তুমিময় বসন্ত পর্ব ১০

তুমিময় বসন্ত পর্ব ১০
writer Mousumi Akter

–বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লম্বা কৃষ্ণচূড়া গাছ টা ফুলে ফুলে লাল হয়ে আছে।গাছে দুই একটা সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে যেনো রক্তবর্ণের লাল সৌন্দর্যর সমাহার।ফাগুন কে বরণ করতেই কৃষ্ণচূড়ার এরুপ সাজ।বাসা থেকে নিচে এসে যেনো অপরূপ সৌন্দর্য্যর রাজ্য দেখতে পেলাম।আর একটু দূরে চোখ যেতেই চোখ পড়লো সারি সারি অসংখ্য কৃষ্ণচূড়া গাছের দিকে।রাস্তার দুই পাশে সারি সারি গাছ গুলো লাল ফুলে ছেয়ে আছে।এখান দিয়ে যাতায়াতরত কোনো মানুষ এই সৌন্দর্য্য উপেক্ষা করতে পারছে না।সবাই ই মুগ্ধ হয়ে দেখছে এই অপরূপ দৃশ্য। আমার ভীষণ ইচ্ছে করছে একটা ফুলের ডাল ছিড়ে হাতে নিতে।কিন্তু এত বড় গাছের ফুল কিভাবে আনবো আমি।আমি কেনো কেউ ই নাগাল পাবেনা।গাছে বসে কোকিল কুহু কুহু করে ডাকছে।পাশের কিছু বাচ্চারা কোকিলের সাথে তাল মিলিয়ে কুহু কুহু ডাকছে।দৃশ্যটা দেখে আনমনে হেসে ফেললাম আমি।আমি নিচে পড়া থাকা ছোট ছোট কিছু ফুলের অংশ হাতে তুলে নিলাম।এই ফুল আমার ভীষণ প্রিয়।ইস কেউ যদি এক ডাল কৃষ্ণচূড়া দিতো আমায়।

রাস্টার ওপাশে ফোনের দোকান আছে।এই এরিয়া টা বেশ নিরিবিলি ধরনের।খুব একটা কোলাহল নেই বললেই চলে।রাস্তার ওপাশে মাত্র দুইটা ফ্লেক্সির দোকান।জানিনা তারা আমাকে ফোন করতে দিবে কিনা।কেননা এখন তো আর ব্যবসায়ী ফোন নেই আগের মতো।একটা ফ্লেক্সিলোড এর দোকানে গিয়ে বললাম,
‘আমার ফোনটা খুজে পাচ্ছিনা আমাকে একটু ফোন করতে দিবেন?’
অল্পবয়সী একটা ছেলে দোকানে।আমার দিকে তাকিয়ে দেখে বললো,
‘আপনার বাসা কোথায় আপু?’
‘আমাদের বাসাটা সরাসরি না দেখিয়ে বললাম একটু ভেতরেই।’
‘ছেলেটি বললো,৪-৫ মিনিটের বেশী কথা বলা যাবে না আপু।আমার পারসোনাল ফোনে বেশী টাকা নেই।আর এগুলা আমার ব্যবসায়ী ফোন।বিকাশ করি,ফেক্সি দেই।’
‘আমি সাথে সাথে একশ টাকা বের করে দিয়ে বললাম আপনার নাম্বারে ফ্লেক্সি দিন।আমি মাঝে মাঝে আসলে দুই এক মিনিট ফোন করতে নিয়েন।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘ছেলেটি বললো,না না আপনি কোথায় এক মিনিট কথা বলবেন টাকা দেওয়া লাগবে না।’
‘আমি খুশী হয়েই দিচ্ছি।রেগুলার এমনি এমনি কথা বললে পরের দিন আসলে আর দিবেন না।আপনি প্লিজ নিন।আমার জোরাজোরিতে ছেলেটি টাকা টা নিয়ে আমাকে ফোনটা দিলো।’
–আমি ফোন নিয়ে একটু সাইডে গেলাম।ভেতরএ টানা এক উত্তেজনা কাজ করছে।অভির কন্ঠ শুনলে আমি কিভাবে সহ্য করবো।এসব ভাবতে ভাবতেই অভির নাম্বার ডায়াল করলাম কিন্তু ফোন বন্ধ।আপনি যে নাম্বারে ফোন করেছেন তা এই মুহুর্তে বন্ধ আছে।কথাটা যেনো হৃদয়ে তীরের মতো বিঁধলো আমার।নিয়তি কি চাইছে না আমাদের এক হতে দিতে।নিয়তি কি এটাই চাই আমাদের আর কখনো যোগাযোগ না হোক।কেনো বন্ধ অভির ফোন।অভির কি কিছু হয়েছে।ভীষণ দুঃচিন্তা ঘিরে ধরলো আমাকে।কেমন আছে আমাকে ছাড়া।দম ফাটা কাঁন্না আটকাতে পারলাম না আমি।কয়েকবার ট্রাই করার পরেও অভির নাম্বারে ফোন ঢুকলো না।দোকানদার কে ফোন টা দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে দোকান থেকে চলে এলাম আমি।

