষারের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিলো আহ্লাদি। তুষার অগ্নি চোখে তাকাল। পারছে না চোখের আগুন দিয়েই এই বেয়াদব মেয়েটাকে ভস্ম করে দিতে। এই মেয়েটাই সব কিছুর জন্য দায়ী।
“তোমার কাছে কি প্রমাণ আছে যে আমি ওকে ছুঁয়েছি?”
আহ্লাদি জবাব দিতে পারল না। আমতা আমতা করে আরজুর মুখের দিকে তাকাল। তুষার পুনরায় শক্ত কণ্ঠে জবাব চাইলো,
“বলো কি প্রমাণ আছে যে আমি ওকে ছুঁয়েছি?”
সঙ্গে সঙ্গে বকুলকে উদ্দেশ্য করে তুষার প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“আমি কি তোমাকে ছুঁয়েছিলাম?”

বকুল হতভম্বের ন্যায় সেকেন্ড তিনেক চেয়ে থেকে আস্তে করে মাথা নাড়লো। তুষার রীতিমতো ধমকের সুরে বলল,
“কথা বলো। বলো, ছুঁয়েছিলাম?”
বকুল ভয়ে কেঁদে ফেলল। দু-দিকে মাথা নেড়ে বলল,
“না। আপনে আমারে ধরেন নাই। খালি কতা কইছিলেন।”
“কথা বলাটা যে মহা পাপ, আর এই বাড়িতে যে এত কাহিনি, এত নাটক হতে পারে তা আগে জানলে কখনোই এখানে আসতাম না। আমার একটা সম্মান আছে। রীতিমতো সম্মান নিয়ে টানাটানি!”
তুষার মুখ দিয়ে বিরক্তি সূচক চ কারান্ত শব্দ উচ্চারণ করে। বকুলের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ ইশারায় ওকে শান্ত হতে বলে মকবুলের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,

“কাকা,আমি এখানে আর এক মুহূর্তও থাকব না। আজকেই এখান থেকে চলে যেতে চাই। আপনাদের এত নাটক সহ্য করার শক্তি পাচ্ছি না।”
মকবুল কি বলবেন ভেবে পেলেন না। নিজের কাছেই খানিকটা লজ্জিত বোধ করছেন। বউয়ের কথায় হারেস কে এভাবে ডেকে এনে ছেলেটাকে অসম্মানিত করা মোটেও উচিত হয়নি। ছেলেটা ভালো ঘরের, ভালো বংশের। সম্পর্ক থাকলে তারই উপকার হতো।

তুষার কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল। সেই বিকেলেই হারেস যাওয়ার সময় আহ্লাদিকে সাথে করে নিয়ে গেল। এবং রাতের মধ্যে তুষারও নিজের সব কিছু গুছিয়ে নিলো। সেও যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। ভোরে স্টিমার ছাড়বে শহরের উদ্দেশ্যে। সেই স্টিমারেই তুষার সব স্মৃতি ফেলে চলে যাবে চিরতরের জন্য। হয়তো আর কোনোদিন মনপুরায় আসা হবে না। হয়তো কোনোদিন বকুলের সামনে দাঁড়ানো হবে না। বুকের ভেতর কোথাও একটা জ্বলছে, পুড়ছে মরিচের মতো। কিন্তু আত্মসম্মানে আঘাত লেগেছে। আর যে নিজেকে বিসর্জন দিয়ে এখানে থাকা যায় না!

শেষতক মকবুলও বার কয়েক বললেন, যা হয়েছে সব ভুলে থেকে যাওয়ার কথা। যে কাজে এসেছিল ও, সেই কাজ শেষ করে যাওয়ার কথা। তুষার রাজি হয়নি। অগ্রিম যে থাকার টাকাটা ও দিয়েছিল, সেটাও নিতে আগ্রহী ছিল না। বরং হাসিমুখেই নিস্তেজ কণ্ঠে বলল,
“আটকাবেন না কাকা। আমার যাওয়া প্রয়োজন।”
এরপর একটা মানুষকে আর বলার কিছুই থাকে না। সে রাতে খেতে বসেও কারো খাওয়া হলো না। আরজুরও কোথাও না কোথাও খারাপ লাগল একটু। শত হোক, নিজের সংসার। এই প্রথম একটা বাইরের মানুষ এলো, তাও আপ্যায়নের বদলে কিসব নিয়ে বিদায় হচ্ছে!

