তান্ডবে ছাড়খার পর্ব ১৩

তান্ডবে ছাড়খার পর্ব ১৩
জাকিয়া সুলতানা ঝুমুর

পরেরদিন সকাল বেলা তাহসান ফজরের নামায পড়ে বাহিরে কিছুক্ষণ হাটাহাটি করে।সাতটার দিকে ডাইনিং টেবিলে নাস্তা করতে যায়।তাহসান যে সেই সাত সকালে উঠেছে এটা আফিয়া বেগমের দৃষ্টি এড়ায়নি।ছেলের সামনে নাস্তা দিয়ে পাশে বসে।তাহসান হাসিমুখে খাবার খায়।আফিয়া ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আব্বু;তোকে খুব খুশী লাগছে যে!”

তাহসান আসলে নিজের মনের প্রফুল্লতা লুকাতে পারছেনা।এই যে না চাইতেও মুখটা কেমন হাসিহাসি হয়ে যাচ্ছে এটা তো বন্যার কারণেই।মেয়েটা তার চাঁদ হয়ে গেছে;এর চেয়ে খুশী আর কি হতে পারে!সে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
“জ্বর ভালো হয়ে গেছে তাই মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছে।”
আফিয়া হেসে ছেলের মাথায় হাত ভুলায়।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“সবসময় এমন হাসিখুশি থাকবি।তোকে এমন দেখতেই আমার ভালো লাগে।”
তাহসান বাধ্য ছেলের মতো মাথা এলিয়ে বললো,
“আচ্ছা।”

বন্যা আজকে একটু বেশী ঘুমিয়েছে।তার মনে হয়েছে অনেকদিন পরে সে এমন শান্তির ঘুম ঘুমালো।এতোদিন বুকে যে পাথরটা চাপা দিয়ে থাকতো আজকে সেটা নেই,নেই লাগছে।সাড়ে আটটার সময় ফ্রেশ হয়ে বের হয়।রেনু বেগম তখন রান্নায় ব্যস্ত;বন্যা রান্নাঘরে গিয়ে তার আম্মাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে।রেনু বেগম চমকে যায় পেছন ফিরে বন্যার হাসিমুখটা দেখে মনে শান্তি পায়।হাতের কাজ রেখে বন্যার ববকাট চুল গুছিয়ে দিয়ে বললো,
“কি ব্যাপার ?”

বন্যা তার মিষ্টি হাসিটা তার আম্মাকে উপহার দিয়ে বললো,
“ভালো আছো আম্মা?”
রেনু বেগম মাথা নেড়ে বললো,
“ভালো।এতো আহ্লাদ করা হচ্ছে কেনো?”
বন্যা রাতের স্মৃতি রোমন্থন করে মুচকি হাসে।মিষ্টি দেখতে রাজকুমারটা যখন একান্ত তার তখন তো তাকেই এসব আহ্লাদ করা মানায়।মায়ের হাত থেকে কাঠি নিয়ে তরকারি নেড়ে বললো,

“এমনি।”
“আচ্ছা।যা টেবিলে নাস্তা দেয়া খেয়ে নে।”
“আব্বা কোথায় আম্মা?”
“কয়টা বাজে খেয়াল আছে?কখনই অফিসে চলে গেছে।আজকাল রাস্তাঘাটে যা জ্যাম,আগে আগে না বের হলে দেরী হওয়ার ভ,য় থাকে।”

বন্যা চুপচাপ নাস্তা সেড়ে ভার্সিটির উদেশ্যে বেরিয়ে যায়।চারতলার বারান্দা থেকে তাহসান মুচকি হাসে।জিন্স আর ঢোলা শার্ট গায়ে বন্যা পিছু ফিরে থাকায় তাহসান হাত নেড়ে বিদায় জানায়।বন্যা প্রতিউত্তরে মুচকি হেসে মাথা নাড়ায়।এই যান্ত্রিক কোলাহলের শহরে সবাই যখন প্রাত্যহিক ঝঞ্ঝাটময় কাজ কর্মে ব্যস্ত দুজন মানুষ খুব গোপনে তাদের ভালোবাসার দিন উদযাপন করে নেয়।

সারাদিন চাতক পাখির মতো তাহসান অপেক্ষা করে কখন বিকেল হবে।যখন বিকেল হলো তখন মোবাইল হাতে নিয়ে বন্যাকে মেসেজ করে বেরিয়ে পড়ে।এই একদিনেই মনে হচ্ছে বন্যা তাহসানের কলিজা হয়ে গেছে,সারাটাক্ষন একসাথে থাকতে ইচ্ছে করে।আচ্ছা সবারই কি এমন হয়?প্রেমে পড়লেই কি এমন পাগলাটে ইচ্ছে মাথায় ভর করে?
বন্যা তখনো ভার্সিটিতে।আজকে তাদের এক্সট্রা ক্লাস ছিলো বিধায় দেরী।তাছাড়া বন্ধুদের পেয়ে বন্যা আজকে গল্পটা একটু বেশীই করে ফেলেছে।তন্নী সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বললো,

