ডাক্তার ম্যাডাম পর্ব ৪

ডাক্তার ম্যাডাম পর্ব ৪
মুমতাহিনা জান্নাত মৌ

আমি বাসায় না থাকলে তুই কি এরকমই পাগলামি করিস?
–না,না।কি বলছেন এসব?আমি তো মাত্র পড়াশোনা শেষ করে মিউজিক টা অন করেছি।
নোমান তন্নির কথা শুনে বললো, মনে তো হয় না তুই আজ পড়তে বসেছিলি?এভাবে মিথ্যা কথা বলে কি লাভ তন্নি?এতে ক্ষতি কিন্তু তোরই হচ্ছে।যা পড়তে বস।এই বলে নোমান তানিশার দিকে একবার তাকিয়েই আবার তার চোখ ফিরে নিলো।আর রুম থেকে বের হয়ে গেলো।

তানিশা তার জায়গাতেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।নোমান রুম থেকে বের হওয়া মাত্র তন্নি বললো,
এখন কয়টা বাজে তানিশা? নোমান ভাইয়া আজ এতো তাড়াতাড়ি ফিরলো কেনো?
তানিশা ঘড়ি দেখে বললো ৯ টা বাজে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

–মাত্র ৯ টা।আর তাতেই ভাইয়ার ওয়ার্ড করা শেষ হয়ে গেলো?
তানিশা তন্নির কথা শুনে বললো, আজ হয় তো ওয়ার্ডের ক্লাস তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেছে।সেজন্য উনিও তাড়াতাড়ি ফিরেছেন বাসায়।
আসলে নোমানকে এখন সারারাত ওয়ার্ডেই থাকতে হয়। সারারাত ওটিতে থেকে আবার সকাল সাতটায় ক্লাসে এটেন্ড করে সে।সকল ক্লাস শেষ করে তবেই সে বাসায় ফেরে।কিন্তু আজ একটু নোমান তাড়াতাড়িই বাসায় ফিরেছে।সেজন্য তন্নি ভীষণ অবাক হলো।

তন্নি নোমানের কথা শুনে কিছুক্ষণ বই নিয়ে পড়াশোনা করলেও তার আর ইচ্ছে করলো না পড়তে। বাসায় তার বেস্ট ফ্রেন্ড এসেছে আর সে তাকে সময় দেওয়া বাদ দিয়ে বই নিয়ে বসে থাকবে?না,তা কিছুতেই হবে না।এজন্য তন্নি বই বন্ধ করে তানিশার কাছে চলে গেলো।
তানিশা একা একা বেলকুনিতে দাঁড়িয়ে আছে আর মনে মনে ভাবছে কবে যে সেও চতুর্থ ইয়ারে উঠবে?চতুর্থ ইয়ারে উঠলে তবুও ডাক্তার হবার স্বপ্নের প্রায় কাছাকাছি চলে যাওয়া যায়।কারণ তখন ওয়ার্ডে ক্লাস হয় নিয়মিত।ডাক্তার হওয়ার সকল নিয়মকানুন কিছুটা শিখে ফেলে স্টুডেন্টরা।

হঠাৎ তন্নি পিছন দিক থেকে তানিশাকে ধরায় সে একদম চমকে উঠলো।তানিশা ভয়ে বুকে থু থু ছিটিয়ে দিলো।
তন্নি তা দেখে হাসতে হাসতে বললো,ডাক্তারদেরকে সবসময় সাহসী হতে হয়।কিন্তু তুই তো একদম ভিতুর ডিম।
তানিশা তখন বললো,আমি মোটেও ভয় পাই না তন্নি।কিন্তু তুই যেভাবে হঠাৎ এসে ধরেছিস ভয় পাবারই তো কথা।
–আচ্ছা বাদ দে।চল না একটু গল্প করি এখন।
তানিশা সেই কথা শুনে বললো, তোর কি পড়াশোনা শেষ হয়েছে?
–রাখ তো পড়াশোনা। ছুটির দিনেও যদি বই নিয়ে বসে থাকতে হয় তাহলে সে ছুটি দেওয়ার কি মানে?তার উপর আবার তুই এসেছিস বাসায়।আজ হবে না এসব পড়াশোনা।চল কিছুক্ষন গল্প করি।

–কি গল্প করবি?
–যেকোন গল্প?
তানিশা তখন তন্নির দিকে ভালো করে তাকালো।তন্নির চোখেমুখে কেমন যেনো প্রেম প্রেম গন্ধ।নতুন প্রেমে পড়লে মুখে যেমন একটা আনন্দের ঝটকা দেখা যায় ঠিক তেমনি তন্নির মুখখানা জ্বলজ্বল করছে।তানিশা তখন নিজেই জিজ্ঞেস করলো,
একটা সত্যি কথা বলবি?
–কি?