বকুলের আজ কান্না থামছে না। বুকের ভেতর উথাল ঝড়। রাত ফুরালেই মানুষটা চলে যাবে। আর বুঝি কোনোদিন তার ছায়া দেখারও সৌভাগ্য হবে না! এইকবার এপাশ, একবার ওপাশ করে শেষমেশ উঠে বসল ও। আজ কোনো বারণ শুনছে না এ মন। এত উচাটন তো আগে কখনো লাগেনি। মানুষটা খালি হাতে যাচ্ছে না, যাচ্ছে ওর গোটা সত্তা চুরি করে। ওর হৃদয়, ওর রুহ, ওর জীবনটাই মানুষটার নামে উৎসর্গ! বকুল চোখ মুছে চুপি চুপি পায়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। একবার দেখে নিলো ও ঘরটা। বাবা-মা সবাই ঘুমিয়ে।

চারিদিকে সব চুপচাপ। তুষারের ঘরের দিকে যেতে যেতে কি মনে পড়ায় থামলো ও। নিজের ঘরে এলো। চৌকির তল থেকে একটা ঝাপি টেনে নিয়ে আসে। সেখানে একটা ছোট্ট কৌটায় খানিকটা গাঢ় ঘন কাজল। বকুল খুব যত্নে কাজল টানে চোখে। ঘরে কোনো আয়না নেই। নিজেকে নিজে দেখতে পায় না। দেখতে হবেও না। ওই মানুষটা দেখুক! সে জানুক, সবসময় এলোমেলো থাকা আধা পাগল মেয়েটা আজ তাকে দেখাতে চোখে কাজল টেনেছে! তারপর দ্রুততার সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

তুষারের দরজা আজ বন্ধ। বকুল আতংকিত বোধ করে। লোকটা কি ঘুমিয়ে গেছে? যদি বকুলকে তার ঘরের সামনে দেখে রাগ করে বসেন? যদি বলেন, কেন এসেছো? চলেই তো যাচ্ছি! তবুও কেন মায়া বাড়াচ্ছো? বকুল কি জবাব দেবে? মাথার ভেতর প্রশ্ন পোকা কিলবিল করে খায়। তবুও সব জড়তা পাশে রেখে বকুল আস্তে করে কাঠের দরজায় টোকা মা*রে। একবার, দুইবার, তৃতীয় বার হাত তুলবার আগেই দরজা খুলে যায়। বকুলের নিঃশ্বাস আঁটকে আসে। চোখ জলে ভরে ওঠে। ও খোদা! মানুষটা এত সুন্দর কেন? এত কেন মায়া ওই মুখে? কাল থেকে যে আর দেখা হবে না! একবার ঐ চোখজোড়া ছুঁয়ে দিলে কি খুব পাপ হবে?

তুষার বলল,
“তুমি?”
বকুল দ্রুত নিজেকে সামলালো। আস্তে করে বলল,
“একটু বাইরে আইবেন?”
“কোথায়?”
“ভয় পাইয়েন না, নিয়া মাইরা ফালাবো না। আমার সাথে এক জায়গায় যাইবেন। আইবেন?”
তুষার মৃদু শ্বাস ফেলে গায়ে গরম কাপড় চাপায়।
“চলো।”

ওরা পাশাপাশি হাঁটে। বকুলদের বাড়ির পেছন দিয়ে যে পথটা সোজা আম বাগানের গিয়ে থামে, সেই পথে এত আঁধারেও অবলীলায় এগিয়ে চলে বকুল তরতর করে। তুষারের হাঁটতে সমস্যা হয়। তবে আজ বুকে ভয় নেই, আতংক নেই। ও অনুভব করে। এক হাত দূরত্বে থাকা মেয়েটা ওর হৃদয়ের এত কাছে কেমন করে এলো? হায় ভালোবাসা- তুমি এক আজব জিনিস! মানুষকে উন্মাদ বানাতে কোনো কমতি নেই তোমার।
আজ আকাশে চাঁদ নেই। তুষার বিড়বিড় করে বলে,