“কি ব্যাপার!আজকে এতো খুশী কেনো?”
বন্যা মুচকি হাসে।মনের খুশী মুখে কেনো ভেসে উঠে?সে তন্নীর প্রশ্নে কোনো উত্তর দেয় না।তন্নীর চোখ এড়ায়না বন্যার মুচকি হাসি।মেয়েটাকে হাসিখুশি দেখলে তার ভালোই লাগে।সবাই চলে যাবার পরে বন্যা রবীন্দ্র সরোবরে চলে যায়।আজকে প্রথম কোনো ছেলের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে তার উপর ছেলেটা তার প্রিয় মানুষ।বন্যার নাকের ডগা ঘেমে উঠে,হাত দিয়ে নাক মুছে নিজেকে শান্ত করে,আসলে তার খুব নার্ভাস লাগছে।

তাহসান চল্লিশ মিনিট ধরে অপেক্ষা করছে।অন্যমনস্ক হয়ে বারবার ঘড়ি দেখছে।মেয়েটা কি আসবেনা?তখনি বন্যা আসে;ধীর পায়ে তাহসানের পাশে এসে বসে।তাহসান হাসিমুখে বললো,
“কি ব্যাপার ম্যাডাম?না আসার ফন্দি আটা হচ্ছিলো বুঝি?”
বন্যা হাসে;মাথা নেড়ে না জানায়।

“বন্ধুরা যাচ্ছিলোনা তাই দেরী হলো।কখন এসেছেন?”
তাহসান ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো,
“প্রায় চল্লিশ মিনিট হবে।”
বন্যা মাথা নেড়ে বললো,
“খুব বেশী অপেক্ষা করতে হলো।”

তাহসান হাসে।বেঞ্চে থাকা বন্যার হাতটা সযত্নে নিজের দুই হাতর মুঠোয় নিয়ে বললো,
“তুমি আমার চাঁদ;তোমার জন্য মাত্র চল্লিশ মিনিট কেনো দরকার হলে সারাটা জীবন অপেক্ষা করে যাবো।এর বিনিময়ে তুমি শুধু আমার হয়ো।”

তাহসানের এই সামান্য কথায় বন্যা ভিষণ মুগ্ধ হয়।ছেলেটা এতো মিষ্টি করে কথা বলে যে ভালো না লেগে থাকাই যায় না।বন্যা ভাবে আগে তো তাহসানকে কিংবা তার কথাবার্তা সবই বিরক্ত লাগতো কিন্তু এখন একটুও বিরক্ত লাগে না বরং বিরক্তির যায়গায় ভালোলাগা লাজ করে এটাই বুঝি প্রেমের শক্তি।সে তাহসানের দিকে তাকিয়ে লজ্জামাখা গলায় আস্তে করে বললো,

“আমি তো আপনারই।সারা জীবনের জন্য।”
তাহসান বন্যার কথায় হেসে ফেলে।আস্তে করে বললো,
“তুমি লজ্জা পেলে আমার ভিষণ ভালো লাগে।তোমাকে লজ্জাবতী ললনা বলতে ইচ্ছে করে।”
বন্যা।চকিত গলায় বললো,

“আপনি বাচ্চা ছেলেদের মতো ফ্লাট করছেন।”
“তাই নাকি?আমিতো আমার লজ্জাবতীর গুনগান গাইছি।তোমার লজ্জা লাগছে নাকি?দেখি দেখি।”
তাহসান মাথা নিচু করে বন্যার দিকে তাকালে বন্যা অন্যদিকে তাকিয়ে বললো,
“চুপ করেন না প্লিজ।”

তাহসান মুগ্ধ হয়ে বন্যাকে দেখে।এতোদিন শক্ত খোলসে তার সামনে আসলেও আজকে এসেছে কোমল হয়ে।এই যে আড়চোখে তাকে দেখা কিংবা লজ্জা পাওয়া সব কিছুই তাহসান আজকে প্রথম দেখছে।শান্ত গলায় বললো,
“আমার সাথে এমনই থাকবে সবসময়।”
বন্যা কথা বাড়ায় না বরং বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নেড়ে বললো,
“আচ্ছা।”

তাহসান দুষ্টু হেসে বললো,
“আজকে আমাদের ফাস্ট ডেট।”
তাহসানের কথায় বন্যাও হাসে।তাহসান বললো,
“ভালো কোনো রেস্টুরেন্টে বসতে পারতাম এখানে কেনো আসতে বললে?”
বন্যা লেকের পানির দিকে তাকিয়ে বললো,
“জীবনে কখনো প্রেম করিনি।স্কুল,কলেজ,ভার্সিটিতে যারা প্রেম করে তারা প্রায়ই রবীন্দ্র সরোবরে ঘুরতে আসে।এই যে আশেপাশে দেখুন কপোত-কপোতী সংখ্যাই বেশী।তাই আমার মনও চাইলো এখানেই আসা ভালো।আপনার ভালো লাগেনি?”