–তোর হয়েছে টা কি বল তো?তোকে কেমন জানি আজ অন্যরকম লাগছে।তুই কি কিছু বলতে চাস আমাকে?
তন্নি তানিশার কথা শুনে চুপ করে থাকলো।কারণ সে সত্যিই কিছু একটা বলতে চায়।কিন্তু বলার সাহস হচ্ছে না তার।আর তন্নি তানিশাকে এজন্যই ডেকেছে তার বাসায়।কারণ সে কথাটা তানিশাকে না বলে থাকতে পারছে না।
হঠাৎ নোমান আবার আসলো তন্নির রুমে।আর তন্নি তন্নি বলে চিৎকার করতে লাগলো।তন্নি নোমানের ডাক শোনামাত্র রুমে চলে গেলো।নোমান তন্নিকে দেখামাত্র বললো,
কি রে?রাত কয় টা বাজে।রুমে আলো জ্বালানো কেনো?
–না মানে ভাইয়া এতোক্ষণ পড়লাম।এখন পড়া শেষ সেজন্য একটু বেলকুনিতে বসে গল্প করছিলাম তানিশার সাথে।
–এতো রাতে গল্প?যা ঘুমে পড়।
–আজ ছুটির রাত না!আরেকটু দেরীতে ঘুমাবো।

নোমান তখন বললো,না এখনি ঘুমাবি।আর যদি ঘুম না ধরে তাহলে আবার পড়তে বস।মেডিকেলে চান্স নিতে গেলে এক সেকেন্ডও নষ্ট করা যাবে না।প্রতিটা সেকেন্ডের অনেক মূল্য এখন।
তানিশা বেলকুনি থেকেই নোমানের সব কথা শুনছিলো।
হঠাৎ নোমান বললো,তোর বান্ধুবী তোকে উপদেশ দেয় না?তুই যে এভাবে সময় নষ্ট করছিস সে কিছু বলে না?
–হ্যাঁ বলে।
–কই তোর বান্ধুবী? ডাক দেখি?

তন্নি সেই কথা শুনে তানিশাকে ডাকতে গেলো।
তানিশা তন্নির কথা শুনে ভীষণ অবাক হলো।নোমান তাকে ডাকছে?যে ছেলে জীবনেও কথা বলে নি তার সাথে।সে আজ হঠাৎ ডাকতে যাবে কেনো?সে নিশ্চয় ভুল শুনেছে।
সে জন্য তানিশা বেলকুনিতেই দাঁড়িয়ে রইলো।
তন্নি তখন বললো, কি রে? কি হলো?শুনতে পাস নি?নোমান ভাইয়া ডাকছে তোকে?
তানিশা তন্নির কথা শুনে রুমে চলে আসলো।

কিন্তু তানিশা রুমে আসতেই নোমান তানিশাকেও একটা ধমক দিলো।নোমান বললো,
বান্ধুবীকে পড়াশোনার বিষয় এ সাহায্য করো না?না শুধু তা তা থই থই করে নাচানাচি করো?
তানিশা নোমানের কথাশুনে একদম বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো।
নোমান এবার শান্তসুরে বললো,তুমি তো মেডিকেলে চান্স পাইছো,তা তোমাকে তো আর বলতে হবে না মেডিকেলে চান্স নিতে গেলে কতটা পরিশ্রম করতে হয়?
–জ্বি।
–তুমি কি চাও না তোমার বান্ধুবীও মেডিকেলে চান্স পাক।
–হ্যাঁ অবশই।
–তাহলে সে কেনো এভাবে সময় নষ্ট করছে?কিছু বলো না কেনো তাকে?এভাবে সময় নষ্ট করলে তো সে এবারও সুযোগ পাবে না।