“চাঁদ টা তো আমার পাশে নেমে এসেছে।”
বকুল গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বলল,
“কি কইলেন?”
তুষার মৃদু হেসে জবাব দিলো,
“কিছু না। এখানে এলে যে!”
“এমনি।”
“কেউ দেখলে…”
বকুল কটাক্ষ করে হাসল।
“নতুন কইরা আর কিইবা হইবো? হইতে দেন। কাইল তো যাইবেনই।”
“হুম।”

এরপর সব চুপ। মৃদুমন্দ বাতাস। গায়ে কা*টা ধরিয়ে দেওয়ার মতো ঠান্ডা কিন্তু এই মুহূর্তে ওরা দুজনেই উষ্ণ। ভালোবাসার আগুন ওদের জাপটে ধরে আছে। পৃথিবীর কোনো অনুভূতি অনুভূতি শূন্য দুটো হৃদয়ে দাপট চালাতে পারছে না।
বকুল বলল,
“আপনে আর আইবেন না?”
তুষার বলল,
“জানি না।”
“আর কোনোদিন আপনের লগে দেখা হইবো না?”
“ভাগ্যে থাকলে!”
“এইখানেই তো মা*ইর খাই আমি। আমার এমুন পোড়া ভাগ্য। আমি সবসময় যা চাই, তাই হারাই।”
“তুমি আমায় চেয়েছিলে কখনো?”
“যদি বলি চাইছি…তাইলে থাকবেন?”
“না বকুল। এবার আমায় সত্যিই যেতে হবে।”

বকুল মৃদু শ্বাস ফেলে। সেই নিঃশ্বাসে মিশে আছে কান্না, লুকোনো আকুতি। ও আর কিছু বলতে পারল না। অন্ধকারে চোখ বুজে মানুষটাকে অনুভব করে। যখন চোখ খুলল, বিদ্যুৎ গতিতে চমকে উঠে। তুষার অত্যধিক সাহসিকতার একটি কাজ করে বসল। এগিয়ে এসে তড়িৎ বকুলকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিলো। এই প্রথম…হয়তোবা এই শেষ! ভাগ্য ওদের দু’জনার কপালে কি লিখে রেখেছে কে জানে!

“কাঁদবে না। চোখের কাজল মুছে যাবে।”
“আপনে দেখছেন?”
“আমার চাঁদ রাণীর গায়ে দাগ, আর মেঘবালক এত কাছে এসেও দেখবে না?”
“আপনের এই শক্ত কতাডা আজকে আমি বুজলাম।”
“কারণ আজ তোমার হৃদয়ে প্রেম চাঁদ রাণী।”
“আমারে ভুইলা যাইবেন?”
“যে হৃদয়ের এত কাছে তাকে কি করে ভুলি?”
“আর কি আইবেন না?”

“আমার সাথে যোগাযোগের একটা নাম্বার এবং আমার বাড়ির ঠিকানাটা তোমায় লিখে দিয়ে যাচ্ছি চাঁদ রাণী। যেদিন ডাকবে, আমি চলে আসবো। মেঘ উড়ে যত দূরেই যাক, ঘুরেফিরে আসবে তো তার চাঁদ রাণীর ধারেই…”
তুষারের ঠোঁট মেয়েটার কপাল ছোঁয়। দুটি মানবের ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে রয় গুমোট ঘোলা প্রকৃতি। ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে রইলাম আমিও, আপনিও! চাঁদ রাণী এবং মেঘবালকের ভালোবাসায় আমার হৃদয়ে দুটি বাক্য সাজে,
‘ব্যর্থ পোড়া বুক নিয়ে ওরা একলা রাত্রির তারা গোণে,
আহারে প্রেম, আহা ভালোবাসা, কি সুনিপুণ হাতে বুকে সূচ বোনে!’

ঝরা বকুলের গল্প পর্ব ১৭

আজকের পর্ব পড়ে কেউ কিছু উপলব্ধি করতে পারবে কীনা জানি না তবে আমি লিখতে সময় শুধু চোখ মুছেছি!

ঝরা বকুলের গল্প পর্ব ১৮