দু’মাস আগের কথা আমার ফোন হঠাত নষ্ট হওয়ায় একদিন যোগাযোগ করতে পেরেছিলাম না অভির সাথে।একদিন পরে অভিকে আরহীর নাম্বার থেকে ফোন দিতেই
অভি পাগলের মতো বলেছিলো,
‘মুগ্ধ কোথায় তুমি।কোথায় হারিয়ে গিয়েছো তুমি।কথা বলছো না কেনো মুগ্ধ।জানো কত হাজার বার ফোন দিয়েছি আমি পাগলের মতো ফোন দিয়েছি,মেসেজ করেছি কিন্তু কোনো রেসপন্স পাইনি আমি।কি হয়েছে মুগ্ধ আমায় বলো প্লিজ।
‘নিজেকে কন্ট্রোল করতে না পেরে বেসামাল ভাবে কেঁদে দিয়েছিলাম আমি।কাঁদতে কাঁদতে কোনো কথা বলতে পেরেছিলাম না আমি।আমার কাঁন্না থামাতে বারবার অভি বলছিলো প্লিজ মুগ্ধ কেঁদোনা।তোমার কাঁন্না আমি সহ্য করতে পারিনা।আর এটা কার ফোন। তোমার ফোন কোথায়?আমার সাথে আজ ই দেখা করো।’
সেদিন মজা করে বলেছিলাম,অভির মন বুঝেছিলাম আমার প্রতি অভির ভালবাসা কতটা গভীর সেটাই দেখছিলাম।

‘আমাদের আর দেখা হবেনা অভি।’
‘কিন্তু কেনো মুগ্ধ?’
‘অভি সব কিছু এলোমেলো হয়ে গিয়েছে।বদলে গিয়েছে সব কিছু।আলাদা হয়ে গিয়েছি আমরা।’
‘প্লিজ মুগ্ধ আমায় খুলে বলো।’
‘আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে অভি।কথাটা বলেই আবার ও বেসামাল ভাবে কেঁদে দিলাম আমি।’
‘বিয়ে মানে।আর তুমি বিয়ে মেনে নিলে।আমি ছাড়া অন্য কাউকে কবুল বললে।’
‘পরিস্হিতি আমাকে বাধ্য করেছিলো।আমি নিরুপায় ছিলাম অভি।’
‘তুমি আমার মানে শুধুই আমার মুগ্ধ।এসব বিয়ে আমি মানিনা মুগ্ধ।আমি ছাড়া পৃথিবীর কারো পাশে তোমাকে আমি মেনে নিতে পারবো না। তুমি কোথায় আছো মুগ্ধ আমাকে বলো।তুমি আমার সাথে চলে আসবে।আজ মানে এক্ষুনি।কি ভাবছো মুগ্ধ জাস্ট চলে এসো। চুপ করে আছো কেনো? ‘
‘আমি যেতে পারবো না অভি।’
‘কেনো মুগ্ধ?’