তানিশা সেই কথা শুনে তন্নির দিকে তাকালো।আর তন্নি তানিশার দিকে।
নোমান তা দেখে বললো এভাবে তোমরা একে অপরকে দেখছো কেনো?আমি কিছু বলছি কিন্তু।
তন্নি সেই কথা শুনে সেখান থেকে চলে গেলো। আর একটা বই হাতে নিয়ে আবার পড়া শুরু করলো।তন্নি মনে মনে ভাবতে লাগলো এই নোমান ভাই টা তাকে এতো শাসায় কেনো?আর মেডিকেলে যে চান্স পেতে হবে তার কি মানে?
তানিশা তার জায়গাতেই দাঁড়িয়ে থাকলো।সে মনে মনে ভাবতে লাগলো এই বাসাতে আসাটাই তার ভুল হয়ে গেছে।কেনো যে সে আসতে গেলো?

হঠাৎ নোমান তানিশাকে বললো,তুমি এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেনো?তোমার কি কোনো পড়াশোনা নাই?তানিশা সেই কথা শুনে নিজেও চলে যেতে ধরলো।
নোমান তখন বললো,ওয়েট!ওয়েট!আগেই কোথায় যাচ্ছো?আগে বলো তোমার পড়াশোনা কেমন চলছে?সবকিছু বুঝতে পারছো তো?
তানিশা কি উত্তর দেবে কিছুই বুঝতে পারলো না।

নোমান তখন বললো,শুধু এপ্রোণ গায়ে দিয়ে ঘুরলেই ডাক্তার হওয়া যায় না।মেডিকেলে চান্স পেতে যতটা পরিশ্রম করেছো তার থেকে হাজার গুন পরিশ্রম করতে হবে এই মেডিকেলে টিকে থাকতে গেলে।তাছাড়া তুমি মাত্র ভর্তি হয়েছো তো এখনো কিছু বুঝতে পারছো না।দুই দিন পরে ঠিকই টের পাবে।তখন এভাবে পাগলের মতো নাচানাচির সময় ই পাবে না।
তানিশা নোমানের কথা শুনে নিচ মুখ হয়ে থাকলো।কারণ নোমান সত্যি কথাই বলেছে।তানিশা ইতোমধ্যে সত্যি হাঁপিয়ে উঠেছে।ডাক্তার হওয়ার শখ তার অনেক আগেই ঘুচে গেছে।
তানিশাদের কলেজে ক্লাস নেওয়ার জন্য আলাদা ডিপার্টমেন্ট থাকে।এসব ডিপার্টমেন্টে গিয়ে গিয়ে ক্লাস করাটাই তো মারাত্নক রকমের ঝামেলা মনে হয় তানিশার কাছে।

বায়োকেমিস্ট্রির ক্লাস টা খারাপ না লাগলেও এনাটমির ডেমো ক্লাস টা এক বর্ণ ও বুঝে উঠতে পারছে না তানিশা।তার উপর আবার ফিজিওলজি তো আছেই।পড়তে পড়তে তানিশার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা!
আবার এসব বিষয়ে নিয়মিত পরীক্ষা লেগেই থাকে।
সবচেয়ে ছোট পরীক্ষা হলো আইটেম,যেটা প্রতিদিনই হয়ে থাকে।এটা মূলত ভাইভার মতো।
বেশ কয়েকটা আইটেম মিলে একটা কার্ড হয়।তারপর কয়েকটা কার্ড পরীক্ষা মিলে একটা টার্ম পরীক্ষা হয়।রিটেন,ভাইভা,প্রাক্টিটিক্যাল তো আছেই।সবশেষে তিনটা টার্ম মিলে একটা প্রফেশনাল পরীক্ষা হয়।
কার্ড, টার্ম আর প্রফ নামক যে পরীক্ষাগুলো হয়,