তাহসান আশেপাশে তাকিয়ে বললো,
“ভালো লেগেছে।তুমি পাশে থাকলে সবই ভালো লাগে।”
“আচ্ছা।”
বন্যা তার ববকাট চুলে হাত দেয়,মাথার চুল এলোমেলো হয়ে গেছে সে হাত দিয়ে ঠিক করার চেষ্টা করছে।ব্যাপারটা তাহসানের চোখে আসে।সে বন্যার ছোট ছোট করে কাঁটা চুলের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখের দৃষ্টি অনুসরন করে বন্যা বললো,

“একটা সত্যি কথা বলবেন?”
“হুম।”
বন্যা খানিকটা ইতস্তত করে বললো,
” আপনার কি লম্বা চুল পছন্দ।”

তাহসান স্থির চোখে বন্যার দিকে তাকিয়ে থাকে।কি বলবে খুঁজে পায় না।আসলে সত্যি বলতে কি তার লম্বা চুলই পছন্দ কিন্তু বন্যার ছোট চুল তাতে অবশ্য তার কিছু আসে যায় না।সত্যিটা বললে যদি বন্যা কষ্ট পায়!তাহসান চায় না তার বন্যা কষ্ট পাক।তাছাড়া বন্যাকে বোধহয় ছোট চুলেই মানায়,ঠিক পুতুলের মতো লাগে।সে হেসে বললো,
“ছোট চুলই ভালো লাগে। আজকাল তো এমনই চলে।তাই না?”
বন্যা এক দৃষ্টিতে তাহসানের দিকে তাকিয়ে থাকে।তার চোখের দিকে তাকিয়ে তাহসান বললো,

“হঠাৎ এই প্রশ্ন কেনো?”
বন্যা ঠোঁট উল্টে বললো,
“তেমন কিছু না,আপনার পছন্দ অপছন্দ জানতে চাচ্ছিলাম।”
“আমার পছন্দ জেনে কি করবে?আমার পছন্দ মতো নিজেকে সাজাবে?খবরদার।এমন কাজ ভুলেও করতে যাবেনা,তুমি যেমন তেমনি থাকো,কারো পছন্দ অনুযায়ী নিজেকে সাজাতে যেও না।তুমি যেমন তেমন রূপেই আমি তোমার প্রেমে পড়েছি।”

বন্যা হেসে বললো,
“আচ্ছা।”
সে লেকের পানির দিকে তাকায়।তারপর কিছুক্ষন দুজনেই চুপ করে থাকে।বন্যা তাহসানের দিকে তাকিয়ে দেখে ছেলেটা কেমন মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে।বন্যাও তাকিয়ে থাকে।তাহসান ভেবে পায়না একটা মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে এতো ভালো লাগবে কেনো?কেমন মায়াভরা নেশালু আকর্ষণ।সে বন্যার গালে আলতো করে টুকা দিয়ে বললো,

“তুমি খুব সুন্দরী বন্যা।”
বন্যা হেসে বললো,
“পাম দিচ্ছেন নাকি বুঝতে পারছিনা।”
তাহসান গভীর চোখে তাকিয়ে বললো,
“না মন থেকেই বলছি কিন্তু সাবধান আমাকে আর ওসব কথার একটা অক্ষরও বলো না।প্রেমিকার মুখে এমন কথা শুনে আমি নির্ঘাৎ হার্ট অ্যাটাক করবো।ইউ নো!তোমার ব্যাপারে আমার হার্ট খুবই দুর্বল।”
বন্যা বুঝতে না পেরে বললো,

“কোন কথা?”
তাহসান দুষ্টু হেসে বললো,
“সালা!আমি যে তোমার সালা হই এটা আর বলোনা।প্রেমিকার মুখে জান মানায় সালা না।বুঝেছো?”
সন্ধার পরে বন্যা আর তাহসান বাসায় আসে।দুজনে একি রিকশা দিয়ে এসেছে।বন্যা সংকোচ করলেও তাহসান আশ্বাস দিয়েছে সন্ধ্যা হয়ে গেছে কেউ দেখবেনা কিন্তু তার ধারনা ভূল প্রমানিত করে চারতলার বারান্দা থেকে আফিয়া বেগম ঠিকই দেখে নেয়।কথায় আছে না যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়।তাহসান বাসায় ঢুকার সাথে সাথেই আফিয়া সামনে এসে দাঁড়ায়।কঠিন গলায় বললো,

“বন্যার সাথে এতো মেলামেশার দরকার নেই।”
তাহসান শান্ত গলায় বললো,
“কেনো?”
আফিয়া চোখের নজর এপাশ ওপাশ করে বললো,
“বন্যা ভালো মেয়ে না।”
“কি করেছে ও?”

তান্ডবে ছাড়খার পর্ব ১২

আফিয়া ইতস্তত করে ছেলের কাছে এসব বলা উচিত কিনা খানিক ভাবে।বললে যদি ছেলের মঙ্গল হয় তাহলে বলবে।উনি চোখ বন্ধ করে বললো,
“ধর্ষিতা ও।বন্যার সাথে এতো চলাফেরা সমাজের মানুষ ভালো চোখে দেখবে না,তাই তুউ আর ওই মেয়ের কাছেও যাবিনা।”

তান্ডবে ছাড়খার পর্ব ১৪