‘আমি গেলে বাবা আর মা দুজনেই সুই*সাইড করবেন লজ্জা আর অপমানে।কারো বিবাহিত মেয়ে স্বামির সংসার ছেড়ে পালিয়ে গেলে সেই মা -বাবা কি কারো সামনে মুখ দেখাতে পারে।সমাজের মানুষ ছিঃছি করবে।আমাকে বলবে চরিত্রহীনা কলংকিনী,দুঃচরিত্রা, আমি স্বামির ঘর ছেড়ে পালিয়েছি।মা -বাবার উপর যতই অভিমান করি আমি আমার জীবনে মা আর বাবাকে সব থেকে বেশী ভালবাসি অভি।আমার নিজের শান্তির জন্য পালিয়ে গেলে তারা মা*রা গেলে এ আমি সহ্য করতে পারবো না।’
‘কি অপরাধ আমার মুগ্ধ।তোমাকে পাগলের মতো ভালবাসা নাকি তোমাকে নিয়ে একটা জীবন বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখা।তোমার মা-বাবা কেনো এমন করলো মুগ্ধ।আমার পারিবারিক কলহে কবে আমার ফ্যামিলি থেকে কাকে খু*ন করেছিলো সেই দোষ কেনো আমার উপর চাপিয়ে আমার থেকে তোমাকে আলাদা করলো মুগ্ধ।এই দোষ কি আমার ছিলো।’

‘আমি জানি অভি এখানে তোমার কোনো দোষ নেই।’
‘দোষ নেই তাহলে কেনো ছেড়ে গেলে আমাকে।আমি তোমাকে জোর করবো না মুগ্ধ।হয় তুমি চলে আসবে না হলে আমি মরে গিয়ে প্রমান করে দিবো আমার ভালবাসা ভুল ছিলো না।’
‘প্লিজ অভি তুমি এসব বললে আমি কিভাবে বাঁচবো।’
‘তুমি কি আসবে নাকি আসবে না মুগ্ধ।আমার ডিসিশন নেওয়া হয়ে গিয়েছে এখন তোমার উত্তরের অপেক্ষায় আছি।’
তখন ই হেসে দিয়ে বলেছিলাম আরে বুদ্ধু আমি মজা করছি।আমি ম*রে গেলেও তুমি ছাড়া কাউকে বিয়ে করবোনা।সেদিনের আমার করা মজাটা যেনো আজ সত্যি হয়ে গেলো।সেদিন বলেছিলাম মজা করে আজ সত্যি সত্যি অভিকে এগুলো বলতে হতো।ভীষণ মন খারাপ নিয়ে বাসায় ফিরলাম।কি ঠিক কি ভুল কিছুই বুঝতে পারছিনা।

দুপুর বারোটার দিকে হঠাত কলিং বেল চাপলো কেউ।দরজা খুলে দেখি একটা ছেলে আয়াস এর বয়সী হবে। আমাকে দেখে বললো,
‘ ভাবি কেমন আছেন?’
‘আপনি.. আসলে আমি তো কাউকে চিনিনা।’
‘আয়াস স্যার আমাকে পাঠিয়েছেন ভাবি।’
‘ওহ আচ্ছা।’
‘স্যার একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।হঠাত স্যার এর শ্বাসকষ্ট বেড়েছিলো।ডাক্তার এসে দেখে ও গিয়েছিলো।স্যার এর প্রেসার পুরোপুরি লো।আসলে স্যার অনেক পরিশ্রম করেন।আমাকে পাঠিয়েছেন একটা হলুদ কালারের ফাইল নাকি ফেলে গিয়েছেন ওটা নিতে।’
‘উনি অসুস্থ। ‘
‘তেমন কিছু হয়নি আপনি চিন্তা করবেন না।আপনি খুব লাকি ভাবি।স্যারের মতো একজন মানুষ পেয়েছেন।’
‘কেনো?’
‘জানেন ভাবি স্যার এত বড় একজন অফিসার কিন্তু আমাদের সাথে আপন ভাই এর মতো মিশেন।তাকে দেখে মনেই হয়না আমাদের থেকে অত বড় পোস্টে চাকরি করেন।আমাদের সারিকা ম্যাম স্যার এর এই গুনের জন্য স্যার কে খুব পছন্দ করতেন।তবে স্যার কখনো পাত্তা দেন নি।স্যার আপনাকে পছন্দ করতেন।স্যার কে বলবেন রাত জেগে কাজ না করতে।স্যার অনেক দায়িত্বশীল। মনে হয় একভাবে কাজ করছে খাওয়া দাওয়া নেই তাই শরীর দূর্বল।’