তানিশা মনে করে সেগুলো কোনো পরীক্ষায় নয়,তানিশার কাছে সেগুলো যন্ত্রনা,নির্যাতন,আর মানসিক চাপ মনে হয়।
পড়তে পড়তে একেক টা স্টুডেন্ট পাগলের মতো হয়ে যায়।তানিশার অবস্থাও এখন পাগলের মতো।কোথাও বেড়াতে যেতেও পারে না সে।দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছে তার।তার বাবা মা নিজেরাই ঢাকাতে এসে দেখে যায় তাকে।
কারণ মেডিকেল কলেজে কোনো লম্বা ছুটি থাকে না।ঈদের ছুটি,পূজার ছুটি ঠিক যতদিন সরকারি অফিসে থাকে, তাদের ছুটিও ততোদিন ই থাকে।

তানিশা এখন মনে মনে ভাবে কোন দুঃখে যে মেডিকেলে পড়তে এলাম?
তানিশা কিছুক্ষনের জন্য তার মেডিকেল লাইফ নিয়ে কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে গেলো।
তানিশা প্রথম যেদিন মেডিকেলে এপ্রোণ জড়িয়ে ক্লাস করতে গেলো, ভীষণ উত্তেজনা ভর করছিলো তার মনে।সাদা এপ্রোণ টাকে সবচেয়ে পবিত্র কাপড় মনে হয়েছিলো তার।প্রথম দিন স্যার দের জ্ঞানগর্ভ কথা শুনে ভেবেছিলো,আহা!কতই না সুন্দর হবে জীবন টা এখন।কত ভালো লাগবে মানুষের সেবা করতে পেরে।সেই খুশিতে আব্বু আম্মুকে ফোন করে বললো,
বাবা, আমার জন্য অনেক অনেক দোয়া করো,মা আমার জন্য বেশি করে দোয়া করো।আমি যেনো মানুষের মতো মানুষ হতে পারি।সারাজীবন অন্যের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে পারি।

কিন্তু নবীন তানিশা সেদিন বুঝে উঠতে পারে নি মানুষের সেবা করতে যেসব পর্যায় পার হতে হবে তা পার করতে গিয়ে সে নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়বে।
আসলে মেডিকেল কলেজ মানেই, ভীষণ পড়ার চাপ,প্রতিযোগিতা, কদিন যেতে না যেতেই শুধু পরীক্ষা আর পরীক্ষা,খিদে চেপে রেখে ক্লাসের পর ক্লাস করে যাওয়া।
তারপরও এতো কষ্টের মাঝে নিজেকে নিয়ে গর্ববোধ করে তানিশা।কারণ বাবা মার স্বপ্নটা যে পূরন করতে পেরেছে।তানিশার বাবার ভীষণ ইচ্ছা ছিলো,তানিশা একদিন অনেক বড় ডাক্তার হবে।এলাকার মধ্যে প্রথম এমবিবিএস ডাক্তার হবে সে।সেই স্বপ্ন পূরনের পথেই আছে তানিশা।

তবে সাদা এপ্রোণ টি গায়ে দেওয়ার পর থেকে তানিশার সম্মান যেনো বহুগুন বেড়ে গেছে।কোথাও যদি এপ্রোণ গায়ে দিয়েই যায় আজব ধরনের এক সম্মানিত ব্যক্তি হয়ে যায় সে।
কথায় আছে না,সূর্যের চেয়ে বালির উত্তাপ বেশি থাকে।তেমনি ডাক্তার দের থেকে মেডিকেল স্টুডেন্ট দের সম্মান যেনো অনেক বেশি থাকে।
একবার তানিশার বাবা হসপিটালে চেকাপ করানোর জন্য ঢাকায় এসেছিলেন।তানিশা কলেজ শেষ করেই বাবাকে নিয়ে হসপিটালে যায়।রিসেপশনে সিরিয়াল নিতে গিয়ে এমন খাতির করা শুরু করলো সবাই,তানিশার জীবনদশায় এরকম খাতির কখনোই পাই নি সে।

ডাক্তার ম্যাডাম পর্ব ৩

তানিশা সবসময় ভাবে,সে বড় কোনো ডাক্তার হতে পারবে কিনা জানে না,তবে এখন থেকেই সকল মানুষের ভালোবাসা পাচ্ছে প্রচুর।
এদিকে নোমান তানিশার প্রফের পরীক্ষার ব্যাপারে একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছে।কিন্তু তানিশা এখনো তার কল্পনার রাজ্য থেকেই ফেরে নি।

ডাক্তার ম্যাডাম পর্ব ৫