ছেলেটার কথা শুনে ভেতরে কেমন খারাপ লেগে উঠলো।কেমন যেনো তার অসুস্থতার জন্য নিজেকে দায়ী মনে হচ্ছে।কেনো জানিনা মনে হচ্ছে আমার জন্য না খেয়ে সে অসুস্থ হয়ে পড়েছে।
‘ছেলেটিকে বললাম ভেতরে আসুন বসুল আমি ফাইল দিচ্ছি।’
‘না ভাবি স্যার বাসায় নেই আমি যেতে পারবো না’
‘সমস্যা নেই আসুন।’
‘না ভাবি ঠিক আছে।’
‘আমি আসছি আমার একটু লেট হবে। ‘
‘জ্বী ভাবি আপনি নিয়ে আসুন, আমি অপেক্ষা করছি।’
–বুয়ার রান্না শেষ হয়েছে কিছুক্ষণ আগেই।আমি টিফিন বক্সে খাবার ভরে একটা শপিং ব্যাগে রাখলাম।শাড়িটা চেঞ্জ করে আরেক টা শাড়ি পরলাম।আয়াসের অফিসে অনেক মানুষ আছে।আমাদের মাঝে যা সমস্যা হোক বাইেরর মানুষকে বুঝতে দিয়ে আয়াস কে ছোট করা যাবেনা।একটা লাল শাড়ি পরে ম্যাচিং গহনা পরলাম।শাড়ি অনেক বার খুললাম আর পরলাম তবুও ঠিক ভাবে পরতে পারছি না।আবার ওদিকে দেরি হয়ে যাচ্ছে।এলোমেলো শাড়ির কুচি নিয়েই খাবারের বক্স হাতে নিয়ে রওনা হলাম।
আমাকে দেখে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটি বললো,
‘আপনি যাবেন ভাবি।’
‘হ্যাঁ। ‘

তুমিময় বসন্ত পর্ব ৯

‘চলুন তাহলে।আপনার হাতের খাবার খেলে স্যার সুস্থ হয়ে যাবেন।আপনাদের বিয়ের আগে অনেক বার ই স্যার আপনাকে নিয়ে কথা বলেছে।আর আজ সকাল থেকে অনেকবার ই বলেছে আপনার কথা।’
তার মানে উনি আমার সামনে নয় আমার আড়ালেও আমার কথা ভাবেন।যতটা খারাপ ভেবেছিলাম ততটাও খারাপ নন উনি।
ক্যান্টনমেন্ট এ প্রবেশ করেই একটা মেয়ে সৈনিক কে দেখে ভাবলাম এই কি সেই সারিকা।হঠাত সারিকার কথা মনে পড়লো কেনো আমার।যে মেয়ে কে দেখছি তার কথায় ভাবছি এই কি সারিকা। ধ্যাত যা তা অনুভূতি হচ্ছে আমার।মন কে স্ট্রং করে এদিক সেদিক না তাকিয়ে আয়াসের কাছে গেলাম।

তুমিময় বসন্ত পর্ব ১১